ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতা এবং পুতিনের দুর্বলতা

এভগেনি ভিক্টোরোভিচ প্রিগোজিনের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের পক্ষ এবং বিপক্ষের উভয় দলই বেশ নড়েচড়ে বসেছেন। এই যুদ্ধের শুরুতে যারা ভেবেছিলেন ক্রেমলিন দুর্ভেদ্য এবং তার নিশ্ছিদ্র প্রাকারের ভেতর থেকে ভেতরের তথ্য বের করে আনা প্রায় অসম্ভব, তারা খানিকটা হলেও হোঁচট খেয়েছেন। কারণ তাদের কাছে পুতিন এক বিস্ময়।

তারা মনে করেন, তিনি এডওয়ার্ড স্নোডেনের মতো কম্পিউটার উইজার্ডকে তার দেশে আশ্রয় দিয়ে সিআইএ ও আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির তাবৎ তথ্য জোগাড় করে ফেলেছেন। এই স্নোডেন ছিলেন আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির কম্পিউটার ইনটেলিজেন্স কনসাল্টট্যান্ট, যিনি দীর্ঘদিন সিআইএর সঙ্গেও কাজ করেছেন। ফলে অনেকে মনে করেছিলেন, আমেরিকা বা পশ্চিমই বরং আর দুর্ভেদ্য নয়, বরং রুশি দুনিয়াকে ভেদ করাই আয়াশসাধ্য। কিন্তু প্রিগোজিনের ঘটনা এই হিসাব-নিকাশকে কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে। অবশ্য এটিও ঠিক যে, ক্রেমলিন এই ঘটনাকে ভালোই সামাল দিয়েছে। কিন্তু যে ঘটনা এই পুরো বাস্তবতাকে নতুন করে দৃশ্যমান করেছে, তাও কম নয়। আর তা হচ্ছে পুতিন ও তার প্রশাসনও আর ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। 

পুতিন সরকারের দুর্বল দিকগুলোর বিবেচনায় প্রথমেই আসে রাষ্ট্রের প্রশাসন এবং সেই সঙ্গে সংবাদ মাধ্যমগুলোর ওপর তার অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ। ফলে পছন্দ কারও হোক বা না হোক, রাশিয়াতে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী সরকার কায়েম আছে- এ কথাটি স্বীকার করতেই হবে। যে কারণে সংবাদ মাধ্যমগুলো পুতিনের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার কারণে ক্রেমলিনের পছন্দমাফিক তথ্য প্রচার করে থাকে। আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত না হলেও প্রবল সেন্সরশিপের কারণে বাইরের দুনিয়ায় প্রচারিত সংবাদ রাশিয়া ছেঁকেই ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়। ফলে রুশ জনগণের একাংশ এখন রাশিয়ার সংবাদ মাধ্যমগুলোর ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। এর একটা খুবই নেতিবাচক দিক আছে। কোনো কোনো সময় ঘটনাপ্রবাহের যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ জনমানসে ঘটে থাকে, তা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত প্রণয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ভুলে গেলে চলবে না, জনগণের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিন্তক, লেখক, সুশীল সমাজের লোকজন- যারা নানারকম দায়িত্বশীল কাজের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া এর মধ্যে সরকারের পুরনো আমলা, সেনাবাহিনীর পুরাতন কর্মকর্তা, সৈনিক, ইনটেলিজেন্সের লোকেরাও অন্তর্ভুক্ত।

ইউক্রেন যুদ্ধের কথাই ধরা যাক। রাশিয়াতে এমন অনেক পুরনো সমরবিদ আছেন, যারা পুতিন সরকারকে এই যুদ্ধে দিকনির্দেশনা দিতে পারতেন। এসব ব্যক্তির তথ্য প্রদানের মাধ্যম দুটি; এক. বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, তা প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া যা-ই হোক না কেন, দুই. সরকার বা প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি কাজ করা ও তথ্য দেওয়া এবং অন্যান্য সহযোগিতা করা। সমস্যা হলো রাশিয়াতে এখন সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সরকার নির্ধারিত লোকেরাই শুধু বক্তব্য বা তথ্য দিতে পারবে- এ রকম এক অলিখিত নিয়ম চলছে। সাংবিধানিকভাবে সেন্সরশিপ নেই, কিন্তু তা প্রবলভাবেই আছে অপ্রকাশ্যে। আবার পুরনো আর্মি কমান্ডের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, পুতিন প্রশাসনের নেক নজরে না থাকলে তাদের বক্তব্যের কোনোই মূল্য নেই। যদিও তাদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যারা সোভিয়েত যুগে বা তার পরপরই উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা, সরকারি আমলা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী ছিলেন। আর সবচেয়ে বড় কথা পুতিনের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকার বিষয়ই শুধু নয়, সঠিক সংবাদ না পেলে কেউই সরকারকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবে না। কিন্তু তারা তো সেই সুবিধা পাচ্ছেন না। আর সরকার স্বভাবতই সবার সঙ্গে মিলিটারি বা অন্যান্য ইনটেলিজেন্সের তথ্য শেয়ার করবে না। 

দুই

রাশিয়াতে ‘সিঙ্গেল রেজিস্টার’ নাম দিয়ে এক সংস্থা অনেক ইউরাল ও ডোমেইনের ওপর তাদের সেন্সর আরোপ করে। এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম মাত্র ২০০৮ সালে। বোঝাই যাচ্ছে এরও জন্ম পুতিন প্রশাসনের হাত ধরেই। যদিও রাশিয়ার সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, রাশিয়াতে সবরকম সেন্সরশিপ নিষিদ্ধ। অবশ্য এজন্য রাশিয়াকে একা দোষ দেওয়া যায় না। সত্তরের দশকে উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহে দুনিয়ার কর্ণধার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারিতে ধরা খেয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি প্রতিপক্ষের কথা শোনার জন্য গোপনে টেলিফোনে আড়িপাতা যন্ত্র লাগানো অনুমোদন করেছিলেন। ইদানীং ভূতপূর্ব মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও দাবি করছেন যে, তার নির্বাচন প্রচারণাকালে তার ওপর নজরদারি করা হয়েছিল। সমস্যা হচ্ছে গণতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রে স্বয়ং রাষ্ট্রপতিও কোনো অপরাধ করে পার পাবেন না। কিন্তু পুতিনকে তার দেশে কে ভুল ধরিয়ে দেবে, কার আছে সেই হিম্মত? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিশেষত; স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতে ওমবুডসম্যান বা নগরপাল রাখা হয়। এই ব্যক্তি হন দলমত নিরপেক্ষ একজন সর্বজনমান্য ব্যক্তিত্ব। যেসব দেশ নামকাওয়াস্তে গণতান্ত্রিক, সেখানে কীভাবে ওমবুডসম্যানই রাখা সম্ভব? পশ্চিমে তো গণতান্ত্রিক সরকার একদিনে কায়েম হয়নি। গণতন্ত্রের উপকারিতা পরীক্ষিত হয়েই সেসব দেশে গণতন্ত্র জায়গা পেয়েছে। 

তিন

সম্প্রতি এক যুবক আমার সঙ্গে একটি কাজের বিষয়ে দেখা করেছে। তার মা রুশ, বাবা বাংলাদেশি। সে সম্প্রতি রুশদেশ ঘুরে এসেছে। আমি রাশিয়ার অবস্থা জানতে চাইলে সে জানাল যে, রাশিয়াতে পুতিনের সিন্ডিকেটভুক্ত না হলে, সেখানে একটা চায়ের স্টলও দেওয়া সম্ভব নয়। তার মতে রুশদেশে দুর্নীতি এখন অসহনীয় অবস্থায়। পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য মিডিয়ার বদৌলতে আমরা জানি, সেদেশের ধনকুবেররা টাকা-পয়সা নিয়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছে; কারণ রাষ্ট্র একেবারেই বিনিয়োগবান্ধব নয়। ওই ছেলেটিই আমাকে জানাল যে, কিছুদিন আগে বাংলাদেশে একটি রুশ ট্যুরিস্টগ্রুপের জন্য সে দোভাষী হিসেবে কাজ করেছে। গ্রুপটি এসেছিল বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা ঘুরে দেখতে। ওই গ্রুপে ছিল পঞ্চাশ জনের ওপর রুশ নারী-পুরুষ। ভ্রমণের এক পর্যায়ে তারা ওকে জিজ্ঞেস করেছে যে, বাংলাদেশে কোনোভাবে থেকে যাওয়া যাবে কিনা? পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে রুশ জনগণ বাংলাদেশে থাকতে চাইবে, যেখানে আমাদের দেশের লোকই নিজ দেশ ত্যাগ করতে চায় দেশের ওপর সন্তুষ্ট না থাকায়? ফলে পুতিনকে যদি টিকে থাকতে হয়, তবে তার জানা উচিত যে, রাষ্ট্রের গদি ধরে রাখার জন্য শুধু সামরিক শক্তিই যথেষ্ট নয়। পুতিন তা ভালো জানেন বলেই মনে হয়। আর এখন দেখা যাক ভূতপূর্ব কেজিবি গোয়েন্দা ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতায় এবং প্রিগোজিনের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কারণে দৃষ্টি উদিত হওয়ায় ঘর গোছানোর কাজটি কীভাবে সম্পন্ন করেন।


লেখক: গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //