করোনা নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচি আবশ্যক : ডা. লেলিন চৌধুরী

প্রতিদিনই বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে দেয়া হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা, এরপর লকডাউনের কথা বলা হলেও দেয়া হলো দুই দফা ‘কঠোর বিধিনিষেধ’। 

এসব পদক্ষেপ কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে- এ নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের মুখোমুখি হন বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহেরীন আরাফাত।

সরকারি নির্দেশনা বা লকডাউনের মতো ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ কতটা কার্যকর হতে পারছে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে?

বিধিনিষেধ নয়, লকডাউনের সিদ্ধান্ত যদি গত মাসের মাঝামাঝি সময়েই নেয়া হতো, তাহলে এখন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতো। কারণ, সংক্রমণের হার যে গতিতে ছড়াচ্ছে, এসব নির্দেশনা সে গতি থামানোর উপযোগিতা রাখে না। আমরা জানি, যখন দেশে একটি মহামারি চলতে থাকে, তখন বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া আবশ্যক; কিন্তু আমরা দেখছি আমাদের এখানে সেই বিজ্ঞানের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে না। এ সময়ে জনচলাচল যত সীমিত করা যায়, সেটি হচ্ছে দরকার। যেমন- সরকারি অফিসের সময় অর্ধেক করে দেয়া; বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিসগুলোতে কি করা হবে সেটা পরিষ্কার করা; যে অফিসগুলো ভার্চুয়ালি করা সম্ভব, সেখানে হোম অফিস করা যেতে পারে। দোকানপাট, বিপণিবিতান, মার্কেট- এগুলো বন্ধ রাখা। রাতে চলাচল সীমিত করার জন্য রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কারফিউ দেয়া। করোনা প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহার করা ও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে সবচেয়ে জরুরি কাজ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাস্তায় নামানো যেতে পারে এ বিষয়টিকে তদারকি করার জন্য। আবার পাড়া কিংবা মহল্লায় কমিটি করা যেতে পারে- ওই এলাকায় কেউ মাস্ক না পরে বাইরে এলে তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া। সেইসঙ্গে যেসব এলাকায় করোনা রোগী বেশি, সেসব এলাকায় রেডজোন ঘোষণা করে এলাকাভিত্তিক লকডাউন ঘোষণা করা। 

করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি কি ঝিমিয়ে পড়ছে? প্রতিদিনই তো এ সংখ্যাটা কমে আসছে...

প্রথম কথা হচ্ছে নিবন্ধন। জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে অনলাইনে ফরম পূরণ করে ভ্যাকসিন দেয়া- এটি আমাদের দেশের সব মানুষের জন্য সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়, অনেকের কাছে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল নেই যে তারা রেজিস্ট্রেশন করবে, থাকলেও সেটির যথাযথ ব্যবহার জানে না। দ্বিতীয়ত, একটি দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার নির্বাচন ব্যবস্থা। যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার ক্ষমতায় বসে। এই নির্বাচনে একজন জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়েই ভোট দিতে পারে, আর আমাদের ভ্যাকসিনের নিবন্ধন এত জটিল, এত নিয়ম যে সরকার পরিবর্তনের চেয়েও এটি কঠিন; যে কারণে নিবন্ধন করে আবার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে যেতে হবে। এটি মোটেই হতে পারে না। আমার কথা হলো- জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়ে যে কেউ ভ্যাকসিন দিতে পারবে, সে নম্বরটি কর্তৃপক্ষ টুকে রাখবে এবং তারা নিজ দায়িত্বে নিবন্ধন করে নেবে। আরেকটা ব্যাপার হলো- মানুষ যে ভ্যাকসিন নিচ্ছে, বা নেবে, কেন নেবে? এ ভ্যাকসিন নিলে মানুষজন করোনায় মারা যাবে না- এ বিষয়টি পরিষ্কার করা। ভ্যাকসিন নিলেও সংক্রমণ হতে পারে; কিন্তু মৃদু সংক্রমণ। এই তথ্যগুলো মানুষকে জানাতে হবে। ভারতের পাশাপাশি একাধিক দেশ থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টা করা উচিত। করোনা নিয়ন্ত্রণে মাস্ক, স্বাস্থ্যবিধি ও ভ্যাকসিন- এ তিনটি বিষয় আমাদের মানতেই হবে।

গত এক বছর ধরে আমরা করোনা সংক্রমণের মধ্যে রয়েছি। এ সময়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নেয়া পদক্ষেপগুলো কিভাবে দেখছেন? আমাদের দেশে এখন কোন পথে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?

মূলত জনসংখ্যার তুলনায় গত এক বছরে আমাদের দেশে কোনো কাজই হয়নি। এমনকি চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। গত একবছর ধরে চিকিৎসকরা যে কাজগুলো করছে তাদের উজ্জীবিত করার জন্যও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সেবার মান কিন্তু একেবারে নিম্নগামী। সারাদেশে যখন মহামারি চরম আকার ধারণ করেছে, তখন জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। পুরো মহামারিটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এক জায়গা থেকে পদক্ষেপ না নিয়ে এটিকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে কার্যকর করা। যেমন মানুষের চলাচল না কমিয়ে গণপরিবহণের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হলো, তাতে কি হলো মানুষের ভিড় কমল না বাড়ল? করোনা সংক্রমণ আরো বাড়ল। তাহলে কি হলো? প্রথমত, মানুষজনকে বাইরে বের হওয়ার কারণটা কমাতে হবে, তারপরে তো গণপরিবহণের ব্যাপার সামনে আসে। মানুষ যদি ঘরে বসেই তার বাইরে গিয়ে করার কাজটা সারতে পারে, তাহলে তো বের হবে না। অথচ এখানে ঘোড়ার গাড়িটাকে তৈরি না করেই ঘোড়াটাকে সরিয়ে নেয়া হলো। এ কাজগুলো কখনোই বিজ্ঞানসম্মত না। পৃথিবীর যেসব দেশ বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, তারা নিজেরাই করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। যারা সেটি করেনি, অনেক ধনাঢ্য দেশ আমেরিকা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। করোনা নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচি নেয়া আবশ্যক। এটি আমাদের করোনা যুদ্ধের জন্য, পৃথিবীর জন্য প্রধান শিক্ষা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //