তীর্থঙ্কর মহাবীরের জন্ম, নির্বাণ এবং তারপর

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৪, ০৩:১৯ পিএম

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ। ফাইল ছবি

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ। ফাইল ছবি

জৈন তথ্যানুসারে, বর্তমান কালচক্রের অবসর্পিণী ভাগের নির্দিষ্ট ২৪ জন তীর্থঙ্করের শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর। আর জৈনরা বিশ্বাস করেন, প্রত্যেক অবসর্পিণী ও উৎসর্পিণীর তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগেই শুধু চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের আবির্ভাব ঘটে এবং এই সংখ্যা সর্বদা নির্দিষ্ট। এ রকমই বর্তমান কালচক্রের চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের প্রথম জন ঋষভ দেব বা ঋষভ নাথ এবং শেষ জন অজিন নির্গ্রন্থ নাথপুত্র, যিনি নিজেকে জয় করার কারণে মহাবীর নামে জগতে খ্যাত হয়েছেন। তার জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৯ অব্দে, চৈত্র শুক্লা ত্রয়োদশীর রাত্রিতে, উত্তরফল্গুনী নক্ষত্রের কালে, বৈশালী নগরীর ক্ষত্রিয় কুণ্ডগ্রাম নামের একটি উপনগরে, এক অতি সম্ভ্রান্ত রাজপরিবারে।

জানা যায়, সেকালে বৈশালীতে একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুরোদস্তুর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তীর্থঙ্কর মহাবীর তার ৭২ বছরের ঘটনাবহুল জীবনকাল অতিবাহিত করে খ্রিষ্টপূর্ব ৫২৭ অব্দে নির্বাণ লাভ করেন। কল্পসূত্রে তার নির্বাণের ইতিহাস বিধৃত রয়েছে। 

“তৎপরে ভগবান মধ্যমা-পাবাতে হস্তীপাল রাজার শুক্লশালায় শেষ বর্ষাকাল যাপন করিবার জন্য উপাগত হইলেন।” (কল্পসূত্র-১২৩)

তীর্থঙ্কর মহাবীর জন্মেছিলেন রাজপুত্র হয়ে। তার নাম ছিল বর্ধমান। পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান শহরের নামকরণ তার নামেই হয়েছিল। রাজপুত্র বর্ধমানের পিতা ছিলেন মহারাজ সিদ্ধার্থ, যিনি জ্ঞাত-বংশীয় ক্ষত্রিয়গণের রাজা ছিলেন। তার মাতা ছিলেন মহারানী ত্রিশলা, যিনি ছিলেন বৈশালী গণতন্ত্রের মুখ্যাধিনায়ক হৈহয় বংশীয় মহারাজ চেটকের ভগ্নী। জৈন সাহিত্যে তিনি নায়পুত্ত (ন্যায়পুত্র) এবং বৌদ্ধগ্রন্থে তিনি নাতপুত্ত (নাথপুত্র) নামে সম্বোধিত হয়েছেন; দুটিই সর্বোচ্চ সম্বোধন। রাজপুত্রের যেসব গুণ থাকা দরকার, তার সবই তার মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় ছিল বলেই জৈনরা বিশ্বাস করেন। 

কিন্তু তার জীবন তো শুধু রাজপ্রাসাদের প্রাকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার জন্য ছিল না। তিনি এসেছিলেন মানুষকে তার জীবন, কাজ ও পরিণতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দিতে। তাই ত্রিশ বছর বয়সে তিনি শ্রমণধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে রাজপ্রাসাদ, সমস্ত ভোগবিলাস, জীবনের সব স্বাচ্ছন্দ্য, প্রিয়তমা স্ত্রী যশোদা ও একমাত্র কন্যা প্রিয়দর্শনা বা অনবদ্যাকে ত্যাগ করে জগতের ও জীবনের গভীর অর্থের উন্মোচনে ব্যাপৃত হন। এক মহাজীবন অতিবাহিত করে তিনি মানবদেহ ত্যাগ করেন। বর্তমান বিহারের পাওয়াপুরীতে তার নির্বাণের মহাপর্বটি সংঘটিত হয়, যা স্মরণ করে আজ অবধি জৈনগণ দিওয়ালী পালন করে আসছেন। কল্পসূত্র বলছে, ‘সেই চতুর্মাসের চতুর্থ মাসে সপ্তম পক্ষে কার্তিক কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চদশম দিবসে যে চরম রাত্রি, সেই রাত্রিতে শ্রমণ ভগবান মহাবীর কালগত হইলেন, অপুনরাবর্তরূপে ঊর্ধ্বে গমন করিলেন। জন্ম-জরা-মৃত্যুর বন্ধন ছিন্ন করিয়া সিদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত, অন্তকৃৎ, পরিনির্বৃত, সর্বদুঃখপ্রহীণ হইলেন।’ (কল্পসূত্র-১২৪)

মূলত জৈন মতে, শেষ তীর্থঙ্করের নির্বাণ লাভের কারণে এই কালচক্রের মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তির জন্য মহাজাগতিক জ্ঞান প্রসারের পরিপূর্ণতারও সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও উদিত হলো, পরম পুরুষ মহাবীরের এই পৃথিবী ত্যাগের পর কী তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাসমূহ ঘটল?

মহাবীরের বাণী ছিল অহিংসার বাণী। জৈনমতে জৈনদর্শন তিনটি ʽঅ’-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত। যথা-অহিংসা, অপরিগ্রহ ও অনেকান্ত। অহিংসা মানুষকে সার্বিক ঘৃণা থেকে মুক্ত রাখে। অপরিগ্রহ মানুষকে জাগতিক মোহ ও সংশ্লিষ্টতা থেকে দূরে রাখে। আর অনেকান্ত শিক্ষা দেয়, মানুষের জ্ঞান মাত্রই সসীম। কিন্তু কিছু কার্যোপযোগিতার কারণে কোনো মতাদর্শই পরিত্যাজ্য নয়। আর সত্যকে তো নানা দিক থেকে দেখার ও বোঝার উপায় আছে। এই নিয়ে গড়ে উঠেছে অনেকান্তবাদ বা জৈন আপেক্ষিকতা। এই তিনের ওপর ভর করে জৈন নির্বাণের পথ সূচিত হয়েছে।      

জৈন নির্বাণের এই ত্রিভুজের প্রত্যেকটি পথ একে অন্যের পরিপূরক। প্রত্যেকটি পথ একে অন্যকে শক্তিশালী করে। তবে জাগতিক সত্যকে সর্বাঙ্গীণভাবে জানেন শুধু অরিহন্তগণ ও ২৪ জন তীর্থঙ্কর। 

শেষ তীর্থঙ্করের এই মনুষ্য জীবনের মহাসমাপ্তির পর পৃথিবীতে তার কিছু সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে। যখন তিনি নির্বাণপ্রাপ্ত হন, কাশীদেশের নয়জন মল্ল গণরাজ এবং কোশল দেশের নয়জন লিচ্ছবী গণরাজ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মহাপুরুষের আলোক নির্বাপিত হওয়ার কারণে তারা সেখানে আলোকসজ্জা করলেন। তারপর থেকে আজ অবধি সেই দিওয়ালী (দীপাবলী) নামক দীপোৎসব চলে আসছে। 

তবে মহাবীর তার শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ আগেই হাতে নিয়েছিলেন। ফলে আলোক নির্বাপিত হওয়ার সুযোগ তিনি রাখেননি। ব্যাপক সংখ্যক শিষ্য ও শিষ্যা তিনি ইতোমধ্যেই তৈরি করেছেন। ইতোমধ্যে ইন্দ্রভূতি গৌতম প্রমুখ সাধু বা মুনিগণ সংখ্যায় ১৪,০০০, আর্যা চন্দনা প্রমুখ সাধ্বীগণের সংখ্যা ৩৬,০০০, শঙ্খ ও শতক প্রমুখ ব্রতধারী শ্রমণোপাসকের সংখ্যা ১,৫৯,০০০ এবং সুলসা, রেবতী প্রমুখ ব্রতধারিণী শ্রাবিকার সংখ্যা ৩,১৮,০০০-এ পৌঁছেছে। তবে মুনি বা সাধু, আর্যা বা সাধ্বী, শ্রাবক ও শ্রাবিকা-জৈন সংঘের এই চার স্তরের বাইরেও অনেক শ্রদ্ধাবান অনুগামী ও অনুগামিনী ছিলেন, যারা মহাবীরের শিক্ষা অর্থাৎ তার দর্শন ও দেশনা কী ছিল তা মানুষকে জানাতে ও ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে ব্রত নিয়েছিলেন। আর সংঘ সম্পর্কে আমরা জানি যে, এই সমগ্র পঞ্চম কালে সংঘ অব্যাহত থাকবে, ফলে মহাবীরের ধর্ম ও বাণীও পৃথিবীতে টিকে থাকবে। সংঘের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে তীর্থঙ্কর মহাবীরের ধর্মের সময়কালেরও অবসান ঘটবে। তবে তা বহু দূরবর্তী ঘটনা। অভিসর্পিণীর পঞ্চম ভাগকে (দশমা) জৈন শাস্ত্রে পঞ্চম কাল বলা হয়। 

এভাবে চব্বিশতম তীর্থঙ্কর তার শিক্ষা টিকে থাকার ও ছড়িয়ে দেওয়ার এক মহান ব্যবস্থাগ্রহণ ও কার্যকর করেছেন। জৈনমতে প্রতি কালপর্বে তীর্থঙ্করের সংখ্যা নির্দিষ্ট, আর তা ২৪ জন। এমতে মহামানব মহাবীরের মধ্য দিয়ে সেই সংখ্যা এই কালপর্বে পূর্ণ হয়েছে। জৈন পঞ্জিকা অনুসারে, আড়াই হাজার বছরের অধিক কাল ধরে তার সংঘ টিকে আছে, যা পৃথিবীতে অত্যন্ত বিরল ও গৌরবময়। ফলে তাদের স্থির বিশ্বাস, তার দৈবশক্তি থেকে বিকীর্ণ আলো যে আরও অধিক কাল জগতে থাকবে, এতে আর আশ্চর্যের কী থাকতে পারে?

লেখক: গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh