অপেক্ষা

একটা ছিমছাম ছোট প্রান্তিক রেল স্টেশন। দেখলে মনে হবে কোনো পাহাড়তলির দেশ। সারাদিন একটাই ট্রেন আসে। বিকেলের দিকে। লোকজন নামে। পরদিন সকালে কিছু যাত্রী নিয়ে ট্রেন ফিরে যায়। বিকেলে ট্রেন আসার কিছুক্ষণ আগে মাঝবয়সী শিক্ষিত চেহারার এক ভদ্রমহিলা প্রতিদিন আসেন। প্ল্যাটফর্মে যাত্রী বিশ্রামের বেঞ্চিতে বসেন। যেন উদগ্রীব, ট্রেনের অপেক্ষায়। ট্রেন এলে, যাত্রীরা নেমে গেলে, বিষণ্ণ হয়ে পড়েন ভদ্রমহিলা। যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন যিনি আসেননি। ভদ্রমহিলার নাম ধরা যাক ডোরা। 

স্টেশন মাস্টার : নমস্কার। কিছু মনে করবেন না, একটু অনধিকার চর্চাই করছি। আমি এখানকার স্টেশন মাস্টার। আপনাকে বেশ কয়েক মাস হলো রোজ দেখি ট্রেন আসার আগে এখানে এসে বসেন। 

ডোরা : হ্যাঁ (দাঁড়িয়ে উঠে), নমস্কার। আসলে একজনের আসার কথা। আমি বলেছিলাম সে এলে আমি স্টেশন থেকে তাকে নিয়ে যাব। 

স্টেশন মাস্টার : তিনি বলেননি ঠিক কবে আসবেন? মানে আপনার সঙ্গে এর মধ্যে কথা হয়নি? 

ডোরা : না। 

স্টেশন মাস্টার : কিন্তু আপনি তো জেনে নিতেই পারেন। মানে যার আসার কথা তার মোবাইল নম্বর নিশ্চয়ই আপনার কাছে আছে। রোজ রোজ অপেক্ষা করে ফিরে যাওয়া। 

ডোরা : না (আবার বেঞ্চে বসে পড়েন)। 

স্টেশন মাস্টার : চলুন আপনি আমার অফিস ঘরে এসেও বসতে পারেন। চা-এ চুমুক দিতে দিতে গল্প করা যাবে। তাছাড়া সন্ধ্যা হয়ে আসছে। 

ডোরা : এই সন্ধ্যা হয়ে আসাটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে জানেন। অপসৃয়মাণ আলো, ঘনিয়ে আসা ছায়া, পাখিদের ঘরে ফিরে আসা। তারপর ওই পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা গ্রামগুলোয় আস্তে আস্তে আলো জ্বলে ওঠা। আপনিই বরং বসুন না এই... এইখানে। জায়গা তো আছে। 

স্টেশন মাস্টার : হ্যাঁ হ্যাঁ। (বসে) আমার অফিসের স্টাফেরা বলছিল। মানে বেশ কিছুদিন ধরে বলছিল। আপনি আসেন অপেক্ষা করে চলে যান... 

ডোরা : কাউকে বিরক্ত তো করি না। 

স্টেশন মাস্টার : প্রথম প্রথম আমিও সেরকম নজর দিইনি। তারপর দেখলাম আপনি যে প্রত্যাশা নিয়ে আসেন, ফেরার সময় বিকেল শেষের পাহাড়ের ঘন ছায়ার মতো এক হতাশা আপনাকে গ্রাস করে। মাঝে মাঝেই দেখতাম। একসময় মনে হলো আপনার সঙ্গে কথা বলি। 

ডোরা : আচ্ছা আমার জায়গায় একটা পুরুষ যদি এরকম প্রতিদিন আসত, আবার চলেও যেত...

স্টেশন মাস্টার : কৌতূহল ঠিকই থাকত। তবে উপযাচক হয়ে এসে আলাপ জমাতাম কি না জানি না। আমার যেটা অবাক লাগছে আপনি যার জন্য অপেক্ষা করছেন তার ফোন নম্বর জানেন না, কবে আসবে জানেন না, মানে তিনি যে এই স্টেশনে আসবেন সেটা নিশ্চিত? অথবা আপনি নিশ্চিত আপনি তারই জন্য অপেক্ষা করছেন?

ডোরা : মনে তো হয়। 

স্টেশন মাস্টার : আপনি হয়তো ভাববেন অনধিকার চর্চা করছি। আসলে পাহাড়তলির এই ছোট্ট স্টেশনটাকে ঘিরেই এখানে বসতি। সবাই প্রায় সবাইকে চিনি, সকলের খবর রাখি। 

ডোরা : দেখুন যার জন্য আমার এই অপেক্ষা, আমি বিশ্বাস করি তিনি আসবেনই। এইরকম একটা জায়গার কথাই তিনি বলেছিলেন। 

স্টেশন মাস্টার : শেষ কবে তার সঙ্গে কথা হয়েছিল? 

ডোরা : ঠিক বলতে পারব না। বছর দশেক তো হবে নিশ্চয়ই। বেশিও হতে পারে। এরকম একটা জায়গার কথাই বলেছিল। বলেছিল একটাই ট্রেন এসে থামে, পাহাড় দিয়ে ঘেরা, মনোরম পরিবেশ। 

স্টেশন মাস্টার : আপনি তো সবে কয়েক মাস হলো এসেছেন। এমন তো হতে পারে উনি এর আগেই হয়তো আপনাকে না পেয়ে ফিরে গেছেন। 

ডোরা : আমাকে সে বলেছিল ১০ বছর পর সে আসবে। ১০ বছর তো সবে হয়েছে। ও আসবে ঠিকই। 

স্টেশন মাস্টার : এরকম স্টেশন তো আরও অন্য কোথাও থাকতে পারে। হয়তো সেখানেও এই একটা ট্রেনই যায়। 

ডোরা : কিন্তু আমার মনে হয় এটাই সেই স্টেশন। 

স্টেশন মাস্টার : আচ্ছা ১০ বছর বলছেন তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। মানে দেখা হয়নি, কথা হয়নি। আপনারা দুজন দুজনকে চিনতে পারবেন তো? 

ডোরা : কেন পারব না? আসলে প্রতিটা মুহূর্তে যে সে আমার সঙ্গে রয়েছে। 

স্টেশন মাস্টার : আপনার বিশ্বাসে আমি আঘাত করতে চাই না। আমি চাই যার জন্য আপনার অপেক্ষা তিনি আসুন, আপনাদের দেখা হোক।

ডোরা : দেখা হবে বলেই তো এতদূর এসেছি। জানেন এতগুলো বছর আমি শুধু অপেক্ষা করে আছি এই দেখা হওয়ার জন্য। 

স্টেশন মাস্টার : বুঝতে পারছি, কিন্তু একটা আশঙ্কা হচ্ছে উনি হয়তো এসেছিলেন কিন্তু আপনারা কেউ কাউকে চিনতে পারেননি। ১০ বছর অনেকটা সময় তো। 

ডোরা : অসম্ভব। দেখা হবে চিনতে পারব না, হতেই পারে না। 

স্টেশন মাস্টার : আচ্ছা ধরুন দেখা হলো। কোনো একদিন উনি ট্রেন থেকে নামলেন। পরস্পরকে আপনারা চিনতেও পারলেন। তারপর? তারপর কী করবেন? 

ডোরা : ভেবে দেখিনি, ভাবার প্রয়োজনও নেই। অপেক্ষা করে আছি, দেখা হলে অপেক্ষার অবসান হবে। 

স্টেশন মাস্টার : অপেক্ষার অবসান হবে। আপনার জীবন থেকে তারপর কতকিছু হারিয়ে যাবে ভাবুন। এই যে বিকেল হলে আপনার মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, ট্রেন আসার সময় হয়েছে। আপনি নিজেকে তৈরি করে এখানে আসেন। অপেক্ষা করেন, তারপর হতাশ হয়ে ফিরে যান। স্টেশনে অন্ধকার নেমে আসে। এই যে এক উৎকণ্ঠা ভরা দৃষ্টিতে ট্রেন থেকে নামা প্রত্যেক যাত্রীকে আপনি দেখেন এগুলো তো হারিয়ে যাবে।

ডোরা : কোনো অপেক্ষাই তো অনন্ত হতে পারে না। অপেক্ষার শেষ তো হবেই। আমি তো আশা করি আমার অপেক্ষারও শেষ হবে একদিন। 

স্টেশন মাস্টার : ধরুন অপেক্ষার শেষ হলো। ভদ্রলোক সত্যি সত্যি নামলেন ট্রেন থেকে। দুজন দুজনকে চিনতেও পারলেন। কিন্তু কিছুটা সময় কথা বলার পর বুঝতে পারলেন ১০ বছর আগে যে লোকটাকে আপনি চিনতেন আর যাকে আপনি এখন দেখছেন দুজনে এক লোক নয়। তার চিন্তা-ভাবনা দর্শন সব বদলে গিয়েছে। আপনার সঙ্গে কথা বলে ভদ্রলোকেরও তাই মনে হলো। 

ডোরা : তা বলে আমি আশা ছেড়ে দেব? মানুষ তো শেষ অবধি আশা নিয়েই বাঁচে। আমিও তো সেই আশা নিয়েই বাঁচছি যে। ১০ বছর গিয়েছে, হয়তো আরও ১০ বছর না হয় যাবে। কিন্তু একটা আশা একটা স্বপ্ন... এগুলো ছাড়া যারা বাঁচে তারা তো মানুষের আদলে অন্য কিছু। আমি তো সেভাবে বাঁচতে পারব না। 

স্টেশন মাস্টার : কিন্তু আশা ভঙ্গ হওয়াটা কি আরও দুর্যোগের নয়?

ডোরা : আমি তো জানি না শেষ অবধি কী হবে। আর জানি না বলেই তো আশা করি। সবটা জানলে তো মানুষ স্বপ্ন দেখতে শিখত না। স্বপ্ন বলেই হয়তো কিছু থাকত না। আপনি কেন আমার স্বপ্নটাকে ভেঙে দিতে চাইছেন!

স্টেশন মাস্টার : আসলে আজ সকালে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। খোঁজ করছিলেন। 

ডোরা : আমার? 

স্টেশন মাস্টার : না, সেভাবে সরাসরি কারো নয়। জায়গাটা সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। এখানকার লোকজন কেমন? বসবাসের জন্য কেমন? স্বাভাবিক কিছু জিজ্ঞাসা। আমার তখন কিছু মনে হয়নি। এখন আপনার সঙ্গে কথা বলার পর মনে হচ্ছে...

ডোরা : (উত্তেজিত) কী মনে হচ্ছে? আচ্ছা ও দেখতে কেমন? মাঝারি গড়ন?

স্টেশন মাস্টার : খুব ভালো করে দেখা বলতে যা বোঝায়, সেভাবে তো দেখিনি।

ডোরা : আশ্চর্য আমার নজর কী করে এড়িয়ে গেল। তাহলে কি? 

স্টেশন মাস্টার : না, না তেমন কিছু নয়। ভদ্রলোক গাড়ি করে এসেছিলেন, ফিরে গেছেন। মনে হলো এই জায়গাটা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করছেন। 

ডোরা : সে-ই, সে-ই। ও এরকমই ভাবত বড় একটা কিছু করার। খোঁজ নিয়ে গেছেন। এবার ট্রেনে করে আসবে। 

স্টেশন মাস্টার : জানেন প্রকৃতির সব কিছুর মধ্যে যেমন একটা সামঞ্জস্য আছে, মানুষের তৈরি সবকিছুর মধ্যে নেই। মানুষ সুবিধাবাদী। তার যখন যা প্রয়োজন তাই করে। আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে অনেক সময় এতদিনের করাটাকে বাতিল করে দেয়। মানুষ তো কথা দিয়েও কথা রাখে না, আসব বলেও আসে না। কিন্তু এমন কোনোদিন হয় যে সন্ধ্যা হলো না, বা সকাল এলো না। হয় না, তাই না। চলুন বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। 

ডোরা : হ্যাঁ দেখুন তো, কথা বলতে বলতে খেয়ালই হয়নি। আপনাকেও অনেকক্ষণ আটকে রাখলাম। আসলে এখানে কারও সঙ্গেই সেভাবে আমার আলাপ নেই। আমি যে প্রতিদিন এই স্টেশনে আসতাম, আপনাকে দেখতাম, আপনি কত ব্যস্ত। 

স্টেশন মাস্টার : হ্যাঁ, এ রকমও তাহলে হয়। দুজন মানুষ দুজন মানুষকে দেখে, কথা হয় না। 

ডোরা : আবার কথা যখন হয়, কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। মেঘ কালো হয়ে ভারী হয়ে ওঠে। খুব ভালো লাগল আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে। মাঝে মাঝে হয়তো কথা বলা যাবে। 

দুজনই উঠে দাঁড়ায়। প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটতে থাকে ধীর পায়ে...

স্টেশন মাস্টার : হ্যাঁ, মানে না। মানে, মানে... যে কথাটা বলার জন্য আসলে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে আসা। আসলে এই আলাপ করতে আসাটা একটা অজুহাত মাত্র। 

ডোরা : আপনি কি কিছু বলতে চাইছেন? আপনি বলতে পারেন। 

স্টেশন মাস্টার : আপনি যেমন অপেক্ষা করে আছেন, আমিও তাই। এখানে আসার পর থেকে আমি অপেক্ষা করে আছি। আজ সেই অপেক্ষার অবসান। 

ডোরা : আমার সঙ্গে আলাপ হয়ে? 

স্টেশন মাস্টার : ঠিক তা নয়। এই জায়গাটা যে আমার অপছন্দ, তা নয়। তবে আমি শহরের লোক, পলিউটেড। খুব বেশিদিন টানা প্রকৃতির সঙ্গে হাঁপিয়ে উঠি। কয়েকদিন হলো বদলির অর্ডার এসেছে। এখানে এসে থেকে ভাবতাম কবে বদলি হবো। এটাই ছিল অপেক্ষা। সেই অপেক্ষা ফুরলো। কাল আমি চলে যাচ্ছি। 

ডোরা : এটাই আপনি বলতে এসেছিলেন? 

স্টেশন মাস্টার : মানে এটুকুই বলতে পারলাম। সবটা বলতে পারারও একটা জোর চাই। 

ডোরা : কারও কারও অপেক্ষা শেষ হয়, কারও কোনো শেষ হয় না অথবা নতুন কোনো অপেক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই দেখুন বৃষ্টি এলো বোধহয়। দু-এক ফোঁটা মাথায় পড়ল। 

স্টেশন মাস্টার : অপেক্ষার শেষ হয় না, শেষ করতে চান না বলে। অপেক্ষা অনেক সময় আপনা থেকেই শেষ হয়ে যায়। আপনি যার জন্য অপেক্ষার কথা বলে এতক্ষণ এত কথা বললেন, তা কি সত্যিই? না কি অন্য কোনো অপেক্ষাকে আড়াল করতে চাইছিলেন। দেখুন বাড়ি পৌঁছানোর আগেই হয়তো বৃষ্টি এসে পড়বে। একটু তাড়াতাড়ি হাঁটি। 

ডোরা : বৃষ্টিই তো আসবে। খুব বেশি হলে না হয় ভিজে যাব। কিন্তু কাল থেকে তো আর কারোরই অপেক্ষা করা হবে না। 

জোরে বৃষ্টি আসে। শব্দ শোনা যায়। যবনিকা নেমে আসে...

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //