‘উপজেলাকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়তে হবে’

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায় বাংলাদেশে। চিকিৎসার বেশিরভাগই উপজেলায় পেয়ে গেলে মানুষকে আর রাজধানীতে আসতে হবে না। এতে করে মানুষের ভোগান্তি কমবে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেয়ে যার যার কাজে নিয়োজিত থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। 

ইমার্জিং অথবা রিইমার্জিং ডিজিজ সম্বন্ধে চিকিৎসকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে সর্বশেষ তথ্যে সমৃদ্ধ করে রাখতে হবে, যেন করোনাভাইরাসের মতো মহামারি শুরু হলে তারা সেটি ম্যানেজ করতে পারেন। ভয় পেয়ে রোগী থেকে দূরে থাকার মানসিকতা দূর করতে হবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। 

ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম মোজাহেরুল হক।

উপজেলাভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রসঙ্গে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, উপজেলাভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে, বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের খুব উপকারে আসবে না, এখন যেমন আসছে না। বর্তমানে যে ধরনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাংলাদেশে কাজ করছে, তা সাধারণ মানুষের খুব কাজে লাগছে না। দেশে সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরকেন্দ্রিক কিছু বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে; কিন্তু এসব হাসপাতালে বিত্তশালীরাই সেবা নিতে পারছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের এখানে প্রবেশগম্যতা নেই। 

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা সত্যিকার অর্থে পৌঁছে দিতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি স্বাস্থ্যসেবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেই মানুষ যেন পেতে পারেন, সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। মেডিসিন, গাইনি অ্যান্ড অবস, নাক, কান ও গলা, কার্ডিওলজি, ক্যান্সার, অর্থোপেডিক্স, নিউরোর মতো চিকিৎসা যেন জনগণ উপজেলা থেকেই পেতে পারেন, সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরদিকে, জেলা হাসপাতালে চালু করতে হবে টার্শিয়ারি স্বাস্থ্যসেবা। জেলা হাসপাতালকে গড়ে তুলতে হবে রেফারাল হাসপাতাল হিসেবে। উপজেলা হাসপাতালে যেসব রোগী ম্যানেজ করা যাবে না, কেবল সেসব রোগীকে জেলা হাসপাতালে পাঠানো হবে রেফারাল ব্যবস্থার মাধ্যমে। উপজেলা হাসপাতালের রেফারেন্স ছাড়া জেলা হাসপাতালে কোনো রোগী ভর্তি হবে না। যেখানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অথবা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ‘সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল’ হিসেবে কাজ করবে। এক কথায় উপজেলা হাসপাতালকে তৈরি করতে হবে একটি কমপ্লিট হাসপাতাল হিসেবে। এসব হাসপাতালকে বছরের শুরুতেই তার প্রয়োজনীয় বাজেট দিয়ে দিতে হবে, যেন প্রয়োজনীয় সব ধরনের খরচ সে নিজেই করতে পারে। এতে করে রোগী সেবায় কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটবে না। প্রতিটি উপজেলা হাসপাতাল একই ধরনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অধীনে চলবে।

তিনি আরো বলেন, উপজেলা হাসপাতালের নিচে থাকবে ইউনিয়ন সাব-সেন্টার ও কমিউনিটি ক্লিনিক। এই দুই সেন্টার থেকে রোগীদের পাঠানো হবে উপজেলা হাসপাতালে রেফার করে। উপজেলা হাসপাতালকে এমনভাবে গড়ে তোলা হবে, যেন বেশিরভাগ রোগীর চিকিৎসাই উপজেলায় হতে পারে। এজন্য উপজেলায় নতুন করে চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে না। এখন উপজেলা হাসপাতালে সরকার যে পরিমাণ চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছে, এই পরিমাণ চিকিৎসক দিয়েই উপজেলা হাসপাতালে রোগীকে সেবা দেয়া সম্ভব। তবে এটি নিশ্চিত করতে হবে, যেন নিয়োগকৃত সব চিকিৎসকই উপজেলায় অবস্থান করেন। চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা ছাড়াও উপজেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সাথে যারা থাকবেন তাদের একটি কৌশলগত পরিকল্পনা করতে হবে উপজেলার প্রয়োজনের নিরিখে যে, তাদের কাছে কী সুবিধা থাকা উচিত। উল্লেখ্য, বর্তমানে একটি উপজেলা হাসপাতালে ২৩ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও উপজেলায় চিকিৎসা হয় না, চিকিৎসকদের পাওয়া যায় না। চিকিৎসা নিতে গেলে রোগীদের হতাশ হয়ে ফিরতে হয়। কারণ নিয়োগকৃত চিকিৎসকরা তার প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনদের ম্যানেজ করেই বাইরে চলে যান। এসব কারণে উপজেলা হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে অধিকাংশ সময় নিয়োগকৃত ২৩ জন চিকিৎসকের সবাইকে পাওয়া যায় না। উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসকদের সাথে একান্তে কথা বলে জানা গেছে যে, তারা ডিউটিকে ভাগ করে নেন। একজন চিকিৎসক এক নাগাড়ে তিনদিন ডিউটি করেন। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে ডিউটি ধরলে ২৪ ঘণ্টায় একজন চিকিৎসকের তিনদিনের ডিউটি হয়ে যায়। এভাবে এক নাগাড়ে তিনদিন ডিউটি করলে একজন চিকিৎসকের তিনদিনে ৯ দিনের ডিউটি হয়ে যায়। এভাবে পর্যায়ক্রমে অন্যরা ডিউটি করেন এবং একজন চিকিৎসক তার নিজের প্রয়োজনে অন্যত্র ঘুরে আসতে পারেন ৯ দিন ও ৯ দিন পরে এসে আবার তার কাজে যোগ দিতে পারেন তাতে কোনো অসুবিধা হয় না। এটি উপজেলা হাসপাতালের সব চিকিৎসকই জানেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধানও এর সাথে জড়িত থাকেন। এভাবে দেখা যায়, উপজেলা হাসপাতালে নিয়োগকৃত ২৩ চিকিৎসকের মধ্যে মাত্র তিনজনকে পাওয়া যায় হাসপাতালে কাজ করছেন। অন্যদের সব সময় পাওয়া যায় না।

অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, উপজেলা হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি ভাঙতে হবে এবং চিকিৎসকদের মানুষের কল্যাণে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। বেশিরভাগ চিকিৎসকই মনে করেন তারা যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা পান না। সে কারণে তারা এভাবে ফাঁক সৃষ্টি করে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন অথবা প্রাইভেট চিকিৎসায় নিজেদের নিয়োজিত করছেন সরকারি অফিস সময়েই। এ ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করে চিকিৎকদের রোগীমুখী করতে হবে। 

তিনি আরো বলেন, চিকিৎসা ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হলে প্রতিটি জেলা হাসপাতালকে অথবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ৫০০ বেডের হাসপাতাল বানাতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে হবে কোনো হাসপাতালে ৫০০ বেড থাকলে সেখানে যেন সব সময় ৫০০ রোগীই চিকিৎসাধীন থাকেন। বেডের বাইরে ফ্লোরিং করে কোনো রোগী থাকতে পারবে না। কারণ প্রত্যেক রোগীরই অধিকার রয়েছে ফ্লোরে নয়, বেডে শুয়ে চিকিৎসা নেয়ার। এটি দেশের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। উপজেলা হাসপাতালকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হলে জেলা হাসপাতাল অথবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপচেপড়া রোগী থাকবে না। আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে, উপজেলা হাসপাতালে হাতে গোনা কিছু রোগী থাকে। জেলা হাসপাতালগুলোও খালি পড়ে থাকছে; কিন্তু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অথবা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলোতে রয়েছে উপচেপড়া ভিড়। এসব সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে এমন রোগী যাচ্ছেন, যাদের চিকিৎসা উপজেলাতেই শেষ করে দেয়া যায়। কারণ উপজেলায় প্রচুর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন।

উপজেলা হাসপাতালের প্রশাসন ও পরিচালন সম্পর্কে অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, উপজেলা হাসপাতাল হবে স্বশাসিত। সরকার থেকে হাসপাতালে যে বাজেট দেয়া হবে, তা একটি কমিটির মাধ্যমে হাসপাতাল নিজেই খরচ করবে প্রয়োজন অনুসারে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওপর থেকে শুধু সুপারভিশন করবে, তারা নীতি-নির্ধারণী কাজগুলো করবে। উপজেলা অথবা জেলা হাসপাতালকে তারা নিয়ন্ত্রণ করবেন না। একটি নীতিমালার আওতায় উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলো নিজেরাই নিজের দেখাশোনা করবে ও প্রয়োজনীয় রিপোর্ট তারা পাঠাবে উপরে। এখন যেমন প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালকে সিভিল সার্জন দেখাশোনা করেন, ভবিষ্যতে সিভিল সার্জন তার অধীন সব হাসপাতাল দেখাশোনা করবেন একটি নীতিমালার অধীনে। বর্তমানে জেলা ও উপজেলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা খাতে যে বাজেট দেয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। আবার এই কম বাজেটই জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল খরচ করতে পারে না। বছর শেষে বরাদ্দকৃত টাকা ফেরত চলে যায়। বরাদ্দকৃত টাকা খরচ করতে না পারার উদাহরণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও রয়েছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে যে বাজেট দেয়া হয় প্রয়োজনের আলোকে খরচ করা সম্ভব, যদি একটি সুষ্ঠু নীতিমালা করে দেয়া হয়। অপচয় ও দুর্নীতি রোধ করতে পারলে জনগণ এর সুফল পাবেন। 

অধ্যাপক মোজাহেরুল হক ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে বলেন, জেলা হাসপাতালগুলোকে আরো উন্নত করতে হবে। উপজেলা থেকে রোগীরা রেফার্ড হয়ে আসবেন, তাদের ম্যানেজ করার যাবতীয় যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসক জেলা হাসপাতালে থাকতে হবে। জেলা হাসপাতালে স্বয়ংসম্পূর্ণ আইসিইউ করে দিতে হবে। অনেক অপারেশন থিয়েটার করে দিতে হবে, যেন প্রয়োজনীয় অপারেশন এখানেই করে ফেলা যায়। অন্যদিকে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অথবা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল কাজ করবে জটিল রোগীদের নিয়ে। তারা গবেষণা করবেন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করার কাজে নিয়োজিত থাকবেন।

অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য একইসাথে দরকার হবে মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর। আরো উন্নত করতে হবে কারিকুলামে। এখন যেসব বিষয় রয়েছে এগুলোর সাথে থাকবে- বিহেভিয়ারাল সায়েন্স, কমিউনিকেশন স্কিল, যেখানে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে কীভাবে সুসম্পর্ক থাকবে, তা নিয়েই দিক নির্দেশনা থাকবে। একইসাথে আরেকটি মেডিকেল শিক্ষা যোগ করতে হবে। তা হলো- ইথিক্যাল প্র্যাকটিস। নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে যেন ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে নৈতিকতার সাথে চিকিৎসা করতে পারেন। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এখানে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। বিএমডিসি প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক ও চিকিৎসক নিয়োগ নিশ্চিত করবে। প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল স্কিল ল্যাব, মেডিক্যাল অ্যাডুকেশন ইউনিট, উন্নতমানের ডিজিটাল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় বিএমডিসি সহায়তা করবেন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কন্টিনিউয়িং মেডিকেল এডুকেশন (সিএমই) নিশ্চিত করবে বিএমডিসি। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ তথ্য, উপাত্ত দিয়ে চিকিৎসকদের অবগত করানোর কাজটিই সিএমই ও বিএমডিসি পালন করবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //