শেখ হাসিনার ভারত সফর এবং বাংলাদেশের অর্জন

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেছেন এবং সেখানে তিনি ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর এই চার দিন অবস্থান করেছেন। সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যখন সামনের বছর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এই সফর প্রচণ্ড গুরুত্বের দাবি রাখে; প্রথমত বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক, দ্বিতীয়ত অভিন্ন নদীগুলোর পানি-বণ্টন, তৃতীয়ত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন এবং চতুর্থত বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক এই চারটি পরিসর থেকে। সাতটি সমঝোতা স্মারক ইতোমধ্যে স্বাক্ষর হয়েছে, সেগুলোতেও এই পরিসরগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আভাস আছে। বলাবাহুল্য যে, এই সফর বর্তমান সরকারের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যবহুল।

অন্যদিকে ভারতের জন্যও শেখ হাসিনার এই সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভুলে গেলে চলবে না, দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশের চেয়ে বড় মিত্র এই মুহূর্তে ভারতের কেউ নেই। তবে হয়তো কেউ কেউ আমাকে শুধরে দিয়ে বলবেন, বাংলাদেশ নয় হাসিনা সরকারের চেয়ে বড় মিত্র এই মুহূর্তে ভারতের কেউ নেই। ফলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই সফরকে যে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেটি খুবই সুপষ্ট, যখন কিছুদিন আগে বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন, আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনতে যা যা করা দরকার, ভারতকে আমি তাই তাই করতে বলেছি। সরকার এই সফরকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অন্যদিকে বিরোধী দল, বিশেষত বিএনপি এই সফরকে বাংলাদেশের অর্জনের জায়গা থেকে হতাশাব্যঞ্জক বলে আখ্যায়িত করেছে। 

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদী রয়েছে। তার মধ্যে তিস্তার জলপ্রবাহ নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিতর্ক বেশ পুরনো। ভারত এর ৪২.৫% পানি পাবে আর বাংলাদেশ পাবে ৩৭.৫%। এই শর্তে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মনমোহন সিং সরকারের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল বাংলাদেশের, ভারত সেই চুক্তি থেকে দ্রুত সরে এসেছিল। এই বছর শেখ হাসিনা জরুরি ভিত্তিতে তিস্তার পানি সমস্যার কথা উচ্চারিত হবে বললেও কার্যত এই সফরে এই বিষয়ে কোনো অগ্রগতিই সাধিত হয়নি। বরং জানা গেছে তিস্তার বাংলাদেশ অভিমুখে ভারত আরও কতকগুলো বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। তবে কুশিয়ারার পানি-বণ্টনে কিছু ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলা চলে। ঊর্ধ্ব সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতি সেকেন্ডে ১৫৩ কিউসেক পানি পাবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তবে যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার নদীর বিষয়ে কোনো ফলপ্রসূ সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। সে বিষয়েও বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলা যায়। এ বছর এপ্রিলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বাংলাদেশ সফরে এলে শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আসাম ও ত্রিপুরার সংযোগ সাধনে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে সেই বিষয়েও কথা হয়েছে, যদিও অনেকের মতে, এতে কৌশলগত ও সামরিক দিক থেকে ‘সাত ভগ্নীকে’ দমনে ভারতই অধিকতর লাভবান হয়েছে। আলোচনা হয়েছে আখাউড়া-আগরতলা রেলসংযোগটির পুনঃ সূচনার বিষয়ে। দুই পক্ষই আগ্রহ দেখিয়েছে দ্রুত আগরতলা ও চট্টগ্রামের মধ্যে বিমান যোগাযোগের সূচনা করতে। এগুলো এই আলোচনাতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলেই মনে করা যায়। 

কিন্তু গত এক দশকে ভারতের সীমান্তরক্ষীরা ২৯৪ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হত্যা বন্ধে কোনো কার্যকর আশ্বাস আদায় করতে পারেননি। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের সুসম্পর্ক থাকার পরও মোদি সরকার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখেনি। আবার দুই প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক আলোচনাতেও এই বিষয়টি কোনো স্থান পায়নি। ইউক্রেন য্দ্ধু নিয়ে অন্য সব দেশের মতোই বাংলাদেশের অবস্থাও টালমাটাল। অনেকে ভেবেছিলেন, ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে তেল ও গম কিনতে সক্ষম হবে। কিন্তু সেই বিষয়টিও এই আলোচনাতে উঠে আসেনি। যেসব প্রকল্প চালু হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তার মধ্যে মৈত্রী প্রকল্পের প্রথম ইউনিটটি দ্রষ্টব্য। এটি খুলনার বিতর্কিত রামপাল কয়লাক্ষেত্রে অবস্থিত। ‘ইন্ডিয়ান ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স আন্ডার কনসেশনাল ফিন্যান্সিং স্কিম’ প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে এই বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি রফা করতে চাচ্ছে। শুরু থেকেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পরিবেশবাদী গবেষক, চিন্তাবিদ ও মাঠকর্মীরা। নানাভাবে দেখিয়েছেন যে, এই প্রকল্প চালু হলে বাংলাদেশের পরিবেশ, বনাঞ্চল ও বাস্তুসংস্থান বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। আর এতে সবচেয়ে বিপন্ন হবে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। ২০১৫ সালে মোদি সরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে বাংলাদেশ একটি চুক্তি করেছিল। আর এবার তা বাস্তবায়ন করতে ভারতের ব্যবসাজগতের নক্ষত্র গৌতম আদানী শেখ হাসিনাকে তার ভারত সফরের প্রথম দিনই টেলিফোনে বার্তা দেন। শ্রীলংকাতে এই আদানীর উইন্ডমিল প্রকল্প কিন্তু প্রবল বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। গোতাবায়া রাজাপাকসেকে এই প্রকল্প আরও বিতর্কিত করেছিল। ফলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুরো সফরটিই আগামী নির্বাচনকে মাথায় রেখে করা হয়েছে; যাতে কোনোভাবে ভারত বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট না থাকে।

ভারত বাংলাদেশের এক বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। ভারত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাতেও এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে যে সহায়তা দিয়েছিল তা কখনো ভুলবার নয়। কিন্তু ভারত নিজেও একটি রাষ্ট্র, যে তার নিজদেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে চাইবে। এই আলোচনাতে ভারত যদি নিজেদের পক্ষে কিছু বেশি আদায় করতে পারে তার জনগণের স্বার্থে, এটি তার দোষ নয়। আর আমরা যদি আমাদের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হই, এটি আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা। ভারতকে বন্ধু মনে করেও এবং তাকে আমাদের সঙ্গে রেখেও আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারি। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের আরও গভীরভাবে চিন্তা করার অবকাশ আছে।


লেখক: গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //