নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অসন্তোষ

এম ডি হোসাইন

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:৩৮ এএম

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

তিন শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে বছরের শেষ পর্যায়ে এসেও সবকিছুতেই ধোঁয়াশা দেখছেন অভিভাবকরা। আর নতুন কারিকুলামে সন্তুষ্ট নন শিক্ষকরাও। ফলে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা ও বাতিলের দাবিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন বিভিন্ন সংগঠন, অভিভাবক ও শিক্ষকরা। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।

শিক্ষকরা বলছেন, এ কারিকুলামে অনেক সমস্যা-অসঙ্গতি। ভয়ে কারিকুলাম নিয়ে কিছু বলতে পারছি না। আমাদের নির্ভয়ে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ কারিকুলামের অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলতে চাই। আর অভিভাবকরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে ভালো করছে, কোন বিষয়ে খারাপ করছে তা জানার সুযোগ নেই। স্মৃতিশক্তি বিকাশের কোনোই সুযোগ নেই এই কারিকুলামে। মাধ্যমিকের নতুন কারিকুলামকে শিক্ষার্থীদের মেধা, শিক্ষা ও নৈতিকতা ধ্বংসকারী শিক্ষা কারিকুলাম উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছে ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিষদের সভাপতি শহিদুল ইসলাম কবির।

আগামী বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কয়েকটি শ্রেণিতে নতুন একটি কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগের সব পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পদ্ধতিতেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। এ ছাড়া থাকছে না নবম শ্রেণিতে বিভাগ পছন্দের সুযোগ। এর বদলে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো বিভাগে পড়তে পারবেন। চলতি বছর প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আগামী বছর বাস্তবায়ন করা হবে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এরপর ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেণিতে এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে ধাপে ধাপে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার কথা রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পরিবেশে পড়ানোর পাশাপাশি মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে দক্ষতা, সৃজনশীলতা, জ্ঞান ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে শেখাতেই নতুন এই শিক্ষাক্রম চালু করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। তবে শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনেকেই এর সমালোচনা করছেন।

রাজধানীর মিরপুরের আলী আকবর নামের একজন অভিভাবক বলেন, এই কারিকুলামে মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষা যেটুকু আছে তাও শেষ হয়ে যাবে, নবম শ্রেণিতে সবার জন্য গণিত ও বিজ্ঞান অভিন্ন পাঠ্যপুস্তক হওয়ায় টপিক আগের চেয়ে কমাতে হবে। ফলে যারা বিজ্ঞান ও গণিত শিখতে আগ্রহী তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এর মাধ্যমে সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রায় নেই হয়ে যাবে। আকবরের ছেলে আগামী বছর নবম শ্রেণিতে উঠবে। ফলে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন।

নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার চেয়ে ব্যবহারিকের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; যার ফলে পড়ার চেয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক নানান কাজের চাপ বেড়েছে, যা অনেক অভিভাবকের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজধানীর আজিমপুরের রুবিনা নামের এক অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে। আগে সন্ধ্যা হলে সে পড়তে বসতো। এখন তাকে একেবারেই পড়তে বসানো যায় না। সারাক্ষণ কী নাকি সব অ্যাসাইন্টমেন্ট করে; বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বসে থাকে। আমি কিছুই বুঝছি না। না পড়লে শিখবে কীভাবে? 

এদিকে শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ মনে করছেন নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন ছিল, সেটি না নিয়েই কাজ শুরু করেছে সরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মো. মজিবুর রহমান বলেন, মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের জায়গায় অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ অবস্থায় নতুন শিক্ষাক্রমটি কতটা কাজে দেবে, সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ধরনের একটি উদ্যোগ গ্রহণের আগে প্রয়োজনীয় গবেষণার পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত প্রতিটি অংশীদারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করা উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি। অভিভাবক এবং শিক্ষকরা এই উদ্যোগের সবচেয়ে বড় দুই অংশীদার। কিন্তু শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের আগে তাদের সঙ্গে কি বসা হয়েছে? বসা হলে কয়জনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা পরামর্শ করা হয়েছে? তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ধাপে ধাপে এটি বাস্তবায়ন করা হলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না বলে আমি মনে করি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রমের চাহিদা নিরূপণ ও বিশ্লেষণের কাজ শুরু হয়। এরপর একাধিক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ২০২১ সালে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১’ তৈরি করা হয়। সরকারের অনুমতিক্রমে ২০২২ সালে ৬০টি স্কুলে পরীক্ষামূলকভাবে এটি চালু করা হয়। এর ফলাফলের ভিত্তিতে ২০২৩ সালে সারা দেশে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যক্রম চালু করা হয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, আমরা যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই কাজ শুরু করেছি। তার পরও যেসব সমালোচনা হচ্ছে, সেগুলো আমরা বিবেচনা করছি। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন মনে করলে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হবে। আপাতত ছেলে-মেয়েরা নতুন শিক্ষাক্রমেই পড়বে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে এর কোনো বিকল্প নেই।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ভয়ংকর মিথ্যাচার করা হচ্ছে; যা শিক্ষাক্রমের অংশ নয়, প্রশিক্ষণেরও অংশ নয়, এমন ভিডিওসহ বিভিন্ন বিষয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ব্যাপকভাবে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আর সেটি হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থহানির ভয়ে। কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছেন। তার সঙ্গে এখন নির্বাচনের সময়, নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকেন, তাদের উসকানি যুক্ত হয়ে গেছে। অতি ডান, অতি বামের উসকানিও যুক্ত হয়ে গেছে। দীপু মনি বলেন, ‘আমি অভিভাবকদের বলব, একটু দেখুন, আপনার সন্তানদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আপনার বাচ্চা যদি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে থাকে, তাহলে তার আচার-আচরণ পরিবর্তন হয়েছে কি না, সে কত নম্বর পেয়েছে, সেদিকে নজর না দিয়ে, সে শিখল কি না, সেদিকে নজর দিন। একটু ধৈর্য ধরুন।

এদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে চলমান সমালোচনা সম্পর্কে মুখ খুলেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, শিক্ষাক্রমে কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে তা সংশোধন করা হবে। তবে এ নিয়ে যে কোনো ধরনের অপপ্রচার করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাক-প্রাথমিক হতে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের মানসম্পন্ন শিক্ষা উন্নয়ন ও প্রসারে এই প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমরা লক্ষ করছি, স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী সম্প্রতি নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন ও ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনমনে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে বা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী কাজকে শিক্ষাক্রমের কাজ বলে প্রচার করা হচ্ছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh