বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি

সংস্কৃতিকে একটি দেশের ধারক ও বাহক বলা হয়। এক কথায় সংস্কৃতি একটি দেশের প্রাণ। আর সেই দেশের প্রাণকে সজাগ ও সতেজ রাখতে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির তুলনার শেষ নেই। কিন্তু সাম্প্রতিকালে দেখা যাচ্ছে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি ধ্বংসের মুখে পড়েছে। নেত্রকোনা জেলার গ্রামবাংলার ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলা ও লোকসংস্কৃতি। 

চৈত্র সংক্রান্তিতে হালখাতার চিত্রও দেখা যায় না বাংলা ও বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ। বর্তমানে কিছু সচেতন সমাজ বাদে প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা মিলে এক ভিন্ন চিত্র। কতিপয় কনসার্ট বা স্থানীয় ক্লাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে শোনা যায় ভিনদেশি ভাষার নাচ-গান ও বাদ্যযন্ত্রের তুমুল হট্টগোল। ধান কাটার পরে গ্রামে নবান্ন উৎসব পালন করা হতো। পিঠাপুলির আয়োজন করা হতো। অগ্রহায়ণে ধান কাটা শেষে টেঁকি চাটা চাউল তৈরী করা হতো। সেই টেঁকি হারিয়ে গেছে কালের আবর্তে। কিন্তু আজ তার বদলে বার্গার, পিজ্জা, চিকেন ফ্রাই পার্টির আয়োজন করা হয়। 

এক সময়কার গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বিনোদন ছিল বায়োস্কোপ দেখা। বায়োস্কোপ দেখিয়ে শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আনন্দ দেওয়ার মাধ্যমে নিজের সংসার চালাত এই পেশায় নিয়োজিত মানুষ। বায়োস্কোপ বিনোদন মাধ্যম বিলুপ্তির পথে। বায়োস্কোপ পেশার লোকেরা পেশা বদলিয়ে অন্য পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে করছেন অন্য কাজ।

বাংলা লোকসংগীতের শক্তিশালী ‘ঐতিহ্যবাহী ধারা’ ভাটিয়ালি গান। প্রযুক্তির নানান সুবিধার কারণে এবং এসব গান সংরক্ষণের অভাবে এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সৃজনশীলতা, মানব-ভাবনা ও কাব্যত্ব না থাকার কারণে এ যুগের পাঠক তা পাঠও করেন না। তবে এখনো কোথাও কোথাও পুঁথিপাঠের আসর চলে। গাড়িয়াল ভাইয়ের জন্য এখন আর কেউ পথ চেয়ে থাকে না। আশ্বিন মাস এলেই নদীতে নৌকাবাইচ হতো, নদীর ধারে বসতো মেলা। এই মেলা থেকে কত রকম নকশা করা মাটির হাঁড়ি-পাতিল কেনা হতো, দেখতে পাওয়া যেতো পুতুল নাচের মতো মনোরঞ্জনমূলক কত রকমের আয়োজন। এখন মেলা হলেও তেমন উৎসব মুখর মেলা হয় না, নৌকাবাইচও হয় না, হয় না পুতুল নাচ। 

নেত্রকোনায় গ্রামবাংলার একসময়ের জনপ্রিয় খেলাধুলার মধ্যে অন্যতম ছিল হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, ওপেন্টি বায়োস্কোপ, সাপখেলা, লাঠিখেলা, লুডু ও কড়িখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, বউচি, পুতুল বৌ, ফুল টোক্কা, বাঘ-ছাগল, বরফ পানি, ষোলোগুটি, এক্কা দোক্কা, সাত-পাতা, দাপ্পা, চারগুটিসহ হাজারো খেলা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এসব ঐতিহ্যবাহী খেলার ন্যূনতম পরিচয়ও নেই। চর্চার অভাবে এসব খেলা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এখন নতুন প্রজন্মের কাছে খেলাধুলা মানে কম্পিউটার গেমস আর বাচ্চাদের কাছে বিনোদন মানেই কার্টুন এবং আধুনিক ডিভাইস।

নেত্রকোনা অঞ্চলে যাত্রাপালা, হুদমার গান, জগেরগান, যোগীর গান, গোয়ালীর গান, ক্ষ্যাপাগান, জারীগান, মালশা গান, পালাগান বা কাহিনীগান, মুর্শিদি, মারফতি, ফকিরি, বিয়ের গীত ইত্যাদি। এগুলো নানান উপলক্ষ নিয়ে রচিত হত। কিন্তু এখন আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসারের ফলে বিয়ের অনুষ্ঠানে গীত নয়, হিন্দি, ভোজপুরী, তামিল, ডিজে গান শোনানো হয়। কোথায় সেই চিরচেনা সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতি নিয়ে দেশ বরেণ্য কবি-সাহিত্যক, লেখক, নাট্য ও চলচ্চিত্র নির্মাণসহ কবিতা লিখা রয়েছে, সেই সাথে বহু বিদেশি পর্যটকও বাংলাদেশকে নিয়ে কবিতা লিখেছে। গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি হল দেশের প্রাণ। আর সেই প্রাণ যদি বিলুপ্তির পথে যায়,তাহলে সে দেশে বসবাস অযোগ্য হয়ে যাওয়ার মতো। তাই দেশের ফুসফুস খ্যাত লোকসংস্কৃতি রক্ষায় দেশ ও বাঙালি জাতি তৎপর হতে হবে। নিজের দেশের সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব নিজেদের। নিজ-সংস্কৃতি রক্ষার্থে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়িত্ব জাতির নিজেরই। 

গবেষক, শিল্পী, পৃষ্ঠপোষক এবং অবশ্যই শ্রোতামহল সহ সকলকেই এক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা তো প্রয়োজনীয় বটেই, কিন্তু সব থেকে যে বিষয়টি প্রয়োজন, তা হলো বর্তমানের শিল্পীদের বাংলা তথা বাঙালি শিল্পের প্রতি গভীর ভালোবাসা। কারণ হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন শিল্পী, কলাকৌশলী, শুভান্যুধায়ী। দেশের উন্নয়নে আধুনিকায়নের প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু সেই আধুনিকতার নামে নিজের সংস্কৃতিকে ভুলে যাওয়া কাম্য নয়। আমাদের ঐতিহ্য রক্ষায় সজাগ হতে হবে। 

বিশ্বায়নের স্রোতে গাঁ ভাসিয়ে হারিয়ে ফেলা যাবে না আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই বাঁচতে পারে আমাদের চির-পরিচিত লোকসংস্কৃতি। এরজন্য গ্রামের মানুষকে সচেতন করতে হবে। লোকসংস্কৃতির প্রয়োজন আছে তা বোঝাতে হবে। যে সকল দারিদ্র্য লোকজন বাঙালির আদি সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় তাদের কে পৃষ্টপোষকতার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। সংস্কৃতি আমাদের তাই রক্ষা করার দায়ভারও আমাদেরকেই নিতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //