উপেক্ষিত ছেলেদের মানসিক স্বাস্থ্য

‘মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা’, যার অর্থ- ছেলেরা ব্যথা পায় না! সত্তরের দশকে ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যান’ তকমাধারী বলিউড অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের এই বিখ্যাত ডায়লগটি শোনেনি, এ উপমহাদেশে অন্তত এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। শুধু বলিউড বা সিনেমা জগৎ নয়, আমাদের সমাজেও একজন ছেলেকে শিশুকাল থেকে সর্বতোভাবে শেখানো হয়, তুমি ছেলে, আবেগী হওয়া, কষ্ট পাওয়া- এসব তোমাকে মানায় না। তাই ছেলেদের মানসিক বিড়ম্বনা শুরু হয় শৈশবেই। 

বলাবাহুল্য, সমাজ ছেলেদের যেমন দিয়েছে অবাধ স্বাধীনতা, তেমনি দিয়েছে অসীম কর্তব্যের বোঝা। ঠিক এসব কারণেই বড় হয়েও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলাটাকে দুর্বলতা মনে করে ছেলেরা। ফলে তাদের মনের খোঁজ রাখার প্রয়োজনবোধ করে না কেউই। অথচ প্রত্যেক মানুষের জীবনে দুঃখ থাকে, সেটাই স্বাভাবিক। একটি মেয়ে যত সহজে তার দুঃখ প্রকাশ করতে পারে; পারিবারিক বা সামাজিক কারণে ছেলেরা সেটা পারেন না। নানা গ-ির মধ্যে আটকে সবার কাছে নিজেদের ‘পুরুষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অনুভূতি প্রকাশে ব্যর্থ হয় তারা। ফলে ভেতর ভেতর ভেঙে পড়তে থাকে ছেলেদের মানসিক স্বাস্থ্য।

ছেলেদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি কীভাবে বোঝা যায়
মানসিক স্বাস্থ্য বলতে সাধারণত বুঝি, আমাদের মন, আচরণ ও আবেগকে সুস্থভাবে প্রকাশ করতে পারার বিষয়টি। যদি মনের স্বাস্থ্য ভালো না থাকে, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া পড়ে শরীরে। আর শরীরের অসুখ যদিও টের পাই, মনের অসুখ সহজে টের পাওয়া যায় না। অতিরিক্ত বিরক্তি প্রকাশ, হঠাৎ রেগে যাওয়া, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো, অতিরিক্ত ঝুঁকিগ্রহণ পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বা মেল ডিপ্রেশনের প্রাথমিক লক্ষণ। যার মূল কয়েকটি কারণ হচ্ছেপছন্দসই চাকরি না পাওয়া, পারিবারিক চাপ, প্রেমে ব্যর্থতাসহ সমাজের ছকে বাঁধা চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়া। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে এসব চাহিদা কিন্তু চাপিয়ে দিয়েছে সমাজই।

এসব কারণে অনেক ছেলেই মানসিক বিকারগ্রস্ত, নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, এমনকি আত্মহত্যার দিকেও ঝুঁকে পড়ে। শুধু তাই নয়, নারীদের তুলনায় পুরুষদের সিজোফ্রেনিয়ায় ভোগার হারও বেশি। অনেকেই মেল ইগোর কারণে বোঝেন না তিনি এই ধরনের মানসিক সমস্যায় আছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারাবিশ্বে নারীদের তুলনায় দ্বিগুণ সংখ্যক পুরুষ আত্মহত্যা করেন। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন না নেওয়া এর অন্যতম প্রধান কারণ। তাই বলাই চলে, সমাজে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অসহায় শিকার হচ্ছেন কিন্তু ছেলেরাই।

করণীয়
একজন ছেলেকে বুঝতে হবে মানসিকভাবে সুস্থ রাখার প্রধান দায়িত্ব নিজেরই। তাই মানসিক রোগ যেন বাসা না বাঁধতে না পারে, সেদিকে সব সময় সচেতন হতে হবে। আপনি পুরুষ, এটা মনে করার আগে মনে করতে হবে, আপনি একজন মানুষ। এ ক্ষেত্রে কখনোই নিজের আবেগ চেপে রাখা যাবে না। কারণ দীর্ঘদিন আবেগের বহিঃপ্রকাশ না হলে ধীরে ধীরে সে মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনে আগ্রাসী ও প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠে। তাই মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতে স্বাভাবিকভাবে আবেগের প্রকাশ করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ছেলেরা নিজেরই কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন

  • ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখা
  • কাছের মানুষেদের কাছে মনের কথা শেয়ার করা
  • ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা
  • নিয়মিত মেডিটেশন ও ব্যায়াম করা 
  • দৈনিক অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুমানো
  • সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা

এর পাশাপাশি, একজন ছেলের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তার পরিবারের সদস্য ও আশপাশের মানুষেরা। তাই মা-বাবার উচিত ছোটবেলা থেকেই একজন ছেলে শিশুর মনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব না ঢুকিয়ে বরং মনুষ্যত্ববোধের চর্চা করানো। এ ছাড়া পরিবারের অভিভাবক থেকে স্কুলের শিক্ষক- সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে ছেলে স্কুলে বা রাস্তায় বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে কিনা। সে শারীরিক নিপীড়ন বা যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছে কিনা সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি। বুঝতে হবে, ছেলেদের মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করেই। তাই কেউ যদি তার কাছের কোনো ছেলেকে এই ধরনের সমস্যায় যুঝতে দেখে, তাহলে তার আবেগকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে পেশাদার কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নিতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //