স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগে ৪ শতাংশ মানুষ

দেশের প্রায় ৪ শতাংশ মানুষের ঘুমের সমস্যা থেকে স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভুগছেন। রোগটি হলে ঘুমের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় অথবা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে থাকে এবং তখনই অনেকেই ঘুম ভেঙে জেগে ওঠেন। এটাই স্লিপ অ্যাপনিয়া। চিকিৎসায় রোগটি ভালো করা যায়।

পরিসংখ্যান বলছে, এই ৪ শতাংশের মধ্যে ২৫ শতাংশ মধ্য বয়সী পুরুষ ও ৯ শতাংশ মধ্য বয়সী নারী স্লিপ অ্যাপনিয়া সমস্যায় ভোগেন। স্লিপ অ্যাপনিয়া হলে ঘুমের মাঝে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণও কমে যায়। অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্ক জেগে ওঠে এবং ঘুম ভেঙে যায়। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে প্রথমেই মানুষের মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা ঘুম ভাঙার পর দীর্ঘশ্বাস নেয় এবং আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। এভারে রাতে বারবার শ্বাস বন্ধ ও ঘুম ভাঙা এই চক্রটি চলতে থাকে। ফলে পরিমাণ মতো ঘুম হয় না বলে এর জটিলতায় অন্যান্য সময় সমস্যা দেখা দেয়। 

জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলছেন, স্লিপ অ্যাপনিয়া হলে ঘুমানোর অল্প সময়ের মধ্যেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করে আক্রান্তরা। এক পর্যায়ে হঠাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিছুক্ষণ পর আবার শুরু হয়। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যেই কোনো কোনো মানুষের মৃত্যু ঘটে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগে আক্রান্ত বেশিভাগ জানেন না রোগটি জটিল এবং এতে অনেক সময় মৃত্যু হতে পারে। স্লিপ অ্যাপনিয়াকে অনেকে বয়সজনিত স্বাভাবিক সমস্যা মনে করেন। ফলে তারা চিকিৎসকের কাছে আসেন না। রোগটি যে মারাত্মক তা বেশিরভাগ মানুষ বুঝতেই চেষ্টা করেন না। ফলে অনেকের হঠাৎ মৃত্যু ঘটছে অসচেতন হওয়ায়। স্লিপ অ্যাপনিয়া নিয়ে কাজ করেন নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। ঘুমের অভাবে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ব্রেন স্ট্রোক, বন্ধ্যত্ব ও ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ এবং মানসিক ব্যাধিতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। করোনার আগে পৃথিবীতে ৫৫ শতাংশ এবং করোনার পরে ৭৭ শতাংশ মানুষ অপর্যাপ্ত ঘুম সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে ২৪ থেকে ২৯ শতাংশ মানুষ নাক ডাকেন, আর এদের অনেকের স্লিপ অ্যাপনিয়া রয়েছে। 

গবেষণা বলছে, ৮০ শতাংশ স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগী বুঝতেই পারেন না যে তিনি একটি ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত। মহাদেশ হিসেবে এশিয়ার মোট জনগোষ্ঠীর ১৬.৩ শতাংশ এবং ইউরোপ-আমেরিকার ৪.৩০ শতাংশ মানুষ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত।

ঘুমের মধ্যে হঠাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় কেন?

এই প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বার বার শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সময় শরীর থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেরিয়ে যায়। শরীরে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা কমে গেলে শরীরে থাকা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম (কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র) শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। এতে কিছুক্ষণ দম বন্ধ হয়ে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে আবার কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যায় এবং নার্ভাস সিস্টেম আবার উজ্জীবিত হয়ে গেলে শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরে আসে। এই পরিস্থিতিটা বেশ জটিল এবং এক্ষেত্রে অনেক সময় মানুষের মৃত্যুও ঘটে।

চিকিৎসায় ভালো থাকা যায় 

স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসনালিকে কেন্দ্র করে শরীরের কোনো কোনো জায়গায় কিছু বাধা সৃষ্টি হয়ে থাকে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে। সেগুলো চিহ্নিত করে অপসারণ করে দিতে পারলে স্লিপ অ্যাপনিয়ার সমস্যা দূর হয়। রোগটি শরীরের অন্যান্য অনেক গুরুতর সমস্যা থেকে হয়ে থাকে, সে কারণে এর চিকিৎসা দীর্ঘ সময় ধরে চালাতে হতে পারে। চিকিৎসকরা মনে করেন, সতর্ক থাকলে এই রোগ এড়ানো সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন তারা। শরীরের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। কারণ ব্যায়াম করলে রক্ত চলাচল বাড়ে এবং অতিরিক্ত চর্বি গলে ওজন কমিয়ে রাখতে সহায়তা করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সবাইকে সুষম খাদ্যাভ্যাস করতে হবে। এছাড়া ঘুমের মধ্যে বার বার দম বন্ধ হয়ে এলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে ভালো থাকা যায়। 

অ্যাপনিয়া কত ধরনের?

নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হলে তাকে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয়। গলায় টনসিল ফুলে গিয়ে এমনটা হতে পারে। শ্বাসনালি এবং গলার সংযোগস্থলে অনেক সময় মাংসপেশি ফুলে যায়, যেটাকে অ্যাডনয়েড বলা হয়। এছাড়া অনেক সময় নাকের ভেতরে মাংসপেশি বড় হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ওজন বেশি এমন বয়স্ক ও শিশু উভয়েরই স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে। এছাড়া হৃৎপিণ্ড, ব্রেন এবং নিউরো সমস্যা থেকে শরীরের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়ে স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভুগতে পারেন কেউ কেউ। এই সমস্যাটা অনেক জটিল এবং গুরুতর হয়ে থাকে। এই দুই ধরনের অ্যাপনিয়াতেই মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে।

নাক ডাকলেই স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয় না 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শরীরের ওজন বেশি হলে ঘুমের সময় শ্বাসনালিকে ঘিরে গলা এবং আশেপাশের জায়গাগুলো সরু হয়ে যায়। নাকের মাংসপেশি অনেক সময় বড় হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে মুখ দিয়ে হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে হয় এবং তখন নাক ডাকার শব্দ হয়। এসব লক্ষণ স্লিপ অ্যাপনিয়ার নয় অথবা বলা যায়, নাক ডাকলেই স্লিপ অ্যাপনিয়া বলেন না চিকিৎসকরা।

স্লিপ অ্যাপনিয়ার বিপদ ঘটে কীভাবে?

নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. তানভীরুল ইসলাম বলেন, স্লিপ অ্যাপনিয়া সমস্যা হলে ব্রেনের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম থেকে নির্দেশনা আসে না বলে কিছু সময়ের জন্য শ্বাস কাজটি শুরু হয় না। আবার দেখা যায়, মস্তিষ্কের নির্দেশনা আসছে কিন্তু শ্বাসনালির প্রবেশ পথে বাধা থাকায় শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকমতো চালানো সম্ভব হয় না কিছু সময়ের জন্য। ফলে ঘুমের মাঝে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণও কমে যায়।

মস্তিষ্ক অক্সিজেন ছাড়া বেশিক্ষণ বাঁচতে পারে না। অক্সিজেন কমে যাওয়ার প্রভাবে মস্তিষ্ক জেগে ওঠে ও ঘুম ভেঙে যায় এবং ঘুম ভাঙার পর শ্বাস নিতে শুরু করে। হঠাৎ মস্তিষ্ক জেগে ওঠায় শরীর স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে দেয়। ফলে ঘুমও আর আসে না। হঠাৎ জেগে ওঠায় ও স্ট্রেস হরমোনের প্রভাবে হার্টবিটের হার বেড়ে যায় এবং এতে বেড়ে যেতে পারে ব্লাড প্রেশার। বেড়ে যায় ডায়াবেটিসের পরিমাণ।

স্ট্রেস হরমোনটি শরীরে খাবার গ্রহণ করার চাহিদাও বাড়িয়ে দেয়। ফলে শরীরে চর্বি বেড়ে গিয়ে ওজন বাড়িয়ে দেয়। প্রদাহ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন রোগের আবির্ভাব হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ৯০ শতাংশের স্ট্রোক, ৭৭ শতাংশ ব্লাড প্রেশার, বুকে ব্যথা ও হার্টঅ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এমনকি স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ৩০ শতাংশের ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ ডা. তানভীরুল ইসলাম জানিয়েছেন।

এ ছাড়া ডিপ্রেশন, মাথাব্যথা, মানসিক রোগগুলো বেড়ে যায়। দিনের বেলায় ঘুম ঘুম ভাব থাকার কারণে কোনো কাজই ঠিকমতো করা যায় না। গাড়ি চালানোর সময় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে গাড়ি চালানো অবস্থায় ঘুমানোর কারণে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর ৭০ শতাংশ অতিরিক্ত ওজনে ভোগে। এ ছাড়া স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত ৮০ শতাংশ মধ্য বয়সী পুরুষ যৌন দুর্বলতাতেও ভোগে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //