পাপুয়ার পয়মন্ত পাখি

পাখি দেখতে পাপুয়া এসেছি। পাপুয়া মানে কিন্তু ‘পাপুয়া নিউ গিনি’ নামের নবীন দেশটি নয়। পাপুয়া একটি অতিকায় দ্বীপ। এই দ্বীপের পুবে অর্ধেকটাতে আছে ১৯৭৫ সালে স্বাধীন হওয়া ‘পাপুয়া নিউ গিনি’ নামের দেশটি এবং এর পশ্চিমের বাকি অংশ ইন্দোনেশিয়ার অঙ্গ। ইন্দোনেশিয়ার ভিসা নিয়ে আমরা এসেছি পাপুয়ার এই পশ্চিম অংশে। 

পাপুয়া দ্বীপের পাহাড়ি বনে অসাধারণ সব পাখি আছে যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এ পাখি দেখার আকাঙ্ক্ষা থাকলে আপনাকে পাপুয়াতেই আসতে হবে। আমরা পাপুয়া ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলাম চার বছর আগে; কিন্তু করোনার কারণে তা স্থগিত ছিল। অবশেষে ২০২৩ সালের শেষে এসে সেটা বাস্তবায়িত হলো। 

অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে আরাফুরা সাগরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে পাপুয়া দ্বীপপুঞ্জ; আয়তনে বাংলাদেশের ছয়গুণ বড়। তবে প্রায় পুরোটাই পাহাড়ি বনে আবৃত বলে এখানে মানুষের বসতি খুব কম। এই সব বনের অনন্য পাখি দেখার জন্য পাপুয়ার তিনটি এলাকায় আমাদের থাকতে হলো সপ্তাহ তিনেক। এলাকার নাম জায়াপুরা, সোরং ও মনোকোয়ারি। এখানে আমাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে স্থানীয় লোকের গৃহে। পাহাড়ি বনে হেঁটে হেঁটে পাখি খুঁজে নেওয়ার কাজে তাঁরাই আমাদের পথ-প্রদর্শক হয়েছেন। 

পাপুয়ার এই পাহাড়ি বন বিখ্যাত হয়েছে প্রধানত স্বর্গপাখি নামক পাখির একটি পরিবারের জন্যই। পাপুয়া দ্বীপেই পৃথিবীর অধিকাংশ স্বর্গপাখি বাস করে। বহুকাল ধরে পাপুয়ার বনে আছে অঢেল কেয়াফল, বনতলে নেই পাখি-শিকারি কোনো প্রাণী। তাই আড়াই কোটি বছরের বিবর্তনে এখানে ফল-খেকো সব আয়েশি পাখির পালকে এসেছে অবিশ্বাস্য সব জাঁকজমক; এবং পূর্বরাগের জন্য পুরুষ পাখিরা সৃষ্টি করেছে পালকের মনমাতানো প্রদর্শনী ও নাচের জটিল কোরিওগ্রাফি। 

পালকের আড়ম্বর আর আজব নাচগানের জন্যই এদের ‘বার্ডস অব প্যারাডাইস’ বা স্বর্গপাখি নাম দেওয়া হয়েছে বলে মনে করলে কিন্তু ভুল হবে। আসলে পা ছিল না বলে এদের স্বর্গপাখি নামটি দেওয়া হয়েছিল। ষোড়শ শতকে এ পাখির যে সব চামড়া ও পালক ইউরোপে আনা হয়েছিল তার সঙ্গে পা ছিল না। তাই লোকে বলতে শুরু করেছিল যে স্বর্গে উড়ে বেড়ায় বলেই ওই পাখিদের পায়ের প্রয়োজন পড়ে না। 

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আলফ্রেড ওয়ালেস ও অন্যান্য ইউরোপীয় বিজ্ঞানী পাপুয়া গিয়ে স্বর্গপাখির তথ্য ও নমুনা সংগ্রহ করলে এ পাখি নিয়ে কল্পকাহিনিগুলো ম্রিয়মাণ হয়ে যায়; ‘বার্ডস অব প্যারাডাইস’ নামটিই শুধু অক্ষয় রয়ে যায়। এখানে আমরা সেই নামেরই সরল বঙ্গানুবাদ করে লিখেছি ‘স্বর্গপাখি’।

স্বর্গপাখির ছবি ও ভিডিও দেখলেও পাপুয়া আসার আগে আমি কোনো জলজ্যান্ত স্বর্গপাখি দেখার সুযোগ পাইনি। এবারই প্রথম স্বচক্ষে স্বর্গপাখি দেখার অভিলাষটি পূরণ হলো। দুর্গম আরফাক পর্বতের অনন্য এই বৃষ্টিবনে আমাদের মাথার ওপরে এসে নাচ-গান করে গেল কয়েকটি বিরল স্বর্গপাখি। 

পাপুয়ায় দেখা সব পাখি নিয়ে লেখা শুরু করলে তা কবে শেষ হবে বলা কঠিন। তাই এখানে আমি মাত্র তিনটি বিশেষ পাখির কথা লিখছি। এই তিনটি পাখি এতই আজব যে এ কথা না লিখলে স্বস্তি মিলবে না। এ লেখাটি পড়লে আপনিও সম্ভবত ভুলতে পারবেন না এদের কথা। এই তিন পাখির মধ্যে রয়েছে দুই ধরনের দুটি মন মাতানো স্বর্গপাখি আর একটি রহস্যে ঘেরা প্যারট। 

প্রথমেই বলি ‘রাজা-স্বর্গপাখি’ দেখার কথা। জায়াপুরা এলাকাতে দেখা পেয়েছি এ পাখির। পাহাড়ের গোড়াতেই বাস করে রাজা-স্বর্গপাখি। আকারে সে শালিকের সমান; বিশ্বের সব স্বর্গপাখির মধ্যে  দৈর্ঘ্যেপ্রস্থে সবচেয়ে ছোট। তারের মতো সরু লেজের পালক দুটো ছাড়া বাকি দেহ মাত্র পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। বড় বড় স্বর্গপাখি রেখে এ পাখির নামটিই কেন ‘কিং বার্ড অব প্যারাডাইস’ হলো সেটা আমার জানা নেই! 

প্রাচীন লাভা আর রূপান্তরিত শিলার ফাঁকে ফাঁকে গজানো সরু ও লম্বা গাছের রৌদ্রোজ্জ্বল বনেই রাজা-স্বর্গপাখিদের বসবাস। অন্যান্য স্বর্গপাখির মতো পর্বতচূড়ায় মেঘে ঢাকা বনের অন্ধকার কোণে গিয়ে বসত গড়েনি সে। বিষুবরেখার নিকটে বলে পাপুয়ায় সারা বছরই গ্রীষ্মকাল; এবং বারো মাস এই বনে রসালো ফলের মেলা। এখানেই চলে এই পাখিদের আহার-নিদ্রা, নাচ-গান, প্রণয় ও প্রজনন। 

গাছের ঝাঁকড়া মাথার মসৃণ সরু ডালে চোখ রেখে আমরা আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি। গাইড বলেছে, এখানে রোজই আসে রাজা-স্বর্গপাখি। গাছের মসৃণ ডালগুলোই পুরুষ-পাখিদের ক্যাটওয়াক। ওখানে হেঁটে হেঁটে ওরা চোখ ধাঁধানো পালকের পোশাক প্রদর্শন করে এবং স্ত্রী-পাখিরা এসে তা দেখে। আমরা প্রার্থনা করছি, শুরু হোক সে প্রদর্শনী। 

তাই হলো; জ্বলন্ত শিখার মতো লাল একটি পাখি উড়ে এলো! পাখির ডানা, মাথা, ঘাড়, গলা সবই সিঁদুর-লাল; শুধু পেটটি সাদা আর পা দুটি ঘননীল। লম্বা পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে পাখিটি খাড়া ডাল বেয়ে উঠতে থাকল হেলেদুলে। কোনো সন্দেহ নেই, ক্যাটওয়াকে হাঁটার এই দক্ষতা তার জন্মজন্মান্তরের। 

দেখতে না দেখতে আরেকটি লাল পাখি এলো এবং পাশের ডাল বেয়ে খাড়া উঠতে থাকল। দুটি পাখিই ডালের শেষ মাথায় ওঠার পর উড়াল দিয়ে নেমে আবার ডালে হেঁটে হেলেদুলে ওপরে উঠতে থাকল। দুজনের মধ্যে কোনো বিবাদ নেই; তারা মুখোমুখি কোমর দুলিয়ে যেন ফক্সট্রট নাচের মহড়া দিচ্ছে। 

স্বর্গপাখির জগতে শুধু পুরুষের গড়নে ও বর্ণে থাকে স্বর্গীয় যত জাঁকজমক। রাজা-স্বর্গপাখিরও তাই। পুরুষের নাক থেকে লেজ পর্যন্ত রয়েছে রক্ত-লাল পালকের মসৃণ আস্তর। মার্বেলের মতো চোখের ওপরে আছে কাজলের টান। সংক্ষিপ্ত লেজের কেন্দ্রে তারের মতো সরু, লম্বা দুটি পালকের মাথায় জ্বলজ্বলে সবুজ গোল চাকতি। 

এ ছাড়াও পুরুষের ডানার নিচে ভাঁজ করে রাখা আছে সবুজ পাড় দেওয়া সারি সারি খয়েরি পালক। স্ত্রী পাখি কাছে এলেই এই লুকোনো পালকগুলো বেরিয়ে আসে, লেজ উল্টো হয়ে চলে আসে পিঠের ওপরে আর লেজের সবুজ চাকতি দুটো মাথার ওপর দুলতে থাকে। তখন সে লাল, সবুজ ও সাদা পালকের একটি দোদুল্যমান বল হয়ে যায়। এই বল-নৃত্যই এ পাখির প্রেম নিবেদনের পন্থা। এই নৃত্য প্রস্তুত করতে এদের নিশ্চয়ই লেগেছে লক্ষ বছর। 

গাছের বাকলের সাথে মিশে থাকা সাদামাটা স্ত্রী-পাখিরাই হলো পুরুষের বল-নৃত্যের দর্শক ও বিচারক। স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন ও নিখুঁত নাচিয়ে হলে স্ত্রী পাখি কাছে আসে; তবে তা ক্ষণিকের জন্য। দক্ষ পুরুষ হলে চোখের পলকে স্ত্রীর ডিম নিষিক্ত হয়ে যায়; এবং তাতেই বহমান থাকে রাজা-স্বর্গপাখিদের বংশধারা। 

দেহাতি পাখিদের মতো জোড়া বেঁধে সংসার করে না রাজা-স্বর্গপাখি। গাছের কোটরে বাসা বাঁধা, ডিমে তা দেওয়া আর ছানা পালনের সব দায়িত্ব একাই বহন করে স্ত্রী পাখি। পুরুষের কাজ ক্যাটওয়াকে হেঁটে শরীর ঠিক রাখা এবং কোনো স্ত্রী কাছে এলে বল-নৃত্য করা। বাকি কাজ কীভাবে সম্পন্ন হবে তা জানে স্ত্রী-পাখি; ওসব নিয়ে পুরুষের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হয় না। 

বনের এই রাজার দেহে ঝালরের মতো ঝুলে-পড়া পালকের বিচ্ছুরণ নেই, যেমনটি আছে অন্যান্য অনেক স্বর্গপাখির। এ জন্যই পালক-লোভী মানুষের হাতে রাজা-স্বর্গপাখি বধ হয়েছে কম। তাই পালক-সমৃদ্ধ স্বর্গপাখিদের মতো পাপুয়ার গহিন বনে পালাতে হয়নি রাজা-স্বর্গপাখিকে; এবং বিপন্ন-তালিকায় ওঠেনি ওদের নাম। 

তবে পাহাড়ের পাদদেশে বসত করার সমস্যাও কম নয়। এখানেই এখন মানুষের বসতি সম্প্রসারিত হচ্ছে বেশি। বনের বৃক্ষ উজাড় করে ভোজ্যতেলের গাছ রোপণ করা হচ্ছে। রাজা-স্বর্গপাখির সংখ্যা কমছে বলেও সতর্কবাণী এসেছে। 

জায়াপুরা থেকে আড়াই ঘণ্টা বিমানে আর ঘণ্টা দুয়েক নৌযানে ভ্রমণের পর আমরা সোরং এলাম। এখানে দেখা পেলাম এক জোড়া একলেক্টাস পাখির। জোড়ার একটি পাখি সিঁদুর-লাল, অন্যটি সবুজ। কে ছেলে আর কে মেয়ে, তা জানা না থাকলে আমরা হয়তো বলতাম লাল পাখিটি ছেলে। আসলে চোখ-ধাঁধানো লাল পাখিটি মেয়ে; ছেলেটি সবুজ পাতার সঙ্গে মিশে আছে। পাখির জগতে এমন উল্টো রং খুবই কম। 

পাখির জগতে উজ্জ্বল রংচং ও বাড়তি সাজসজ্জা থাকে পুরুষের দেহে। মেয়ে পাখিদের পালক সাদামাটা হয়; কারও নজর কাড়ার কোনো প্রচেষ্টা থাকে না তাদের। তার বড় কারণ, শত্রুর চোখ এড়িয়ে ডিম দেওয়া, ডিমে তা দেওয়া ও ছানা পালার মূল দায়িত্ব মেয়েরাই বহন করে। তাই আবাসস্থলের মাটি, পাথর কিংবা গাছের সঙ্গে মেয়ে পাখির পালকের রং মিশে গেলেই আপদ কম। 

ছেলের চেয়ে মেয়ে বেশি রঙিন, এমন ব্যতিক্রমী পাখিও কিছু আছে পৃথিবীতে। বাংলাদেশেও আছে দুটি পরিবার; নাম রাঙাচ্যাগা ও নাটাবটেরা। এ পাখিদের রং যেমন উল্টো, প্রজননের রীতিও উল্টো। এ পাখির ছেলেরাই ডিমে তা দেয় ও ছানা পালে। ডিম দিয়েই মেয়েরা বিদায় হয়; এবং অন্য ছেলের বাসায় আবার ডিম দেয়। ভূচর এই পাখিদের ছানার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে মায়েরা এক ঋতুতে একাধিক বাসায় ডিম না দিলে বংশরক্ষা হয় না। 

একলেক্টাসকে কিন্তু এই ব্যতিক্রমী পাখির দলেও ফেলা যায় না। কারণ এদের রং উল্টো হলেও প্রজননের রীতি উল্টো নয়। এ পাখির মেয়েরাই ডিমে তা দেয় ও ছানা পালে; এ কাজে পুরুষের ভূমিকা গৌণ। তাহলে ছেলে একলেক্টাসের রং গাছের সঙ্গে মিশে থাকার মতো আর মেয়ের রং দৃষ্টিকাড়া লাল হলো কেন? এর ব্যাখ্যা এখনো দিতে পারেনি পাখিবিদেরা। 

ব্যাখ্যাতীত বৈসাদৃশ্য আছে বলেই এ পাখির নাম হয়েছে একলেক্টাস-প্যারট। একলেক্টাস মানে অসমরূপ। এই অসঙ্গতি নিয়ে পাখিবিদের কৌতূহলের শেষ নেই; কিন্তু এ নিয়ে গবেষণা করা সহজ নয়। শুধু পাপুয়া, মালাক্কা, সাম্বা ও তানিম্বার নামের চারটি দ্বীপে পৃথিবীর চার প্রজাতির একলেক্টাস বাস করে। দ্বীপের নামেই এদের নাম হয়েছে ‘পাপুয়া-একলেক্টাস’, ‘মালাক্কা-একলেক্টাস’, ‘সাম্বা-একলেক্টাস’ ও ‘তানিম্বার-একলেক্টাস’। এই সব দুর্গম দ্বীপের পাহাড়ি বনে এসে দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ চালানো কঠিন। 

এত দিনে এ কঠিন গবেষণাগুলো হাতে নেওয়ার মতো পাখিবিদ হয়েছে পৃথিবীতে। তারা একলেক্টাস পাখির আরও একটি আজব আচরণের কথা জানতে পেরেছেন। তারা দেখেছেন, মা-একলেক্টাস প্রায়ই তার ছেলে-ছানাগুলো মেরে ফেলে। ডিম ফুটলেই ছেলের গায়ে সবুজ ও মেয়ের গায়ে লাল পালক থাকে। অনেক মা-পাখি তার সবুজ ছানাগুলো মেরে বাসার বাইরে ফেলে দেয়। 

বৃষ্টিবনের বিশাল গাছের ১০০ ফুট উঁচুতে প্রাকৃতিক ফোকর পেলে তার ভিতর একলেক্টাস বাসা করে। এসব বনে বছরে দশ মাস বৃষ্টি হয় এবং বৃষ্টির পানি ঢোকে না এমন ফোকর মেলে কম। শুকনো ফোকর দখলের জন্য তাই মেয়ে একলেক্টাস পাখিরা রক্তক্ষয়ী লড়াই করে। অত কষ্ট করে বাসা বেঁধে, ডিমে তা দিয়ে ছানা জন্ম দেওয়ার পর মায়েরা কেন ছানা মেরে ফেলে? 

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাখি-পর্যবেক্ষকরা দেখলেন, ভালো ফোকরে বাসা করতে পারলে মায়েরা তাদের ছানা মারে না। আমরা জানি, খাবারের ঘাটতির কথা ভেবে পেলিক্যান, ঈগল ইত্যাদি পাখি বাড়তি ছানা মেরে ফেলে। খাবার কম থাকলে তা একাধিক ছানার মধ্যে ভাগ করে সবগুলোকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার চেয়ে ওরা একটি ছানা বাঁচানোর চেষ্টা করে। এই বনে তো ফলভুক একলেক্টাস পাখির খাবারের অভাব নেই। এখানে হয়তো শুকনো বাসাই আহার্যের চেয়ে মূল্যবান। 

তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, বেছে বেছে ছেলে-ছানাগুলোকে হত্যা করাই বা কেন! পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, স্বাবলম্বী হতে মেয়ে-ছানার চেয়ে ছেলে-ছানার এক সপ্তাহ বেশি সময় লাগে। তাদের অনুমান, ছেলেগুলো মেরে ফেলে মা-পাখিরা অল্প দু-তিনটি মেয়ে-ছানাকে দ্রুত স্বাবলম্বী করতে পারে। তাই ডিম ফোটার তিন দিনের মধ্যেই ছেলে হত্যার কঠিন কাজটি করে ফেলে মা-পাখি। 

এই বৃষ্টিবনে বৃষ্টিহীন সময়টি খুব ছোট। ওই সময়ের মধ্যে ছানা বড় করে কোটর ছেড়ে যাওয়াটা জরুরি। আর্দ্র বাসায় সব ছানা মরে যাওয়ার চেয়ে শুধু মেয়ে-ছানা বেঁচে গেলে তবু তো মন্দের ভালো। তাছাড়া এ পাখিদের বংশরক্ষার জন্য সম্ভবত ছেলে-ছানার চেয়ে মেয়ে-ছানা বেশি প্রয়োজন। এমনও হতে পারে যে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের চেয়ে মেয়ের গড় আয়ু কম। তা হলে ছেলের চেয়ে মেয়ের সংখ্যা বেশি হলেই তো ভালো। 

একলেক্টাস পাখি সম্বন্ধে আরও তথ্য পাওয়া গেলে আমরা যাকে ‘অসঙ্গতি’ বলছি তার ব্যাখ্যা হয়তো পাওয়া যাবে। তার আগে এ কথা অবশ্যই বলা যায় যে, দুনিয়ার তাবৎ বন্যপ্রাণীর মতো একলেক্টাস পাখিও তাই করে যা ওর বংশধারা টিকিয়ে রাখার জন্য জরুরি। মানুষের মতো খেয়াল-খুশির বশে অথবা ন্যায়-অন্যায় বোধ থেকে কিছু করার সুযোগ নেই একলেক্টাস পাখির। 

সোরং থেকে বিমানে আমরা মনোকোয়ারি এলাম। এখানে জিপে উঠে দীর্ঘ পাহাড়ি পথে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসে এক আদিবাসী গ্রামে আমরা ঘাঁটি গাড়লাম। তারপর একজন আদিবাসী-গাইডের সঙ্গে শেষরাতে পর্বতের চড়াই বেয়ে উঠলাম ‘লাল-স্বর্গপাখি’ দেখার আশা নিয়ে। পর্বতচূড়ায় সূর্যোদয়ের সময় পুরুষ পাখিরা গাছের মগডালে এসে নাচ-গান করে। পালকের চোখ-ধাঁধানো প্রদর্শনী ও নাচ-গান দিয়েই এদের দিন শুরু হয়। সেটা শেষ হলে তবে ওঠে পানাহারের কথা। 

আমাদের হতাশ হতে হলো না; প্রত্যুষের প্রাণমাতানো আলোয় গাছের মগডালে ডানা মেলে এসে বসল সুপুরুষ একটি লাল-স্বর্গপাখি। আকারে পাতি-কাকের সমান হলেও কোমর থেকে লম্বা দুই-গুচ্ছ লাল পালকের ঝালর ঝুলে আছে বলে দেখে অনেক বড় মনে হয়। লেজের দুপাশ দিয়ে বিশাল লম্বা ফিতার মতো সরু দুটি পালক বেরিয়ে বাতাসে দুলছে। 

মনে হয় যেন পাখি নয়, একটি অতিকায় র‌্যা ফ্লেসিয়া ফুল ফুটে আছে গাছের শুকনো ডালে। সোনালি ঘাড় বাঁকিয়ে, লাল ডানা ছড়িয়ে দিয়ে আর সবুজ মাথার জোড়া-খোঁপা উঁচিয়ে পাখিটি চেঁচিয়ে হাঁক ছাড়ল। অমনি আরেকটি পুরুষ এসে বসল অন্য ডালে। শুরু হলো শোরগোল, দাপাদাপি আর পালকের জটিল প্রদর্শনী। 

পাশাপাশি দুটি ডালে শক্তিশালী সবুজ পায়ে তাল ঠুকে ও কোমর দুলিয়ে পাখি দুটি স্বর্গীয় এক ট্যাঙ্গো নাচের মহড়া দিতে থাকল। মসৃণ এই ডালের গায়ে পল্লব, প্রশাখা কিংবা বাকলের চিহ্নমাত্র নেই। রোজ রোজ এমন মহড়া দিয়েই ডালগুলোকে এরা প্রস্তুত করেছে পূর্বরাগ ও পরিণয়ের প্রকৃষ্ট স্থান হিসেবে। 

আমরা জানি বাংলাদেশের পয়মন্ত পাখিদের রঙিন পালকের সাজসজ্জা ও নাচ-গানের স্বর্গীয় উপস্থাপন দেখে কবি জীবনানন্দ দাশ কতটা বিস্মিত ও আপ্লুত ছিলেন। ‘পাখি’ শিরোনামে এক কবিতায় তিনি লিখেছেন :

বিচিত্র এ জীবনের পর

করেছে নির্ভর

রোম ঠোঁট পালকের এই তার মুগ্ধ আড়ম্বর। 

..এই পাখি এতটুকু, তবু সব শিখেছে সে

এ এক বিস্ময়। 

লাল-স্বর্গপাখি দেখেই মনে আসে ‘রোম ঠোঁট পালকের মুগ্ধ আড়ম্বর’ এই কথাগুলো। স্বর্গপাখির নাচের বিচিত্র মুদ্রাগুলো দেখে মনে হয় সত্যিই ‘সব শিখেছে সে’। শুধু যে শিখেছে তা নয়; নাচটি সৃজনও তো ওরাই করেছে। চোখধাঁধানো এ আয়োজন ও আড়ম্বরের লক্ষ্য হলো তাদের সাদামাটা স্ত্রী পাখির মনোরঞ্জন করা। স্ত্রীর তুষ্টির পথ ধরেই পালকের আড়ম্বর ও নাচের এই নাটকীয়তা উদ্ভূত ও পরিমার্জিত হয়েছে লক্ষ বছরে। 

বনের ওপরে ক্ষীণ সূর্য উঠেছে। স্বর্গপাখির মহড়া চলছেই। এ মুগ্ধ আড়ম্বর ও নৃত্যনাট্যের অনাহূত দর্শক আমরা লুকিয়ে আছি পাতার আড়ালে। আশা করছি, অচিরে দেখা দেবে এ নাচের কাক্সিক্ষত সেই দর্শক-স্ত্রী-স্বর্গপাখি। নিরাভরণ সে দর্শকেরা নীরবে এলেও পুরুষের উত্তেজনা ও আকুতি দেখে আমরা তা ঠিকই বুঝতে পারব। 

মেঘভাঙা রৌদ্রে বন থেকে বাষ্প উড়ছে। এখনো কোনো স্ত্রী-পাখির দেখা নেই। তাই সুপুরুষ দুই স্বর্গপাখি এক সময় তাদের প্রভাতি আয়োজনে ক্ষান্তি দিল। তাদের সুকুমার দেহে নেই কোনো ক্লান্তি কিংবা হতাশার অভিব্যক্তি। নৃত্যের মহড়া তাদের জীবনের অঙ্গ। এতে তাদের দেহ সুঠাম, পালক ঝরঝরে ও মঞ্চটি মসৃণ থাকে। 

মসৃণ ওই শাখা দেখে বোঝা যায় কোনো বৃক্ষে স্বর্গপাখিদের প্রাত্যহিক নাচের মহড়া চলে। হাজার হাজার বছর ধরে আদিবাসীরা ও সব বৃক্ষের ঠিকানা মনে রেখেছে; আর প্রয়োজনে বুমেরাং নিয়ে সেখানে হাজির হয়েছে। সে কালে তাদের আচার-অনুষ্ঠানে স্বর্গপাখির পালক দিয়ে সাজগোজ করাটা ছিল অপরিহার্য। 

স্বর্গপাখির পালকে সুসজ্জিত হওয়ার শখটি ইউরোপ ও এশিয়াতেও রপ্তানি হয়েছিল ১৯ শতকে। তখন সেখানেও তাবৎ রাজা-গজা ও বনেদি মহিলার পোশাকে স্বর্গপাখির পালক দেখা দিয়েছিল। এর ফলে মর্ত থেকে স্বর্গপাখিরা প্রায় উৎখাত হতে বসেছিল। সেই কুৎসিত ফ্যাশনটি স্তিমিত হয়ে যায় ২০ শতকে; হাঁপ ছেড়ে বাঁচে স্বর্গপাখিরা। 

পাপুয়ার আদিবাসী লোকেরা আজও স্বর্গপাখির নাচের জন্য নির্ধারিত বৃক্ষের ঠিকানা মনে রাখে। তবে সেটা স্বর্গপাখি মেরে পালক আহরণ করার জন্য নয়; আমাদের মতো শৌখিন পাখি-দর্শকের গাইড হওয়ার জন্য। ওরা জানে, স্বর্গপাখি বেঁচে থাকলেই আসবে পর্যটক। পর্যটকও জানে, পাপুয়ার পাহাড়ে আদিবাসী থাকলেই তারা সহজে স্বর্গপাখির খোঁজ পাবে। এই দুই জগতের মানুষের কাছেই পাপুয়ার পাখিরা সত্যি পয়মন্ত। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //