ভালোবাসার উল্টোপিঠ

জাহানারা একদৃষ্টিতে তার ফোনের দিকে চেয়ে আছে। ফরহাদ তাকে ফোন দিয়েই যাচ্ছে। গত পরশু ফরহাদ এসেছিল। প্রস্তাব সে যা দিয়েছে তাতে দোষের কিছু নেই সেকথা সত্য। তবুও জাহানারার এসবে গা ঘিনঘিন করে। এতদিন বাচ্চাকাচ্চা হলে ফরহাদ তার ছেলের বয়সীই হতো। সেবার বৈদ্য কবিরাজের ওষুধের জোরে তার যে গর্ভ ফুলে ফেঁপে উঠেছিল সেটা ভেবে জাহানারা ব্যথা পায়। তখন তার কী আনন্দ ছিল। অনেক গাছগাছন্ত খাওয়ার পর তার গর্ভে মানুষ নাড়াচাড়া করছিল সেবারই প্রথম তখন তার কুড়ি বছর বয়স। দুনিয়াদারির ভাবগতি বোঝা দায় মৃত সন্তান প্রসব করেছিল জাহানারা। কতলোকই বুঝিয়েছে সেলিমকে। কিন্তু সেলিম জাহানারাকে রাখেনি। নতুন বিয়ে করেছে, সংসার হয়েছে। সেই থেকে নিরুদ্দেশ জাহানারা। ছোটবেলায় কত গল্প শুনেছে ঢেঁকিশাকের ফুল যে পায় তার গর্ভধারণে সমস্যা হলে এই ফুল খুব কাজে দেয়। কিন্তু ফুল পেলে কেউ যাতে জানতে না পারে যে সে ফুল পেয়েছে। বাড়ির পশ্চিমে আছে ছোট্ট সুপারি বাগান। বাগানের তল জুড়ে বুনো ঢেঁকিশাক। জাহানারা কতদিন ঢেঁকিশাকের ফুল খুঁজেছে। ভেবেছে স্বামীর কাছে এবার দাম পাবে, ঘর পাবে হয়তো পরিপূর্ণ সন্তান পাবে। কিন্তু সুপারিতলায় ঝরঝর করে ঝরে পড়েছে সুপারির ফুল ঢেঁকিশাকের ফুল আর সুপারি বাগানের ঢেঁকিশাকে মেলেনি তার। সেই জাহানারার সন্তান গেল, একে একে স্বামী গেল, সংসারে সব গেল। এখন এই ঢাকাইয়া জীবন তার ভালো লাগে না। বাবারকুলে যাও দু-একজন আছে তারা জানে জাহানারা হারবাল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। জাহানারা জানে না সে আসলে কী করে। ঘর থেকে বের হওয়া আর ঘরে ফেরা কোনোটারই মাপকাঠি তার নেই। বৈশাখের মেঘের মতো তার আসা যাওয়া। কখনো হঠাৎ ভারী বর্ষণ আবার কখনো নির্ভার আকাশ। 

ফরহাদের খাউজানি মনে হলে জাহানারার রক্ত গরম হয়ে যায়। 

হালারপুত। অত শরীর পোড়ে তো বিয়ে করো না ক্যান! দরকার পড়লে অন্যখানে গিয়া মাগি লাগাও। আমার পিছে তোর কী! কুড়ি বছরের পোলা আমারে সে দিনরাত ফোন দেয়! দুদিন পর আমারে ভালা লাগবে না। তখন পিছ লইবি পাড়ার অন্য মাইয়ার লগে। 

নিজে নিজে এসব বলতে বলতে অস্থির হয়ে ওঠে জাহানারা। 

ফরহাদ ঢাকায় এসেছে বছর দুয়েক হলো। হামিম বিক্রস্-এ ভাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। সারাদিন মাটি মাখো, কাদা মাখো, কয়লা মাখো এসব করে করে ফরহাদ গ্রামের সবুজ মেহগনি পাতার মতো কিশোর যেন ফিকে দেয়ালের মতো শহরের যুবক হয়ে উঠেছে। ফরহাদের মনে প্রেম ভালোবাসা যে কিছু নেই তা নয়। বরং ফরহাদ মনে মনে স্বপ্ন দেখে অনেক টাকাকড়ি কামিয়ে সে দেশে ফিরবে। দেশে আসলে তার আছেটা কী! তবুও ফিরবে। দেশ বলে যার কিছু নাই তার তো ফেরার কোনো তাড়া নাই। ফরহাদ ঘর করতে চায়। যেমন করেই হোক তার খুপরি হলেও ঘর চাই। ছোটকাল থেকে শুনে এসেছে যে ঘরে ঘরনি নাই সে নাকি ঘরই না। ফরহাদের মনে ঘর আর ঘরনি রাতদিন ভরা বানের জলের মাছের মতো উলটপালট করে। জাহানারার রূপ ফরহাদকে মুগ্ধ করে না তা নয়। তবুও জাহানারা ফরহাদের থেকে বয়সে অনেক বড়। ফরহাদ চায় জাহানারার মতো রূপ নিয়ে তার ঘরে তার বয়সী নারী আসুক। 

পরিশ্রমের আর বিনিময়ে অর্থের রোজগারের কথা মনে আসলে ফরহাদের কাছে এই আশা মাঘের রোদের মতো মিলিয়ে যায়। সারাদিন খেটেখুটে ফরহাদ পায় পাঁচশ টাকা। খেয়ে-দেয়ে হাতে আর থাকেটাই কত? অথচ এই শহরে কত রঙের মানুষ। ফরহাদ দেখে ভিক্ষা করে মানুষ তার থেকে বেশি টাকা আয় করে।

ভাটার ইট কাঠ আর কয়লার ধোঁয়ায় কালি মেখে মেখে ফরহাদকে আর কুড়ি বছরের ছোকরা মনে হয় না। ফরহাদ জাহানারাকে ইঙ্গিত দেয়। জাহানারা রাস্তার ধারে থাকা ঘরের পাশে গিয়ে শিস বাজায়।

-ও জানু। আরে জাহানারা। তুমি তো আবার জাহানারা আপা না কইলে মাইন্ড করো। আছো কেমন? রোজগার কেমন করতাছ।

-ফরহাদ চুপ করছোস তুই। তোরে কিন্তু আমি হাতুড়ি দিয়া ছ্যাঁচা দিমু। বান্দির পুত আমার সাথে মশকরা করো।

-আরে খ্যাপো কেন জানু। তুমি এই যে ফ্যাক্টরিতে 

টাকা-পয়সা কামাও। এরপর রাত-বিরাতে কতলোকে তোমার সাথে টাংকি মারে। এত ট্যাকা রাখবা কই! আর আসল কথা হইল কী জানো তোমারে দেখলে আমার দেলটা ভসকাইয়া যায়। মনে হয় আপন কইরা লইয়া যাই।

এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না জাহানারা। ঘরের ঝাড়– হাতে ফরহাদের দিকে তেড়ে যায়। ফরহাদও যেতে যেতে বলে যায়- যতই তাড়াও আমায় এই কইয়া রাখলাম, মনে ধরলে ডাক দিও। তোমারে বড় ভালোবাসি। কত মানুষকে নিয়াই তো তুমি রাত পার করো আমারে একদিন ডাকো না ক্যালায়। আমি তোমারে টাকা কম দিমু না। 

কথাটা মনে রাইখো।

জাহানারা মাঘের পরিপূর্ণ হলুদ গাঁদা। ফরহাদের মনে হয় এখনই এই রূপ নিতে না পারলে বসন্তেই তা শুকিয়ে যাবে। আর শেফালি কেবল মাঘ শেষ করা পলাশের কলি। শেফালির কথা মনে করে ফরহাদের দুঃখ হয়। শেফালি তাকে ভালবেসেছে, গোপন প্রণয়ের আস্বাদও শেফালিই তাকে দিয়েছে কিন্তু ফরহাদের কর্মহীন বেকার জীবন ওকে নিয়ে এসেছে ঘোর নরক শহরে। শেফালির খোঁজখবর সে পায়। ওর বাবা শেফালিকে এখনো বিয়ে দিতে পারেনি। মাঘের সূর্যের মতো শেফালির আশা যে দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে সে কথা ফরহাদের অজানা নয়। হঠাৎ পাত্র মিলে গেলে শেফালির বাবা শেফালিকে আর কেন ঘরে রাখবে?

শহরের এই ইটভাটার লাল মাটি পার হতে হতে ফরহাদের চোখে পড়ে ধুলার আস্তরণে ঢাকা ভাঁটগাছের সারি। সারি সারি ভিটাশিলাপাতির বন যেন আপন রঙ বদলে নিয়েছে ইটভাটার জেরে। ফরহাদের মনে হয় তার গ্রামের রাখা গিদাল কৃষ্ণপালার গান গেয়ে বেড়াত। সেই লাইনটা তার মনে পড়ে যায়- বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজ্জনে জানে, মন মোর পোড়ে তবু কেহ নাহি দেখে। ফরহাদ যেন তেমন এক ইটের ভাটায় এসে পড়েছে। বাইরে শান্ত নীরবতা ভিতরে মাটি পুড়ে পুড়ে লাল ইটে পরিণত হচ্ছে। পোড়া ইটে থাকা জল তৃষ্ণা আর শহরে পোড়া ফরহাদের মনে প্রেম তৃষ্ণা। কারণে অকারণে সে ছুটে যায় জাহানারার কাছে। কোনোদিন জাহানারা আপা, কোনোদিন জানু, কোনোদিন জানু আপা নানা সম্বোধনে সে জাহানারার নিকবর্তী হতে চায়। 

জাহানারা ভাবে পুরুষ এক ধর্ষকসুলভ মন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। সে জোর করে, জবরদস্তি করে আবার প্রেম, ভালোবাসাও সে দেখায়। কত পুরুষই তো আসে জাহানারার ঘরে। এদের সকলে যে কেবল ধর্ষক সে নয়। পতিতার কাছে এসেও নিজের প্রেমময় পুরুষ মনটা প্রকাশ করে যায় অনেকে। একারণে কখনো কখনো ফরহাদের প্রলোভন নিয়ে জাহানারা ভাবে না তা নয়। অনেকবারই ভেবেছে। সেলিম তাকে কত অপমান করেই না তাড়িয়ে দিয়েছে। জাহানারা সেই থেকে সন্তানের চিন্তা আর করেনি। জীবনযাপনের অস্ত্র হিসেবে সে বেছে নিয়েছে সন্তান উৎপাদনের অনুৎপাদিত প্রাককর্মকে। 

ইটভাটার হাড়ভাঙা খাটুনি ফরহাদ ভুলে যায় তার পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। বাড়িতে বসবাসের মতো দুটো একচালা টিনের ঘর করতে আর শেফালিকে ঘরে তুলতে গেলেও তার বেশ কিছু টাকার দরকার। শেফালি তাকে প্রেম দিতে পারে, তাকে ভোরবেলা ভুরভুর করা নারী শরীরের ঘ্রাণ দিতে পারে। সত্যিকারের সকালে ফোটা শিউলি হতে পারে শেফালি। কিন্তু এই ইটভাটার কঞ্জুস মালিকদের হাতে পড়লে আর শ্রমিকের যেন কোনো দামই থাকে না তা নিজেকে দিয়ে বুঝেছে সে। এতসব চিন্তা নিয়ে ফরহাদ দুচোখে খুঁজে ফেরে টাকা আর কার্তিকের কুকুরের মতো সঙ্গম লিপ্সা। 

জাহানারার ঘরে সেদিন এসেছে মানিক। এমন একটা দিনে এসেছে যে সেদিন ফরহাদের কাজকর্ম নেই। সারাদিন মানিক থেকেছে জাহানারার ঘরে। ফরহাদ ভেবেছে ভ্রমরের খিদা মিটলে ভ্রমর চলে যাবে সে কিছুটা সময় পাবে জাহানারার সাথে আলাপচারিতার। কিন্তু এ ভ্রমরের চলে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। এমন দীর্ঘ সময় কাটালে জাহানারা দিনে হাজার দুয়েক টাকা আয় জোরগার করে বলে ফরহাদ শুনেছে। আর মানিক মালদার পাটি। ট্রাকের ড্রাইভার হলেও ইদানীং নানা অকাজ করে টাকা কামিয়ে একটা ট্রাকও কিনেছে সে। কিন্তু ড্রাইভারি ছাড়েনি। ইটভাটার ট্রাক হিসেবে মানিককে ভালো করেই চেনে ফরহাদ।

একদিন তো ফরহাদ মানিকের মাথায় ঝামা ইট মেরেই দিয়েছিল। মানিকের জন্মগতই একটা হাত খাটো, স্টিয়ারিং ঘুরাতে তাই কখনো কখনো ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে। সেবার গাড়ি প্রায় ফরহাদের গায়েই উঠেছিল কিন্তু লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচিতে বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছে ফরহাদ। সেই থেকে মানিককের সাথে তার মনোমালিন্য। মানিকের জন্মহাত ছোট হলেও অর্থ হাত বা বেহায়াপনা ফরহাদের তুলনায় ঢের বেশি। এরকম শিশ্নদারতন্ত্রী লোক দেখলে ফরহাদের মনে হয়- আরে বাবা গাছের ফল খা তাই বলে ফুলটা কখনোই নজরে পড়বে না এদের! জাহানারাকে এরা কেবল ভোগই করে চলল। 

মানুষ পৃথিবীতে কী আজব এক কাগজ বের করেছে টাকা। এদের চাল, ডাল কিনতে টাকা লাগে, বিয়ে করতে টাকা লাগে, মাগিপাড়ায় গেলে টাকা লাগে আবার ধর্মের ঘরের যাতায়াতেও টাকা লাগে। অথচ পশুপাখিদের কত শান্তি! না লাগে টাকা না লাগে ধর্ম। প্রেম আছে তো বাসাবাড়ি করো, নাই তো উড়ে যাও।

সন্ধ্যায় মানিকের চলে যাওয়ার পর জাহানারা নিজেকে নতুন রূপে সাজিয়ে তুলেছে। ঘরের ভাঙা আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে প্রায় নিতম্ব বেয়ে খসে পড়া শাড়ির পাড়টা ধরে ঠিক করছিল। উষ্কখুষ্ক হয়ে যাওয়া ব্লাউজটা খুলে খোলা বুকে অন্য একটা ব্লাউজ পড়ে নিচ্ছিল। ব্লাউজের উষ্ণতা থেকে সরিয়ে রেখেছে তার নাতিশীতোষ্ণ টাকার ব্যাগটি। সাজগোজের চুল পরিপাটি করে নিজেকে পুনরায় নতুন ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার মতো জেগে তুলছিল পুব আকাশে। তখন সন্ধ্যা তারা উঁকি দিচ্ছিল, গোধূলির আলোয় কিছু পাখি তখন কিচিরমিচির করেছিল বাঁশবনে। সারাদিন নানাপ্রান্ত ঘুরে যেন পাখিরা নিজেদের সব আলাপ এই গোধূলির জন্যই জমিয়ে রাখে। এমন এক শরীর জুড়ানো আলোয় জাহানারা সজ্জিত হওয়ার সব কর্মকা- চোখে পড়ে ফরহাদের। জাহানারার খোলা বুকের এই ছবি যেন চোখ থেকে সরছেই না তার। ঘামে ভেজা শ্রম ফরহাদকে স্বাবলম্বী হতে দেয় না অথচ কামুক শরীর জাহানারাকে টাকার ব্যাগ উপহার দিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ঘরের টেবিলে ড্রয়ার লাগিয়েছে জাহানারা, বুকের মধ্যে রেখে দিয়েছে মানিব্যাগ। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ফরহাদ। ক্রমশ এগিয়ে যায় রক্তাক্ত দৃষ্টি নিয়ে। জাহানারার ভয়ার্ত হরিণীর চোখ যেন আত্মসমর্পণ করে ফরহাদের কাছে।

এ কী! ফরহাদ তাকে ভোগের বদলে প্রাণপণে টেনে ধরছে তার টাকার ব্যাগ। কামুক দুটো সাপের আকাঙ্ক্ষিত শরীরী স্বাদ যেন যুদ্ধে রূপান্তর হয়। প্রবলভাবে জাহানারা চেপে ধরে তার সারাদিনের ও সারাবছরের অর্থের ব্যাগ। ফরহাদের এক হাতে মানিব্যাগ অন্য হাতে টুঁটি চেপে ধরে আছে জাহানারার। প্রবল শ্রমিকের শক্ত হাতে জাহানারা দম বন্ধ হয়ে মারা যায়।

জ্যোৎস্নালোকিত পূর্ণিমা সন্ধ্যায় ফরহাদ জাহানারার চৌকাঠ মারিয়ে সোজা বাসে চেপে বসে। তার সামনে ভেসে ওঠে ভোরের শেফালি। দূর গ্রামে উষ্ণ বুক আর নিঃসঙ্গ চিবুক নিয়ে অপেক্ষা করছে কেউ। থোকা থোকা গোলাপের বদলে সে রক্তমাখা হাতে ধরে আছে সেই ব্যাগটি। 

এতটা অবাক ফরহাদ আর কোনো দিন হয়নি। সম্ভ্রম বিক্রি করে তবে জাহানারা কেবল পেটের ক্ষুধাই মিটিয়েছে। এই ব্যাগে মাত্র তিনশ টাকা! 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //