সরকার গঠনের পাঁচ মাসেও মেঘ কাটেনি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠনের ৫ মাস অতিক্রান্ত। নতুন সরকারের ১০০ দিনকে ‘হানিমুন পিরিয়ড’ বলা হয়ে থাকে। এবার নির্বাচনের পর এই শব্দটা খুব একটা উচ্চবাচ্য হয়নি। এর কারণ সুস্পষ্ট। নির্বাচনে দেশের দ্বিতীয় বড় দল বিএনপিসহ বেশ কতক দল অংশগ্রহণ না কারায় রাজনৈতিক সংকট এবং বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে জাতীয়ভাবে ন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে অর্থনৈতিক সংকট বিরাজমান ছিল। 

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এই দুই সংকট এবং চাপ ও ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভয়হীন চিত্তে উচ্চারণ করেছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার লাইন : ‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়/ আড়ালে তার সূর্য হাসে,/ হারা শশীর হারা হাসি/অন্ধকারেই ফিরে আসে।’

তবে নতুন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার প্রায় ৫ মাস অতিক্রান্ত হলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গন থেকে মেঘ বা অন্ধকার যা-ই বলা হোক না কেন তা দূর হয়নি। তবে সংকট ঘনীভূত হয়ে দেশ অস্থিরতার মধ্যে চলে যাচ্ছে, এমনটা নয়। অবশ্য বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অবস্থা চলছে তা থেকে সুস্পষ্ট, সংবিধান সমুন্নত রেখে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের উপায় সরকার বা সরকারি দলের হাতে নেই। এমতাবস্থায় বিএনপিকে প্রায় ৫ বছর বসে থাকতে হবে নতুবা গণ-আন্দোলন কিংবা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের ভেতর দিয়ে সরকারকে উৎখাত করতে হবে। 

পত্রিকা পাঠে জানা যায়, বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। এই চাওয়ার ভেতর দিয়ে এটা সুস্পষ্ট, লন্ডনে পালিয়ে থাকা দলের প্রধান নেতার নির্দেশে বিএনপি ভুল ও উল্টোপথে অনেক দূর এগিয়েছিল। প্রশ্ন হলো এতটা ভুল করার পর ঘুরে দাঁড়ানো আদৌ সম্ভব হবে কি? নির্বাচনী ট্রেন মিস করে সংসদ-পথ হারিয়ে পথ বের করা অনেকটাই অসম্ভব বৈকি! ইতোমধ্যে বিভিন্ন দল ও জোটের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। আলোচনার এই প্রক্রিয়া চলতে চলতে কোথায় পৌঁছাবে এবং কোন ধরনের অন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করবে, তাতে কতটুকু জমায়েত করতে পারবে, আন্দোলনে জোয়ার আসবে কিনা প্রভৃতি সব প্রশ্নের মধ্যে বিএনপি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। মূল নেতা পালিয়ে থাকা অবস্থায় এই পাক থেকে উদ্ধারের কাণ্ডারি কে হবেন কে জানে?  

নির্বাচনী ডামাডোলের প্রথম দিকে বিএনপির হাবেভাবে মনে হয়েছিল পিটার হাসের পিঠে চড়েই ক্ষমতায় গিয়ে বসতে পারবে। সম্প্রতি সফরের সময় মন্ত্রীদের সঙ্গে যৌথ ব্রিফিংয়ে ডোলান্ড লু যখন বলেন ‘বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন চায় যুক্তরাষ্ট্র’ কিংবা তার সঙ্গে যখন বিএনপির বৈঠক হয় না, তখন বিএনপির যে মোহভঙ্গ থেকে মনভঙ্গ হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়।

প্রসঙ্গত, বিএনপি নির্বাচনের আগে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছে। নির্বাচনের পর দলটি ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। এখন জানা যাচ্ছে বিএনপি ওই কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে চাইছে। তাই এটা সুস্পষ্ট, বিএনপি এখন রয়েছে বিভ্রান্তি ও বিভক্তির মধ্যে।

সর্বোপরি সাংগঠনিক দিক থেকে বিএনপি রয়েছে সবচেয়ে বিপদে। নামিদামি পত্রিকায় যদি হেডিং হয় ‘আন্দোলনের তহবিল আত্মসাৎ বিএনপির নেতাদের’ কিংবা ‘ঢাকা মহানগরেও বিএনপির আন্দোলনের তহবিল নয়ছয়’ তবে আর থাকে কি! এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ আরও সুবিধাজনক পর্যায়ে দলকে নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একদিকে বিভক্তি-পাল্টাপল্টি আর অন্যদিকে আত্মীয়-পরিজনের সাংগঠনিক ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা এতে বাদ সাধছে। এখানে ওখানে ছাত্রলীগে পাল্টাপাল্টি মারপিটও দলের ভাবমূর্তিকে ক্রমেই ক্ষুণ্ণ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অনন্য। মানুষ যেমন তার ওপর ভরসা রাখছে, তেমনি কোনো বিক্ষুব্ধতা বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংকট দানা বেঁধে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও তিনি হস্তক্ষেপ করলে তার সমাধান হচ্ছে। 

কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পুনঃপুন নির্দেশ সত্ত্বেও অর্থনীতির সংকট থেকে যাচ্ছে। নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল ‘দ্রব্যমূল্য সকলের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে’। কিন্তু  নির্বাচনের ৫ মাস চলে গেলেও তা হয়নি। নির্বাচনী ইশতেহারে আরও একটি অঙ্গীকার ছিল, ‘নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ’ করা হবে। এ ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগ পরিদৃষ্ট হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য ও স্বাস্থ্য খরচে মানুষ দিশেহারা ও পিষ্ট। 

সর্বোপরি নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর কতক বিষয়ে কিছু করবে বলে জনগণ উন্মুখ হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত (ক) ঘুষখোর, ঋণ-কর-বিলখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের ‘বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত’; (খ) ‘শুল্কফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচার, হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন, মজুদদারি ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং অতি মুনাফা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা’ গ্রহণ; (গ) ‘পুঁজি পাচার অপরাধীদের বিচারের অধীনে’ আনা এবং ‘সংশ্লিষ্ট দেশের সহযোগিতায় পাচার করা অর্থ-সম্পদ ফেরত আনার উদ্যোগ’ লক্ষণীয় হয়ে উঠছে না।

বাস্তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঈপ্সিত কাজগুলো দৃশ্যমান না হওয়ায় মানুষ আশাহত হচ্ছে, ক্ষুব্ধতা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকট যদি ঘনীভূত হতে থাকে, তবে যে কোনো ইস্যুতে স্ফুরণ হতে পারে। ১৯ মে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় মিরপুরে খেটে খাওয়া মানুষের জমায়েত সংবাদ মাধ্যমে দেখে তেমনটা মনে হচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে অঙ্গীকার অনুযায়ী ব্যবস্থাসমূহ কার্যকর ও দৃশ্যমান করা অতীব জরুরি।


শেখর দত্ত
কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //