‘স্বাস্থ্য উন্নয়নকেন্দ্রিক সেবার পুনর্গঠন জরুরি’

জনস্বাস্থ্য ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট- আইইডিসিআরের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তিনি দেশের সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতি, দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা এবং করোনার টিকার বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনিন্দ্য আরিফ

ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ডা. মুশতাক হোসেন: করোনার প্রথম ঢেউ এখনো বিদ্যমান আছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের লক্ষণ দেখা গেলেও এখনো তা বাংলাদেশে আসেনি। প্রথম ঢেউ ধীরে ধীরে কমে আসছে। মাঝখানে যে সংক্রমণ শনাক্ত এবং মৃত্যুর হার কিছুটা বেড়েছিল। সেটাকে ঠিক দ্বিতীয় ঢেউ বলা যায় না। এটা প্রথম ঢেউয়ের মধ্যে ওঠানামা আর কি। আগেও এটা হয়েছিল। শনাক্তের হার যদি শতকরা ৫ শতাংশের নিচে পরপর চার সপ্তাহ থাকে, তাহলে বলা যাবে প্রথম ঢেউ কমে গেছে। আবার যদি শনাক্ত বৃদ্ধি পায়, তাহলে বলা যাবে যে, দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। দেশে করোনা সংক্রমণের নয় মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রথম ঢেউয়ের সময় দেখা গেছে, যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করে, সীমান্তে চলাচল বন্ধ করে দিয়ে, বন্দর বন্ধ করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। একই সময়ে অনেক উন্নত দেশে সংক্রমণ দেখা গেলে, তারা আমাদের মতো তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তারা অনেকটা অসতর্ক থাকায় অনেক মানুষ সংক্রমিত হয়েছে এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমাদের মতো অনেক স্বল্পোন্নত দেশ উন্নত অনেক দেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে শিক্ষা নিয়ে সংক্রমণ রোধে ভালো ভূমিকা রাখতে পেরেছি।

বলা হয়ে থাকে, মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তাকে বিলম্বিত করা যায়। আমরা ঠিক এই কাজটি করতে পেরেছি। আমরা দেখেছি যে ভেন্টিলেটরের চাইতে হাই ফ্লো অক্সিজেন অনেক বেশি কার্যকর। সেটা আমাদের এখানে প্রয়োগ করে অনেক মৃত্যুকে ঠেকানো গিয়েছে। তারপরে উপুড় করে অক্সিজেন দিলে ফুসফুসে অক্সিজেনটা বেশি যায়। আমরা সেটা করেছি। আমাদের চিকিৎসকরা প্রথম দিকে এ বিষয়ে আত্মস্থ হতে সময় নিয়েছেন। তারা ভয়ভীতির মধ্যে ছিলেন। মহামারি বিলম্বিত হওয়ায় তাদের সেই মানসিক সংকটটা কাটানো সম্ভব হয়েছে।  

এক্ষেত্রে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় আমাদের কোন কোন বিষয়ে উন্নতি করতে হবে?
ডা. মুশতাক হোসেন: এখন যেসব বিষয়ে উন্নতি করা দরকার, সেসব বিষয়ের মধ্যে প্রধান হলো- স্বাস্থ্য বিভাগের মধ্যে অনেকে আছেন, যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয়; কিন্তু তারা করোনা সংক্রমণের তদারকিতে নিয়োজিত আছেন। এটা সঠিক নয়। আমি মনে করি, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা দরকার এবং প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া দরকার। যারা বিশেষজ্ঞ নন, তারা করোনা সংক্রমণের ব্যবস্থপনায় সংযুক্ত হলে সমস্যা তৈরি হয়। এ জন্য জেকেজি, রিজেন্ট হাসপাতালের মতো দুর্নীতিবাজরা সুযোগ নিতে পেরেছে।

এখানে আমাদের শিক্ষা হলো, যারা বিশেষজ্ঞ তারা যদি জনবলেও কম থাকে, তারপরেও তাদের দিয়ে ব্যবস্থাপনা করা উচিত। যেমন- ইপিআই দীর্ঘদিন ধরে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থাপনায় আছে। এখন কেউ যদি বলে ইপিআইর জনবল কম আছে, আমরা বেশি জনবল দিয়ে এটার ব্যবস্থাপনা করব, তাহলে সেটা সঠিক হবে না। করোনা মহামারির সময় আমরা দেখেছি যে, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানকে পাশ কাটিয়ে টাকা খরচ করার দিকে যাওয়া হয়েছে। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়নি। এর ফলে উল্টো ফল হয়েছে। এরপরের ব্যাপারটি হলো চেইন অব কমান্ড। বিশেষ করে ইনসিডেন্ট কমান্ডার থাকা দরকার ছিল। করোনা সংক্রমণের প্রথমদিকে আইইডিসিআর ইনসিডেন্ট কমান্ডার ছিল। এরপরে সেটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজির কাছে চলে যায়।

এটা সঙ্গত ছিল; কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজির পদত্যাগের পর নতুন ডিজি আসার পরে এই ইনসিডেন্ট কমান্ড কার হাতে, সেটা দৃশ্যমান নয়। যদি এটা হয় যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বদলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা প্রধানমন্ত্রী অথবা কেবিনেটের হাতে ইনসিডেন্ট কমান্ড চলে গিয়েছে, সেটা ঠিক আছে; কিন্তু সেটা তো ঘোষিত থাকতে হবে। স্বচ্ছতার সঙ্গে এটা দৃশ্যমান থাকা উচিত। এরপরে আমাদের শনাক্ত রোগীদের আইসোলেশনে রাখতে হবে। এ জন্য সামাজিক সহায়তা এবং সরকারি সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা এখন সব কিছু খুলে গেছে। যিনি শনাক্ত হচ্ছেন, তিনি কিন্তু তার জীবিকা হারাতে চাইবেন না। তাই তাকে সহায়তার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে দিতে হবে যে, তিনি একঘরে হয়ে নেই। এখন আমাদের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর বন্ধ করে রাখা যাবে না। তাই শনাক্তকে আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিন রেখে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার জায়গাটা বন্ধ করতে হবে। শুধু মাস্ক পরতে বলে কিংবা সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে বলার মাধ্যমে সংক্রমণ কমানো যাবে না। কোনোভাবেই জনগণের ওপর দোষ চাপিয়ে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। তবে সরকারি প্রচারণা যে কাজে আসছে না, তা নয়। এই যে মাস্ক পরার ওপর জোর দেওয়াতে কিন্তু সংক্রমণ অনেক কমে আসছে। যদি এখন আমরা রিলাক্স করে বসে থাকি, তাহলে সংক্রমণ আবার বেড়ে যাবে। এ জন্য প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেওয়া দরকার। শুধু বিদেশ থেকে যন্ত্র কিনে আনলেই চলবে না। এটা ঠিক আমাদের যন্ত্রের অভাব রয়েছে। তবে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দিলে লাখ লাখ টাকা বেঁচে যাবে। আসলে আমাদের জনস্বাস্থ্যকেন্দ্রিক, মহামারি প্রতিরোধকেন্দ্রিক এবং স্বাস্থ্য উন্নয়নকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসেবার পুনর্গঠন দরকার। 

এখন যে করোনা শনাক্তের হার ওঠা-নামা করছে, সেক্ষেত্রে কী করণীয় থাকতে পারে?
ডা. মুশতাক হোসেন: ওঠা-নামা তো করতেই পারে। তবে মানুষ কিন্তু পরীক্ষা করতে আসছে না। মৃত্যুর যে হার দেখছি, সেই অনুযায়ী কিন্তু শনাক্ত হচ্ছে না। সারাদেশে শনাক্তের হার মোটামুটি একই রকম আছে; কিন্তু শনাক্ত হচ্ছে কম। আমাদের রোগী শনাক্তের হার আরও বেশি হওয়া দরকার, রোগী মৃত্যুর হারের তুলনায়। যাদের মৃদু লক্ষণ তারা হাসপাতালে আসছে না। যাদের অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছে, তারা হাসপাতালে এলে পরীক্ষা করে করোনা পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে; কিন্তু যাদের মৃদু লক্ষণ আছে, তাদেরও পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। এ জন্য সহায়ক আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যেন বোধ করে করোনা হলে তাদের কোনো সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা হবে না। তাদের জীবন-জীবিকা যেন হুমকির মুখে না পড়ে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে এবং অর্থ নেওয়া যাবে না। অর্থের বিষয়টি সামান্য মনে হতে পারে; কিন্তু অনেকের কাছে এটি বাড়তি বোঝা মনে হতে পারে। আমাদের শনাক্তের হার বাড়াতে হবে। মৃত্যুর কাছাকাছি শনাক্তের হার নির্ধারণ না করা গেলে, এখন সংক্রমণ যে নিম্নগামী আছে, সেটি আর থাকবে না।

এখন টিকা প্রদানের ব্যবস্থাপনা কী রকম হওয়া উচিত বলে, আপনি মনে করেন?
ডা. মুশতাক হোসেন: আমাদের টিকা দানের অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। ইপিআই অনেক আগে থেকে টিকা দিয়ে আসছে। তবে এক্ষেত্রে আরও জনবল নিয়োগ দেওয়া দরকার। টিকা সংরক্ষণের জন্য কোল্ড চেইনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর প্রথমেই সব টিকা আসবে না এবং সবাইকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে না। এখানে অগ্রাধিকারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে, তারা প্রথমে টিকা পাবেন। আর বাকিরা সমর্থন করবে। এখন যদি অন্যরা সমর্থন না করে, তাহলে তো সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ নেবে। কোনোভাবেই বিশৃঙ্খলা বা অনাস্থা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না। টিকা বিতরণের সময় কিছু বৈজ্ঞানিক ধাপ মেনে চলতে হবে। তাড়াহুড়ো করা চলবে না। তাড়াহুড়ো করলে কিন্তু অনাস্থা চলে আসবে। আমরা কিন্তু টিকার দিকে মুখ ফেরানো জাতি নই। আমরা টিকায় অভ্যস্ত জাতি। পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতাগুলো দ্রুত পরিহার করতে হবে। সেখানে যেন দেরি না হয়। পরিপূর্ণ লাইসেন্স পেতে আরও দুই বছর দেরি হবে। তখন বাধ্যতামূলক টিকার ব্যবস্থা করতে হবে। 

টিকা বিতরণের ব্যবস্থাপনায় সরকারের কী ভূমিকা থাকতে পারে?
ডা. মুশতাক হোসেন: টিকা বিতরণ তো সরকারই করবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যে ‘এক্সপান্ডেড প্রোগ্রাম অব ইমুনাইজেশন’ কর্মসূচি রয়েছে, তার আওতায় টিকা দান করতে হবে। টিকা পরিবহন করে বড় বড় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দিতে হবে। সেখানে কোল্ড চেইনগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকা দেওয়া হবে, সেই তালিকা করা হচ্ছে। এটার ডিজিটাল বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ‘এ টু আই’ প্রকল্পের লোকজন দেখাশোনা করছে। হাসপাতালের যেসব নার্স, প্যারামেডিকেল কর্মী রয়েছেন, তারা টিকা দান করবেন। তাদের প্রশিক্ষণের কাজ চলছে। যে টিকাটি আসবে, সেটির বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য আরেকটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হচ্ছে।

গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, সরকার টিকা সংরক্ষণে ৪৯০টি ফ্রিজ কিনবে। সরকারের এই উদ্যোগকে কীভাবে দেখছেন?
ডা. মুশতাক হোসেন: ইপিআই প্রকল্পে যেসব টিকা দেওয়া হয়, তার জন্য অনেক জায়গা থেকে ধার নিতে হয়। স্বচ্ছতার ভিত্তিতে আমাদের কেনাকাটা, সরঞ্জামাদি সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //