শতাব্দীপ্রাচীন ‘রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ’

১৮৯৩ সালে কলকাতার শোভাবাজারের বিনয় কৃষ্ণ দেবের বাসভবনে গঠিত হয়েছিল ‘বেঙ্গল একাডেমি অব লিটারেচার’। এরপর ১৮৯৪ সালের এপ্রিলে একটি সভার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নাম বদলে রাখা হয় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’।

৫২৩ সদস্য সংখ্যার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রখ্যাত সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবীনচন্দ্র সেন, দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত গুপ্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, দেবেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, অমৃতকৃষ্ণ মল্লিক, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ও দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু। 

১৯০৫ সালে পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশনে কলকাতার বাইরে পরিষদের শাখা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ’। ২৮ সদস্য নিয়ে রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ-এর যাত্রা শুরু হয়। ১৩ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী কমিটি গঠন করে, কাকিনার জমিদার মহিমারঞ্জন রায়চৌধুরী ও কুন্ডির জমিদার সুরেন্দ্র চন্দ্র রায়চৌধুরীকে আজীবন সভাপতি ও সম্পাদক করা হয়।

এই কমিটির মাধ্যমেই পরিচালিত হতো রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ-এর সকল কার্যক্রম। রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ হলো বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের একমাত্র শাখা সংগঠন যা কলকাতার বাইরে উৎপত্তি ও বিকাশ লাভ করেছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি রংপুর তথা উত্তরাঞ্চলের ইতিহাস গবেষক এবং লেখকদেরকে একত্রিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ পরিষৎ-এর কর্মসূচি ছিল এমন- প্রত্নলিপি, মুদ্রা, পাণ্ডুলিপি, প্রাচীন মূর্তি ও অন্যান্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ, সাময়িকী প্রকাশ, প্রাচীন গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ এবং লেখক ও গবেষকদের জন্য আলোচনাসভার ব্যবস্থা করা ছিল কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। 

জাতীয় জ্ঞান কোষ বাংলাপিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে, রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ গঠনে স্থানীয় জমিদারগণ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তারা এর বিকাশের জন্য অর্থ, জনবল ও সাহায্য সামগ্রীও দান করেন। কুন্ডির জমিদার মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী ও সুরেন্দ্রচন্দ্র রায়চৌধুরী এবং কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্যরা এই সংগঠন প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের জমিদাররাও এতে বিশেষ অবদান রাখেন এবং এর সদস্যপদ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মুর্শিদাবাদ জেলার কাসিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, কুচবিহারের মহারাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুর ও মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুর, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় এবং দিঘাপতিয়ার (রাজশাহী) কুমার শরৎকুমার রায়। 

১৯৪৫ সালে সুরেন্দ্রচন্দ্র রায়চৌধুরীর মৃত্যু হলে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র সৌমেন্দ্রকুমার রায়চৌধুরী পরিষদের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পরিষৎ-এর অধিকাংশ সদস্যের ভারতে চলে যাওয়া এবং ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে পরিষদের কার্যক্রমেও স্থবিরতা নেমে আসে।

রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকাটি ছিল সংগঠনের মুখপত্র। এই পত্রিকাটি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯০৬ থেকে ত্রৈমাসিক সাহিত্য সাময়িকী হিসেবে প্রকাশ হতে থাকে। পত্রিকাটি দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। প্রথম অংশে থাকত- উত্তরবঙ্গের লোককাহিনি, প্রত্নতত্ত্ব, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং ওই অঞ্চলের অপ্রকাশিত পুথির বিবরণ। আর দ্বিতীয় অংশে থাকত- পরিষদের বার্ষিক প্রতিবেদন, মাসিক কার্যবিবরণী, দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও সেগুলোর লেখকদের বিবরণ। ১৯০৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সাতজনের সম্পাদনায় এর ২০টি সংখ্যা প্রকাশ হয়। ১৯৩৯ সালের সংখ্যা প্রকাশের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। 

পরিষদের দুষ্প্রাপ্য দলিলপত্র ও অন্যান্য সংগ্রহসহ পত্রিকার সকল সংখ্যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর এখানে তিব্বত, আসাম ও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন পুরাকীর্তি ও দুষ্প্রাপ্য পুথিতে সমৃদ্ধ একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছিল, যা ২০০৮ সালে তাজহাট জমিদার বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। 

রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ-এর পাশেই রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির অবস্থান। এর দায়িত্বে থাকা আজিজুল হক সালু জানালেন, শতাব্দীপ্রাচীন এ পরিষদের বর্তমানে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম নেই। শুধু প্রতি সপ্তাহের শনিবার স্থানীয় কবি ও লেখকরা এখানে মিলিত হন এবং তাদের সাহিত্য আসরের মধ্যেই এর কার্যক্রম অনেকটা সীমাবদ্ধ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //