দখিনের শতবর্ষী নৌকার হাট

প্রবাদ আছে, ‘ধান নদী খাল, এই তিনে বরিশাল।’ ধান এখন বরিশালের চেয়ে দিনাজপুরসহ দেশের আরও একাধিক জায়গায় বেশি হলেও নদী ও খালে বরিশালের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই। মূলত পুরো বরিশাল বিভাগই অসংখ্য নদী ও খালের মিষ্টি জলে সিঞ্চিত। বর্ষা মৌসুমে এখনো বরিশাল অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ, বিশেষ করে পণ্য পরিবহন, মৎস্যসম্পদ আহরণ ও কৃষিকাজে ছোট ছোট ডিঙি নৌকার ব্যবহার আছে। আর এই চাহিদা মাথায় রেখে বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি সদর এবং পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার সীমান্তে আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নে নদীর পাড় ও নদীর ভেতরে এখনো জৌলুস ধরে রেখেছে শতবর্ষী নৌকার হাট। এ যেন আবহমান বাংলার নদী-খাল-সবুজ প্রকৃতি আর নৌকার এক চলমান ছবি। 

প্রশাসনিকভাবে এই হাটের অবস্থান নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নে। সবুজে ঘেরা ছোট নদীর তীরে প্রতি সোম ও শুক্রবার এই হাট বসে। সারা বছর কমবেশি নৌকা বিক্রি হলেও মূলত গ্রীষ্মের মাঝামাঝি, বর্ষাকাল এবং শরৎকালে যখন নদী-খাল ও জলাশয়ে পানি থাকে; সেই সময়গুলোয় এই হাট বেশি জমজমাট থাকে। তখন শুধু ক্রেতা-বিক্রেতা নন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকেই মানুষেরা আসেন এই ব্যতিক্রমী বাজার দেখতে। অর্থাৎ এটি এখন কেবল একটি হাট নয়, বরং পর্যটনকেন্দ্রও।

শুধু এই আটঘর কুড়িয়ানাই নয়, বরং সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার এই বাজারের কাছাকাছি বলদিয়া ইউনিয়নের চামী একতা বাজারে এবং সোম ও বৃহস্পতিবার মিয়ারহাট বন্দরেও নৌকার বেচাকেনা হয়। এখানে বিক্রি হওয়া নৌকাগুলো মূলত আশেপাশের গ্রামেই তৈরি হয়। আবার অন্য এলাকা থেকেও অনেকে এখানে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। ভরা মৌসুমে প্রতি হাটবারে এখানে সাত থেকে আট লাখ টাকার নৌকা বিক্রি হয়।

আকার ও কাঠের মানভেদে প্রতিটি নৌকা আড়াই হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এসব নৌকা সাধারণত দুই থেকে তিনজন যাত্রী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন। মূলত এসব নৌকায় যাত্রী একজনই থাকেন। অর্থাৎ যিনি নৌকা চালান। তিনি নৌকা চালিয়ে পেয়ারাসহ নানারকম ফল ও ফসল বোঝাই করে বাজারে নিয়ে যান। আবার কেউ কেউ এসব ছোট নৌকা মাছ ধরা বা বর্ষা মৌসুমে ছোটখাটো দূরত্বে যেতেও ব্যবহার করেন। আবার আকারে একটু বড় এবং একসঙ্গে ৫-৬ জন ওঠায় যায়, এমন নৌকা সাধারণত ৬ থেকে ৯ মিটার লম্বা হয়। 

নৌকা কিনলে তার সঙ্গে বৈঠা ফ্রি নয়। বরং আলাদা করে বৈঠা কিনতে হয়। আকার ও কাঠের মানভেদে প্রতিটি বৈঠা বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।

হাটে বিক্রির জন্য নেছারাবাদ, বানারীপাড়া, নাজিরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার ছুতাররা (মিস্ত্রি) তাদের তৈরি ডিঙি (ছোট নৌকা) এখানে নিয়ে আসেন। ক্রেতারা আসেন সকাল থেকেই। সারাদিন চলে বিকিকিনি। একসময় এই অঞ্চলে সুন্দরী কাঠ সহজলভ্য ছিল। তখন এই কাঠ দিয়ে যেসব নৌকা তৈরি হতো, তা ছিল বেশ টেকসই। কিন্তু সুন্দরী কাঠ এখন দুষ্প্রাপ্য বলে কড়াই, চাম্বুল ও মেহগনি কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করা হয়। কম দামি এসব নৌকার আয়ুষ্কাল সাধারণত এক থেকে দুই মৌসুমের বেশি হয় না। বছরের ৫ মাস এখানে নৌকার হাট বসলেও জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে ক্রেতা-বিক্রেতা বেশি থাকে। 

প্রায় আধা কিলোমিটারজুড়ে সড়ক ও খালের প্রান্ত ছুঁয়ে শত শত নৌকা সাজিয়ে রাখা হয়। খুব ভোরে হাটের কার্যক্রম শুরু হয়। জমজমাট থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। যদিও সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হাট সবচেয়ে বেশি জমজমাট। আর সোম ও শুক্রবার হাট বসলেও শুক্রবার ভিড় হয় বেশি।

এ ধরনের একটি নৌকা তৈরিতে একজন মিস্ত্রির দেড় থেকে দুই দিন সময় লাগে। বাড়িতে নৌকা তৈরির পর একটির ওপর আর একটি নৌকা সাজিয়ে ট্রলারে করে বিক্রির জন্য আনা হয় হাটে। 

কুড়িয়ানা খালকে কেন্দ্র করেই সচল এই এলাকার অর্থনীতি। এখানকার মানুষের জীবিকা মূলত এই খাল ও প্রকৃতিনির্ভর। বর্ষা মৌসুমে এখনো এই এলাকার গ্রামীণ জনপদের মানুষের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান বাহন এই নৌকা। 

যদিও নদীমাতৃক দেশের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম এখন সড়ক পথ। অপরিকল্পিত সেতু ও বক্স কালভার্ট অনেক ছোট নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন করেছে। এ ছাড়া গ্রামীণ জনপদে এখন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক হয়ে উঠেছে প্রধান গণপরিবহন। নৌপথের তুলনায় এতে সময়ও কম লাগে। এসব কারণে কমেছে নৌকানির্ভরতা। ফলে আটঘর কুড়িয়ানার এই নৌকার হাট আর কত বছর জমজমাট থাকবে-সেটি বিরাট প্রশ্ন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //