বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ে ফিলিস্তিনিদের লড়াই, ভাগ্য নির্ধারণে এ লড়াই: মানসুর

এসমাত মানসুর-এক ফিলিস্তিনি বন্দি। যিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে কারাবরণ করেছিলেন ইসরায়েল বাহিনীর হাতে। ইউসেফ এম আলজামাল মানসুরের সঙ্গে তার বন্দি জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও বন্দি অবস্থায় তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে কথা বলেন। মানসুর যিনি কিনা ২০ বছর জেলেই কাটিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তার বয়স ৪৫। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি ফিলিস্তিনি বন্দিদের পরিস্থিতি, কারাগারের সাহিত্য এবং বিশ্বের কাছে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বার্তা নিয়ে তিনটি উপন্যাস লিখে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। তার লেখা উপন্যাস সবার কাছে হয়েছে জনপ্রিয়। তার এই সাক্ষাৎকারটি কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হলো। 

আপনার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চলুন শুরু করা যাক। যদি নিজের সম্পর্কে বলেন এবং ইসরায়েল বাহিনীর হাতে বন্দি হবার আগ পর্যন্ত কেমন ছিল আপনার জীবন-এসব নিয়ে যদি বলেন?

আমার নাম মানসুর। পশ্চিম তীরের রামাল্লার দার আল-ইর গ্রামে আমার বসবাস। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার আগে আমি কারাবরণ করি। তখন রামাল্লার কাছে ইসরায়েল বাহিনী সেনা অভিযান শুরু করেছিল। তাদের অভিযানটি ছিল অবৈধ ও সেখানে তাদের অবৈধ স্থাপনা গড়েছিল। কারাবরণের সময়  আমি ১৭ বছর বয়সী হাই স্কুলের ছাত্র। তখনো আমি প্রাপ্তবয়স্ক হইনি। আমাকে ২২ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল আর যার মধ্যে ২০ বছর কাটিয়েছি ইসরায়েল কারাগারে। 

এসময় আমাকে বাধ্যতামূলকভাবে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষের জিজ্ঞাসাবাদের কাছে দাঁড়াতে হয়েছিল। একবার জেরুজালেমের আল- মাসকুবিয়া ডিটেনশন সেন্টারে ৬৩ দিন ধরে একটানা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। আর অত্যাচারের সকল পদ্ধতি ছিল ভয়াবহ। কারণ আমি ফিলিস্তিন সামরিক অপারেশনের সদস্য ছিলাম। এরপরে অবশ্য আমাকে অনেকবার বহু কারাগারে স্থানান্তর করেছিল তারা। ২০১৩ সালে আমি মুক্তিলাভ করি। 

আপনার তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত উপন্যাসগুলোর বিষয়বস্তু কি?

আমি যখন বন্দি হই তখন খুব কম বয়স ছিল। অত্যন্ত কম বয়সের হওয়ায় বন্দি থাকাকালীন সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কে অনেক রকমের জ্ঞান লাভ করি। একজন বন্দির জন্য পড়া, লেখা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষালাভ করাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। কারণ, আমাদের জীবন কেটে যায় স্বাধীনতা সংগ্রামে। আমরা যুদ্ধ করি, সংগ্রাম করি ফিলিস্তিনবাসীদের জন্য। আর এটাই আমাদের অব্যাহত সংগ্রামের নিশ্চয়তা। 

ইসরায়েল কর্তৃক গাজা দখলের শুরুর দিকে ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল প্রিজন সার্ভিস (আইপিএস) জেলখানায় বন্দিদের জন্য বই ও পত্রিকা পড়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল।  দখলদার বাহিনী সেসময় শুধুমাত্র তিনটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাদে ফিলিস্তিন বন্দিদের জন্য এক টুকরো কাগজ ও কলম পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। এর বাইরে ইসরায়েল প্রকাশিত পত্রিকা পড়ার অনুমতি ছিল। 

কাগজ ও কলম পাবার জন্য দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক সংখ্যক ফিলিস্তিন রাজবন্দি প্রথমবারের মতো  অনশনে যান। আমরা বইও চেয়েছিলাম। আমরা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চেয়েছিলাম এবং সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও আয়ারল্যান্ডের বিপ্লব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলাম। ১৯৬৯ সালের ওই সফল অনশন ধর্মঘটের ফলে অবশেষে কারাবন্দিদের ভাগ্যে বইয়ের দেখা মিলল। অথচ এরপরেও আইপিএস বারবার সুযোগ পেলেই কারাগারে বইয়ের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিতো। ফিলিস্তিন বন্দিরা ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রসের (আইসিআরসি) মাধ্যমে চুরি করে উপন্যাস, নাটক, কবিতার নানা বই সংগ্রহ করতেন। যেখানে নানা মানুষের জীবন সংগ্রাম, রাজনৈতিক জীবন, বিশ্লেষণ নিয়ে লেখা থাকত। আর এগুলোর বেশিরভাগ ছিল স্বহস্তে লিখিত। 

উপন্যাস পড়ায় কীভাবে অভ্যস্ত হলেন? 

কারাগারে প্রবেশের সময় আমি মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলাম। তাই অন্যরা আমাকে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বলতেন। অন্যরা আমাকে তাদের লাইব্রেরির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। তখন থেকেই গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস, নাটকসহ সাহিত্যের নানান বিষয়ে পড়তে লাগলাম। ফিলিস্তিন ও বিশ্ব বিপ্লবের নানান কারণ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে শুরু করি। আমার লেখার অভ্যাসও গড়ে তুলি। বিশ্ব থেকে দূরে থেকেও অন্ধকার দেয়ালের আড়ালে বসে নির্যাতিতদের কণ্ঠস্বর হিসেবে আমাকে কিছু একটা করতে হবে সেই বিবেক জাগ্রত হয়।

আমি লিখতে শুরু করি। তিনটি সাহিত্যকর্ম শেষ করি। বন্দি অবস্থাতেই সেগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ছিল-‘  A Prison inside Prison’, যেখানে আমি কারবন্দিদের একাকীত্বের নানান দিক তুলে ধরেছি। বন্দি জীবন যতটা কষ্টের, একাকীত্বতা তাঁর চেয়েও অধিক কষ্টের । 

কতদিন আপনি কারা প্রকোষ্ঠে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ছিলেন? 

আমি টানা দুইমাস একদম নিঃসঙ্গ অবস্থায় বন্দি ছিলাম। যদিও সপ্তাহে একবার আমাকে রেগুলার প্রিজন ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যাওয়া হতো। আমি জানি, যেসব রাজবন্দি ৭ থেকে ১৫ বছর একা কারাবাস করে থাকেন তারা মিশ্র অভিজ্ঞতা লাভ করেন। সামগ্রিকভাবেই আমরা অনেক কিছু শিখে থাকি। 

আমার উপন্যাসটি ফিলিস্তিনের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ইভালুয়েশন কমিটি কর্তৃক প্রথম স্থান লাভ করেছিল। এরপরেই বেশ কয়েকটি ছোট গল্প নিয়ে- A Closed Space নামের  আরেকটি বই প্রকাশ করি। বইটিতে বন্দি ও মুক্তির মধ্যকার প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কথা বলেছি। 

বিশেষ এমন কোনো দৃশ্যের কথা কী মনে পড়ে যা আপনাকে খুব দুঃখ দিয়েছিল?   

কারাগারে ২০ বছর যাবত এক ফিলিস্তিনি বন্দির মায়ের কষ্টের চিৎকার শুনতাম। সাক্ষাতের শুরুর দিকে ছোট একটি জানালার নেটের মধ্যদিয়ে কথোপকথন হচ্ছিল, কিন্তু ক্রমেই তার বয়স বাড়ার সঙ্গে কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। তার কথা আর স্পষ্ট ছিল না। আইপিএস নেটের পরিবর্তে কাঁচের একটি দেয়াল তুলে দিয়ে টেলিফোনের মাধ্যমে উভয় প্রান্তে অবস্থিত দুজনের কথা বলার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। বন্দিরা পুরো সময় তাদের মায়েদের সাথে কথা বলতে চাইতেন। এমনকি কাঁচের ওই দেয়ালে টোকা দিয়ে নিজের অবস্থানের জানান দিত যদি না দেখতে পেতেন একে অপরকে। এটা সত্যি অত্যন্ত বেদনার্ত ছিল। 

আমার তৃতীয় বইটি গাজা নিয়ে লেখা। ‘Silek (fence in Arabic)’ নামক বইটিতে গাজা সীমান্ত নিয়ে লিখেছি। আমি বন্দি ছিলাম বিয়ার আল-সাবা কারাগারে। এটি গাজায় অবস্থিত ছিল। সেখানকার অধিবাসীরা সীমান্ত বেড়া পাড়ি দেয়ার সময় তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতেন। তারা মিশর সীমান্ত ও ইসরায়েল নিয়ে কথা বলতেন। তারা কথা বলতেন সীমান্ত বেড়া, দেয়াল ইত্যাদি নানা বিষয়ে। 

আমি সেসব গল্পই লিখেছিলাম। নিজ অভিজ্ঞতা, পরিবর্তন ও ২০০৭ সালে হামাস যখন গাজার ক্ষমতা নিল সেসব নিয়েও লিখেছি। এ বইগুলো আমার মুক্তির পর প্রকাশিত হয়। আরেকটি উপন্যাসের নাম-  Al-Khazneh (আল-খাজমেহ) বা নিরাপদ।  উপন্যাসটিতে ইসরায়েলের জেল থাকে বন্দিদের পালানোর চেষ্টা নিয়ে  লিখেছি। আপনারা জানেন ২০২১ সালে গিলবোয়া কারাগার থেকে ছয়জন (৬) বন্দি পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। অথচ যেটিকে নিয়ে ইসরায়েলিরা সবচেয়ে সুরক্ষিত জেলখানা হিসেবে গর্ব করতেন। এজন্যই আমার লেখায় ‘আল-খাজানাহ’ টার্ম ব্যবহার করেছি। 

কারাগারের বাইরে কীভাবে লেখাগুলো পাঠাতেন? 

আমি সাধারণত রাত ১২টার পর যখন বন্দিরা ঘুমিয়ে পড়তেন তখন লিখতে বসতাম। আমার কক্ষে দশ থেকে বারোজন থাকতেন। আমার ওপরে একজন, তার ওপরে আরেকজন, এভাবেই থাকতে হতো আমাদের। নিজের কোনো ব্যক্তিগত জায়গা ছিল না লেখার জন্য। তাই অপেক্ষা করতাম। সবাই যখন ভোরে উঠে প্রার্থনার জন্য যেতেন তখন আমার লেখাগুলো আমার আরেক ভাইকে দিতাম কপি করে রাখতে। তিনটা করে কপি রাখা ছিল আমাদের। আর যতক্ষণ না পুরো লেখা শেষ হতো এভাবেই লেখাগুলো সংরক্ষণ করতাম। 

লেখা শেষ হলে তা বাইরে পাঠানো ছিল আরেক চ্যালেঞ্জ। কারো সাজার মেয়াদ শেষ হলে তারা ক্যাপসুল আকারে গিলে পেটে বহন করতেন। কারণ চিঠি আকারে এসব নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কারা কর্তৃপক্ষ কেউ বের হবার সময়ে সবকিছু নজরে রাখতেন। তাই এভাবেই লেখাগুলো বাইরে পাচার করতাম। আবার কখনও কাপড়ের ভাঁজে কিংবা উকিলের মাধ্যম বা অন্য উপায়ে পাঠাতাম। 

ব্যক্তিগতভাবে আপনি কি পালানোর চেষ্টা করেছিলেন? 

আমি অবশ্য পালানোর চেষ্টা করিনি। আমার এমন সুযোগ যেমন আসেনি তেমন সাহসও ছিল না। কিন্তু আমি সকল বন্দিদের দেখতাম সবসময় পালানোর এক মনোভাব তাদের মধ্যে ছিল। আমার এক রুমমেট ছিলেন যিনি এর আগে একবার আসকালান কারাগার থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। 

সত্যি বলতে এক সেন্টিমিটার খুঁড়তে একমাস সময় লেগে যেত। অনেক ধৈর্য ও একইসঙ্গে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনীয়তার মাধ্যমে এটি করা খুব কঠিন ছিল। 

’প্যালেস্টাইন প্রিজনার ডে’ তে বিশ্বের জন্য ফিলিস্তিনিদের জন্য কী বার্তা রয়েছে? 

বিশ্বের জন্য এই দিনে আমাদের বার্তা হলো- যারা বন্দি রয়েছেন তারা হলেন রাজবন্দি, মুক্তির জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন তারা। ইসরায়েলি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের এই লড়াই। শুধু বন্দি কারাগারের মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ নয়। বন্দিদের পরিবার, আত্মীয়-পরিজনের সাথেও যে নির্মম আচরণ ইসরায়েল বাহিনী করছে সেটি উপেক্ষার বিষয় নয়। বন্দিদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে জোরপূর্বক আখ্যা দেয়া হচ্ছে। তারা ন্যায় বিচার বঞ্চিত। এই দখলদারিত্ব শেষ করার জন্য তাদের এ লড়াই। তারা একজন সত্যিকারের মানুষের যেসব গুণাবলী থাকা দরকার সেগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে ইসরায়েলিরা দখলদারিত্ব, অবিচার, আধিপত্য ও সামরিক বাহিনী এবং সামরিক আইনের দ্বারা তাদেরকে নিষ্পেষিত করে যাচ্ছে। তাই তাদের একটাই বার্তা, তাদের এই সংগ্রামের কারণ একটাই-মুক্তি।  আর তা হলো অন্যায় দখলদারিত্বের কাছ থেকে। তাদের বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ে এ লড়াই। তাদের ভাগ্য নির্ধারণে এ লড়াই। 

-পলিটিক্স টুডে

 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //