‘রাষ্ট্রের বেশির ভাগ মানুষই কোনো না কোনোভাবে বঞ্চিত’

ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা মুফতি ফয়জুল্লাহ। বিভিন্ন সময়ে বিতর্কের কারণে আলোচনায় থেকেছেন। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেল বয়কটের দাবি তোলার কারণে রয়েছেন আলোচনায়।

তিনি ইসলামী ও জাতীয় রাজনীতি এবং সমসাময়িক বিষয়াবলি নিয়ে কথা বলেছেন সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহমুদ সালেহীন খান

সম্প্রতি আপনি ৭১ টিভি বয়কটের ডাক দিয়েছেন; কিন্তু কেন?

একটি গোষ্ঠীর প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ৭১ টিভিকে। শুরু থেকেই বিভিন্ন সময়ে নানা ইস্যুতে অযথা ও প্রসঙ্গহীনভাবে ইসলামকে টেনে এনে হেয়প্রতিপন্ন করা এবং ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের সহযোগিতার জন্য চ্যানেলটি ব্যবহার করা হচ্ছে। কোরআন ও হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রচার করাই যেন তাদের একমাত্র এজেন্ডা। শুরু থেকেই এই কাজটি করে এলেও এবার জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছি চ্যানেলটিকে বয়কট করার জন্য। আমাদের এই ডাকে সাড়া দিচ্ছেন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।

৭১ টিভির একটি প্রতিবেদনে ওয়াজের একাংশ শোনানো হয়- লেখাপড়া কিংবা চাকরি করা নারীর কাজ নয়, নারীর প্রধান কাজ পুরুষকে তৃপ্তি দেয়া। তাদের ভাষ্যমতে, সারাবছর ওয়াজ মাহফিলে এসব কথা বলেন আলেম-ওলামারা, যা তাদের ভক্তদের ধর্ষণ কিংবা নারীকে অপদস্ত করার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। ওয়াজ-মাহফিল নিয়ে এরকম ভিত্তিহীন মন্তব্যে এবার দেশজুড়ে ক্ষেপেছে আলেমসমাজসহ সাধারণ জনগণ।

ওয়াজ-মাহফিল নিয়ে আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। এই বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা দেবেন?

ওয়াজ-মাহফিল হলো সবচেয়ে বড় গণসমাবেশ। কোনো কোনো বক্তা মাহফিলে বেফাঁস ও ভুল কথা বলেন, এটি যেমন সত্য; বেশিরভাগ মাহফিলে ভালো ভালো কথা বলা হয়, সেটি তার চেয়েও সত্য। ৭১ টিভি খুঁজে খুঁজে আপত্তিকর কথা যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে, মাহফিলের হাজারো ভালো কথার একটিও কি কখনো প্রচার করেছে? কোনো কোনো মূর্খ বক্তা ওয়াজ-মাহফিলে নারীকে নিয়ে বেফাঁস কথা বলে এটি অসত্য নয়। তাই বলে সেসব বক্তব্যের কারণে ধর্ষকরা নারী ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ হয়েছে- টিভি চ্যানেলটি কীভাবে এই মিথ্যাচার ও নোংরা মন্তব্য করতে পারে? এ থেকেই বোঝা যায় চ্যানেলটির উদ্দেশ্য সৎ নয়।

ওয়াজ মাহফিল থেকে ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ হয়েছে- এমন জবানবন্দি কি আজ পর্যন্ত কোনো ধর্ষক থেকে পাওয়া গেছে? ধর্ষক কখনো ওয়াজ-মাহফিলে যাক বা না যাক- ৭১ টিভির মতো চ্যানেলগুলো অবশ্যই দেখে। এসব চ্যানেল যেভাবে নারীকে পণ্য ও ভোগ্যবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করে, তা থেকেই বরং ধর্ষকদের উৎসাহিত হওয়ার কথা। করোনাভাইরাস মহামারিতে আমাদের দেশসহ সমগ্র বিশ্ব যখন উদ্বিগ্ন, তখনো তারা নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।

কী ধরনের বিভ্রান্তি, একটু ব্যাখ্যা করুন

করোনাকালে ৭১ টিভি একটি টকশোতে আক্রান্ত মানুষগুলোর মরদেহ দাফন না করে পুড়িয়ে ফেলার দাবি তুলেছিল। এতে নাকি ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা কমে যায়। যেখানে চিকিৎসকরা সবাই একমত ছিল- রোগী মারা যাওয়ার ২-৩ ঘণ্টা পর মরদেহ থেকে আর ভাইরাস ছড়ায় না, সেখানে ৭১ টিভি মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার কথা বলে আসছিল। এখানেও তাদের সূক্ষ্ম ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব ছিল। করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিকে জানাজা ও কবর না দিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলার অনৈসলামিক প্রস্তাব তারা দিয়েছিল।

আপনারা তো তখন কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি দেননি। বরং নীরব ছিলেন। আমরা দেখেছি ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ মরদেহ জানাজা ও দাফনে অংশ নিয়েছেন। এটিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

ঢালাওভাবে অভিযোগটি সত্য নয়। তখন সবার মধ্যে ভয় কাজ করছিল। অনেক আলেম-ওলামাই জানাজা পড়িয়েছেন, দাফনে অংশ নিয়েছেন; কিন্তু সেগুলো খবরে আসেনি। আমি এটিকে মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবই বলবো। 

৭১ টিভির মতো একটি সংবাদমাধ্যমকে বয়কটের ঘোষণার মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করছেন কি?

রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় সংবাদমাধ্যমকে। সংবাদমাধ্যমের কাজ কী? বস্তু ও সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করা; কিন্তু আপনি দেখবেন ৭১ টিভি ইসলামকে ভুলভাবে প্রচার করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ নাগরিক মুসলমান। সেখানে কোরআন ও হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা, প্রচার করার কোনো অধিকার নেই কারও। ইতিপূর্বে তারা আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসায় জঙ্গি কানেকশন আছে বলে ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রচার করেছে, করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য মুসলমানদের সম্মিলিত দোয়া অনুষ্ঠানকে কটাক্ষ করে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে ধমক দিয়েছিল ৭১ টিভির অনুষ্ঠানে। এক সময় চার-পাঁচজন ‘আধা নাস্তিক’কে বসিয়ে মাত্র একজন আলেমকে টকশোতে এনে নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা করা হয় এই টিভির অনুষ্ঠানে। পাঠ্যপুস্তকে ইসলামী চেতনাবিরোধী অধ্যায়ের বিরুদ্ধে হেফাজতের বক্তব্য সরকার মেনে নেয়ায় চরম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল এই চ্যানেলটি। সম্প্রতি এই চ্যানেল ওয়াজ-মাহফিলকে ধর্ষণের কারণ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। তাই আমরা এবার এই চ্যানেলটি জোরালোভাবে বয়কটের ডাক দিয়েছি।

তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমের ওপর আপনাদের কোনো ক্ষোভ নেই...

আমরা সংবাদমাধ্যমের মত প্রকাশের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করছি না। শুধু বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিয়ে জনমত তৈরি করতে চাইছি- নবীর বিরুদ্ধে, কোরআনের বিরুদ্ধে যে কোনো অপপ্রচার হলে যেন ওই সংবাদমাধ্যমকে তারা বয়কট করেন।

ধর্মীয় ইস্যু ছাড়া, জাতীয় কিংবা জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে আপনাদের কর্মসূচি থাকে না, সেটির কারণ কি ব্যাখ্যা করবেন? 

আপনার এই কথাটির সাথে আমি একমত নই। আমাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি কম নয়। আমাদের সব বিষয়ে কর্মসূচি থাকে; কিন্তু ধর্মীয় ইস্যুর কর্মসূচি বেশি আলোচিত হয়। অন্য ইস্যু কম আলোচনায় আসে বলে অনেকে মনে করেন- আমরা দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলি না। আপনারা, সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা আমাদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন বলে আমাদের জনসম্পৃক্ত কর্মসূচিগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেন না। আপনারা মুখিয়ে থাকেন আমরা ধর্মীয় ইস্যুতে কোনো বক্তব্য দেই কি-না, তার জন্য।

অনেকদিন থেকেই দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। এটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

নিষিদ্ধের দাবি সাধারণ নাগরিকদের নয়। তারা ধর্মপ্রাণ। অবশ্যই এসব দাবি বামপন্থীদের। ইসলামি রাজনীতি নয়; বরং বামপন্থী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। তাদের কারণে দেশে কোনো উন্নতি হয় না। সমৃদ্ধিও হয় না। তাদের কারণে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়। বামপন্থীদের কারণে এ দেশের ওপর আল্লাহর রহমত বন্ধ থাকে। তাদের রাজনীতি সমাজ ও দেশের জন্য অকল্যাণের, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।

দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনাদের মূল্যায়ন কী?

বাস্তবতা হলো- দেশের মানুষ চরমভাবে হতাশ। তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। সরকার যতই উন্নয়নের কথা বলুক না কেন, রাষ্ট্রের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষই শুধু সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। রাষ্ট্রের বেশির ভাগ মানুষই কোনো না কোনোভাবে বঞ্চিত এবং নির্যাতিত। মানুষ মনে করছে, তারা তাদের রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছে।

দেশে আপনারা কি কখনো এককভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন?

আমরা এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, বরং ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করি। আর এর জন্য আমাদের শক্তি-সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি প্রয়োজন আল্লাহপাকের সাহায্য। আল্লাহপাকের সাহায্য পেলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।

যে দেশে ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান, সেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন উঠছে কেন?

দেখুন, আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থা কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী পরিচালিত হয় না। দেশের অনেক নাগরিকের মধ্যেই ইসলামের অনুশাসনের চর্চা নেই। আমরা এই জিনিসটিই প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছি।

আপনারা তো অনেক বছর ক্ষমতার অংশিদারিত্বে ছিলেন, তখন পারেননি কেন?

এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা নিজেদের ঐক্য ধরে রাখতে পারিনি।

ঐক্য ধরে রাখতে প্রতিবন্ধকতা কোথায়?

সত্যিকার অর্থেই যারা ইসলাম চায়, সময়ের ব্যবধানে আজ হোক কাল হোক, তাদের মধ্যে ঐক্য হয়ে যাবে।

আপনারা লক্ষ্য করছেন, ইসলামী সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ না হলেও ইসলামী জনতা কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। মানুষ এখন অনেক সচেতন, কার মত কী, তা মানুষ বুঝতে পারে। ঐক্যের ব্যাপারে আমাদেরও পরিকল্পনা আছে। তবে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে আমরা সতর্কভাবে অগ্রসর হচ্ছি।

আপনাকে ধন্যবাদ। 

আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //