সাক্ষাৎকার
শাহেরীন আরাফাত
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:৫৮ পিএম
আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০২:৫৮ পিএম
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:৫৮ পিএম
সাক্ষাৎকার
শাহেরীন আরাফাত
আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০২:৫৮ পিএম
সম্প্রতি ভারত-চীন দ্বন্দ্ব এবং বাংলাদেশ ও ভূ-রাজনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে সবিস্তারে কথা বলেন ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতিতে পরিবর্তন, ক্রসফায়ার এবং সাংবাদিকতার সংকট নিয়েও মতামত তুলে ধরেন।
প্রশ্ন: সম্প্রতি ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় আপনার একটি বিশ্লেষণ প্রকাশের পর, এটিকে কেন্দ্র করে ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় কল্লোল ভট্টাচার্য একটি কলাম লিখেন। আপনার ওই প্রতিবেদনটি সাংবাদিক ও কূটনৈতিক মহলে বেশ আলোচিত হয়। দুটি লেখাতেই ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উষ্ণতা কমে যাওয়া’র বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। আবার সেখানেই চীন-পাকিস্তানের প্রসঙ্গও আলোচিত হয়। আঞ্চলিক পর্যায়ে একদিকে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব, আবার অন্যদিকে বৈশ্বিক পর্যায়ে চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্ব সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। আমাদের দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের কথা আপনার লেখাতেও উঠে এসেছে। ভূরাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়গুলোকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
শ্যামল দত্ত: আমি যে লেখাটি লিখেছি, সেটি ছিল মূলত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপ প্রসঙ্গে। সেখানে রাজনীতিতে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত আছে। দীর্ঘদিন ধরে আমি কূটনীতি বিষয়ক সাংবাদিকতা করেছি, সেইসঙ্গে এ বিষয়ে নিজের একটা আগ্রহও রয়েছে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছু অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চীন এবং পাকিস্তান কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে, যে কারণে গত ছয় মাসে তিনবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। এগুলোকে আমি মনে করি, একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত। সরকারের যে পর্যায়েই হোক না কেন, কিছু পরিবর্তন তো হয়েছে। না হলে যেখানে দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কই ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল, সেখানে এই আলোচনা হতো না। এ ক্ষেত্রে কার কি ভূমিকা সে বিশ্লেষণে আমি যাইনি। তবে আমি এটুকু দেখেছি যে, বাংলাদেশে নীতিগত কিছু পরিবর্তন আসছে। তার নেপথ্যের কারণগুলো হয়তো ভিন্ন আলোচনার দাবি রাখে।
আমার লেখাটি নিয়ে দিল্লিতে কল্লোল ভট্টাচার্যই শুধু না, আরও কয়েকটা মিডিয়ায় লেখালেখি হয়েছে। পাকিস্তানের ডন পত্রিকাতেও ওই লেখার রেফারেন্স দিয়ে কলাম লেখা হয়েছে। এমনকি আমি পাকিস্তানের টিভি চ্যানেল থেকে টকশোতে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণও পেয়েছি। এগুলোকে লেখাটির একটি উপমহাদেশীয় প্রতিক্রিয়া বলতে পারেন। নিশ্চয়ই লেখাটিকে সবাই সিরিয়াসলি নিয়েছেন। বাংলাদেশেও কয়েকটি পত্রিকাতে এ নিয়ে লেখা এসেছে।
আমি মনে করি, আমরা একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বাস করি। এখানে মত প্রকাশ এবং ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। আমার কথাই একমাত্র সত্য- আমি সেটি বিশ্বাস করি না, করতে চাইও না। ভিন্নমত থাকবে। এটিই কিন্তু গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। গণতন্ত্রে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রকম মতামত থাকবে। আমি যে বিশ্লেষণ করেছি, এর বাইরেও বিশ্লেষণ থাকতে পারে। তবে আমি দেখতে পাচ্ছি, এ অঞ্চলে এবং এর বাইরেও চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিশেষত দক্ষিণ চীন সাগরকে কেন্দ্র করে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটা টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে তাইওয়ান, হংকং ইস্যুও রয়েছে। এখানে গালওয়ানে চীন-ভারত সংঘর্ষের পর দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ভিন্নমাত্রায় দাঁড়াচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীন সম্পর্কোন্নয়ন করেছে। ফলে চীন এখন এ অঞ্চলে আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব রাখতে পারছে। ভুটান-নেপালের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অনেক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তো আগে থেকেই ছিল।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও একটি পরিবর্তন এসেছে। এক সময় বিশ্ব ছিল ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ কবলে। সোভিয়েতের পতনের পর সে অবস্থার পরিবর্তন হয়। এখন যে নতুন একটি ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে, আমার মতে সেটির ধরন একটু ভিন্ন। এখানে চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মার্কিন-চীন দ্বন্দ্বের সঙ্গে আমরাও কোনো না কোনোভাবে জড়িত। আর এসব কারণেই আমাদের এখানেও পরিবর্তন ঘটছে বলে আমি মনে করি।
প্রশ্ন: আমরা দেখছি, ভারত সম্পর্কোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশে যেমন উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতিক পাঠিয়েছে; একইভাবে নেপালেও তারা শীর্ষ কূটনীতিক পাঠিয়েছে। এ বিষয়গুলোকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
শ্যামল দত্ত: আপনি হয়তো জানেন, গত সোমবার (১০ আগস্ট) ভারতের মন্ত্রিসভা বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়- নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে হবে। তারা নিজেরাও বুঝতে পেরেছে, সম্পর্কের কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। এই ঘাটতির কারণ নানাবিধ। আমি সে আলোচনায় যাচ্ছি না। আমার ধারণা, তারই আলোকে সাম্প্রতিক এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। সম্প্রতি একটি বিতর্কিত অঞ্চলকে নিজেদের মানচিত্রে দেখিয়েছে নেপাল। এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব আছে। আবার এ ক্ষেত্রে চীনের একটা ভূমিকা আছে। নেপালের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিতে কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী অলির নেতৃত্বাধীন গ্রুপ চীনের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ। আবার মাধব কুমার নেপালের নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ আছে, যারা চীনের সঙ্গে এত মাখামাখির পক্ষে না। তবে অলি সরকার ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্ট কাজে লাগাচ্ছে। সম্প্রতি অলির বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব আনার চেষ্টা করছিল কমিউনিস্ট পার্টির একটি গ্রুপ। সেটি ঠেকানোর জন্য সেখানকার চীনা রাষ্ট্রদূত (হু ইয়ানচি) সংসদ সদস্যদের বাড়িতে পর্যন্ত গিয়েছেন। চীন একসময় এমনটা করত না- তারা স্থানীয় রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখত; কিন্তু গত পাঁচ-সাত বছরে দেখা গেছে, চীন এখন রাজনৈতিক ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
প্রশ্ন: যে ভ্যাকসিন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী চলছে, সেটি কোনদিকে যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন? অনেক দেশ ভ্যাকসিনের আগাম অর্ডার দিয়ে রেখেছে। সে ক্ষেত্রে এ যুদ্ধে আমরা পিছিয়ে পড়লাম কি না?
শ্যামল দত্ত: বাংলাদেশের ভ্যাকসিন অর্ডার দেওয়ার প্রয়োজনই নেই। ভ্যাকসিন নিতে হলে ওয়ার্ল্ড ভ্যাকসিন অরগানাইজেশনের (গ্যাভি) অনুমতি লাগবে। সেখানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো অগ্রাধিকার পাবে। আর বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে পুরস্কৃত। কয়েকটি রোগের টিকা আমরা এত সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছি, যা তৃতীয় বিশ্বের অন্য কোনো দেশ পারেনি। আমাদের একটি শক্তিশালী ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা রয়েছে। বাংলাদেশ গ্যাভিতে ইতোমধ্যে ৫০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করেছে। মাস দুয়েক আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে গ্যাভির সভায় অংশগ্রহণও করেছেন। তাই এটি ঠিক নয় যে, বাংলাদেশ ভ্যাকসিন নিয়ে কিছু করেনি।
আবার ভ্যাকসিন যে কবে আসবে, সেটি নিয়েও কিন্তু বলা কঠিন। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতামত হলো- ভ্যাকসিন বাজারে আসতে অনেক সময় লাগবে। হ্যাঁ, ইতোমধ্যে একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে; কিন্তু সেটি শুধুই প্রতিযোগিতা। মানুষের শরীরে প্রয়োগ পর্যায়ে আসার যে সময় নির্ধারণ করা হচ্ছে, তা নিয়ে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ডব্লিউএইচওর অনুমোদন ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে কেউ মানবদেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে পারবে না। হয়তো টেস্টিংয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তার মানে ভ্যাকসিন আসাটা সময়সাধ্য ব্যাপার। কোনো ভ্যাকসিনই পরীক্ষার তৃতীয় পর্যায় অতিক্রম করেনি। তৃতীয় পর্যায়টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ পর্যায় দেড়-দুই মাস চলার পর এর ফলাফলের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক অনুমোদনের বিষয়টি আসবে। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশ গ্যাভির সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। ট্রায়াল পর্যায়ে আমরা হয়তো যাইনি। আগাম অর্ডার দেওয়ার কোনো দরকার নেই। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটসহ আরও অনেকেই কোটি কোটি ডোজ তৈরি করবে। বিশ্বের ৬০ শতাংশ ভ্যাকসিনই ভারতে উৎপাদিত। বাংলাদেশে শুধু দুটি প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। তারাও এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বমূলক উৎপাদনে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
এ মুহূর্তে ভ্যাকসিন নিয়ে দৌড়াদৌড়ির চেয়ে বেশি জরুরি হলো- আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরা, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যে জোর দেওয়া, যেখানে আমাদের ঘাটতি আছে। আবার চীনের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অপেক্ষায় আছে। এর মধ্যে ভারতীয়রাও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করতে চায় বলে জানিয়েছে। বিভিন্ন দেশে এ ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল চলছে। ট্রায়াল সেখানেই চালানো হয়, যেখানে আক্রান্তের হার বেশি। বাংলাদেশে আক্রান্তের হার অনেক বেশি। তাই বাংলাদেশে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল চলতে পারে। তবে এ বছর শেষের আগে কোনো ভ্যাকসিন চূড়ান্ত হবে বলে মনে করি না। তাই বাংলাদেশের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না বলেই মনে করি।
প্রশ্ন: করোনাকালে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের বেতন কমেছে। আমরা দেখেছি, করোনাকালে বিভিন্ন জায়গায় দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে খবর প্রকাশের জের ধরে সাংবাদিকের ওপর হামলা চালানো হয়েছে, মামলা দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের ওপর সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। ফলে সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সরশিপের মধ্যে আছেন। করোনাকালে সাংবাদিকতার এসব সংকটকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
শ্যামল দত্ত: এটি আসলে একটি চ্যালেঞ্জ। এটি শুধু বাংলাদেশের একার বিষয় নয়। কভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকেই সারাবিশ্বের সাংবাদিকদের জন্যই নানামুখী চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। তবে বাংলাদেশের সংকট আরও বেশি। কারণ, এখানে এ ক্ষেত্রটি একদমই অনিয়ন্ত্রিত। প্রথম থেকেই নীতি-নির্ধারণে আমাদের কিছু ত্রুটি ছিল। এখানে প্রিন্ট পত্রিকা, অনলাইন, টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিটি মাধ্যমেই সংকট আছে। ব্যবসা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সংবাদমাধ্যম কীভাবে চলবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছিল না। এর মধ্যে প্রত্যেককেই নিজের মতো করে কৌশল নির্ধারণ করতে হয়েছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এমনিতেও চ্যালেঞ্জিং। যেখানে গণতন্ত্র এখনো শক্ত ভিত পায়নি, সেখানে সাংবাদিকতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ তো বটেই।
আপনি দেখবেন যে, সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন (নোয়াব) সংবাদকর্মীদের সহায়তায় একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে; কিন্তু এ প্যাকেজ দিয়ে মিডিয়া টিকিয়ে রাখা সম্ভব কীভাবে? এ সংকট এর চেয়ে অনেক বড়। অনেক ছোটখাটো পত্রিকা এ সময়ে বন্ধ হয়ে গেছে। কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরুর পর অনেক বাড়িতে পত্রিকা ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এমন প্রচারণা ছিল যে, পত্রিকার সঙ্গে করোনাভাইরাস চলে যাবে। পত্রিকার সার্কুলেশন যদি না থাকে, তাহলে পত্রিকা চলবে কি করে। এখন কিন্তু নতুন কোনো প্রডাক্ট নেই, নতুন কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম নেই। আর বিজ্ঞাপন ছাড়া মিডিয়ার আয় তো বন্ধ। এটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের অংশ। অনেকেই এটিকে বলছেন- ‘নিউ নরমাল’, করোনা-পরবর্তী অবস্থা। এ অবস্থায় মিডিয়া কীভাবে চলবে, সেটিরও একটি নীতিগত অবস্থান মিডিয়ার নীতি-নির্ধারণী ব্যক্তিদের ঠিক করতে হবে।
হ্যাঁ, সাংবাদিকদের ওপর হামলা-মামলা হচ্ছে। এ হামলা-মামলা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এটি আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এখানে সাংবাদিকদের নিজস্ব কোনো শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম নেই। প্ল্যাটফর্মগুলো দ্বিধাবিভক্ত। সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভক্ত, মালিকদের সংগঠন বিভক্ত, রিপোর্টারদের সংগঠনও বিভক্ত। যে কারণে একক জায়গা থেকে পুরো বিষয়টি মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এ কারণে সরকার ও অন্যান্য মহল থেকে নানা রকমের হুমকি-ধমকি আসতেই থাকে। আর এগুলোকে মোকাবেলা করেই আমাদের এগোতে হবে।
তবে আমাদের নিজেদের এটি ঠিক করতে হবে যে, নতুন বাস্তবতায় মিডিয়া কীভাবে টিকে থাকবে। অনেকেই বলছেন সাবস্ক্রিপশনের দিকে যাওয়ার কথা। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকা এখন সাবস্ক্রিপশনে চলে গেছে। আপনাকে এখন অনলাইনে তাদের পত্রিকা পড়তে হলে টাকা দিয়ে সাবস্ক্রাইব করতে হবে। এমন একটা চিন্তা-ভাবনা টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। আমরা তো ফ্রি দেখি। এই যে বাংলাদেশের ৩০-৪০টি টেলিভিশন চ্যানেল আমরা দেখছি। তার জন্য কিন্তু একটি টাকাও চ্যানেলগুলো পাচ্ছে না। ক্যাবল অপারেটররা পয়সা নিয়ে যাচ্ছে। এ থেকে যদি এক টাকা করেও চ্যানেলগুলো পেত, তাহলে কিন্তু তাদের একটি নিজস্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠত। সারাবিশ্বেই কিন্তু প্রিন্ট পত্রিকার সংখ্যা কমে আসছে। মানুষের এখন পুরো পত্রিকা পড়ার সময় নেই। নতুন জেনারেশনকে আপনি পত্রিকা পড়াতেই পারবেন না। তারা আপডেটেড থাকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর পেয়ে যায়; কিন্তু খবরের ভেতরে ঢুকতে চায় না। সে সময়টা নেই। মানুষের জীবনযাত্রা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। আমরা অনেকটা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে যাচ্ছি। তাই এগুলো মাথায় রাখতে হবে যে, আজ থেকে ২০-৩০ বছর আগের বাস্তবতা আর আজকের বাস্তবতায় অনেক পার্থক্য এসেছে। লাইফস্টাইল পরিবর্তিত হয়েছে অনেক। এর সঙ্গে মিলিয়ে আমাদের নিজস্ব গণমাধ্যম কৌশল নির্ধারণ করতে হবে বলে আমি মনে করি।
প্রশ্ন: করোনাকালেও আমরা দেখছি, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নামে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
শ্যামল দত্ত: সংবাদমাধ্যম তো আর ‘ক্রসফায়ার’ করে না, বন্ধও করতে পারবে না। এটি বন্ধ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সম্প্রতি এ বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে মেজর (অব.) সিনহা রাশেদের ক্রসফায়ারের পর। আমি নিজেও এ নিয়ে লিখেছি। সেখানে এক বছরে প্রায় ১৪৫ জনকে ‘ক্রসফায়ার’ দিয়েছে শুধু পুলিশ। এর বাইরে র্যাবের ‘ক্রসফায়ার’ আছে। এমনকি টেকনাফে যোগাযোগ করে আমি শুনলাম, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পর্যন্ত সেখানে ‘ক্রসফায়ার’ দেয়। সেখানে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ারে ৪০-৫০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। ক্রসফায়ার নিয়ে আমাদের এখানে এক অদ্ভুত রকমের সাইকোলজি কাজ করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এর এক ধরনের জনপ্রিয়তাও আছে, আবার সুশীল সমাজের মধ্যে এর তীব্র সমালোচনাও আছে। এমনকি আমি দেখেছি, কোনো কুখ্যাত সন্ত্রাসীর ক্রসফায়ারের পর আনন্দ মিছিলও বের হয়েছে, মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। এটিই বাস্তবতা। এর মূল কারণ হলো- মানুষের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি কোনো আস্থা নেই। তারা মনেই করে না যে, প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় কোনো সন্ত্রাসীর শাস্তি হবে। ফলে যখন ওই সন্ত্রাসীদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে, তখন তারা এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করে। আমাদের অবশ্যই এ সমস্যার মূল ভিত্তিটুকু বুঝতে হবে।
টেকনাফ বা বাংলাদেশের যেখানেই এমন ঘটনা ঘটুক না কেন, গণমাধ্যমকে এসবের বিরুদ্ধে আরও সোচ্চার হতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। এক সময় লাতিন আমেরিকায় যখন বাম আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তখন তা দমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন দমনেও তৎকালীন ইন্দিরা সরকার ‘এনকাউন্টার’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। মুম্বাইয়ে এক সময় পুলিশের এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট গ্রুপ গঠন করা হয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ে এগুলো হয়েছে; কিন্তু এটি কোনো সমাধান না। সমাধান খুঁজতে হবে প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যেই। এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ারে কোনো সমাধান কিন্তু আসেনি। সমাজের ভেতর থেকেই সমাধান খুঁজতে হবে। সমাজের বাইরে থেকে কোনো সমাধান আরোপ করা যায় না।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : সাক্ষাৎকার চীন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh