সাম্প্রতিক শিখ অধ্যায় এবং ভারত-কানাডার সম্পর্কে টানাপড়েন

সাম্প্রতিক সময়ে অমৃত পাল সিং সাধুঁ ইস্যুতে শিখ অধ্যায় এবং খালিস্তান আন্দোলন বিষয়টি আবারও বিশ্বের নজর কেড়েছে। এই বছর ২৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের মোগার এক গুরুদুয়ারা ভারতীয় পুলিশ বাহিনী ঘেরাও করলে তাকে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। পরে আসামের কেন্দ্রীয় কারাগারে তাকে প্রেরণ করা হয়। তখনই আন্দাজ করা গিয়েছিল, এই ঘটনার পরবর্তী ধারাবাহিকতা আছে। ঘটনার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে আততায়ীর হাতে খুন হন হরদীপ সিং নিজ্জার নামের একজন শিখ, যিনি ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক। কানাডাতে যে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তার সংযোগ ছিল বলে অনেক সূত্রের বরাতে জানা যাচ্ছে। খালিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। 

অন্যদিকে শিখ সংগঠনগুলো গোড়া থেকেই বলে আসছিল, নিজ্জার ছিলেন একজন সক্রিয় মানবাধিকার কর্মী। আর নিজ্জার নিজে বলছিলেন, তিনি শান্তিপূর্ণ উপায়ে একটি স্বাধীন শিখরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত এবং সেই শান্তিপূর্ণ সম্ভাবনাগুলোই তিনি খতিয়ে দেখছেন। নিজ্জার সম্পর্কে অনেক ভালো কথাও শোনা যায়। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ গির্জাতে বন্দুকধারীদের হাতে বহু মুসলমান মারা গেলে এবং কানাডার এক স্কুলে আদিবাসী শিশুদের গণকবর আবিষ্কৃত হলে নিজ্জার সমবেদনার অংশ হিসেবে নানা কর্মসূচি নেন এবং বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করেন। ভারত সরকার অবশ্য বলছে, তিনি জঙ্গি সংগঠন খালিস্তান টাইগার ফোর্সের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং সংগঠনটির কাজের একজন বড় মদদদাতা ছিলেন। এই বছর ফেব্রুয়ারিতে ভারত সরকার এই সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর তালিকাভুক্ত করে। 

বলা চলে কানাডার ডায়াসপোরা শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজ্জার ছিলেন একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি ২০১৮ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সুরেতে অবস্থিত গুরু নানক শিখ গুরু দুয়ারার প্রধানের পদে এলে বিষয়টি সবার নজর কাড়ে। নিউইয়র্ক টাইমস তখন এই সমাবেশে অত্যন্ত পুরনো ও খুবই প্রভাবশালী শিখ গুরু দুয়ারাগুলোর এক বৃহৎ নেতৃবর্গ যোগ দিয়েছেন বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০২২ সালেও নিজ্জার তার পদ ধরে রাখেন। গুরু দুয়ারাটি শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদের একটি স্প্রিং বোর্ড হিসেবে পরিচিত এবং নিজ্জার তার একজন জোরালো কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। শিখ ফর জাস্টিস নামের সংগঠনের একজন অন্যতম পুরোধা এবং ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত খালিস্তান নির্বাচনের প্রধান ব্যক্তিত্বও তিনি ছিলেন। এই নির্বাচনের উদ্দেশ্য ছিল, শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী শিখ জনগণের মধ্যে কতজন উৎসাহী ও নিবেদিত তা খতিয়ে দেখা। বলা বাহুল্য, ভারত এই বিষয়টিকে সুনজরে দেখেনি। 

এই বছরের ১৮ জুন হরদীপ সিং নিজ্জার নিহত হন। সমস্যা দানা বাঁধে যখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ১৮ সেপ্টেম্বর ঘোষণা দেন, কানাডীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভারত সরকার ও নিজ্জার হত্যার একটি বিশ্বাসযোগ্য যোগসূত্র আবিষ্কারের পথে। কানাডার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বিল ব্লেয়ার বলেছেন, অভিযোগ প্রমাণ হলে কানাডা একে তার সার্বভৌমত্বে আঘাত হিসাবে গণ্য করবে। অন্যদিকে মার্কিন কূটনীতিক ডেভিড কোহেন পাঁচ দেশের সমন্বিত গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ট্রুডো গণভাষণে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন বলে জানিয়েছেন। এই পাঁচটি দেশ হলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কর্মকর্তারা কানাডাকে জানিয়েছে, হত্যার প্রচেষ্টা অনেক দূর গড়ানোর পর তারা জানতে পেরেছিল। নিজ্জারকে অবশ্য আগেই ‘তার জীবন বিপন্ন’- এই মর্মে কানাডার গোয়েন্দা বাহিনী মারফত সতর্কবাণী জানানো হয়েছিল। ঘটনার দিন ভেঙ্কুভারের গুরুদুয়ারা থেকে তিনি বের হলে ওঁৎ পেতে থাকা দুই আততায়ী তাকে গুলি করে হত্যা করে। কানাডার অভিযোগ, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রধান পবন কুমার রায় তার কিছুদিন আগে কানাডাতে ঘাঁটি গাড়েন। এই ঘটনার জের ধরে কানাডা একজন ভারতীয় শীর্ষ কূটনীতিক এবং পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারত কানাডার একজন শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। 

এদিকে ভারতীয় মিডিয়াগুলো বলছে, পশ্চিমা মিডিয়া, বিশেষ করে দি নিউইয়র্ক টাইমস, দি ফিনানশিয়াল টাইমস ও দি ওয়াশিংটন পোস্ট নিজ্জারকে সাধু, নিরীহ পাইপ মিস্ত্রি এবং একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। অথচ তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড কর্নার নোটিশ জারি আছে। তাদের অভিযোগ, তিনি নাকি প্রথম দফায় ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে কানাডায় এসেছিলেন। তার নাগরিকত্বপ্রাপ্তির আবেদনও নাকি দুবার খারিজ করা হয়েছিল অসাধু উপায় অবলম্বনের জন্য। পাকিস্তানেও তিনি নাকি কয়েকবার গিয়েছেন আইএসআই-এর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে। তিনি পাঞ্জাবের এক হিন্দু পুরোহিত ও তার বিরুদ্ধে মতপ্রকাশকারী এক শিখ নেতার হত্যা এবং পাঞ্জাবে দুবার বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। এই সূত্রগুলোর বরাতে আরও জানা যাচ্ছে, তিনি নাকি একে-৪৭ সঙ্গে রাখেন, যা কানাডাতে আইনত নিষিদ্ধ। 

দারশান সিং টাটলার গবেষণা গ্রন্থ ‘দ্য শিখ ডায়াসপোরা: দ্য সার্চ ফর স্টেটহুড’-এ আমরা দেখি শিখ জঙ্গি সংগঠন বাব্বার খালসা বহুদিন ধরেই কানাডাতে তাদের একটি উইং পরিচালনা করছে। এমনকি ১৯৮৬ সালে মন্ট্রিয়ালে নিউইয়র্কগামী এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে তারা বোমা স্থাপনের ষড়যন্ত্র করলে তা ধরা পড়ে। এই ঘটনায় দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও প্রদান করা হয়। একই বছর ইন্টারন্যাশনাল শিখ ইয়ুথ ফেডারেশনের চার সদস্য ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে আসা পাঞ্জাবের রাজ্যমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। এই ঘটনায় কানাডীয় সরকার প্রত্যেককে বিশ বছর কারাদণ্ড দেয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ওই বছর অক্টোবরে ভেঙ্কুভারে বলেন, ইয়ুথ ফেডারেশন অব ব্রিটেন এবং বাব্বার খালসা অব কানাডা ভারতকে বিভাজনের চেষ্টা চালাচ্ছে এবং তিনি পাঞ্জাবের পানথিক কমিটির বরাতে একটি কাগজ হাজির করেন। ওয়ার্ল্ড শিখ অরগানাইজেশনের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আছে। ফলে ভারত যদি মরিয়া হয়ে কোনো ঘটনা ঘটায়, তার মানে সে তার রাষ্ট্র বিপন্ন মনে করছে। তা না হলে সে কেন এই ঝুঁকি নেবে? রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা তো সহজ নয়। আমরা কি কখনো চাইব চাকমা বা কুকিরা বাংলাদেশ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করুক? 

অন্যদিকে পশ্চিমের অনেক সমালোচনার পরও বলতে হয়, তার কারণে কোনো কোনো স্বাধীনতা আন্দোলন এখনো টিকে আছে। খালিস্তানের অনেকের মতে শিখদের দাবি ন্যায়সঙ্গত। একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী তার স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। এখানে পশ্চিমের স্বার্থ আছে। তারপরও তাকে তো কাউকে না কাউকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে হবে। ফলে বিষয়টির কোনো সরলরৈখিক উত্তর নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশে আমরা যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে লিখি, তাদের বিদেশি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লিখতে হয়। কারণ আমাদের কোনো নিজস্ব আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক নেই। ফলে সেসবের ওপর ভিত্তি করেইবা আমরা কী সিদ্ধান্তে আসতে পারি?

লেখক: গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //