মেসিময় কাতার বিশ্বকাপ

স্পোর্টস ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০৩:৩৭ পিএম

আর্জেন্টিনার জার্সিতে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা এখন লিওনেল মেসি। ছবি: সংগৃহীত

আর্জেন্টিনার জার্সিতে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা এখন লিওনেল মেসি। ছবি: সংগৃহীত

কাতার বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের সময় যত গড়িয়েছে ততই মনে হচ্ছিল ফ্রান্স টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিততে যাচ্ছে। তখন লেখার শিরোনামটা হতে পারত, ফরাসী সৌরভে সুরভিত কাতার বিশ্বকাপ। তখন হতাশ হতে হতো লিওনেল মেসিকে। ২০১৪ সালে মারিও গোৎজে আর ২০২২ সালে এসে কিলিয়েন এমবাপ্পে।

আট বছর পর এসে কাটল না অর্জেন্টিনার দুঃখগাথা। মেসির কপালে আর জুটল না বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি। ফরাসি সৌরভে সুরভিত কাতার বিশ্বকাপ। টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতে নিল ফ্রান্স। ভাগ্যবিধাতা মুখ ফিরিয়ে নিল আবারও আর্জেন্টিনার কাছ থেকে।

ডিয়াগো ম্যারাডোনা হতে পারলেন না মেসি। তার ভাগ্যের সঙ্গে মিলিয়ে ৩৬ বছরের হতাশা কাটানোর লক্ষ্য থাকলেও তার কিছুই হয়নি। দুর্র্দান্ত খেলে ফাইনালে উঠলেও ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। বিশ্বকাপ না জেতার কষ্ট নিয়েই আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে বিদায় বললেন এলএম টেন। সারা ফুটবল দুনিয়া মেসির জন্য প্রার্থনা করলেও বিফলে গেছে তাদের সেই চাওয়া। এমন ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন সারা দুনিয়ার কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমী। 

কিন্তু একটা ম্যাচের পরতে পরতে কতটা উত্তেজনা আর থ্রিলার জড়িয়ে থাকতে পারে সেটা যেন বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের জন্য জমিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে ভাগ্য বিধাতা এবার আর মুখ ফিরিয়ে নেননি। নিজের ভাগ্যাকাশে ১৮ ডিসেম্বর যেন স্বপ্নের একটি দিন হয়ে থাকবে লিওনেল মেসির। নিজের স্বপ্নের অধরা বিশ্বকাপ ট্রফি তিনি জয়লাভ করলেন এবার।

ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতল মেসির আর্জেন্টিনা। এবারের বিশ্বকাপটা অত্যন্ত সুন্দরভাবেই আয়োজন করেছে কাতার। নিজেদের সেরাটা দিতে কোনো কিছুর কমতি রাখেনি তারা।

নিজেদের সংস্কৃতিকে সবসময় ফুটিয়ে তুলেছে তারা নানাভাবে। বিশ্বকাপের ফাইনালেও সেটি ফুটিয়ে তোলা হলো। ট্রফি নেওয়ার সময় ফিফা প্রেসিডেন্ট জিওভান্নি ইনফান্তিনো ও কাতারের আমির মেসিকে একটি কাতারের আলখাল্লা পরিয়ে দেন। যা কাতারের ঐতিহ্যগতভাবে বেশ পরিচিত। এটি পরেই মেসিকে বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে জয় উদযাপন শুরু করতে দেখা যায়।

এর বাইরে কাতার বিশ্বকাপকে যদি মেসিময় বলা হয় তাহলে এতটুকু ভুল বলা হবে না। কিংবদন্তি হতে হলে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা নাকি উঁচিয়ে ধরতেই হবে এলএম টেনকে। ক্লাব ফুটবলে সবকিছু জেতা এ আর্জেন্টাইন তারকার অপূর্ণতা ছিল ওই একটাই। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ, প্রতিবেশীদের দেশে খুব কাছে গিয়েও শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হলো না আর্জেন্টিনা ও লিওনেল মেসির দলের। দ্বিতীয়বার সুযোগ পেয়েই আর্জেন্টিনাকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেই তবে বাড়ি ফিরলেন।

সময়ের হিসেবে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি জয়ের স্বাদ পেল আলবিসেলেস্তেরা। একই সঙ্গে লিওনেল মেসি গড়েছেন বেশকিছু ব্যক্তিগত রেকর্ড। কাতারের দোহার লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে ৮০ হাজারের বেশি দর্শক সাক্ষী হলেন এই রেকর্ডগুলোর। যা এই খুদে জাদুকরকে বাঁচিয়ে রাখবে বছরের পর বছর ধরে।

সবচেয়ে বড় যে রেকর্ডটি গড়েছেন তার মধ্যে সবার ওপরে, দুইবার গোল্ডেন বলজয়ী একমাত্র ফুটবলার হলেন তিনি। বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইতিহাস ভাঙার হাতছানি ছিল মেসির সামনে। দেশকে শিরোপা জেতাতে না পারলেও ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছিলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। জিতেছিলেন বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার গোল্ডেন বলও।

এবার কাতার বিশ্বকাপেও গোল্ডেন বল জেতেন তিনি। বিশ্বকাপে দুবার সেরা ফুটবলার হওয়ার নজির নেই অন্য কারও। এই রেকর্ড গড়া বিশ্বের একমাত্র ফুটবলার হলেন তিনিই। দ্বিতীয় রেকর্ডটি হলো, বিশ্বকাপের সব পর্বে গোল। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু হওয়া বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপের সব পর্বে গোল করার অনন্য এক রেকর্ড গড়েছেন লিওনেল মেসি।

বিশ্বকাপের এক আসরে গ্রুপপর্ব, রাউন্ড অব সিক্সটিন, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে গোল করে এই রেকর্ড গড়েছেন সাতবারের ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার জেতা এই ফুটবলার। বিশ্বকাপে এমন নজির নেই আর কারও। যা তাকে অমরত্বের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছে।

বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন, আর্জেন্টিনার জার্সিতে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা এখন লিওনেল মেসি। পেছনে ফেলেছেন আর্জেন্টিনার আরেক কিংবদন্তি গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে। সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে গোল করার মাধ্যমে ফুটবল বিশ্বকাপে ছাড়িয়ে যান বাতিস্তুতার ১০ গোলের রেকর্ডকে। আর ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে দুই গোল করে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড নিজের দখলে নিলেন তিনি।

বিশ্বকাপে মেসির গোল সংখ্যা এখন ১৩টি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচও এখন তার। কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে নামার আগে ২৫ ম্যাচ খেলেছিলেন মেসি। ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনাল খেলতে নেমে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ২৬ ম্যাচ খেলার নতুন রেকর্ড গড়েছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে মেসি পেছনে ফেলেছেন জার্মানির বিশ্বকাপজয়ী সাবেক অধিনায়ক লোথার ম্যাথিউজের ২৫ ম্যাচ খেলার রেকর্ড।

সবচেয়ে বেশি মিনিট মাঠে থাকার রেকর্ডও গড়েছেন। ফাইনালের আগে বিশ্বকাপে মেসি খেলেছিলেন সর্বমোট ২১৯৪ মিনিট। সময়ের হিসাবে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে। ২২১৭ মিনিট খেলে শীর্ষে ছিলেন ইতালির সাবেক অধিনায়ক পাওলো মালদিনি। ফাইনালে ২৪ মিনিট খেলে শীর্ষে উঠে যান আর্জেন্টাইন প্রাণভোমরা। ইতিহাস গড়েছেন সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জয়েরও।

বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন তিনি। কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা জিতিয়ে আরও একটি রেকর্ড স্পর্শ করলেন তিনি। বিশ্বকাপের এ পর্যন্ত ১৭ ম্যাচ জিতে এই তালিকায় এককভাবে শীর্ষে ছিলেন জার্মানির সাবেক তারকা মিরোস্লাভ ক্লোসা। ফাইনাল জিতে ক্লোসার এই রেকর্ডে ভাগ বসালেন সাতবারের বর্ষসেরা ফুটবলার।

বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোলেও অবদান এখন মেসির। বিশ্বকাপে এই নাম্বার টেন গোল করেছেন ১৩টি এবং করিয়েছেন ৯টি। দলের ২২টি গোলে অবদান রয়েছে তার। বিশ্বকাপের ১২ গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের ১০টি গোল করিয়েছেন ব্রাজিলের ফুটবল সম্রাট পেলে। দলের মোট ২২টি গোলেও অবদান রয়েছে তার।

ফাইনালে ২ গোল করে ফুটবল সম্রাট পেলেকে ছুঁয়েছেন লিওনেল মেসি। এ ছাড়া সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্টে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। বিশ্বকাপে সতীর্থদের দিয়ে সবচেয়ে বেশি ১০টি গোল করিয়েছেন পেলে। আর বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত মেসি সতীর্থদের দিয়ে গোল করিয়েছেন ৯টি।

ফাইনালে সতীর্থদের দিয়ে আরও দুটি গোল করাতে পারলে ভেঙে যেত ফুটবল সম্রাট পেলের রেকর্ড। আর একটি গোলে সাহায্য করলে ছুঁয়ে ফেলতেন ব্রাজিলের কালো মানিককে। কিন্তু না হওয়ায় সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্টের তালিকার দ্বিতীয় থেকেই বিশ্বকাপ শেষ করলেন লিওনেল মেসি। সবচেয়ে বড় কথা শিরোপা জেতায় যে পূর্ণতা এসেছে সেটাই মেসিকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে রাখল। রাখবে যত দিন বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাস থাকবে ঠিক তত দিন। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh