স্বাধীনতার প্রতীক স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম অধ্যায় ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পক্ষে বহির্বিশ্বে জনমত সৃষ্টি আর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল গঠনে ভূমিকা রেখেছেন ফুটবলাররা। শামিল হয়েছিলেন দেশমাতৃকার হয়ে পাকিস্তানি জান্তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে। 

বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে দৃঢ় কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়েই দেশের একঝাঁক তরুণ ফুটবলার গঠন করেছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার থিয়েটার রোডের ৮ নম্বর বাড়িটিতে ছিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের কার্যালয়। সেখানেই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রতি নিজের সমর্থন জানান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফুটবল দলের স্বপ্নদ্রষ্টাদের যোগাযোগ করিয়ে দেন জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান এবং এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) শামসুল হক। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দল গঠনের প্রাথমিক ফান্ড হিসেবে উদ্যোক্তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ১৪ হাজার রুপি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের কথা উল্লেখ করে খেলোয়াড়দের মুজিবনগরে গিয়ে দলে যোগ দিতে বলা হয়। 

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের আবির্ভাব ঘটেছিল ‘ক্রীড়া সমিতি’ নামে। পরে স্বাধীন বাংলা বেতারের আদলে নাম পরিবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক রেখে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে পৃষ্ঠপোষক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির সভাপতি হন শামসুল হক। এক পর্যায়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে গেলে আরও দুজন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাদের একজন আশরাফ আলী চৌধুরী (এমএনএ) ও এনএ চৌধুরী (ক্রীড়াঙ্গনের কালু ভাই, এমপিএ)। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন লুৎফর রহমান, কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ মোহসীন, সদস্য এমএ হাকিম (এমএনএ), এমএ মতিন (এমপিএ), গাজী গোলাম মোস্তফা (এমপিএ), শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (এমপিএ) ও মুজিবুর রহমান ভুঁইয়া। উদ্যোক্তা ও সংগঠক সাইদুর রহমান প্যাটেল। কোচ ননী বসাক এবং ম্যানেজার ছিলেন তানভীর মাজহার তান্না।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে অধিনায়কত্ব করেছেন দুজন। মোট ১৩টি ম্যাচের মধ্যে জাকারিয়া পিন্টু ১০টি এবং ৩টি ম্যাচে আইনুল হক ছিলেন অধিনায়ক। প্রথম ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই, পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলায়। অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু ও সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শংকরের নেতৃত্বে বাংলাদেশের পতাকা হাতে ম্যাচ-পূর্ব মাঠ প্রদক্ষিণের ছবিটা বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে অনবদ্য ছবি। 

কৃষ্ণনগরে নদীয়া জেলা একাদশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে বেশ ঝামেলা হয়। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকার পরেও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন। গেয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। জেলা শাসক দীপক কান্তি ঘোষের অনুমতি নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়েছিল। তাতে বিপদে পড়েছিলেন দীপক কান্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি ভারত সরকারের নৈতিক সমর্থন থাকলেও এমন বেআইনি কাজে ক্ষুব্ধ হয়েছিল সরকার। দীপক কান্তিকে পদ থেকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু তাতে ইতিহাসের চাকাকে কোনোভাবে থামিয়ে দেওয়া যায়নি।

জাকারিয়া পিন্টু স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে যোগ দেওয়ার পূর্বে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ফুটবল দলের কথা জেনে চলে আসেন নদীয়ায়। প্রথম ম্যাচেই স্বাধীন বাংলা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। শুধু তাই না, স্বাধীন বাংলাদেশকেও প্রথম নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ১৯তম মারদেকা ফুটবলে পিন্টু ছিলেন অধিনায়ক। বলেছেন, ‘এ ইতিহাস কারও নেই। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক আমি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক আমি। পৃথিবীর আর কেউ এটা হতে পারবে না।’ 

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শংকর হাজরা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরির যে দায়িত্ব আমাদের ছিল, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল সেই দায়িত্ব পালনে ছিল শতভাগ সফল। মূলত এ কারণেই আমরা দলের প্রত্যেক সদস্য মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছি। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের একটা জার্সি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে স্থান পেয়েছে, সেটাও তো বিরাট সম্মানের।’ 

মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ১৩টি ম্যাচ খেলে। যদিও অনেকেই আবার ১৬টি ম্যাচের কথা বলেছেন। কিন্তু ম্যাচ সংখ্যা বড় কথা নয়। ম্যাচগুলো থেকে প্রাপ্ত কয়েক লাখ ভারতীয় রুপি জমা পড়ে মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে। সবচেয়ে বড় কথা, বিরুদ্ধ পরিবেশে বাংলাদেশের বীর ফুটবলাররা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের আগেই বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন স্বাধীনতার মূর্ত-রূপ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //