কানাডার স্মৃতি

বরফে ঢাকা এক আত্ম-পরিচিতির মুখ

বাংলাদেশিরা নানা ধরনের কাজে প্রবাসে যায়, সেটা মিডিল ইস্ট হোক অথবা কানাডা। মধ্যপ্রাচ্যে যায় পকেটের টানে। আর নর্থ আমেরিকা, ইংল্যান্ডে যায় টাকার সঙ্গে ভালো চিকিৎসা, পরিবেশ, বাচ্চাদের লেখাপড়া ইত্যাদির জন্য। টাকাটা তো আছেই। আমিও গিয়েছিলাম বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য কানাডায়, ছিলাম ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত। তারপর ফেরত আসি। বাংলাদেশিদের কয়েকটি বিষয় মনে আছে। তারা লেখাপড়ার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। আমি এক জরিপের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তাতে দেখা যায় যে জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি স্কুল কলেজে যায়, খুবই পজিটিভ বিষয়। আমার ধারণা, কয়েক প্রজন্মে এদের অবস্থা মৌলিকভাবে উন্নত হবে। বাবা-মা লেখাপড়ার ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয় না।

দুই
অভিবাসী অনেকেরই ইংরেজি দক্ষতা নেই তেমন। তা ছাড়া কানাডিয়ানরা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো ডিগ্রি মানে না। এর ফলে অনেককে প্রথমে বাধ্য হয়ে শ্রমিকের কাজ নিতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এটা অনেকের জন্য কষ্টের বিষয়। আমি এক পাকিস্তানিকে চিনতাম যে দোকানে শেলফে মাল উঠাত। এদিকে লাহোরে সে ছিল ব্যাংক ম্যানেজার। খুব রেগে থাকত, দুঃখের কথা বলত।

তিন
এই ঝামেলার ফলে অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের যথাসম্ভব ‘কানাডিয়ান’ বানাতে চেষ্টা করত। এর মধ্যে অন্যতম ছিল মাতৃভাষা চর্চা না করা। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের সংখ্যা খুব কম, তাই তাদের সম্পর্কে তেমন জানি না। অনেক দেশি ভাইদের বাচ্চারা তেমন বাংলা জানত না, এটা কালচার অস্বীকার করার ইচ্ছা থেকে নয়। শুরুতে তারা যে ধাক্কা খেয়েছে ভালো কাজ না পেয়ে, সেটা থেকে বাচ্চাদের রক্ষা করার ইচ্ছা থেকে ঘটে। 

চার 
এই প্রবণতায় এমন কোনো অসুবিধা হয় না, তবে বাচ্চারা কিছুটা, ‘না ঘরের না ঘাটের’ হয়ে পড়ে। স্কুলে তেমন কিছু হয় না। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে উঠে অনেকের আত্মপরিচিতির সংকটে পড়ে। তারা কে? তাদের জীবনযাপন, ভাবনা, পরিবার। আগামীর সুযোগের ক্ষেত্রে মূলধারার সাদাদের মতো নয়, তারা আলাদা। এটা যখন বোঝে তখন অনেকের কষ্ট হয়, যা হয়তো অবধারিত প্রথম অভিবাসী প্রজন্মের জন্য। তবে খুব কম মানুষ সিস্টেম ত্যাগ করে, দেশ ছাড়ে। মধ্যবিত্তের স্বর্গ নর্থ আমেরিকা, তবে সংকট থাকে। আর তাদের বাবা-মার সংকট অন্য লেভেলে। একটা স্মৃতির কথা বলি। 

পাঁচ 
আমার ব্র্যাকে কাজের অভিজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশি এনজিও বিসিএসে একটা পার্টটাইম কাজ পাই। সব কাজই অভিবাসীদের নিয়ে। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুশতাক সাহেব, একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট মানুষ, যিনি সৌদি আরবে কাজ শেষে কানাডায় চলে আসেন। বাংলাদেশিরা উনাকে খুব মানতেন। ওই অফিসে একদিন এক ফোন পাই এক হাসপাতাল থেকে। এক কানাডীয় ডাক্তার ফোন করে সাহায্য চান, এক অদ্ভুত সমস্যা। তার এক রোগী ভর্তি আছে বেশ কিছুদিন, অনেক বয়স্ক। ইন্ডিয়ার বাঙালি হিন্দু মানুষ। লোকটি জানে তার মৃত্যু যে কোনো সময় হতে পারে। তার একটি শেষ ইচ্ছা আছে। একজন বাঙালি পুরোহিতের কাজ থেকে মন্ত্র শুনবেন, ধর্মের বাণী শুনবেন, একটু আলাপ করবেন। তাকে সাহায্য করতে পারি?

ছয় 
উনার স্ত্রী বিগত, ছেলে ওদেশীয় বিয়ে করে বাংলা কবে ভুলে গেছে! ছেলেসহ নাতি-নাতনিরা কেউ বাংলা জানে না। তারা অনেক দেখাশোনা করছে, কিন্তু যেহেতু পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজ ছোট, তাদের যোগাযোগ কম। তাই এই সন্ধান আমাদের কাছে। আমি তাকে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়ে ফোন ঘুরানো শুরু করলাম।

সাত
টরন্টোতে সবার সঙ্গে সবার ভাব ও ঝগড়া, তাই মেলামেশা অনেক। আমরা পূজায় দাওয়াত পেতাম। তার মধ্যে একজনকে ফোন করে জানতে পারলাম যে ওই শহরেই তিনটি পূজা কমিটি আছে। তাদের মধ্যে আবার কয়েক ভাগ। যাক, এভাবে ঘুরতে ঘুরতে জানা গেল একজন ফুলটাইম পুরোহিত আছেন শহরে। ফোনে যোগাযোগ করলে খুব খুশি হলেন। তক্ষুনি রাজি হলেন, পুণ্য কাজ। ওই ভাগাভাগির কথাটা বললাম। তিনি একটু ক্ষুব্ধ হয়েই বলেন, “আমরা কি বাংলাদেশি বাঙালি না? আমরা যেখানেই যাব বিভক্ত হব। এটাই আমাদের পরিচয়।” আমি উনার সঙ্গে একমত হলাম।

আট 
দিন সাতেক পর ডাক্তার ফোন করে আমাকে ধন্যবাদ দেন। পুরোহিত ভাই একাধিকবার গেছে আলাপ করেছে, রোগী এখনো আছে। তার পরিবারের লোকজনের মধ্যেও অনেক স্বস্তি এখন। আমার খুব ভালো লেগেছিল। বুঝেছিলাম ভাষার টান নয়, নিজের কাছে নিজের টান। সেই মানুষটি তার নিজেকে খুঁজছেন, যেটা হারিয়ে গেছে প্রবাসের বরফের নিচে। সব কিছুর জন্য দাম দিতে হয়, এটাও একটা।

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //