গল্পগুলো সোনার অথবা রুপার হরিণ

দুই বন্ধু স্কুল থেকে পালানোর সময় তাদের সূক্ষ্ম একটি পরিকল্পনা ছিল। আবরার জানত, সে পালাচ্ছে তার জীবন থেকে মুক্তি পেতে। আর নাসিউস জানত, সে পালাচ্ছে আবরারকে ফিরিয়ে আনতে। তাদের পালানোর মধ্যে কোনো ইতরবিশেষ পার্থক্য ছিল না। দুজনই পলাতক, দুজনকেই বাবা-মা খুঁজছে।

আবরার গিয়ে একটি চায়ের দোকানে কাজ নিল। আর নাসিউস দোকানের পাশে ঝালমুড়ি বিক্রি করে। তাদের রাত হয়।

রাত হলে তাদের চোখে ঘুম থাকে না; মেসের খাটে, ছারপোকার দঙ্গলের ভেতর তাদের রাশি রাশি উল্লম্ফন, তাদের চিতা, তাদের অনল জ্বালাতে থাকে। জ্বলতে জ্বলতেভোর হয়। চোখ মেলে দেখতে পায় না আবরার সীমাকে, কিংবা নাসিউস দেখে না শিমলাকে।

আবরার জানত, শিমলা শেষ পর্যন্ত নাসিউসেরই হবে। তবু আবরারকে বাঁচাতেই নাসিউস তার সাথে পালিয়েছে।

স্কুলের ঘণ্টাগুলো ভালোই, বেশ কাটছিল। স্কুল পালিয়ে মাঝেসাঝে খালের পাড় ধরে হেঁটে গেছে ঈদগাহর পাড়, অরণ্যের ভেতর, তাদের নিবিড় আলিঙ্গনে প্রেমময় বাঁধা হতে দোষ ছিল না।

তবু সীমা পোষ মানল না। বুকের ভেতর থেকে খচ করে পালিয়ে গেল পোষা ময়নাটা। আবরারের চোখের জলে চায়ের কাপে টুংটাং উচ্চারণে কান্নাগুলো লুকিয়ে যায়।

নাসিউসের একদিন ফোন আসে, তার শিমলাও নাকি পালিয়েছে।

দুই বন্ধু পার্কে বসে সিগারেট খায়। ধোঁয়ায় ওড়ায় দুঃখ। তারপর সব ভুলে যায়।

দুই বন্ধু একদিন নষ্টপাড়ায় যায়। মেসের আরেক চানাচুর বিক্রেতা বড় ভাইয়ের সাথে রেখে আসে জীবনের বিষাদ।

সেই থেকে, তাদের টাকা জমলেই, বড় কম বয়সে, নিজেকে সমর্পণের সুরে রেখে আসে মেয়েমানুষের কাছে। 

আবরার চোখ বুজে কল্পনা করে, সে আছে সীমার ওপর, সীমা তার শীৎকারে, চিৎকারে ভরিয়ে তুলছে তাকে। তখন তার মনে হয়, সেসবের অন্ধকার থেকে, তৃণকুঞ্জ থেকে, এই ভালো। নাচতে থাকো আমার সীমা, নিজেকে রাশি রাশি মেলে দাও আমার বিছানায়।

তারপর অবশ হয়ে, নতজানু হয়ে দেখে এ তার শিমলা নয়। পারুল অথবা মাঝবয়সী মেয়েমানুষ তাদের তাড়া দেয়। বেরোয়।

তারা বেরিয়ে আসে।

নাসিউস হয়তো ভাবে, তার শিমলার কথা। আহ শিমলা, তুমিও আমাকে দুঃখ দিলে! তবু সে আবরারের দিকে চায়। জানে, ভুলে গেলে বন্ধুটি তার বাঁচবে না। কী সুখে, কী দুখে যে সে বেঁচে আছে তা শুধু নাসিউসই জানে। তাই সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শিমলার কথা তুলতে চায় না, পারলে ভুলে যায়। কিন্তু তারা দুজনই জানে, তাদের কেউই ভুলতে পারছে না প্রেমকে।

তবু ভুলে থাকা বছর চলে যায়, বছর ঘুরে আবারও বছর আসে। তারপর আবারও বছর আসে। এভাবে দিনগুলো কেটে যায়। 

তারা দুজন নওল কিশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করে। খবর আসে, তাদের প্রেমিকারা মা হয়েছে, কেউ একাধিক।

তাদের দুজনের মধ্যে বাবা হওয়ার খায়েশ জাগে, তারা বিয়ে করতে চায়। কিন্তু হন্যে থাকা ঢাকায় তাদের বউ জুটবে কেমন করে?

গাঁজার ধোঁয়ায় নেশা হয়। ক্বচিতে বাংলা মদের কড়া বিষে নিমেষে চুপ করে থাকে।

তবে তাদের বুদ্ধিজ্ঞান বেশ ভালো। দুজনই উপার্জনের রাস্তায় নিজেদের উন্নীত করে নিয়েছে। আবরার এখন মিষ্টির দোকানের কারিগর আর নাসিউস মুদি দোকানে কাজ করে। 

দুজনের টাকা আসে মাস শেষে। টাকা পেলে টুক করে ছুটে চলে যায় ও পাড়ায়। মেশে, গভীরভাবে আলিঙ্গনের নীরে দুঃখগুলো ধুয়ে দিয়ে আসে। আসার সময় দুই প্যাকেট সিগারেট কিনে আয়েশ করে খায়। 

ওই কয়েক দিনই। তারপরই আবার হিসেব করে চলতে হয়। বেশি প্যানিক উঠলে গুলিস্তানে একটি-দুটি মোবাইল থাবাটাবা দেয়, তবে খুব বুঝে-শুনে। 

চানাচুর বিক্রেতা ভাইটা এখন পুরোপুরি মোবাইল ছিনতাইবাজ। প্রতিদিন চল্লিশ পঞ্চাশটা মোবাইল নিয়ে আসে তার সাগরেদরা। আর সে এখন দক্ষিণে, কোথাও কোনো একটি জায়গায় বড় একটি ফ্ল্যাট নাকি নিয়ে নিয়েছে, আছে সুখেই। 

-শালা এখন বারে বসে মদ গেলে! দুই বন্ধু খেঁকিয়ে ওঠে।

সন্ধ্যার পর তারা পার্কের কোনায় বসে তামাক বাছে। অন্ধকারে তাদের দক্ষ হাত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ফেলে ভাং পাতা, ফুলের শুঁড়গুলো।

আগুনে আগুনে তাদের নেশা গাঢ় হয়। মুদি দোকানের কাজ সেরে নাসিউস যায় আবরারের দোকানে। সেখানে সুযোগ হলে বন্ধু তাকে একটি মিষ্টি খাওয়ায়। দোকান থেকে বের হয়ে দুজনে পান মুখে দেয়।

চিবুতে চিবুতে তারা মেসের পথ ধরে। মেসে গিয়ে রেঁধে খায়। দুই বন্ধু এখন টিকাটুলীর এদিকে একটি সস্তা রুম নিয়েছে। 

আগের মেসের অনেকেই ওই চানাচুর বিক্রেতা ছিনতাইবাজের সাথে কাজ করতে দক্ষিণে চলে গেছে। এখন আর তাদের সাথে থাকার উপায় নেই।

দুই বন্ধু ভয় পেয়েছিল। তারা ভেবেছিল, এ পথে তাদের এগোনো ঠিক হবে না। তাই তারা চুরিচামারিতে তেমন জড়িয়ে যায়নি।

একদিন তাদের শখ হলো, তারা যুগলভাবে একটি মেয়ের সাথে শুবে। মেয়েদের অতলান্ত আজ দেখে ছাড়বে দুজন। 

মেয়েটি প্রথমে রাজি হয়নি। বলেছে, একজনের পর একজন আসতে। কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা। দুজনই একসাথে যাবে। এর জন্য যত টাকা লাগে নিতে হয় নিক। তবু তারা এমনটিই চায়।

পুরাতন কাস্টমার বলে মেয়েটি তাদের ফিরায় না। মøানমুখে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।

-তোমরা কি আজ তোমাদের গল্প বলবা? মেয়েটি প্রশ্ন করে। 

দুই বন্ধু হতভম্ব হয়ে পরস্পরের দিকে চায়। তারা আবার যুগপৎ মেয়েটির দিকে চোখ রাখে। নাসিউসের মনে হয়, ওই মেয়েটি এই পাড়ার মেয়ে নয়, সে তার শিমলা। আর আবরার ভাবে, সে চেয়ে আছে সীমার দিকে।

তাদের দুজনের চোখ অবনত হয়, আনত হয়। আবার জেগে ওঠে। কামনার চোখে চায় মেয়েটিকে। আবার তারা তাদের প্রেমিকার রূপে দেখে মেয়েমানুষটিকে।

তাদের ভেতর কামভাব জাগে। তারা হামলে পড়তে চায়। 

মেয়েটি তাদের থামায়। বুকের ভাঁজে রাখা গরম কনডমের প্যাকেট তুলে দেয় দুজনের হাতে।

বিরক্তিকর শব্দ তুলে দুই বন্ধু প্যাকেট ছেঁড়ে। মেয়েটির হঠাৎ পেট ব্যথা হয়। চিনচিন করে ওঠে কেমন যেন।

তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই বন্ধু, যেন তারা তাদের প্রেমিকাকে ছিঁড়ে ফেলতে চায়, ফালা ফালা করে ফেলতে চায় করাতকলে ফেলে।

তাদের আক্রোশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রক্ত গরম হয়ে মাথায় উঠে যায়। 

কাজ শেষে মেয়েটি তাদের থামায়। 

-তোমরা তো তোমাদের গল্প বললা না? মেয়েটি প্রশ্ন করে।

দুই বন্ধু চোখ ফিরিয়ে চায়। মেয়েটিকে আবার পাড়ার মেয়ে হিসেবেই দেখে। তাদের চোখে ভুল হয় না। এ তাদের সীমা অথবা শিমলা নয়। এ পারুল অথবা মাঝ বয়সের মেয়েমানুষ। তারা দুজন উঠে যেতে যেতে বলে,

-আমাদের কোনো গল্প নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //