সবার সামনে দিয়েই চলছে কালো আমেরিকানদের নিধন

বর্ণবাদী পুলিশি সহিংসতার প্রতিবাদে উত্তপ্ত গোটা দেশ; সেই সাথে কভিড-১৯ মহামারি ও তা নিয়ন্ত্রণে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত অবস্থান- সব মিলিয়ে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে যুক্তরাষ্ট্র। এই দুর্বিষহ সময় ঘিরে ট্রুথআউট পত্রিকার সাথে কথা বলেন বিশ্বখ্যাত বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি, যাকে বলা হয় আধুনিক ভাষাতত্ত্বের জনক। 

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক জর্জ ইয়েন্সি। এটি প্রকাশিত হয় ৫ জুন। 

সাম্প্রতিক দেশকালের জন্য ভাষান্তর করেছেন অরুন্ধতী বসু

কভিড-১৯ নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে জর্জ ফ্লয়েডের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাইব। পাশাপাশি এই ঘটনা কেন্দ্র করে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যুত্তরাষ্ট্র ও গোটা বিশ্বে যে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হয়েছে; সে বিষয়েও আপনার মতামত জানতে চাই। বিশেষ করে তথাকথিত বিদ্রোহ দমনে ট্রাম্পের সেনাবাহিনী মোতায়েনের উস্কানি নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।

এটি আসলেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড; কিন্তু এ বিষয়টি পরিষ্কার থাকা দরকার যে, কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের এখনো হত্যা করা হচ্ছে। মিনিয়াপোলিসের কয়েকজন বর্ণবাদী পুলিশের নৃশংসতা এ অপরাধের ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, মহামারিতে মৃত্যুর হার কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মধ্যে অনেক বেশি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার যেসব কাউন্টিতে গড়ে বেশি কৃষ্ণাঙ্গের বাস, সেসব জায়গায় অন্য কাউন্টিগুলোর তুলনায় করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর হার তিনগুণ বেশি। সংকট মোকাবেলায় কীভাবে সম্পদ ব্যবহার করতে হয় তা না জানায় কৃষ্ণাঙ্গদের এ অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। তবে এর গভীরে আছে ৪০০ বছরের পুরনো নির্মম বর্ণবাদ।

মানব ইতিহাসে দাসত্বের মতো কলঙ্কজনক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে প্লেগের আবির্ভাব ঘটেছে। এ ব্যবস্থাই দেশটির শিল্প, অর্থ, বাণিজ্য ও সাধারণ সমৃদ্ধির একটি প্রধান ভিত্তি। সময়ের সাথে প্লেগের প্রকোপ প্রশমিত হয়েছে। তবে তা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। আমেরিকার দাসত্ব কেবল তার অনৈতিক কার্যকলাপের জন্যই অন্য দেশগুলোর তুলনায় আলাদা নয়, এর সাথে জড়িত ত্বকের রঙের বিষয়টি। এ ব্যবস্থায় কৃষ্ণবর্ণের অর্থই ছিল ‘তোমাকে সহজাতভাবেই দাস হতে হবে’। 

অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর। প্রায় এক শতক আগে ১৯২৪ সালে ইহুদি ও ইতালিয়ানদের বিতাড়িত করতে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী অভিবাসন আইন প্রণয়ন করা হয়। সেসময় ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকতেন ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষ ও ইতালীয়রা। বর্ণবাদীরা তখন মনে করতেন, ইহুদি ও ইতালীয়দের পরিচালিত অপরাধমূলক সিন্ডিকেট থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে হবে। আইন প্রণয়ন করে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারলেই এ জটিলতা থেকে মুক্তি মিলবে। তবে শেষ পর্যন্ত এ জটিলতার সমাধান হয়েছিল। একই ঘটনা ঘটে আইরিশদের সাথে; কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের বিষয়টি আলাদা। বর্ণবাদ ও শেতাঙ্গ আধিপত্যে অভিশপ্ত সমাজে তারা স্থায়ীভাবেই বিবর্জিত হয়েছেন। বিশেষত গত ৪০ বছরে নয়া উদারনৈতিক আগ্রাসনে তা আরো বেড়েছে, অগাধ ধন-সম্পদ বেড়েছে, দুর্বলরা হয়েছে আরো বিপর্যস্ত। 

যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ

সবার সামনে দিয়েই চলছে কালো আমেরিকানদের নিধন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আক্রোশ সীমাহীন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকা, বিপুল সম্পদ ও করপোরেট ক্ষমতাবলে বর্ণবাদী পুলিশি নৃশংসতা ঢাকতে মহামারিতেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। তবে এই মহামারির মধ্যেও বায়ুদূষণ বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন ট্রাম্প। বিজনেস প্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এতে কভিড-১৯ পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠবে। এ বায়ুদূষণে প্রতি হাজারে ১০ জন আমেরিকানের মৃত্যু হতে পারে। মৃত্যু এ ক্ষেত্রে সব শ্রেণিতে হয় না। মৃত্যু হয় নিম্নআয়ের মানুষের, যারা দূষিত ও ঘণবসতিপূর্ণ পরিবেশে বাস করেন বা থাকতে এক রকম বাধ্য হন। এসব চালিয়ে যাওয়া খুব সহজ। প্রতিবাদকারীরা এটা ভালোভাবেই জানেন। এজন্য তাদের গবেষণার প্রয়োজন নেই। অনেকের জন্য এটি বাস্তব অভিজ্ঞতা। তাই প্রতিবাদকারীরা শুধু কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর পুলিশি নৃশংসতার বিরুদ্ধেই নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মৌলিক পুনর্গঠনের দাবিও জানাচ্ছেন।

প্রতিবাদকারীরা শুধু দেশজুড়ে তাদের কর্মসূচি থেকেই সমর্থন পাচ্ছেন না, বিভিন্ন জরিপ থেকেও পাচ্ছেন। জুনের শুরুর দিকে এক জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকানদের ৬৪ শতাংশ প্রতিবাদকারীদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন, ২৭ শতাংশ এ বিক্ষোভে সমর্থন দেননি, বাকি ৯ শতাংশ বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন। বর্তমানের এই বর্ণবাদী বিক্ষোভকে তুলনা করা যেতে পারে ১৯৯২ সালের বিক্ষোভের সাথে। তখনো এমন একটি বিক্ষোভ হয়েছিল। লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ কর্মকর্তারা রডনি কিং নামের এক কৃষ্ণাঙ্গকে নির্যাতন করে প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়েছিল। এ ঘটনার প্রতিবাদে সেসময় এক সপ্তাহ দাঙ্গা চলে। দাঙ্গায় নিহত হন ৬০ জনের বেশি মানুষ। শেষে প্রেসিডেন্ট বুশ ঘটনাস্থলে ফেডারেল সেনা সমর্থিত ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যদের পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। ওই বিক্ষোভের উত্তাপ লস অ্যাঞ্জেলেসেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখনকার মতো নয়। ট্রাম্প এখন উদ্বিগ্ন নিজেকে নিয়ে। তিনি এখন ভাবছেন, আগামী নির্বাচনে কীভাবে এই ট্র্যাজেডিকে ব্যবহার করা যায়। তার সহজাত প্রবৃত্তি সহিংসতার কথাই বলেছে। এজন্য বিক্ষোভকারীদের শিক্ষা দিতে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী পাঠাতে চেয়েছেন। সহিংসতার মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনায় ট্রাম্পের প্রতি নিন্দা জানিয়েছেন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের সাবেক চেয়ারম্যানরা। একইসাথে তারা সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন প্রতিবাদকারীদের প্রতি। সাবেক জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন লিখেছেন, ‘আফ্রিকান আমেরিকানদের মনে আজ যে ভীতি ও রাগ কাজ করছে, তা পুরোপুরি অনুভব করেছি বা বুঝেছি- একজন শ্বেতাঙ্গ হিসেবে এমন দাবি করতে পারি না; কিন্তু সেখানে কিছু সময় থেকেছি। তাই ভালোই জানি, দেখেছিও। বুঝেছি তাদের অনুভূতিগুলো কতটা সত্য আর কতটা বেদনাদায়ক।’ হয়ত গত দুই দশকের পরিবর্তনগুলোর একটি চিহ্ন মুলেনের এই বার্তা। আমেরিকার জনগণের একটি বড় অংশ আমাদের সমাজের দীর্ঘদিনের গোপন সত্যকে স্বীকৃতি দিতে চলেছে। বিষয়টিকে অন্ধকারে একটি সূক্ষ আলোকরেখার সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে আমেরিকার কথাই বলে থাকি আমরা। তবুও কভিড-১৯ এর কারণে মৃত্যুর সংখ্যা আমাদের দেশেই বেশি। আমরা পদ্ধতিগতভাবেই অপ্রস্তুত ছিলাম। এই অসঙ্গতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এক্ষেত্রে ট্রাম্পের ভূমিকাই বা কী?

প্রস্তুতির অভাব মূলত তিনটি কারণে- পুঁজিবাদী যুক্তি, নয়া উদারনৈতিক মতবাদ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র। সংক্ষেপে বিষয়টি আলোচনা করা যাক। ২০০৩ সালে সার্স মহামারির পর বিজ্ঞানীরা ভালোভাবেই জানতেন, এমন আরেকটি মহামারি হতে পারে। আর মহামারির কারণ হবে অন্য আরেকটি করোনাভাইরাস। তারা এটাও জানতেন, কি করতে হবে; কিন্তু জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। কাউকে না কাউকে জ্ঞানের ব্যবহার করতে হবে। নিশ্চিতভাবেই এ জ্ঞান ব্যবহারের দায়িত্ব প্রথমে বর্র্তায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর ওপর। তাদের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থার সাথে বড় অঙ্কের মুনাফাও রয়েছে; কিন্তু এসব কোম্পানি আটকে আছে পুঁজিতান্ত্রিক যুক্তিতে। বিজ্ঞানীদের জ্ঞান ব্যবহার করে নতুন কিছু উদ্ভাবনে কোনো মুনাফা নেই। ওষুধ কোম্পানিগুলো মুনাফার দিকে ছুটে চলে। নয়া উদারনৈতিক মতবাদের উদয়কালে, প্রায় ৪০ বছর আগে যেমনটা অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিম্যান বলেছেন, করপোরেশনের একমাত্র কাজ শেয়ারহোল্ডারদের দর বৃদ্ধি করা। ২০১৭ সালে প্যাথজেনের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ফাস্ট-ট্র্যাক গবেষণা প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে শীর্ষ ওষুধ কোম্পানিগুলো। গবেষণা প্রস্তাবে করোনাভাইরাসও ছিল। 

এরপরের প্রার্থী সরকার। বিভিন্ন সময় বহু ভ্যাকসিন ও ওষুধ তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও রেখেছে সরকার; কিন্তু সে পথও বন্ধ করে রেখেছে নয়া উদারনৈতিক মতবাদ। এ মতবাদের প্রচলন হয়েছিল রোনাল্ড রিগ্যানের সময় থেকে। সেসময় তিনি আমাদের বলেছিলেন, সরকারই একটি সমস্যা। অর্থাৎ, নাগরিকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো সরকারি নথি থেকে অবশ্যই সরিয়ে ফেলতে হবে। ব্যক্তিগত খাতকে নিরঙ্কুশ দায়মুক্তি দিতে হবে, যা নয়া উদারনীতিবাদের মূল উপাদান ও সুবিধাভোগী। সুতরাং সরকারকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যাবে।

তৃতীয় কারণ স্বতন্ত্র সরকারসমূহ। বিজ্ঞানসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোয় নজর রাখতে প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ প্রেসিডেন্টস কাউন্সিল অব অ্যাডভাইজর্স অন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (পিসিএএসটি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আরেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দায়ভার নেয়ার পর পিসিএএসটিকে মহামারি মোকাবেলার ওপর গবেষণা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। বিজ্ঞানমনস্ক ওবামা প্রশাসন মহামারি মোকাবেলার অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করেছে। এ কাজ চলে ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত। এরপর ক্ষমতায় আসে ট্রাম্প প্রশাসন। ট্রাম্প প্রশাসনের কার্যক্রম চালুর দিন কয়েকের মধ্যেই মহামারি মোকাবেলা সম্পর্কিত প্রস্তুতিসহ বিজ্ঞান বিষয়ক সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। চীনা সহকর্মীদের সাথে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন আমেরিকান বিজ্ঞানীরা। 

সেটি বন্ধ হয় ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে। সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনেও (সিডিসি) অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যখন আমেরিকায় মহামারির প্রকোপ তুঙ্গে সে সময় বাজেট প্রস্তাবে সিডিসির জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পে ভর্তুকি বাড়ানো হয়। পদ্ধতিগতভাবেই বিজ্ঞানীদের জায়গায় আসীন হয়েছেন শিল্প কর্মকর্তারা। জনগণের ওপর যে প্রভাবই পড়ুক না কেন সর্বোচ্চ মুনাফাটা নিশ্চিতভাবেই অর্জন করবেন তারা। 

ট্রাম্পের এসব সিদ্ধান্ত এসেছিল তার প্রিয় পণ্ডিত রাশ লিম্বার মতামত অনুসারে, যাকে তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম প্রদান করেছিলেন। তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, বিজ্ঞান হলো- ‘ছলনার চার কোণার মধ্যে একটি’, অন্য তিনটি হলো- শিক্ষা, মিডিয়া ও সরকার, এর সবই ‘প্রতারণার গুণে বিদ্যমান’। প্রশাসনের পথনির্দেশক অবস্থান হলো- ১৯৩৬ সালে যা ছিল ফ্রাঙ্কোর মূলমন্ত্র- ধীশক্তির পতন হোক! মৃত্যুর জয় হোক! ফলে যুক্তরাষ্ট্র মহামারির সময় ‘পদ্ধতিগতভাবেই অপ্রস্তুত’ ছিল। 

ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প বলেছিলেন, অলৌকিক উপায়ে একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে কভিড-১৯। তিনি ভুল ছিলেন। পরে চীনকে দোষারোপ করেন। এমনকি রোগটিকেও বর্ণবাদী চেতনায় ব্যবহার করেন। কেউ হয়তো বলবেন কভিড-১৯ মোকাবেলায় ট্রাম্পের পরিপূর্ণ ব্যর্থতায় তার হাত রক্তাক্ত। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

ট্রাম্প প্রধানত দায়বদ্ধ অতিধনী ও করপোরেশনের কাছে, যার কারণে লাখো মার্কিন নাগরিক মারা গেছেন। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পরও তার বিদ্বেষে ভাটা পড়েনি। গত ডিসেম্বরে প্রথম সংক্রমণ প্রকাশ্যে আসার কয়েক সপ্তাহ পর ভাইরাসের অস্তিত্ব চিহ্নিত ও জিনোমের বিন্যাস করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অবহিত করেন চীনা বিজ্ঞানীরা। এশিয়া ও ওশেনিয়ার দেশগুলো এ ব্যাপারে প্রায় একসাথে সাড়া দেয় ও পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। অন্যদের ক্ষেত্রে অবস্থা বিভিন্ন রকম ছিল। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস দুটিতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা মহামারি নিয়ে হোয়াইট হাউসকে নিয়মিত সতর্কবার্তা দিলেও আমলে নেননি ট্রাম্প। পুঁজিবাাজারে ধস নামলে টনক নড়ে তার; কিন্তু এত দিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে; লাখো মৃত্যু, সেই সাথে হু হু করে বাড়ে সংক্রমণের সংখ্যা। ট্রাম্প ও তার চাটুকাররা এখন আমেরিকানদের প্রতি তার অপরাধ ঢাকতে নানা অজুহাত দিচ্ছেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। প্রথমে অর্থায়ন বন্ধ করে পরে ডব্লিউএইচও থেকে বেরিয়ে আসায় এখন বিপাকে পড়েছেন আফ্রিকান, ইয়েমেনিসহ অন্যান্য দরিদ্র মানুষ, যারা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগেও নানা রোগ মোকাবেলায় ডব্লিউএইচওর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। করোনাকালে তো তাদের অবস্থা আরো সঙ্গিন। ডব্লিউএইচও চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন বলে অভিযোগ তুলেছেন ট্রাম্প। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা খুবই হাস্যকর। এই সংস্থা থেকে বেরিয়ে এসে চীনের প্রভাব আরো বাড়িয়ে দিলেন তিনি; কিন্তু বোকামির জন্য তার সমালোচনা করাও অন্যায়। এর ফলাফল আমাদের দেখায়- তিনি কখনোই এ বিষয়টিকে প্রথম স্থানে রাখেননি। 

অদক্ষ ট্রাম্প ছাড়া কীভাবে আমরা ও বিশ্ব উভয়ই আরেকটি মহামারি মোকাবেলা করতে পারি? ভবিষ্যতের প্রস্তুতি হিসেবে কি কি করতে হবে?

আমার মনে হয় এক্ষেত্রে ‘অদক্ষ’ সঠিক শব্দ নয়। ট্রাম্প তার প্রাথমিক লক্ষ্যপূরণে বেশ দক্ষ। যেমন- সম্পদ বৃদ্ধি, করপোরেট ক্ষমতা ও মুনাফা অর্জন। যেকোনো কার্যকর প্রতিষ্ঠান নিমেষে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম ট্রাম্প। কংগ্রেসনাল রিপাবলিকানদের এমনভাবে আতঙ্কিত করে রেখেছেন, তার প্রায় সব পদক্ষেপই নির্দ্বিধায় মেনে নেন তারা। এমনকি ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজে জড়িত বিজ্ঞানীদের যখন ট্রাম্প চাকরিচ্যুত করেন, তখনো টুঁ শব্দ শুনিনি তাদের মুখে। এছাড়া সবচেয়ে সম্মানিত রিপাবলিকান সিনেটর ৮৬ বছরের চাক গ্রাসলিকেও মারাত্মক অপমান করেছেন তিনি। গ্রাসলি এই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তার দীর্ঘ পেশা জীবন ব্যয় করেছেন। এগুলোকে দারুণ কৃতিত্ব বলা যায় বৈকি! আর পরবর্র্তী বৈশ্বিক মহামারি রুখতে কি করতে হবে, তা নিয়ে তো বিজ্ঞানীরাই উপদেশ দিচ্ছেন। সেগুলো মেনে চলতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পরবর্তী মহামারি আরো খারাপ আকার ধারণ করতে পারে। এজন্য প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। করোনাভাইরাস ও অন্যান্য সম্ভাব্য প্রতিকূলতা অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থাকা উচিত। এছাড়া রোগ উপশমে ভ্যাকসিন ও ওষুধ উৎপাদনে বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়াটা খুব দরকার। আর কিছু পরিকল্পনা নেয়া জরুরি, আরেকটি মহামারি শুরু হলে তা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

নোম চমস্কি

বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে নয়া উদারনৈতিক মতবাদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতে এ মতবাদের কারণে করুণ পরিণতি দেখা যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোর ব্যবসা মডেল যেন কোনো কারণ ছাড়াই বিপর্যয়ের জন্য আমন্ত্রণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণভাবে বললে, অকার্যকর বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সমাজের জন্য বোঝা। ল্যানসেটের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোর বার্ষিক ব্যয় প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলার, সেইসাথে রয়েছে ৬৮ হাজার অতিরিক্ত মৃত্যু। যুক্তরাষ্ট্র সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে দেশটি অন্য সমাজের সমপর্যায়ে উন্নীত হতে পারে না, বরং এর পরিবর্তে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষত জরুরি সেবা সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও ব্যয়বহুল ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। আপনি যদি স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারেন, তাহলে এর বিনিময়ে থাকবে একটি স্বাস্থ্যকর বিল।

এই নয়া উদারনৈতিক মতবাদের কারণেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথের গবেষণা, ওষুধ উন্নয়ন থেকে পরীক্ষা ও বণ্টন বাধাগ্রস্ত হয়। সেইসাথে মার্কিন আইন ক্রমাগত উপেক্ষা করে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। সরকারি সহায়তায় উৎপাদিত ওষুধ (কার্যত সব ক্ষেত্রেই) যুক্তিসঙ্গত দামে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। এই বিষয়গুলোর সম্পর্কে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে ডিন বেকারের গবেষণা, যিনি এমন কিছু পদক্ষেপের কথা বলেছেন, যা চালু করা হলে উদ্ভাবনের কোনো ক্ষতি ছাড়াই বিপুল সঞ্চয় সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আরো অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ও রয়েছে। সেগুলোতেও গুরুত্ব দিতে হবে।

নভেম্বরে নির্বাচনের সময় খুব কাছে চলে এসেছে। ক্ষমতা ধরে রাখতে ট্রাম্প কি ভোট জাালিয়াতির শরণাপন্ন হবেন? তা-ই যদি হয়, রাজনীতির খেলায় আপনি এটিকে কীভাবে দেখছেন?

ট্রাম্প ও তার সহযোগীরা এরই মধ্যে এ কাজ করতে শুরু করেছেন। এটিই প্রথম নয়। তারা জানেন, তাদের দলটি সংখ্যালঘু। আর রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখতে জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় অবশ্যই নিতে হবে। তাদের জন্য অনেক কিছুই ঝুঁকির মধ্যে আছে। কোনো প্রজন্মের জন্য নেয়া তাদের ডানপন্থী নীতিগুলোই আরো চার বছর ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হবে। দেশের জনগণ কি চায়, তার কোনো গুরুত্ব নেই। এটা হলো বিচারব্যবস্থায় ম্যাককনেলের কৌশল। এ ব্যবস্থায় উচ্চ থেকে নিম্ন পর্যায়ের সব কার্যক্রম থাকে তরুণ ডানপন্থী বিচারকদের হাতে, যারা জনস্বার্থে বিশেষায়িত কর্মসূচিগুলোয় বাধা দিতে পারে। হারানো বর্তমান সুযোগগুলো তাদের সর্বনাশ করে দিতে পারে। এতে ব্যক্তি ট্রাম্পের জন্য ক্ষতির সম্ভাবনা আরো তীব্র, এমনকি তিনি যদি এটিকে সাধারণ মানুষের মতো মনস্তাত্বিকভাবে গ্রহণ করতে সক্ষম হন তবুও। তার অনাক্রম্যতা হারালে তিনি গুরুতর আইনি অভিযোগের শিকার হতে পারেন। উত্তর কোরিয়ার রীতিতে রিপাবলিকান পার্টি আত্মসমর্পণ করেছে তার কর্তৃত্বের কাছে। তাই তাকে প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়েছে কমই। বাকিটা কল্পনা করে নিতে পারি আমরা।

আমার কাছে এটিকে ডিস্টোপিয়ান মনে হচ্ছে। তবে ক্ষমতালোভী ট্রাম্প যে ক্ষমতা ধরে রাখতে মিলিশিয়া বাহিনীকে ব্যবহার করবে না, তা কে বলতে পারে? কোনো ধারণা...

এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ মেয়াদি সাংবিধানিক সংকটের মুখে রয়েছে। সিনেট মৌলিকভাবে অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, কিছুটা হলেও ইলেক্টোরাল কলেজ। জনতাত্ত্বিক ও কাঠামোগত কারণে শ্বেতাঙ্গ, ক্রিশ্চিয়ান, গ্রামীণ, ঐতিহ্যবাহী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যকারী ভোটাররা সংখ্যালঘু হয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। নিক্সনের ‘সাউদার্ন স্ট্র্যাটেজির’ আগে যেমনটি করেছিলেন বর্ণবাদী সাউদার্ন ডেমোক্র্যাটরা। এই কার্যক্রম তাদের রিপাবলিকান হতে ভূমিকা রেখেছিল। এটি সাংবিধানিক সংশোধনী দ্বারা কার্যত অপরিবর্তনীয়। ট্রাম্পের হাত ধরেই এই আসন্ন সংকট শিগগিরই আসতে পারে। 

নিজের কথা বলা আপনার বিশেষ পছন্দ নয়, জানি; কিন্তু এই ৯১ বছর বয়সে আপনি কীভাবে কভিড-১৯ মোকাবেলা করছেন?

এটা আমার ও আমার স্ত্রীর জন্য কঠিন কোনো সমস্যা নয়। অনেকের জন্য এটি একেবারেই আলাদা একটি গল্প। এই মুহূর্তটি প্রকৃত অর্থেই পরাবাস্তব। এই সংকট থেকে উত্তরণের পথই ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। যারা এই মহামারির জন্য দায়ী, তারা বসে নেই। নিজ স্বার্র্থে তৈরি করা কঠোর ও কর্র্তৃত্ববাদের সংস্করণ নিশ্চিতে নিরলস কাজ করছে তারা। একটি চড়া মূল্যের বিনিময়ে মহামারি থেকে পরিত্রাণ পাবো আমরা। ট্রাম্প অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে দিলেও পারমাণিক যুদ্ধ আমরা এড়াতে পারি; কিন্তু বর্তমান রীতিতে চলতে থাকলে পোলার বরফ গলে যাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন থেকে পরিত্রাণ মিলবে না। আরো চার বছর ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকলে বিপর্যয় আরো বাড়বে।

(ঈষৎ সংক্ষেপিত)


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //