আজ থেকে কার্যকর নতুন বাজেট

গত ২৬ জুন ‘উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’ শীর্ষক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নতুন বাজেট পাস হয়। আজ শনিবার (১ জুলাই) থেকে কার্যকর হচ্ছে সেই বাজেট। 

সাধারণত অন্যান্য বছর ৩০ জুন তথা আগের অর্থবছরের শেষ দিন বাজেট পাস হলেও ঈদুল আজহার ছুটির কারণে এবার আগেই পাস করা হয় নতুন বাজেট। এবারের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। 

এ বাজেট সরকারের টানা তিন মেয়াদের ১৫তম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৪তম বাজেট। আবার সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ এবং বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট এটি। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের  উত্থাপিত পঞ্চম বাজেট এটি।

গত ১ জুন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র লক্ষ্য। তাই এবারের বাজেটে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী ভৌত, সামাজিক ও প্রযুক্তি অবকাঠামো বিনির্মাণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যাতে করে স্মার্ট সমাজ, স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার এবং সর্বোপরি স্মার্ট অর্থনীতি গঠনের পথ সুগম হয়।

জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি আরও দাবি করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের গত সাড়ে ১৪ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ এখন অন্যান্য দেশের জন্য উন্নয়নের ‘গ্লোবাল রোল মডেল’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে জিডিপির আকার ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে। প্রাক্কলন করা হয়েছে, ২০৪১ সালের আগেই বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে বাংলাদেশ।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার এর আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড়। বাজেটটি ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকার প্রাক্কলিত জিডিপির ১৫ দশমিক ২১ শতাংশ।

এবারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

রাজস্ব হিসেবে ৫ লাখ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংগ্রহ করবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যন্য উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে আরও ৭০ হাজার কোটি টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা আগামী অর্থবছরের চেয়ে ৬৭ হাজার কোটি টাকা কম।

প্রস্তাবির বাজেটে ব্যয়ের খাতগুলোর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা।

খাতভিত্তিক বরাদ্দ

আগামী বাজেটে ১৩টি খাতে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। খাতভিত্তিক বরাদ্দ হলো—জনসেবা খাতে ২ লাখ ৭০ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৪৯ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা, প্রতিরক্ষা খাতে ৪২ হাজার ১৪২ কোটি টাকা, জন নিরাপত্তা খাতে ৩২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১ লাখ ৪ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য খাতে ৩৮ হাজার ৫০ কোটি টাকা, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ৪০ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা, আবাসন খাতে ৭ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ৫ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৮৭ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা, কৃষি খাতে ৪৩ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা এবং বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম খাতে ব্যয় ৫ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা।

'মাথাপিছু আয় হবে ১২,৫০০ ডলার'

স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী।

তিনি বলেন, 'আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। দারিদ্রসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ। চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়।'

জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে সরকার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল সরকার।

মূল্যস্ফীতি নামানোর লক্ষ্য

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

সর্বজনীন পেনশন

পরবর্তী অর্থবছর থেকে সর্বজনীন পেনশন চালু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন পাশ হয়েছে। আশা করছি, ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকেই বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা সম্ভব হবে।'

এবারও গুরুত্বহীন স্বাস্থ্যখাত

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের জন্য মোট বাজেটের ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ ছিল।

নতুন বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে মোট ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা আগের বাজেটে ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।

শিক্ষায় বরাদ্দ কমেছে

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ।

ইউনেস্কোর পরামর্শ, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত।

আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার জন্য মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা শিক্ষাখাতে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।

কৃষি খাতে বরাদ্দ কমেছে

কৃষি খাতে বাজেট বরাদ্দ আগামী অর্থবছরে টাকার অঙ্কে বাড়লেও খাতওয়ারি বরাদ্দের নিরিখে এবার এই খাতে বরাদ্দ শতকরা দশমিক ৩৩ ভাগ কমেছে।

আগামী অর্থবছরে কৃষি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের শতকরা ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কমেছে

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৩ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার ৭ কোটি টাকা বা ২২ শতাংশ কম।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সুবিধা বাড়ছে

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৬ হাজার ৫০৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে এবং ৫ হাজার ২১১টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলমান আছে।

এ ছাড়া, সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিদ্যমান আবাসন সুবিধা ৮ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা  কামাল।

সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ছে

প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ১১ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে মোট ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

ইসির বাজেট বাড়ছে

নির্বাচনী বছরে নির্বাচন কমিশনের মোট বাজেট বাড়ছে ৮৬৮ কোটি টাকা। তবে কমিশনের জন্য উন্নয়ন বাজেট ২০২২-২৩ অর্থবছরের বিদায়ী বাজেট থেকে ৪৬৭ কোটি টাকা কমছে।

প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, এই সাংবিধানিক সংস্থাটির পরিচালন বাজেট আগের বাজেটের চেয়ে ১ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনের সামগ্রিক বাজেট বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে ১ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা বেড়ে আসন্ন অর্থবছরে দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা।

করমুক্ত আয়সীমা বেড়েছে

গত ৩ বছর করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত থাকলেও এবার মূল্যস্ফীতির কারণে করদাতাদের বিষয় বিবেচনায় করমুক্ত আয়কর সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

পেট্রল-অকটেন-ডিজেল আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব

পেট্রল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ করে নতুন শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি মেট্রিক টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতদিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।

জ্বালানিতে বরাদ্দ অর্ধেক কমিয়ে বিদ্যুতে বাড়ছে ৪০ শতাংশ

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।

আগামী অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ বিভাগের বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।

জ্বালানি বিভাগের বরাদ্দ আগামী অর্থবছরের জন্য ৪৯ শতাংশ কমিয়ে ৯১১ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ বিভাগের বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //