মার্কসীয় দর্শনের ধারাবাহিকতায় গ্রামসি ও তার হেজেমনি তত্ত্ব

এক নজরে গ্রামসির পরিচিতি
১৮৯১ সালে দক্ষিণ ইতালির সার্দিনিয়া দ্বীপে গ্রামসির জন্ম। চার বছর বয়সে একটি উঁচু সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে বালক গ্রামসির দৈহিক বিপর্যয় ঘটে। বয়স বৃদ্ধির পর তিনি শারীরিকভাবে কুব্জ ও খর্বকায় হয়ে পড়েন। দৈহিক এই আধা-পঙ্গুত্ব নিয়েই গ্রামসি ১৯১১ সালের ১৬ নভেম্বর ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯১৫ সালের এপ্রিলে ক্রমাগত দৈহিক ও স্নায়বিক অচলাবস্থার কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে দিতে বাধ্য হন।

এমন একজন দৈহিক প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন অর্থহীন হয়ে পড়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু জন্ম যার অমিত-তেজ নিয়ে, তার জীবন তো অর্থহীন হতে পারে না। স্বল্পপরিসরের জীবনে তারই প্রমাণ দিয়েছেন গ্রামসি। শারীরিকভাবে এই আধা-পঙ্গুত্বের মাঝেই গ্রামসি ইতালির বিপ্লবী আন্দোলনে এবং ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার তাত্ত্বিক এবং বাস্তব বিপ্লবী অনুশীলনের কাজে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৮ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ফ্যাসিস্ট শাসনের বিচারালয়ে ২০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে, ১০ বছর কারাভোগের মধ্যেই ‘প্রিজন নোট’ নামের বিপ্লবী তত্ত্বের এক বিস্ময়কর আকরগ্রন্থ লিখে গেছেন তিনি। ১৯৩৭ সালের ২০ এপ্রিল কারাবন্দি অবস্থায় মাত্র ৪৬ বছর বয়সে এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জীবনাবসান ঘটে।

ভূমিকা
মার্কসীয় দর্শনের ওপর ভিত্তি করে গ্রামসির ‘দর্শন’, ‘হেজেমনি’ ও ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লব’ (Passive Revolution) তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে লেনিনবাদের যুগেই, অর্থাৎ ১৮৭১ সালে ফ্রান্সে ‘প্যারি কমিউনের’ উত্থান ও তার রক্তাক্ত পতন এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পৌঁছানোর প্রেক্ষাপটে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ‘লেনিনবাদ’ ও ‘গ্রামসিবাদ’ দুটোই সমসাময়িক কালের। কিন্তু তবুও সাম্রাজ্যবাদী যুগে দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজ বিপ্লবের বাস্তব রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে গ্রামসির চিন্তা লেনিনবাদকে অতিক্রম করেছে। অথবা অন্যভাবে গ্রামসির চিন্তাকে বলা যায়, সমালোচনা ও পর্যালোচনা সাপেক্ষে লেনিনবাদের সম্প্রসারিত রূপ।

কিন্তু গ্রামসি তার চিন্তার বিশদ ও পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার জন্য যে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল, সে সময় তিনি পাননি। শারীরিক আধা-পঙ্গুত্ব এবং অকালমৃত্যুই এর প্রধান কারণ। গ্রামসি তার দর্শন ও হেজেমনি তত্ত্বের আলোকে সমাজে সর্বহারাশ্রেণির দর্শন ও সংস্কৃতির হেজেমনি প্রতিষ্ঠার তত্ত্ব লিপিবদ্ধ করেছেন, ১০ বছর কারান্তরালে থেকে ফ্যাসিবাদের খড়্গের নিচে বসে বিক্ষিপ্তভাবে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিরকুট আকারে, যা তার মৃত্যুর পরে সেই অসংখ্য চিরকুট একত্রে সন্নিবেশিত করে ‘প্রিজন নোট’ বা ‘কারারচনা’ নামে প্রকাশ হয়েছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার পৃষ্ঠার এই প্রিজন নোটের গভীরে প্রবেশ করা এমনিতেই এক দুরূহ কাজ। বলতে গেলে এই ‘মহাসমুদ্র’ ঘেঁটে গ্রামসির তত্ত্বের গভীরে গিয়ে বোঝাবুঝির কাজটি বাংলাদেশে বসে করা এক দুঃসাধ্যের কাজ।

এ কারণে গ্রামসির তত্ত্ব নিয়ে আমাদের পড়াশোনা করতে হয় পশ্চিমের গ্রামসি-বিশেষজ্ঞদের অতিতত্ত্বচর্চা এবং ধোঁয়াশাপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেণের ওপর ভিত্তি করে। এজন্য গ্রামসি নিয়ে আমাদের লেখালেখি করতে হচ্ছে অনেকটা আলো-ছায়ার মতো করে আধাআধি বুঝে এবং কিছুটা অস্পষ্টতা নিয়ে। বলতে দ্বিধা নেই, ‘গ্রামসিবাদ’ বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে এসব সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নিয়েই এই লেখার আয়োজন। বলাবাহুল্য, গভীর ও জটিল তত্ত্বচর্চায় আমি একেবারেই বকলম, তাই বর্তমান লেখাটিকে গ্রামসির তত্ত্ব নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত সরলপাঠ হিসেবে গণ্য করাই বেহতর।

যৎকিঞ্চিৎ কৈফিয়ত
বাংলা ভাষাভাষীদের গ্রামসি পাঠে একটি বড় সমস্যা হলো- গ্রামসির তত্ত্বের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে ‘হেজেমনি’, তা সর্বত্রই এখানে বাংলায় লেখা হয় ‘আধিপত্য’- যে বাংলা শব্দটি অন্তত আমরা বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত ব্যবহার করি নেতিবাচক অর্থে (কারও ইচ্ছা বা সম্মতির বিরুদ্ধে কোনোকিছু চাপিয়ে দেওয়ার অর্থে)। যেমন- আমরা যখন বাংলাদেশের ওপর কোনো বিদেশি শক্তির আধিপত্যের কথা বলি, তখন তা আমাদের ইচ্ছার বাইরে অসুবিধাজনক বা ক্ষতিকর কিছু বলে মনে করি। কিন্তু গ্রামসি তার লেখায় হেজেমনি কথাটি ওইরকম কোনো নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেননি। হেজেমনি কথাটা তিনি ব্যবহার করেছেন নেতৃত্ব বা প্রভাব অথবা আরও সুনির্দিষ্টভাবে সম্মতিসূচক আনুগত্য প্রতিষ্ঠার অর্থে। তাছাড়া অভিধানেও হেজেমনি শব্দের বাংলা অর্থ লেখা হয়েছে প্রধানভাবে ‘প্রভাব’ বা ‘নেতৃত্ব’। ‘নেতৃত্ব’ ও ‘আধিপত্য’- দুটি এক জিনিস নয়। যা-ই হোক, নানা দিক বিবেচনা করে পাঠকদের অনুমতি সাপেক্ষে বর্তমান নিবন্ধে আমরা হেজেমনির বাংলা, আধিপত্য না লিখে, লিখব- নেতৃত্ব, প্রভাববলয় ও সম্মতিসূচক আনুগত্য।

১. গ্রামসির দর্শন
গ্রামসির দর্শনচর্চার পরিধি অনেক বড়, বহুমাত্রিক ও গভীর। বক্ষ্যমাণ ক্ষুদ্রপরিসরের লেখায় তার বিশদ আলোচনার অবকাশ নেই। তবু কোনো জটিল তত্ত্বচর্চায় না গিয়ে গ্রামসির দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য এবং বিশেষ বিশেষ প্রবণতাগুলো এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

এই মর্মে প্রথমে গ্রামসির দৃষ্টিতে ‘দর্শন’ ও ‘কাণ্ডজ্ঞান’- এ দুয়ের সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক বিচার দিয়ে শুরু করি। কাণ্ডজ্ঞান বা শুভজ্ঞানকে গ্রামসি, দর্শনের একেবারে ভ্রুণ অবস্থা বলে মনে করেন। এজন্য কাণ্ডজ্ঞানকে দর্শন বলা যায় না। গ্রামসির মতে দর্শন হলো মানুষের চিন্তার এমন এক বৌদ্ধিক অভিব্যক্তি, যা কাণ্ডজ্ঞানের দ্বারা হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। গ্রামসির দর্শনের মূল প্রবণতা হলো, মানুষ এবং সমাজ সম্পর্কে চিন্তা-চর্চায় সক্রিয়, সচেতন জিজ্ঞাসা-সমালোচনা-বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা এবং তার মধ্য দিয়ে কা-জ্ঞানকে অতিক্রম করে যাওয়া।

গ্রামসির বিবেচনায়, দর্শনচর্চা কোনো অবাস্তব, উদ্দেশ্যহীন, লক্ষ্যহীন, অরাজনৈতিক চিন্তাচর্চা নয়। গ্রামসির মতে, মার্কসের চিন্তাচর্চা হলো বিধিবদ্ধ বাস্তব বৌদ্ধিক দর্শনচর্চা। গ্রামসি মার্কসের দর্শনকে নতুন অভিধায় ‘কর্মকাণ্ডের দর্শন’ বলে অভিহিত করেছেন। নিজের দর্শনকে তিনি বলেছেন ‘আন্দোলনের স্বার্থে দর্শনচর্চা’। দর্শনচর্চার এই দুটোই অভিনব নাম, যার আবেদন সুতীক্ষ্ণ ও লক্ষ্যভেদী। কর্মকাণ্ডের দর্শনের অর্থ হলো-মানুষ ও সমাজের মুক্তির জন্য 

আন্দোলন-লড়াইয়ের স্বার্থে দর্শনচর্চা। এই দর্শন মানুষের দৈনিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন ও রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে প্রতিক্ষণ সম্পর্কযুক্ত। গ্রামসির মতে, মার্কসের চিন্তাকে কর্মকাণ্ডের দর্শন রূপে বুঝতে হলে এবং তা আত্মস্থ করতে হলে ব্যক্তিমানুষ, সমাজবদ্ধ মানুষ এবং বিভিন্ন শ্রেণিবর্গের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমগ্র কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমভাবে প্রবেশ করতে হবে।

কর্মকাণ্ডের দর্শন মতে, ব্যক্তিমানুষের কর্মময় জীবনের প্রথম কাজ হলো- আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মআবিষ্কার (নিজেকে চেনা) এবং আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মরূপান্তরের মধ্য দিয়ে দর্শনে প্রবেশ করা। এই দর্শনে প্রবেশ করার জন্য দর্শনের ‘সাতখ- রামায়ণ’ পাঠ করার প্রয়োজন নেই। তার জন্য আত্মজিজ্ঞাসা, বাস্তব কর্মকাণ্ড ও অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট। কর্মকাণ্ডের দর্শনের বাইরে সাধারণ দর্শনচর্চা হলো পণ্ডিতজনদের বিশ্বজগৎ নিয়ে উচ্চমার্গীয় চিন্তাচর্চা। তবে একজন সমাজ বিপ্লবীর দর্শনচর্চার কথা যদি বলতে হয় তাহলে গ্রামসির কথাই বলতে হবে। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে কারান্তরালে বসে কোথা থেকে, কী বিষয় নিয়ে এবং কীভাবে গ্রামসি তার দর্শনচর্চা শুরু করেন তার একটা বাস্তব দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরি। কারান্তরালে বসে শ্রমিক ও নির্বিত্তশ্রেণির দর্শনের কথা ভাবতে ভাবতে গ্রামসি তার ‘প্রিজন নোটে’র চিরকুট লিখতে গিয়ে দিব্যচোখে দেখতে পান- ইতালির পুঁজিবাদ পুরোপুরি ফ্যাসিবাদ হয়ে ওঠার জন্য এমন একটা অবস্থা তৈরি করছে, তা সহজেই শ্রমিক আন্দোলনের ধারকে ভোঁতা করে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, বৃহত্তর দর্শনকে ভুলে গিয়ে কেবলমাত্র তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া ও সাধারণ অধিকার পাওয়ার জন্য শ্রমিকশ্রেণির লড়াইও ফ্যাসিবাদের আস্ফালনে পরিণত হতে পারে। (প্রিজন নোট)। 

আর সেই দর্শন নিজে বোঝার জন্য এবং অন্যদেরকে বুঝানোর জন্য গ্রামসির ভাষা হয়ে ওঠে খুবই চিত্তাকর্ষক ও ব্যতিক্রমিক। মার্কসের দর্শন গ্রামসির দর্শনচর্চার মূল ভিত্তি হলেও, সেটি কোনো যান্ত্রিক ফ্রেমের মধ্যে বন্দি থাকেনি। এ কারণে গ্রামসির দর্শনচর্চা হয়ে উঠেছে সৃজনশীল চর্চা, যার অভিব্যক্তি হুবহু মার্কসের মতোও নয়, খানিকটা অন্যরকম ও অনন্য। মার্কসের কথাগুলোকেই হুবহু উদ্ধৃতি আকারে ব্যবহার না করে, তাকে আরও সৃজনশীল ও জীবন্ত করে তুলে গ্রামসি বলেন- উৎপাদনের উপায়সমূহের (কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) সামাজিকীকরণের চেয়ে শ্রমিকশ্রেণির চিন্তা, দার্শনিকতা ও সংস্কৃতি উৎপাদনের উপায়সমূহের সামাজিকীকরণের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। (প্রিজন নোট)। 

এখানে গ্রামসি মার্কস পাঠ করে মার্কসের বক্তব্যের সাধারণ অর্থের ফ্রেমের মধ্যে আটকে থাকেননি। তিনি মার্কস অধ্যয়ন করেছেন মার্কসকে ক্রিটিক করে। মার্কস উৎপাদনের উপায়গুলোর সামাজিকীকরণের কথা বলে তার কথা যেখানে শেষ করেছেন, গ্রামসি সেখান থেকেই শুরু করে শ্রমিকশ্রেণির দর্শন ও সংস্কৃতির সামাজিকীকরণের কথা বলে মার্কসের চিন্তার আরও সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণ রূপ দিয়েছেন। এমনকি শ্রমিকশ্রেণির দর্শনের সামাজিকীকরণকে তিনি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। বিপ্লবীকর্মকা-সহ সব ক্ষেত্রে দর্শন তথা বিশ^দৃষ্টিকোণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার চিন্তা মার্কসেরই চিন্তা। গ্রামসি তাকে আরও পরিপূর্ণ রূপ দিয়েছেন। গ্রামসি দর্শনটাকেই নির্ণায়ক মনে করেছেন। কিন্তু যান্ত্রিক মার্কসবাদীরা মার্কসকে ক্রিটিক না করে মার্কসের তত্ত্ব যেটুকু পাঠ করেন তা হুবহু প্রয়োগ করতে যান। 

গ্রামসির বক্তব্য অনুযায়ী, শ্রমিকশ্রেণির দর্শন ও সংস্কৃতির সামাজিকীকরণের অর্থ হলো, শ্রমিকশ্রেণির দর্শন শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেণিকে বুঝলেই সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লব হবে না। এই দর্শন ও সংস্কৃতি সমাজের অন্যান্য নির্বিত্তশ্রেণি ও সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে। এই দর্শন ও সংস্কৃতি সর্বত্রই ছড়িয়ে দিয়ে সমাজের মধ্যে শ্রমিকশ্রেণির প্রভাববলয় বা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গ্রামসির মতে পুরসমাজ বা নাগরিক সমাজ নিয়ে তৈরি রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোসহ সাধারণ জনগণের চিন্তা ও চেতনায় শ্রমিকশ্রেণির দর্শন, সংস্কৃতি ও ইতিহাসবোধ সৃষ্টি করতে পারলেই সমগ্র জনগণের ও সমাজের ‘ভাগ্য’ পাল্টানোর বিপ্লবের বিজয় নিশ্চিত হতে পারে। সাম্রাজ্যবাদী যুগে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ভাবাদর্শ ও পুঁজিবাদী সংস্কৃতির যে বিশাল প্রভাববলয় তৈরি হয়েছে, সেখানে যে কোনো দেশে শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আগে সাংস্কৃতিক বিপ্লবটাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করাই সম্ভব নয়, অথবা কোথাও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল হলেও, সে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এটাই হলো গ্রামসির বিপ্লবী দর্শনের মূল কথা, এবং মার্কসের কর্মকাণ্ডের দর্শনের সারাৎসার। আর এইভাবে গ্রামসি বিপ্লবের তত্ত্বটাকে আমাদের কাছে সহজ করে দিয়েছেন।

সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লব বোঝার ক্ষেত্রে গ্রামসি আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দিয়েছেন। সেটি হলো- বিপ্লব করার জন্য বিপ্লবী নেতারা যে ‘মতাদর্শকে’ সর্বাধিক গুরুত্ব দেন, দর্শনকে মতাদর্শের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে মতাদর্শ-মতাদর্শ করে গলদঘর্ম হন, সেখানে গ্রামসি মনে করেন, মতাদর্শ মূল্যহীন হয়ে পড়ে, যদি দর্শনটা বোঝা না যায়। গ্রামসির মতে, ইতালির শ্রমিকশ্রেণি যে পুঁজিবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শিক লড়াইকে প্রাধান্য না দিয়ে অর্থনীতিবাদী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, সাধারণ অধিকার পাওয়ার আন্দোলনের মধ্যে ঘুরপাক খায়, যার ফলে তার বিপ্লবী চেতনা ভোঁতা হয়ে যায়, এমনকি বুর্জোয়া দর্শন ও বুর্জোয়া সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফলে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের মধ্যে যে গ্রামসি ‘ফ্যাসিবাদী প্রবণতার’ লক্ষণ দেখেন- সেটি মতাদর্শের সংকটের কারণে নয়। সেটি হলো শ্রমিকশ্রেণির দর্শন বা ভাবাদর্শ না বোঝার সংকট। তাই শ্রমিকশ্রেণিসহ সব নির্বিত্তশ্রেণির বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য গ্রামসি মতাদর্শ খোঁজেন না, সন্ধান করেন দর্শনের- যে দর্শন আত্মজিজ্ঞাসার, আত্মোপলব্ধির, আত্মবিশ্লেষণের এবং সমাজ ও ইতিহাসবোধের।

বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে প্রায়শই বলা হয়ে থাকে যে, বিপ্লবের বাস্তব অবস্থা বা উপযুক্ত পরিস্থিতি না থাকার কারণেই বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে। কথাটা একদিক থেকে যথার্থও বটে। মার্কসও তার Critique of Political Economy প্রবন্ধের মুখবন্ধে একথা বলেছেন। কিন্তু গ্রামসি এ বিষয়ে উল্টো প্রশ্ন তুলে যা বলেন, সেখানে বিপ্লবের বাস্তব অবস্থার চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে বিপ্লবের দর্শনের বাস্তব অবস্থা। গ্রামসি বলেন- বিপ্লবের বস্তুগত পরিস্থিতি যদি পরিপক্বও থাকে, শ্রমিক ও নির্বিত্তশ্রেণির মধ্যে বিপ্লবের দর্শন না থাকলে কি বিপ্লব সফল হতে পারে? (প্রিজন নোট)।

সব নির্বিত্তশ্রেণি ও জনগণের মাঝে শ্রমিকশ্রেণির দর্শন প্রতিষ্ঠার গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে গ্রামসি আরও বলেন- পৃথিবী ও সমাজের বিষয়ে নিজের সচেতন ধারণা গড়ে তোলা এবং সেই সঙ্গে নিজের সৃজনশীল বুদ্ধি খাটিয়ে কর্মকাণ্ডের দর্শনে পৌঁছানো, নিজের কর্মক্ষেত্র বা কর্তব্য বুঝে নেওয়া এবং বাইরে থেকে নিজের মতবাদে তৈরি ব্যক্তিত্বের ওপর পরিবর্তনকামী কোনো প্রস্তাব বা মতবাদকে অন্ধভাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করা- ইত্যাদি হলো সমাজের মধ্যে বিপ্লবী দর্শন ও সংস্কৃতির প্রভাববলয় (হেজেমনি) স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। (প্রিজন নোট)।

গ্রামসির মতে কর্মকাণ্ডের দর্শনের উদ্ভব ঘটে, ইতিহাসের মধ্যে অবস্থান করে কর্মশীল মানুষের প্রাথমিক চিন্তাচর্চা থেকে। কিন্তু ব্যক্তির এই চিন্তার পরিধি খুবই ক্ষুদ্র, যা প্রথম প্রকাশ পায় কাণ্ডজ্ঞান বা শুভজ্ঞান রূপে। পরে তা আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মোপলব্ধি ও আত্মবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে দর্শনে রূপ নেয়। এই আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মবিশ্লেষণ থেকে উৎসারিত দর্শন ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে ছড়ায় এবং তা গোটা সমাজকেই প্রভাবিত করে। পুরো ব্যাপারটিই যেহেতু ইতিহাসের মধ্যে থেকে ঘটে, তাই গ্রামসি ইতিহাসের গতিমান সত্যকে আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে সমাজে দর্শন ও সংস্কৃতির সার্বিক বিকাশের সম্ভাবনা দেখেন। ইতিহাস বা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মধ্যে থেকে মানববিবর্তনের সামগ্রিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মানুষের মধ্যে যে জীবনময় প্রণোদনা প্রবাহিত হতে থাকে, বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর চেতনা সঞ্চারিত হয়ে সেই প্রণোদনা মানবগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের দর্শনে রূপান্তরিত হয়ে তার সামাজিকীকরণ ও বাস্তবায়ন ঘটে। গ্রামসির মতে, এভাবেই মার্কসের দর্শন হয়ে ওঠে সমাজ বিপ্লবের কর্মকাণ্ডের বৈজ্ঞানিক দর্শন। গ্রামসি এর অন্তর্নিহিত রূপ উপলব্ধি করেন ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পরিপ্রেক্ষিতে। 

এই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রেক্ষিতেই ব্যক্তি ও সমাজবদ্ধ মানুষ তার মন, মনন ও সমাজের সব উপাদানের সমালোচনা, পর্যালোচনার মাধ্যমে বিচার করার প্রয়াস পায়। ব্যক্তিমানুষের যে কাণ্ডজ্ঞান বা শুভজ্ঞান তা সমাজবদ্ধ সব মানুষের সহজাত প্রবণতা। গ্রামসি সেটিকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদেরই প্রতিফলন হিসেবে দেখেন। গ্রামসি বলেন- প্রত্যেক সামাজিক স্তরেই নিজস্ব কাণ্ডজ্ঞান বা শুভজ্ঞান আছে, যা আসলে জীবন ও মানুষ সম্পর্কে বাস্তব ধারণারই প্রতিফলন। প্রত্যেকটি দার্শনিক ধারা শেষ হয়ে যাওয়ার পর কা-জ্ঞান একটা নির্যাস হিসেবে থেকেই যায়। প্রাথমিক বাস্তব ধারণার এই নির্যাসই শেষপর্যন্ত তার ঐতিহাসিক মূল্যের স্বাক্ষর হিসেবে থেকে যায়। কাণ্ডজ্ঞান অনড় অচল কিছু নয়, বরং তা ক্রমাগতই নিজেকে রূপান্তরিত করে চলে এবং বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা ও সামষ্টিক জীবনের দার্শনিকতাকে ধারণ করে পূর্ণ দর্শনের রূপ নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে চলে। (প্রিজন নোট)। 

গ্রামসির বিবেচনায় কর্মকাণ্ডের দর্শনকে গোড়া থেকেই হতে হবে বিতর্কমূলক ও সমালোচনামূলক। মার্কসের পুরো দর্শনও তর্কমূলক ও সমালোচনামূলক। এই তর্ক ও সমালোচনা-পর্যালোচনা হবে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পরিপ্রেক্ষিতে। সমাজ বিশ্লেষণের কাজও হবে সেই পরিপ্রেক্ষিতেই। এইভাবেই নির্ধারণ করতে হবে সমসাময়িককালের নতুন সমস্যাগুলো কী এবং পুরনো সমস্যাগুলোকেই বা কীভাবে বিশ্লেষণ করা হবে তাও।

কর্মকাণ্ডের দর্শন ও সাধারণ দর্শন
কর্মকাণ্ডের দর্শনের বাইরে দর্শন বলে কোনোকিছু গ্রামসি মানতে চান না। তবু সাধারণ দর্শন বা ‘নিহিতার্থবাদী দর্শনের’ অস্তিত্ব আছে বিরাট ওজন নিয়ে। এই দর্শনের বড় দুর্বলতা হলো- সমাজের নিচুতলার সঙ্গে দার্শনিকদের কোনো দার্শনিকতার সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে না। এই উচ্চমার্গীয় দর্শন কখনো সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারে না। তাছাড়া এই দর্শনের মধ্যে রাজনীতি-অর্থনীতির উপাদানও বড় একটা নেই।

গ্রামসি মনে করেন, বরং ধর্মের মধ্যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের উপাদান রয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানও রয়েছে। এটা বিবেচনা করলে এগুলোকে মতাদর্শ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি বলে চিহ্নিত করা যায়। ঐতিহাসিকভাবে ধর্মের উত্থান ও তার প্রচার, প্রসার হয়েছে মানুষ ও সমাজকে কেন্দ্র করেই এবং মানুষ ও সমাজের প্রয়োজনেই। সাধারণত ধর্মের দাবি হলো, মানুষ ও সমাজের সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণের জন্য সে নিবেদিত। এর মধ্য দিয়ে লক্ষ্য করা যায়, ধর্ম শুধু ধর্মতান্ত্রিকতা ও গোঁড়ামি চর্চাই নয়, সেটি রাজনীতি ও সংস্কৃতিও। আবার ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোকে ধর্মের ইতিহাসকে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাসও বলা যায়। ষোলো শতকে জার্মানির কৃষকযুদ্ধে সামন্ত-ভূস্বামী এবং ক্যাথলিক চার্চ ও যাজকমণ্ডলীর নিষ্ঠুর শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজন খ্রিষ্টধর্মীয় পাদ্রি টমাস মন্তেসরের নেতৃত্বে যে ঐতিহাসিক কৃষকযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেটি ছিল শ্রেণিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে বিপ্লবী নেতা মন্তেসর কৃষকদেরকে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছিলেন খ্রিষ্টধর্মের মৌলিক নীতি ও আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে। অথচ সেটি কোনো ধর্মযুদ্ধ ছিল না। সেটি ছিল সেক্যুলার শ্রেণিযুদ্ধ, বিশুদ্ধ শ্রেণিসংগ্রাম।

চৌদ্দশ বছর আগে আরবের নবী মোহাম্মদ পৌত্তলিকতা ও সমাজের অনাচার, অবিচার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, এবং নিম্নশ্রেণি বেদুইনদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষে-মানুষে সাম্যপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, উচ্চশ্রেণি ধনিক-বণিক কোরাইশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় অর্জন করেছিলেন। ধর্মীয় বাকধারায় সেই লড়াইও ছিল শ্রেণিসংগ্রাম। তার মধ্যেও ছিল রাজনীতি ও মতাদর্শ। আর সে লড়াই সূচিত হয়েছিল ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ধারার মধ্যেই।

হাল আমলে লাতিন আমেরিকায় সমাজবিপ্লবের প্রগতিশীল ধারার আন্দোলনে খ্রিষ্টীয় ক্যাথলিক পুরোহিতদের নেতৃত্বে Liberation Theology নামে যে নতুন সংগঠনের উত্থান ঘটেছে, সেখানেও দেখা যায় ধর্ম রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে হাজির। সেখানকার ক্যাথলিক ধর্মসংঘগুলো ধর্মতাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক প্রশ্নগুলোকে মুলতবি রেখে বাইবেলের ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির মৌলিক নীতি-আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে সমাজে মানুষের যথার্থ স্থান এবং নির্বিত্তশ্রেণিসহ গণ-মানুষের মুক্তির আন্দোলনে নেমেছে।

গ্রামসি তার লেখালেখিতে খ্রিষ্টীয় ধর্ম সংঘগুলোর বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। গ্রামসি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছেন যে, খ্রিষ্টধর্ম তার মতবাদ ও সংস্কৃতিকে উচ্চকুটি থেকে নিম্নকুটি মানুষের মধ্যে এবং নগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সমগ্র সমাজের ওপর দৃঢ়বদ্ধ প্রভাববলয় বা সম্মতিসূচক আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। গ্রামসি আরও লক্ষ্য করেছেন, ধর্ম তার মতবাদ ও সংস্কৃতি প্রচারের মাধ্যমে কীভাবে ধনী ও দরিদ্র উভয় শ্রেণির মানুষকে একসূত্রে গেঁথে সমাজের সব মানুষের মধ্যে এক নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। গ্রামসি মনে করেন, শ্রমিকশ্রেণির দর্শন ও সংস্কৃতি যেহেতু সব মানুষের মুক্তির বাস্তব দর্শন, তাই এই দর্শন ও সংস্কৃতি নিয়ে অবশ্যই পুরসমাজসহ সব সমাজের ওপর সুদৃঢ় প্রভাববলয় তৈরি করা সম্ভব। ধর্ম সম্পর্কে গ্রামসি খুবই কম কথা বলেছেন। এমনকি মার্কস এবং এঙ্গেলস ধর্ম ও অতীতের শ্রেণিসংগ্রামগুলোতে ধর্মীয় বাকধারা ব্যবহার সম্পর্কে যতটুকু আলোচনা করেছেন, ততটুকুও নয়। তবে সমাজে শ্রমিকশ্রেণির ভাবাদর্শ ও সংস্কৃতির প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠায় ধর্মের ব্যবহারিক কর্মকৌশলকে গ্রামসি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেছেন।

এইভাবে গ্রামসি মার্কসীয় ধারার কর্মকাণ্ডের দর্শনকে বহুমাত্রিক আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং শ্রমিকশ্রেণিসহ সব নির্বিত্তশ্রেণি ও গণ-মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পুরসমাজসহ সমগ্র সমাজের মধ্যে সর্বহারা শ্রেণির দর্শন ও সংস্কৃতির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার তত্ত্ব উপস্থাপন করে সমাজ বিপ্লবের নতুন ধারার জন্ম দিয়েছেন, যা একইসঙ্গে দার্শনিক, রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক।

২. গ্রামসির হেজেমনি তত্ত্ব এবং বিপ্লবের বর্তমান গতিপথ
গ্রামসির ‘হেজেমনি’ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে, পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোতে (কোন?) ঐতিহাসিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির মুখোমুখি সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ‘ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রাম’ তার উপযোগিতা হারাল এবং যার ফলে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের নতুন রণরীতি প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়ল, সেই বিষয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি। তবে তারও আগে সেই আলোচনার পূর্বাভাষ হিসেবে পাশ্চাত্যের আজকের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর বিভিন্ন কালপর্বের অবস্থা সম্পর্কে কিছু কথা এখানে বলে নিলে আলোচনায় সুবিধা হবে।

সাধারণভাবে আমাদের দেশে অনেক মানুষের মধ্যেই হয়তো এমন একটা ধারণা এখনো বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, পাশ্চাত্যের (ইউরোপের) সাদা চামড়ার মানুষের দেশগুলো বুঝি উনিশ শতকের শিল্পবিপ্লবের অব্যবহিত পর, অথবা তারও আগে থেকেই উন্নত দেশ ছিল। কিন্তু এটি একেবারেই একটি ভুল ধারণা। মূলত শিল্পবিপ্লবের আগে সামন্ততান্ত্রিক যুগে ইউরোপীয় দেশগুলো অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রাচ্যের, বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় অকল্পনীয়ভাবে পশ্চাৎপদ ছিল। সাধারণ উদাহরণ দিয়েই বলা যায়, মধ্যযুগে ইউরোপীয়রা যখন সারাদিনে তিন বেলা শুকনা রুটি চিবায় এবং রুটির চেয়েও সস্তা নিকৃষ্টমানের মদ গিলে হতাশায় দিন কাটায়, ভারতবাসীরা তখন কবির ভাষায় তিন বেলা পঞ্চ-ব্যঞ্জন আর দুধে-ভাতে আনন্দে দিন কাটায়। চৌদ্দ-পনেরো শতকের দিকে আরবীয় মুসলিম বিশ্বের দামেস্ক ও বাগদাদ নগরীতে যখন শত শত ‘হাম্মাম’ (সাধারণ জনগণের জন্য উষ্ণজলের বড় বড় স্নানাগার বা গোসলখানা) নির্মাণ করা হয়েছিল, ইউরোপের মানুষদের মধ্যে তখন গোসল করার সংস্কৃতিই তৈরি হয়নি।

শুনলে অবিশ্বাস্যই মনে হবে, আঠারো শতকের মাঝামাঝি কালেও, এমনকি উনিশ শতকে শিল্পবিপ্লবের কিছু পরেও ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল ভারতবর্ষের তুলনায় অনেক অনেক পেছনে। বহুল প্রচারিত তথ্য অনুযায়ী ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলায় ও ভারতবর্ষে উপনিবেশ কায়েম করার সময়কালে যখন বাংলার জিডিপি ছিল ২৫ শতাংশ, আর সমগ্র ভারতবর্ষের ছিল ২২ শতাংশ, তখন ইংল্যান্ডের জিডিপি ছিল ৩.৫ শতাংশ। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের আত্মজীবনীতেও এ তথ্যটির উল্লেখ আছে। এই তথ্যের একশ ভাগ সত্যতা প্রমাণ হয় আরও দুই তথ্যের সুবাদে। তার একটি হলো পলাশীর প্রান্তরে বাংলা (এবং ভারতবর্ষের) স্বাধীনতার সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে, রবার্ট ক্লাইভ বাংলা দখলের পর মুর্শিদাবাদের রাজধানী নগরীতে ঢুকে সেখানকার সমৃদ্ধি ও জৌলুস দেখে এতই বিস্মিত হয়েছিলেন যে, তিনি স্বগতোক্তি করে বলেছিলেন, ‘আহা! আমাদের লন্ডন যদি এরকম হতো!’ দ্বিতীয় তথ্যটি আমরা কোট করব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি থেকে। তিনি লিখেছেন- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলা দখল করে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়, তখন একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর (লন্ডন-লে.) কিনতে পারত। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১৮) এসব তথ্য থেকে প্রমাণ হয় ইংল্যান্ড তথা ইউরোপ তখন প্রাচ্যের তুলনায় কত পিছিয়ে ছিল। শিল্পবিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের শিল্প কারখানাগুলো গড়ে উঠেছিল আমাদের বাংলার অর্থে। 

যা হোক, মূল আলোচনায় ফিরে আসি। গ্রামসির ‘হেজেমনি’ ও ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লব’ তত্ত্বের উদ্ভবের আগে ইউরোপে শ্রমিকশ্রেণির দ্বারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ‘ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রাম’ (বুর্জোয়াবিরোধী মুখোমুখি সশস্ত্র লড়াই) কীভাবে তার উপযোগিতা হারিয়েছে সেই বিষয়ে এখন সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে নিই। 

উনিশ শতকের গোড়াতে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে পূর্বেকার সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা উচ্ছেদ হয়ে ইউরোপে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে মাত্র। বণিক পুঁজি, শিল্প পুঁজিতে এবং বণিক বুর্জোয়া, শিল্প বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে কেবল। ইতিমধ্যে বুর্জোয়াশ্রেণির শোষণ-নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের যন্ত্র বুর্জোয়া রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় আইন, পুলিশ ও আমলাবাহিনী, যদিও তখন তা ছিল দুর্বল ও অ-সুসংহত।

এদিকে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা উদ্ভবের পর নব্য শিল্প মালিকদের ‘দর্শন’ হয়ে উঠল কারখানার শ্রমিকদের রক্ত শোষণ করে পুঁজি বৃদ্ধি করা। প্রায় পুরো উনিশ শতক জুড়ে ইউরোপীয় পুঁজিপতিরা দ্রুত পুঁজি বৃদ্ধির স্বার্থে কলকারখানার লাখ লাখ শ্রমিকের ওপর নিষ্ঠুর শোষণ ও বর্বরোচিত নিপীড়ন চালায়। বুর্জোয়ারা তাদের কারখানায় শ্রমিকদেরকে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা খাটায় নামমাত্র মজুরিতে। শ্রমিকশ্রেণি শ্রমদাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়া এবং কোনো প্রকার দাবিদাওয়া বা প্রতিবাদ করার ন্যূনতম সুযোগ থাকে না। এরূপ শাসরুদ্ধকর অবস্থায় শ্রমিকশ্রেণির ভেতরে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও ঘৃণা একপর্যায়ে বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে তা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কলকারখানার মেশিন ও যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করতে থাকে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভিন্ন উপায়ে ক্ষোভ প্রকাশ ও আন্দোলন-সংগ্রাম চালাতে থাকে। 

ইতিমধ্যে ইউরোপে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির বিপ্লবের তত্ত্বেরও উদ্ভব ঘটে গেছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়েই ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘শৃঙ্খল ছাড়া প্রোলেতারিয়েতের হারাবার কিছু নেই’ ইত্যাদি স্লোগান নিয়ে কার্ল মার্কসের ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’ প্রকাশিত হয়ে গেছে। ইউরোপের অনেক দেশে বিভিন্ন নামে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টিও গড়ে উঠেছে। এমনকি কোথাও কোথাও শ্রমিকশ্রেণির লড়াই বুর্জোয়া রাষ্ট্র উৎখাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে (বিশেষ করে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও ডেনমার্কে)। গোটা ইউরোপের পুঁজিপতিরা তখন কমিউনিজমের সাক্ষাৎ ‘ভূতের’ ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। কারণ বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলো তখনো দুর্বল ও অ-সুসংহত। এজন্য বুর্জোয়াশ্রেণির পক্ষে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান আন্দোলন-লড়াই ও অভ্যুত্থানকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্রের আইন, পুলিশ ও আমলাদের দ্বারা প্রতিহত করা সম্ভব নয়। ইউরোপের এইরূপ টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে ১৮৭১ সালে ফ্রান্সে শ্রমিকশ্রেণির সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্যারি কমিউনের উত্থান ঘটে। শ্রমিকশ্রেণি প্যারিসের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। আবার রক্তাক্ত লড়াই থেকে শুরু করে ১০ সপ্তাহের মাথায় সেই প্যারি কমিউনের রক্তাক্ত পতনও ঘটে।

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ধারায় উনিশ শতকের গোড়ায় ইউরোপে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার উদ্ভবের পর থেকে ১৮৭১ সালের প্যারি কমিউন পর্যন্ত দীর্ঘ সময়কালটি ছিল পুঁজিবাদের ‘ক্লাসিক্যাল যুগ’। আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই দীর্ঘ সময়কালে ইউরোপে বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের শ্রেণিসংগ্রামের রূপ ছিল ‘ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রাম’।

চিরায়ত পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তর এবং ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রামের যুগের অবসান
উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের দোরগোড়ায় এসে ইউরোপের চেহারা একেবারে পাল্টে গেল। এই সময়ে, অর্থাৎ শিল্পবিপ্লবের প্রায় একশ বছর পর ইউরোপসহ গোটা পশ্চিমা বিশ্বের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে যে আরেক অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটল, সেটা হলো ‘পুঁজির মহাবিপ্লব’। মার্কস এ বিপ্লবের পুরোটা দেখে যেতে পারেননি। লেনিন এর প্রায় পুরোটাই দেখেছেন এবং এ ‘বিপ্লবের’ চরিত্র বিশ্লেষণ করে এর নাম দিয়েছেন ‘সাম্রাজ্যবাদ’। 

এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ইউরোপের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সম্পদশালী দেশগুলোতে ঔপনিবেশিক শোষণ-লুণ্ঠন এবং এসব দেশের বিপুল অর্থসম্পদ পাচারের মাধ্যমে ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলোর পুঁজি অকল্পনীয়ভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠে বিশাল আকার ধারণ করল। উপনিবেশিত দেশগুলোর ওপর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর শোষণ-লুণ্ঠনের ভয়াবহতা বোঝার জন্য সম্ভবত একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে (১৯৪৭ সালে) যখন ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নেয়, তখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হিসাবে ব্রিটিশ-পূর্ব বাংলার জিডিপি ২৫ শতাংশ এবং সমগ্র ভারতের জিডিপি ২২ শতাংশ কমে গিয়ে প্রায় ১ শতাংশে নেমে আসে। এ থেকেই বোঝা যায়, কীরকম ভয়াবহ লুণ্ঠনযজ্ঞটি ঘটেছিল। একদিন মুর্শিদাবাদের সমৃদ্ধি ও জৌলুস দেখে বিস্মিত রবার্ট ক্লাইভ তার সম্পদহীন দেশের রাজধানী নগরী লন্ডন নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা পূরণ হয়েছিল। 

দুই
উপরের আলোচনার মধ্য দিয়ে এককালের অর্থসম্পদহীন ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের ছয়-সাত দশকের মধ্যে পুঁজির যে বিশাল উল্লম্ফনের চিত্র পাওয়া গেল এবং তার ফলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর পরাক্রমশালী শক্তি হয়ে ওঠার যে বাস্তব অবস্থা তৈরি হলো, তা আন্দাজ করতে পারলে গ্রামসির ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লব’ ও ‘হেজেমনি’ তত্ত্ব বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য অনেক সহজ হবে।

মূলত শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর, প্রথম কয়েক দশকে ইউরোপের বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলোর পুঁজিপতিরা তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নিষ্ঠুর শ্রমিকশোষণের মাধ্যমে যে পুঁজি গড়ে তুলেছিল তা দিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা এবং সুসংহত রাখা, শুধুমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে (রাষ্ট্রের আইন, পুলিশ ও আমলাবাহিনী দিয়ে) সম্ভব ছিল না। এর প্রধান কারণ ছিল, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শ্রমিকশ্রেণিসহ সব নির্র্বিত্তশ্রেণির ওপর বুর্জোয়াশ্রেণির নিষ্ঠুর শোষণ-নিপীড়ন সামাজিকভাবে ছিল অন্যায্য, অমানবিক ও বর্বরোচিত- যা সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এর ফলে তখন বুর্জোয়াশ্রেণির নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র ছিল বলতে গেলে গোটা সমাজ থেকেই বিচ্ছিন্ন। এ কারণে নিষ্ঠুর শোষণ-নিপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিকশ্রেণির ক্ষোভ, বিক্ষোভ এবং আন্দোলন-লড়াই ক্রমান্বয়ে তীব্র আকার ধারণ করলে বুর্জোয়া রাষ্ট্র নড়বড়ে হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু ইতিমধ্যে দেশে দেশে ঔপনিবেশিক শোষণ-লুণ্ঠনের মাধ্যমে পুঁজির মহাবিপ্লব ঘটে যাওয়ায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর পুঁজিপতিরা তাদের বুর্জোয়া ব্যবস্থার নানা সংস্কার সাধনের সুযোগ পেল। এরই মধ্যে তারা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, শ্রমঘণ্টা কমিয়ে আনাসহ শ্রমিকদের অনেক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করল। ইতিমধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটার ফলে উৎপাদনের উপায়সমূহের উন্নতি ঘটল, ফলে শ্রমিকদের অমানবিক শ্রমের অনেক লাঘব ঘটল। এর পাশাপাশি দেশে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির দ্রুত বিকাশ ঘটতে লাগল, বিকাশ ঘটতে লাগল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার। রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে স্বাধীনভাবে গড়ে উঠল জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। গড়ে উঠল নতুন নতুন বহু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাকেন্দ্র। সর্বোপরি দেশের পুরসমাজ (সিভিল সোসাইটি) নিয়ে গড়ে উঠল রাষ্ট্রের শক্তিশালী উপরিকাঠামো। সেই উপরিকাঠামোকে ভিত্তি করে গড়ে উঠল বহু সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংঘ, ধর্মসংঘ, সেবা সংঘ ও মিশনারি। 

গড়ে উঠল বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র, এমনকি পশুক্লেশ নিবারণ কেন্দ্রসহ বহু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এইসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ল সমাজের সব স্তরে। আর এই সবকিছুই গড়ে উঠল বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বুর্জোয়া দর্শন, বুর্জোয়া সংস্কৃতি ও পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারণা নিয়ে। 

পুরসমাজ নিয়ে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের যে শক্তিশালী উপরিকাঠামো তৈরি হলো তার মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলো পুঁজিবাদী দর্শন ও বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রভাববলয়। এই প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠিত হলো কোনো ভয়-ভীতি প্রদর্শন বা পুলিশি ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা নয়। তা প্রতিষ্ঠিত হলো পুরসমাজ ও জনগণের সম্মতিক্রমে। এই বুর্জোয়া প্রভাববলয় শুধুমাত্র সাধারণ জনগণের মধ্যেই নয়, তা প্রভাবিত করল শ্রমিকশ্রেণিকেও। এভাবেই সমাজের ওপর বুর্জোয়াশ্রেণির প্রভুত্ববাদী ক্ষমতা শক্তিশালী হলো। বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা সুদৃঢ়ভাবে সুসংহত হলো। আর তা ঘটল এক ‘নীরব বিপ্লবের’ মাধ্যমে।

গ্রামসি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের এই নীরব বিপ্লবের নাম দেন ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লব’ (Passive Revolution)। এরই আরেক নাম ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ (Cultural Revolution)। হাল আমলের ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল-কেন্দ্রিক মার্কসীয় ধারার বোদ্ধা গবেষক থিওডোর-অ্যাডর্নো এর আরও আধুনিক নাম দিয়েছেন ‘Culture Industry’ (সংস্কৃতির কারখানা)। আধুনিক বুর্জোয়া এনলাইটেনমেন্টের আওতাধীনে এই কারখানায় রয়েছে পুঁজিবাদী দর্শন ও সংস্কৃতির বিশাল শক্তিশালী মাধ্যম এবং তার রয়েছে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা, যেমন- সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, নাটক, সিনেমা, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম, ক্রীড়া সংস্কৃতি, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি, ইত্যাদি। এই Cultural Industry শুধু পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশের মানুষের চিন্তা-চেতনাকেই নিয়ন্ত্রণ করে না। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যুগে দুনিয়ার তাবৎ মানুষ উৎপাদন-পুনরুৎপাদন করে, রাজনীতি করে, সংস্কৃতিচর্চা করে, চিন্তা করে, কথা বলে, খায়-দায়, হাঁটে, দৌড়ায়, হাসে, কাঁদে ও ঘুমায় এই বৈশ্বিক পুঁজিবাদী সংস্কৃতির ঘোরের মধ্যে থেকে। পুঁজিবাদী বিশ্বের সব স্তরে পুঁজিবাদী দর্শন ও সংস্কৃতির এই যে সর্বগ্রাসী প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠিত হলো, এটাই হলো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে বুর্জোয়াবিরোধী ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রামের উপযোগিতা হারানোর সবচেয়ে বড় কারণ। অবশ্য পুঁজিবাদী দেশগুলোর বাইরে ১৯১৭ সালের অক্টোবরে রাশিয়ায় ‘বুর্জোয়া শ্রেণির’ বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের যে ঘটনা ঘটে, সেটি ছিল এক ব্যতিক্রমিক ও অস্বাভাবিক ঘটনা। 

যা হোক, পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোতে বুর্জোয়াশ্রেণির ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লবে’র মধ্য দিয়ে চিরায়ত শ্রেণিসংগ্রামের যুগ শেষ হয়ে গেলে, গ্রামসি শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং সমাজতন্ত্রে উত্তরণের বিপ্লবের বিকল্প রণনীতির কথা ভাবতে থাকেন। তিনি বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলোর দীর্ঘ শান্তিপূর্ণ ‘নীরব বিপ্লবের’ মাধ্যমে রাষ্ট্রের উপরিকাঠামো ও সমগ্র সমাজের ওপর বুর্জোয়াশ্রেণির সুদৃঢ় সাংস্কৃতিক প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠার ঘটনাকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও শিক্ষণীয় বিষয় বলে মনে করেন। সমাজ পরিবর্তন ও জনগণের মুক্তির দার্শনিক গ্রামসির চিন্তা-চেতনাগুলো হলো এরকম-শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মানে তো শুধু আইন, পুলিশ-আমলা দিয়ে তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্র দখলে রাখা নয়। এই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আগের কাজ রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোর নাগরিক সমাজ ও জনগণের মন জয় করা। আর জনগণের মন জয় করা সম্ভব একমাত্র জনগণের মুক্তির দর্শন ও সংস্কৃতি দিয়ে। জনগণের মুক্তির দর্শন ও সংস্কৃতি দিয়ে যদি পুরসমাজ ও গণ-মানুষের মন জয় না করা যায় তাহলে রাষ্ট্রক্ষমতা কীভাবে দখল করা সম্ভব? অথবা অন্য কোনোভাবে ক্ষমতা দখল করলেও সেই রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়েই বা কী করা যাবে? আইন, পুলিশ ও আমলা দিয়ে রাষ্ট্র চালানো যায়, কিন্তু সেটি দিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটানো যায় না। গ্রামসির উপলব্ধি হলো, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আগের কাজ হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির দর্শন ও সংস্কৃতি দিয়ে রাষ্ট্রের উপরিকাঠামো ও সমাজের নির্বিত্তশ্রেণিসহ সব স্তরের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রভাববলয় সৃষ্টি করা।

গ্রামসি আরও উপলব্ধি করেন, শ্রমিকশ্রেণির দর্শন ও সংস্কৃতি, বুর্জোয়া দর্শন ও সংস্কৃতির তুলনায় শুধু শ্রেষ্ঠই নয়। সমাজের সব নির্বিত্তশ্রেণি ও সাধারণ জনগণের উপযোগী দর্শন ও সংস্কৃতি হিসেবে তা বহু-বহুগুণ শক্তিশালী। গ্রামসি মনে করেন, শ্রমিকশ্রেণিও দীর্ঘসময় নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে পুরসমাজ ও সমগ্র সমাজের মধ্যে তার দর্শন ও সংস্কৃতির প্রভাববলয় বা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটাতে পারে। আর এটাই হলো গ্রামসির ‘হেজেমনি’ তত্ত্বের মূল কথা।

গ্রামসির মতে, পুঁজিবাদী দর্শন ও সংস্কৃতির অচলায়তন ভাঙার কাজ অস্ত্রের বিপ্লব দ্বারা সম্ভব নয়। একমাত্র নিরস্ত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলন দ্বারাই তা সম্ভব। তাই আজকের যুগে শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং জনগণের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে উত্তরণের বিপ্লব মূলত সাংস্কৃতিক বিপ্লব। অনেকেই মনে করেন, আজকের বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ভাবাদর্শ ও সংস্কৃতির অপ্রতিরোধ্য অচলায়তনের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের দর্শন ও সংস্কৃতির বিপ্লব কী করে সম্ভব? বিশেষ করে অনেক দেশেই যেখানে পুঁজিবাদী-আমলাপুঁজিবাদী সংস্কৃতির সঙ্গে ফ্যাসিবাদ যুক্ত হয়েছে, সেখানে সর্বহারার দর্শন ও সংস্কৃতির আন্দোলন শুরু করাই তো সম্ভব নয়। এটি একেবারেই ভুল ধারণা। একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখতে পাই- মানুষের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলন সারা পৃথিবীব্যাপী প্রতিনিয়তই চলছে। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন আজ পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য উভয় মেরুতেই চলছে। বাংলাদেশেও দেখা যায়, মুষ্টিমেয় সংখ্যক একচেটিয়া সুবিধাভোগী লোকদের বাদে শহর-নগর-গ্রামগঞ্জের প্রতিটি মানুষ প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ। জনগণের এই অসন্তোষ ও ক্ষোভের পরিবেশের মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলন-লড়াই কঠিন ও বিপজ্জনক হলেও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য অনুকূল। দেশের ছাত্র-বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীরা লেখালেখি ও সভা-সেমিনারে বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে বিদ্যমান আমলা পুঁজিবাদী-ফ্যাসিবাদী রাজনীতি এবং গণবিরোধী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবিরত প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। তরুণ প্রজন্ম নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছে। এছাড়াও রাজনৈতিক আন্দোলনের বাইরে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অঙ্গনে, অফিস-আদালতে, কলে-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে, এমনকি চায়ের আড্ডায় সর্বত্রই প্রকাশ পাচ্ছে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক আন্দোলন অবিরতই চলছে। 

কিন্তু এসব আন্দোলন, প্রতিবাদ সংগঠিত ও সংঘবদ্ধভাবে না হওয়ায় অনেকটাই অরণ্যে রোদনে পরিণত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে চেতনা আছে, কিন্তু তা সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ নয়। গ্রামসি বলেছেন, সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ চেতনার কথা। তার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের উপরিকাঠামো এবং সমাজের নির্বিত্তশ্রেণিসহ সাধারণ জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সঠিক চিন্তার মেধাবী প্রজন্মের পার্টির। 

এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলা দরকার। গ্রামসির ‘হেজেমনি’ এবং নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পুরো ব্যাপারটি হলো ‘গণতান্ত্রিক’। কোনো ডিক্টেটরশিপ, জোরজবরদস্তি বা ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে কিংবা জনগণের সম্মতির বাইরে কোনোকিছু চাপিয়ে দিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ তো দূরের কথা, এমনকি কোনো ব্যক্তির ফলের বাগান থেকে একটি আপেল পেড়ে খাওয়াও সম্ভব নয় (সম্ভব হলেও তা হবে দস্যুতা)। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো গণতন্ত্র। সমাজতন্ত্র হলো গণতন্ত্রেরই উচ্চতম রূপ। সমাজতন্ত্রের অর্থ হলো মানুষের স্বাধীনতা ও পরিপূর্ণ গণতন্ত্র। গ্রামসি বলেন- আজকের যুগে শ্রমিক ও নির্বিত্তশ্রেণি অপেক্ষাকৃত নতুন এক রাজনৈতিক জগতে সঞ্চরণমাণ, যেখানে শ্রেণিসংগ্রাম ও সমাজতন্ত্রে উত্তরণের স্বরূপ হলো গণতন্ত্র। (Gramsci and Marxist Theory: Edited by Mouffe, Published by Routledge and Kegan Poul, London ১৯৭৯) 

গ্রামসির উদ্ধৃতিতে ‘নতুন রাজনৈতিক জগতে’র অর্থ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অতীতের দাস ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ছিল ‘রাজনীতিবিহীন’ সমাজ। সমাজতন্ত্র তো দূরের কথা, বলতে গেলে ‘স্বাধীনতা’ ও ‘গণতন্ত্র’ শব্দেরও তখন উদ্ভব হয়নি। সে তুলনায় আজকের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শোষণের যুগে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সাম্যের কথা সর্বত্র উচ্চারিত হয়। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সাম্যের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আজ যদি ‘বিশ্ব গণভোট’ হয় তাহলে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পড়বে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সাম্যের পক্ষে। এ থেকেই বোঝা যায়, আজকের সমাজ বা পৃথিবী গ্রামসির হেজেমনি ও নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের এক উর্বর ক্ষেত্র। প্রয়োজন শুধু সংঘবদ্ধ ও সৃজনশীল উদ্যোগের। 

হেজেমনি ‘প্রভুত্ব’ নয়, নেতৃত্ব
গ্রামসির মতে, রাষ্ট্রের উপরিকাঠামো ও সমাজের মধ্যে কোনো একটি শ্রেণি বা গোষ্ঠীর প্রাধান্য প্রকাশ পায় দুই রূপে। একটি ‘প্রভুত্ব’ রূপে, আরেকটি বৌদ্ধিক ও নৈতিক ‘নেতৃত্ব’ রূপে। এই দুই ধরনের প্রাধান্যই মূলত দর্শন ও সংস্কৃতির প্রাধান্য। একটি প্রাধান্য হলো- বুর্জোয়া দর্শন ও সংস্কৃতির, আরেকটি শ্রমিকশ্রেণির দর্শন ও সংস্কৃতির। আর এই দুই ধরনের দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের সম্মতিক্রমে। উপরিকাঠামো ও সমাজের ওপর বুর্জোয়াশ্রেণির দর্শন ও সংস্কৃতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য থাকে প্রভুত্ব কায়েম করা। এর বিপরীতে উপরিকাঠামো ও সমাজের ওপর শ্রমিকশ্রেণির (বিপ্লবী শ্রেণির) দর্শন ও সংস্কৃতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থাকে বৌদ্ধিক, নৈতিক ও মানবিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। সে হিসেবে এর একটি হলো বুর্জোয়াশ্রেণির হেজেমনি, আরেকটি শ্রমিকশ্রেণির হেজেমনি। গ্রামসির ‘হেজেমনি’ হলো- সমাজের ওপর বুর্জোয়া শ্রেণির প্রভুত্বকামী হেজেমনির বিপরীতে শ্রমিকশ্রেণির বৌদ্ধিক ও মানবিক দর্শন এবং সংস্কৃতির হেজেমনি প্রতিষ্ঠা করা।

নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের উত্তরণ
আমরা এর আগে উল্লেখ করেছি, পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ক্লাসিক্যাল ফর্মের প্রোলেতারিয়েত বিপ্লবের ব্যর্থতা থেকে গ্রামসি বিপ্লবের নতুন রণনীতির কথা ভাবেন এবং সেই ভাবনা থেকেই তিনি উদ্ভাবন করেন ‘হেজেমনি’ ও ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লবে’র তত্ত্ব। এই তত্ত্বের আলোকেই গ্রামসি শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের রণনীতি সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, বুর্জোয়া শ্রেণি, তার রাষ্ট্র এবং তার হেজেমনি বিস্তারকারী ব্যবস্থাগুলোর মাধ্যমে একসঙ্গে যে বিশাল সাংগঠনিক শক্তি ও ক্ষমতার ভা-ারগুলো গড়ে তুলেছে সেগুলোকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে দীর্ঘস্থায়ী ‘নিষ্ক্রিয় সংগ্রাম’ চালানো প্রয়োজন। এই সংগ্রামকে গ্রামসি ‘অস্থায়ী সংগ্রাম’ বলেও অভিহিত করেছেন। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেছেন, শ্রমিকশ্রেণির এই ‘নিষ্ক্রিয়’ বা ‘অস্থায়ী’ বিপ্লব আবার বুর্জোয়াশ্রেণির নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের বিভিন্ন রূপের সঙ্গে এবং তাদের তৈরি করা নতুন নতুন ধরনের সংস্কারবাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই বিপ্লব আসলে বুর্জোয়াশ্রেণির শান্তিপূর্ণ ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লবে’র বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির শান্তিপূর্ণ ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লবে’র এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম। গ্রামসি এই বিপ্লবের তাৎপর্য অনুসন্ধান করেন মার্কসের ‘ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’ প্রবন্ধের মুখবন্ধের মধ্যে। 

গ্রামসি ১৯৩৩ সালের এক লেখায় নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের ধারণাটিকে মার্কসের ‘ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’ প্রবন্ধের মুখবন্ধে উল্লেখিত উত্তরণের বিশ^জনীন সমস্যার সঙ্গে যুক্ত করেন। অবশ্য এর আগেই গ্রামসি তার প্রথম নোটবুকে ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লব’ বা ‘বিপ্লবহীন বিপ্লবে’র কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানেও তিনি বলেছেন- নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের তত্ত্ব যেন ‘ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’র মুখবন্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুসিদ্ধান্ত।’ এ কারণে গ্রামসির নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের ধারণাটিকে অনুধাবন করতে হবে, এক সমাজ থেকে আরেক সমাজে উত্তরণের প্রশ্নে ‘ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’র মুখবন্ধের দুই মৌলিক নীতির পর্যালোচনার মাধ্যমে। সেই দুটি নীতি হলো, ১. ‘কোনো সমাজ কাঠামোর ভেতরের উৎপাদিকা শক্তির যতক্ষণ পর্যন্ত সামনে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তা বিলুপ্ত হয় না’, এবং ২. ‘যে সব দ্বন্দ্ব সমাধানের মতো উপযুক্ত পরিস্থিতি সমাজের মধ্যে ইতিমধ্যে তৈরি হয়নি, সেগুলোর দায় সমাজ কখনোই গ্রহণ করে না’।

গ্রামসি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের, শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রে রূপান্তরের ব্যাপারটিকে দীর্ঘস্থায়ী নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের ‘উত্তরণ’ হিসেবে দেখেছেন। এই উত্তরণের ব্যাপারটি খুবই জটিল ও অস্পষ্ট। গ্রামসির মতে, এই উত্তরণ নির্ভর করে গণতান্ত্রিক ও সৃজনশীল তৎপরতার মাধ্যমে উপরিকাঠামোসহ সমাজের সব স্তরে শ্রমিকশ্রেণির দর্শন ও সংস্কৃতির হেজেমনি শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা তার ওপর। গ্রামসির মতে, নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের ওপর শ্রমিকশ্রেণির সাংস্কৃতিক হেজেমনি শক্তিশালী হলে, উপরিকাঠামো ও সমাজের ওপর বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রভাববলয় শিথিল হয়ে পড়বে। এর ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে। এর অর্থ হলো, বুর্জোয়া ব্যবস্থাটির আর বিকাশের সম্ভাবনা নেই। আর তখনই শুরু হবে উত্তরণের পর্ব। এই অনুসিদ্ধান্তে গ্রামসি পৌঁছেন মূলত মার্কসের ‘মুখবন্ধে’র পর্যালোচনার মাধ্যমে, যেখানে মার্কসের মতেই- ‘অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে রাষ্ট্রের (বুর্জোয়া রাষ্ট্রের) নিয়ন্ত্রণ যখন শিথিল হয়ে পড়ে তখন একটি উৎপাদন কাঠামো থেকে আরেকটি উৎপাদন কাঠামোতে উত্তরণের প্রক্রিয়া হয় নিষ্ক্রিয়’।

তবে দীর্ঘস্থায়ী নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের সময়গুলোতে গ্রামসি রাজনৈতিক আন্দোলনও চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এই রাজনৈতিক লড়াই বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে পরিচালিত হবে খণ্ডিতভাবে। গ্রামসি এটাকে বলেছেন ‘পরিখা যুদ্ধ’। এর মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির প্রভাববলয়ভুক্ত কোনো কোনো অঞ্চলে খণ্ডিতভাবে প্রোলেতারিয়েত শ্রেণির রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়ে উঠবে। 

অনেকে মনে করেন, বর্তমান যুগ হচ্ছে প্রবল পরাক্রমশালী পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি খুবই জটিল এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল উৎপাদন-পুনরুৎপাদনের যুগ। তাই অর্থনীতি ও প্রযুক্তির প্রবল শক্তি নিয়ে পৃথিবীর আসমুদ্রহিমাচল সর্বত্রই পুঁজিবাদী ভাবাদর্শ ও সংস্কৃতির যে অপ্রতিরোধ্য প্রভাববলয় তৈরি হয়েছে, তার বিপরীতে উপরিকাঠামো ও সমাজের ওপর সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ ও সংস্কৃতির প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। এই মর্মে তারা খুবই সহজ প্রত্যয় নিয়ে গ্রামসির ‘হেজেমনি’ তত্ত্বের কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন। 

কিন্তু গ্রামসি হেজেমনি তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন খুবই কঠিন প্রত্যয় নিয়ে। গ্রামসির দৃঢ়প্রত্যয় হলো- যত কঠিন কাজই হোক, উপরিকাঠামো ও সমাজে শ্রমিকশ্রেণির ভাবাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে জনগণের রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা ও সমাজতন্ত্রে উত্তরণ কখনোই সম্ভব নয়। গ্রামসি মনে করেন, ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ধারায়, সমাজের বিদ্যমান পুঁজিবাদী উৎপাদিকা শক্তির, সামনে আর বিকশিত হতে না পারার শর্তকে ত্বরান্বিত করার জন্যই চলতে থাকবে এই সাংস্কৃতিক হেজেমনি প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লব’। গ্রামসির ‘হেজেমনি’ তত্ত্ব, মার্কসীয় ধারায় সমাজ পরিবর্তনের চিন্তার ইতিহাসে নতুন কোনো তত্ত্ব নয়। এটি মার্কস ও লেনিনের চিন্তারই ধারাবাহিক উচ্চতর রূপ। সমাজ ও জনগণের ওপর নেতৃত্বের অর্থই হচ্ছে- দর্শন ও সংস্কৃতির নেতৃত্ব, তা যে শ্রেণিরই হোক। 

৩. প্রাচ্যে গ্রামসির হেজেমনি তত্ত্বের প্রয়োগ
বিগত শতকের ষাটের দশক পর্যন্তও পশ্চিমা গ্রামসি বিশেষজ্ঞরা গ্রামসির ‘হেজেমনি’ ও ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লবে’র তত্ত্ব প্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য মনে করতেন না। তাদের ভাষ্যমতে গ্রামসিও তা মনে করতেন না। সত্তরের দশকের পর তাদের অনেকেই হেজেমনি তত্ত্ব প্রাচ্যের দেশগুলোর জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য মনে করলেও তা নিয়ে বিতর্কও ছিল। সে বিতর্ক মনে হয় এখনো খানিকটা আছে। আমাদের এখনকার আলোচনা সেই বিষয় নিয়েই। তবে এ বিষয়েও আলোচনার আগে নানা প্রাসঙ্গিকতার কারণে তৃতীয় বিশ্বের পশ্চাৎপদ রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লব এবং তার প্রবণতা ও ব্যর্থতা সম্পর্কে এখানে কিছু কথা বলে নেওয়া খুবই জরুরি।

পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্নে ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রামের যুগের অবসানের পর এসব দেশে পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। তার মধ্যে আবার পুঁজিবাদের ভেতরেই ‘সমাজতন্ত্রে’র (হিটলার-মুসোলিনির সমাজতন্ত্রের) স্লোগান নিয়ে ফ্যাসিবাদের উত্থান অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলে পশ্চিমের সংকট আরও ঘনীভূত হয়।

ইতিমধ্যে ১৯১৭ সালে সংঘটিত অক্টোবর বিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোর শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে সাময়িকভাবে বিপ্লবী চেতনার কিছুটা জাগরণ লক্ষ্য করা গেলেও, একপর্যায়ে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এ সময় গ্রামসি লক্ষ্য করেন, ইউরোপে রুশ অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসছে। রুশ বিপ্লব নিয়ে ইউরোপীয় শ্রমিকদের আর কোনো আগ্রহ নেই। ১৯২৬ সালে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক বন্ধু তোগলিয়াত্তিকে লেখা এক চিঠিতে গ্রামসি বলেন- ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের ৯ বছর পরে আজ ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বলশেভিকদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বৈপ্লবিক চেতনা আর অনুভূত হচ্ছে না। এখন সেটি এক ভবিতব্য, যার ফলাফল আজ নিঃশেষ হয়ে গেছে।

গ্রামসির এই মন্তব্য ছিল বাস্তব অবস্থারই প্রতিফলন। আসলেই অক্টোবর বিপ্লবের পর রুশ কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির বড় রকমের তত্ত্বগত বিচ্যুতি এবং মাত্র একটি দেশে, তাও আবার কঠোর একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে ‘সমাজতন্ত্র’ নির্মাণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা ইত্যাদি কারণে আন্তর্জার্তিক ক্ষেত্রে তার সাফল্য সম্পর্কে মানুষের আস্থা টলে যেতে শুরু করেছিল।

গ্রামসি অক্টোবর বিপ্লব-পরবর্তী সোভিয়েত রাষ্ট্রকে ‘অর্থনৈতিক কর্পোরেট রাষ্ট্র’ বলে আখ্যায়িত করে, সেই রাষ্ট্রে যে একনায়কতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তার ধ্বংসাত্মক দিকগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন এইভাবে- অর্থনৈতিক কর্পোরেট রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো, এটি এমন এক নতুন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেটি গড়ে ওঠে এক নতুন সামাজিক গোষ্ঠীর একনায়কতান্ত্রিক কর্তৃত্বের ওপর ভিত্তি করে। এর চরিত্র হয়ে ওঠে শুধুই অর্থনৈতিক। অর্থনীতির বাইরে ব্যক্তি ও সামষ্টিক মানুষের দার্শনিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সব দিক দিয়ে সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন এ রাষ্ট্রের লক্ষ্য নয়। বরং তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে অর্থনীতি, অর্থাৎ উৎপাদন। এইরূপ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোর উপকরণগুলো এবং জনসমাজ দর্শন ও সংস্কৃতিগতভাবে পশ্চাৎগামী অবস্থায় থাকতে বাধ্য হয়। দার্শনিকতা ও 

সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই ধরনের রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি হয় ধ্বংসাত্মক। অতীতের সমালোচনা এবং পুরনোকে ভুলে যাওয়ার বা তাকে ধ্বংস করার চেষ্টার মধ্যে তা সীমিত থাকে। আর রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় একনায়কতান্ত্রিক অনমনীয় কেন্দ্রীকরণ। প্রয়োজন পড়ে  এক প্রভুত্বকামী পরাক্রমশালী আমলাতন্ত্র এবং সমাজের স্বাধীন আত্মিক জীবনের ওপর সর্বগ্রাসী জোরজবরদস্তিমূলক নিয়ন্ত্রণ। (Revolution against ‘CAPITAL’) অক্টোবর বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে হুবহু এমন রাষ্ট্রব্যবস্থাই কায়েম হয়েছিল। গ্রামসি তথাকথিত রুশ সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত পতন দেখে যেতে পারেননি, তবে ‘রুশ সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন যথার্থ বলে প্রমাণ হয়েছে।

অক্টোবর বিপ্লবের বড় অসংগতি
রুশ বিপ্লব সম্পর্কে গ্রামসির পর্যালোচনার বাইরেও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখানে আলোচনা হওয়া দরকার। সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে গ্রামসির যে তীক্ষ্ণ সমালোচনা-পর্যালোচনা এতক্ষণ আমরা পাঠ করলাম, সেটি হলো অক্টোবর বিপ্লবের পরবর্তী সময়কার চিত্র। কিন্তু রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতার সামগ্রিক চিত্র পাওয়ার জন্য শুধুমাত্র অক্টোবর বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায়ের পর্যালোচনাই যথেষ্ট নয়। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের (প্রাচ্যের) দেশগুলোর বিপ্লব বোঝার জন্য ‘অক্টোবর বিপ্লবের’ও পর্যালোচনা হওয়া জরুরি।

অক্টোবর বিপ্লব হয়েছে প্যারি কমিউনের পতনের ৪৬ বছর পরে, অর্থাৎ ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রামের যুগ শেষ হওয়ার অনেক পরে। সে হিসেবে অক্টোবর বিপ্লব, গ্রামসির ‘হেজেমনি’ তত্ত্ব অনুযায়ী তো নয়-ই, এমনকি লেনিনবাদ অনুসারেও হয়নি। কারণ, বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির মুখোমুখি লড়াইয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ‘চিরায়ত শ্রেণিসংগ্রামে’র যুগ যে শেষ হয়ে গেছে, এটি গ্রামসিরও আগে লেনিনই প্রথম বুঝেছিলেন। অথচ সেই লেনিন রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লব করেছেন ‘চিরায়ত শ্রেণিসংগ্রামে’র তত্ত্ব অনুসারে, যেখানে কোনো চিরায়ত বুর্জোয়া শ্রেণিই ছিল না।

সে হিসেবে অক্টোবর বিপ্লবকে বলা যায় অনেকটা ফুটবল খেলার গোলকিপারবিহীন গোলপোস্টে গোল দেওয়ার মতো। অর্থাৎ আকস্মিক একটি সুযোগকে কাজে লাগানোর মতো ঘটনা (মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ কোনো ‘আকস্মিকতা’র তত্ত্ব নয়)। লেনিন এটা ভালোভাবেই বুঝতেন। কিন্তু বলশেভিকরা এই ফাঁকা মাঠে গোল করার সুযোগটা যখন নিয়েছিল, তখন তারা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের নাজুক অবস্থা এবং পশ্চাৎপদ রুশ সমাজের বাস্তব অবস্থার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে, দীর্ঘস্থায়ী গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সেই সঙ্গে দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের গাড়ির সঙ্গে তড়িঘড়ি করে ‘সমাজতন্ত্রের’ নামে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের উন্মত্ত ঘোড়া জুড়ে দিয়েছিল। 

আবার সেখানেও দেখা যায় এক বড় রকমের অসংগতি। সেটি হলো- অক্টোবর বিপ্লবের ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রাম, কোনো ক্লাসিক্যাল বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে হয়নি, কারণ রাশিয়ায় ক্লাসিক্যাল বুর্জোয়াশ্রেণির অস্তিত্বই ছিল না যা আগেই বলা হয়েছে। এমনকি বলতে গেলে সে বিপ্লব কোনো বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধেও হয়নি। সেটি হয়েছে রুশ লিবারাল ডেমোক্র্যাটস, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস এবং বিপ্লবী সোশ্যালিস্টদের (এক অংশের) বিরুদ্ধে, যারা মাত্র আট মাস আগে ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে’র মাধ্যমে জার সাম্রাজ্যবাদ ও জারতন্ত্র উৎখাত করে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করেছিল এবং রাশিয়ার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে যাদের ভূমিকা ছিল প্রগতিশীল ও বৈপ্লবিক। অর্থাৎ তারাও ছিল বিপ্লবী। 

অক্টোবর বিপ্লবের এই যে বড় অসংগতি, সেটি ছিল লেনিনবাদের পরিপন্থী, কারণ লেনিন রুশ বিপ্লবকে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ই বলেছেন (এমনকি অক্টোবর বিপ্লবের পরও), এবং সেই সঙ্গে তিনি ‘যুক্তফ্রন্টের’ কথাও বলেছেন (যা তিনি কমিনটার্নের তৃতীয় কংগ্রেসে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন)। আর সে অনুযায়ী লিবারাল ডেমোক্র্যাটস, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস ও বিপ্লবী সোশ্যালিস্টরা ছিল রাশিয়ার গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মিত্র, যুক্তফ্রন্টের অংশীদার। লেনিনবাদের যে ‘সূত্র’ মোতাবেক তৃতীয় বিশ্বের পশ্চাৎপদ অবিকশিত পুঁজির দেশগুলোর জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির পার্টির নেতৃত্বের অপরিহার্যতার কথা বলার পাশাপাশি সব দেশপ্রেমিক শক্তির সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্টকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, রাশিয়ায় সেই দেশপ্রেমিক বিপ্লবী শক্তিগুলোকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া’ আখ্যা দিয়ে, তাদের বিরুদ্ধে কামান দাগিয়েই সংঘটিত হয় অক্টোবর বিপ্লব। অক্টোবর বিপ্লবের এই অসংগতি বা বিকৃতিই বিপ্লব-পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনব্যবস্থাকে চালিত করেছিল গ্রামসির ভাষায় ‘এক নতুন সামাজিক গোষ্ঠীর একনায়কতান্ত্রিক আমলাতন্ত্রে’র দিকে।

সমাজ বিপ্লব সম্পর্কে গ্রামসির চিন্তা আবর্তিত হয়েছে প্রধানত ইতালিসহ ইউরোপীয় বুর্জোয়া সমাজকে কেন্দ্র করে। প্রাচ্যের সমাজও তার চিন্তায় ও লেখায় এসেছে, কিন্তু তা ব্যাপকভাবে নয়। বিশেষ করে অক্টোবর বিপ্লবকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘটনাবলি তার চিন্তায় ও লেখায় যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, প্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা-পর্যালোচনা তার লেখায় পাওয়া যায় না। তার একটা কারণ হতে পারে, গ্রামসির জীবদ্দশায় চীন ও ভিয়েতনাম বিপ্লবসহ প্রাচ্যের দেশগুলোতে কমিউনিস্ট আন্দোলন অতটা তীব্র হয়ে ওঠেনি। এসব দেশে তখন উপনিবেশবিরোধী জাতীয় মুক্তির আন্দোলন-লড়াই ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও, গ্রামসি প্রাচ্যের দেশগুলোকে হেজেমনি তত্ত্ব-প্রয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র বলে মনে করেননি। তাছাড়া গ্রামসির তখনকার চিন্তামতে প্রাচ্যের দেশগুলোতে ঐতিহাসিক কারণেই পুরসমাজ বা সিভিল সোসাইটির বিকাশ না ঘটায় রাষ্ট্রের উপরিকাঠামো সেভাবে গড়ে ওঠেনি, যদিও সব দেশের ক্ষেত্রে হয়তো এক রকম ছিল না। যা হোক, এসব কারণেই গ্রামসির সমসাময়িক কালের, এমনকি তার কিছু পরবর্তীকালের গ্রামসি চর্চাকারীরা মনে করতেন, প্রাচ্যের দেশগুলোতে গ্রামসির হেজেমনির তত্ত্ব একেবারেই গৌণ। 

কিন্তু গ্রামসির ‘হেজেমনি’ ও ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লব’ তত্ত্বের উদ্ভবের পর প্রায় একশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ধারায় ইতিমধ্যে পৃথিবী ও বিশ্বসমাজ বহুমাত্রিকভাবে অনেক পাল্টে গেছে। গ্রামসির কালে প্রাচ্যের (এশিয়া-আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার) দেশগুলোর যুগ ছিল ঔপনিবেশিক যুগ। কিন্তু বিশ শতকের ষাট-সত্তর দশকের মধ্যেই সেই যুগের অবসান ঘটে গিয়ে প্রাচ্যের দেশগুলো ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যে অনেক দেশ অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এমনকি বিশ শতকের গোড়ার দিকের প্রাচ্যের অতি পশ্চাৎপদ দেশ চীন আজ অর্থনীতি ও টেকনোলজিতে পশ্চিমা উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সাত-আট দশক আগে এসব দেশে যেখানে বলতে গেলে কোনোই আধুনিক শিল্পকারখানা ছিল না, সেখানে বহু আধুনিক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। গ্রামসির সময়ে প্রাচ্যের দেশগুলোর শিল্পপণ্য যেখানে পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশে রপ্তানি হওয়ার কথা চিন্তাও করা যেত না, সেখানে এসব দেশের আধুনিক শিল্পপণ্য আজ ইউরোপ-আমেরিকায় বিপুল আকারে রপ্তানি হচ্ছে।

প্রাচ্যের দেশগুলোতে গড়ে ওঠা লাখ লাখ আধুনিক শিল্পকারখানায় আজ কাজ করছে কোটি কোটি শিল্পশ্রমিক। এসব দেশের অধিকাংশের অর্থনীতি প্রধানত সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর হলেও এবং তার চরিত্র নয়া-ঔপনিবেশিক ও আমলা বুর্জোয়া হলেও, এসব রাষ্ট্রের উপরিকাঠামো হিসেবে গড়ে উঠেছে পুরসমাজ (সিভিল সোসাইটি), গড়ে উঠেছে মধ্যবিত্তশ্রেণি। উপরিকাঠামোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অ-রাষ্ট্রীয় বহু সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। গড়ে উঠেছে বহু এনজিও ও সেবামূলক সংস্থা এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাকেন্দ্রসহ বহু প্রতিষ্ঠান। অবশ্য এই সবকিছুই গড়ে উঠেছে আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। উপরিকাঠামোসহ এসব প্রতিষ্ঠান ধারণ করে আছে গোটা সমাজকে এবং সমাজের সব স্তরের জনগণকে। আর স্বাভাবিক কারণেই উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর মতোই উপরিকাঠামোসহ সমগ্র সমাজের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নয়া-ঔপনিবেশিক ধাঁচের আমলা-পুঁজিবাদী ভাবাদর্শ, চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতির প্রভাববলয় (হেজেমনি)। সুতরাং এসব দেশে উপরিকাঠামো ও গোটা সমাজের ওপর প্রভাববলয় সৃষ্টিকারী নয়া-ঔপনিবেশিক আমলা-পুঁজিবাদী ভাবধারা ও সংস্কৃতির বিপরীতে বৌদ্ধিক, নৈতিক ও মানবিক দর্শন ও সংস্কৃতির হেজেমনি প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে নির্বিত্তশ্রেণিসহ গণ-মানুষের রাষ্ট্র এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা ও আকাক্সক্ষা দুঃস্বপ্নমাত্র। 

এইসব বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটেই প্রাচ্যের দেশগুলোতে নির্বিত্তশ্রেণি ও জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথে গ্রামসির হেজেমনি তত্ত্ব অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। এমনকি পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোর চেয়েও আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। তবে প্রাচ্যে হেজেমনি তত্ত্বের বাস্তবায়ন ঘটবে খুবই সৃজনশীল প্রয়োগের মাধ্যমে, প্রাচ্যের মতো করে। প্রাচ্যের চিন্তার জগৎ ও দার্শনিক ভাবনা বহুমুখী ও বৈচিত্র্যময়। প্রাচ্যের বিপ্লব ঘটবে, মার্কসের দর্শন, লেনিনের চিন্তা ও গ্রামসির হেজেমনি তত্ত্বের সঙ্গে প্রাচ্যের মন ও মননের সাযুজ্য ঘটিয়ে। তার জন্য মার্কস ও লেনিন নতুন করে পাঠ এবং গ্রামসি চর্চার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোর বিপ্লবী অনুশীলনে গ্রামসি চর্চা এখনো শুরুই হয়নি। এর কারণও অত্যন্ত পরিষ্কার। সেটি হলো, এসব দেশে মার্কসীয় ধারার বিপ্লবী আন্দোলন এখনো পর্যন্ত ‘যান্ত্রিক মার্কসবাদে’র খাঁচা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। 

- লেখক ও গবেষক

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. আনতোনিও গ্রামসি : নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ, সম্পাদনা ও অনুবাদ : সৌরীন ভট্টাচার্য, সমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্ল পাবলিশার্স, কলকাতা। 
২. Karl Marx: Economic and Philosophical Manuscripts: Translated by T.B. Baltimore, Frederic Unger Publishing Co. New York. 
৩. Karl Max: Critique of Political Economy. 
৪. গ্রামশি বিচার-বিশ্লেষণ, শোভনলাল দত্তগুপ্ত, সম্পাদিত : পার্ল পাবলিশার্স, কলকাতা। 
৫. Gramsci Antonio: Ed. by T. Bottmore: Dictionary of marxist thought. Oxford Blackwell, ১৯৮৩. 
৬. Lenin: April Theses.
৭. Gramsci and lenin: 1917-1922, Socialist Register, London.
৮. ভি-আই. লেনিন : শেষ প্রবন্ধ ও চিঠি, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো। 
৯. Mouffe. C. (Ed.) Gramsci and Marxist Theory, London, Routledge and kegan paul, ১৯৭৯. 
১০. আজিজুর রহমান : আমার সমাজতন্ত্র: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা। 
১১. আলতাফ পারভেজ : গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা। 
১২. গ্রামসি : পরিচয় ও তৎপরতা : সম্পাদনা, ফকরুল চৌধুরী, প্রকাশক পারভেজ হোসেন, সংবেদ, ঢাকা। 
১৩. আনতোনিও গ্রামশি : সমাজ রূপান্তরে সংস্কৃতি; সম্পাদনা ও অনুবাদ : সমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্ল পাবলিশার্স, কলকাতা। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //