‘পাছে সত্যভ্রষ্ট হই’এই ভয় জেগেছিল এমনকি মহর্ষি বাল্মীকির মনে। ব্রহ্মার মানসপুত্র দেবর্ষি নারদ তার কাছে ঈশ্বরের কীর্তিকথা পেড়েছিলেন। স্বল্পে কি স্রষ্টার কথা রচনা করা যায়? মহর্ষির মহাচিন্তা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘তবু, নাহি জানি সমগ্র বারতা, সকল ঘটনা তাঁর- ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে।’
কিন্তু সংবাদ-সমাজে কী দেখছি আমরা? ঘটনার পুরোটা না জেনেই খবর তৈরি ও প্রচার করছি। সত্যচ্যুতির ভীতি তো দূরের কথা, উল্টো ভুল, বিভ্রান্তিকর ও বিকৃত তথ্য যাচাই না করেই সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রকাশে প্রথম হওয়ার বাজে-লোভ-এই বিপথে ঠেলে দিচ্ছে সাংবাদিকদের। আর সামাজিক মাধ্যম যেন কু-তথ্যের হাট। এখানে কু-তথ্যের ভিড়ে প্রকৃত তথ্য চেনাই দুরূহ হয়ে উঠেছে। যেমনটা দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অতিনিকট প্রতিবেশী দেশে।
ভারতে ভোটের মৌসুম চলছে। সাত দফায় পুরো দেশে ভোট হবে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয় পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় থাকতে চায় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ভারতের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ১০ বছরে এমন দ্যুতিহীন হয়ে পড়েছে যে, ক্ষমতাসীনদের চোখে তারা ‘দুর্বল প্রতিপক্ষ’। তবু এবারের ভোটেও ভারতে বিশেষত রাষ্ট্রযন্ত্র বিরোধী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কু-তথ্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেও যে কু-তথ্য কম ছড়াচ্ছে, তা নয়। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোয় কু-তথ্যের প্রবল ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে।
যেমন, সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওচিত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে এক প্রচারসভায় বলতে শোনা যায়, দক্ষিণের রাজ্য তেলেঙ্গানায় মুসলিমদের দিকে মুখ তুলে চাইবে না বিজেপি, মানে সবরকম সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিজেপির বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর এবং বিশেষ করে মুসলিমবিদ্বেষের অভিযোগ আছে, সত্য। কিন্তু এই ভিডিওটি বানানো।
আরেকটি ভাইরাল ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, চিত্রনায়ক আমির খান ও রণবীর সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির কড়া সমালোচনা করছেন এবং তারা বলছেন এই ভোটে কংগ্রেসকে তারা সমর্থন করছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি এই কু-তথ্যসমৃদ্ধ ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর দুই তারকাই পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের মৌসুমেও কু-তথ্যের মহামারি ছিল। কাশ্মীরের কথা বলা যায়। ভোটের মাস দুয়েক আগে কাশ্মীরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে আত্মঘাতী হামলা হয়েছিল। ঝুলিতে ভোট টানতে বিজেপি এ নিয়ে কু-তথ্য ছড়িয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি কথা ছড়িয়ে পড়েছিল-ভোটে জিতলে ওই আত্মঘাতীর পরিবারকে বড় অঙ্কের অর্থ-অনুদান দেওয়া হবে এবং কারাগার থেকে অন্য সব জঙ্গিকে মুক্তি দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কংগ্রেসের এক নেতা; যা ছিল ডাহা মিথ্যা।
কিন্তু কু-তথ্য কেন ছড়িয়ে পড়ছে? গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতে এবারের ভোটেও একদিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাভরা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন ও পোস্ট, অন্যদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী আখ্যান এবং নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষী পোস্ট ও প্রতিপক্ষ প্রার্থীর বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেওয়া পোস্ট অবারিতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে।
মেটার দাবি, দিন-রাত এক করে তাদের কর্মীরা কু-তথ্য চিহ্নিত ও সেগুলোর ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে কাজ করছেন। কিন্তু ফ্যাক্ট-চেক তথা
তথ্য-যাচাই করতে করতেই জনে-জনে ছড়িয়ে পড়ছে কু-তথ্য। তথ্য বিশৃঙ্খলা ও কু-তথ্যের এই রথ শ্লথ করার উপায় কী আসলে? শক্তিশালী আইন ও এর প্রয়োগ? তখন যদি কথা বলার স্বাধীনতা খর্ব হয়? উভয়সংকট। তা হলে?
সত্যভ্রষ্ট না হয়ে সত্যনিষ্ঠ হওয়ার শিক্ষা ও চর্চা থাকা চাই সব ক্ষেত্রে। কিন্তু সত্য কী?
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh