অন্যের গান দিয়ে নিজের পরিচয় বহন করা যায় না

পরিচিতজনরা আদর করে ডাকেন ‘লুই’। পুরো নাম- জিনিয়া জাফরিন লুইপা। মাত্র তিন বছর বয়সে গানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে তার। বগুড়া শিশু একাডেমিতে তিন বছর বয়সে তাকে ভর্তি করে দেন মা। তবে গানের পাশাপাশি তিনি নাচ ও অভিনয়েও সমান পারদর্শী। ২০১০ সালে টেলিভিশনের সেরাকণ্ঠের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তিনি সংগীতশিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তারপর প্রকাশ করেন প্রথম একক অ্যালবাম ‘ছায়াবাজি’। এরপর আর পেছনফিরে তাকাতে হয়নি। গান ও নানা বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এন আই বুলবুল

গানের সঙ্গে সখ্য কীভাবে?
আমার পরিবারের কেউ গানের চর্চা করতেন না। ছোটবেলায় মা শিশু একাডেমিতে ভর্তি করে দেন। গানের পাশাপাশি নাচ-অভিনয়ও করতাম সেখানে। একটা সময় এসে পরিবার থেকে বলা হলো- তিনটি বিষয় নিয়ে দৌড়ানোর প্রয়োজন নেই। যে  কোনো একটি বেছে নেওয়ার কথা বলা হলো। তারপর থেকে শুধু গানের সঙ্গেই আছি; কিন্তু গানকে পেশা হিসেবে নেবো কখনো ভাবিনি। তবে এখন গানের সঙ্গেই নিয়মিত বসবাস করছি। ঘর সংসারের সঙ্গে গানটাকে নিয়ে আছি।


কখন থেকে গানকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন?
২০১০ সালে আমি সেরাকণ্ঠ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। সেই প্রতিযোগিতায় আমি চতুর্থ হই। তারপর ২০১৩ সালে আমি বিয়ে করি। আমার স্বামী নিজেও সংগীতের সঙ্গে জড়িত। বলা যায়, তার অনুপ্রেরণায় গানকে পেশা হিসেবে বেছে নেই। আমার আজ এ অবস্থানে আসার ক্ষেত্রে আমার স্বামীর অনেক অবদান আছে। সেই আমাকে এ পর্যন্ত আসতে সহযোগিতা করেছে।  এখন পর্যন্ত সে আমার সঙ্গে ছায়ার মতো আছে। আমিও সব কাজে তার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই।

গান ও সংসার দুটি একসঙ্গে কীভাবে সামলান?
আমি প্রথমেই বলেছি, আমার স্বামীর কারণেই গানকে পেশা হিসেবে নিয়েছি। গানের জন্য তার কাছ থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাই। তবে এটিও সত্য, সংসারটিকেও আমি সমান গুরুত্ব দিচ্ছি। দিন শেষে আমাদের সব মানুষকে ঘরে ফিরে আসতে হয়। সেটি যদি ঠিক না থাকে, তাহলে এই যশ-খ্যাতি দিয়ে কী করব? আমাদের অনেকে পেশার জন্য নিজের সংসারের প্রতি উদাসীন হয়ে থাকেন। আমি মনে করি, ইচ্ছে থাকলে নিজের পেশার সঙ্গে সংসারটিও ঠিক রাখা যায়।

গানকে পেশা হিসেবে নিতে গিয়ে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন?
সব পেশাতেই প্রতিবন্ধকতা থাকে। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে অন্য পেশা থেকে এটির পার্থক্য হলো- আমাকে কোনো বিরক্ত হতে হচ্ছে না। নিজের স্বাধীন মতো কাজ করতে পারি এ সেক্টরে। কোনো প্রতিষ্ঠানে যদি আমি চাকরি করতাম, তাহলে একটা নির্দিষ্ট সময় আমাকে মেইনটেন করতে হতো। এখন আমি আমার মতো করে কাজ করছি। এর বাইরে কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। তার মধ্যে একটি হলো- অনেক সময় আমাদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন শিল্পীদের গানকে প্রমোট করে না। তারা ভাইরাল ও জনপ্রিয় শিল্পীদের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। এ ছাড়া প্লেব্যাকেও সিন্ডিকেট আছে। সেখানে সবাই নিয়মিত কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না। যার কারণে অনেক সময় ভালো কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

আমাদের দেশে মেয়েদের গানকে পেশা হিসেবে নেবার সুযোগ কতটুকু আছে বলে মনে করেন?
গানকে পেশা হিসেবে নেবার সুযোগ আছে; কিন্তু গানের প্রতি যদি সেই ভালোবাসা না থাকে, তাহলে গানে না আসাই ভালো মনে করি। সারাবিশ্বে এখন নারী শিল্পীরা এগিয়ে আছেন। আমাদের দেশেও নারী শিল্পীরা পুরুষ শিল্পীদের চেয়ে পিছিয়ে নেই। তবে নারীদের সবখানেই কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। সেগুলো ওভারকাম করার সামর্থ্য রাখতে হবে। আমাদের দেশের নারী শিল্পী সংসদ হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, আগামীতে এ সংগঠন আরও এগিয়ে যাবে।

এ সময়ে আমাদের সংগীতাঙ্গনকে কীভাবে দেখছেন?
আমাদের এখানে এ সেক্টরে অন্য পেশার লোকজন আসছেন এখন বেশি। মূলধারার শিল্পীর বাইরে অনেক শখের শিল্পী আছেন। যারা কয়েকটি গান তুলে নিজেকে শিল্পী দাবি করছেন। বাইরের লোকজন এই পেশায় আসায় কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত অনেক শিল্পীও উপেক্ষিত হচ্ছেন। কেউ কেউ অভিমানে গান থেকে দূরে আছেন। গানের জগতে গানের মূল মানুষরা থাকলে হয়তো এ মাধ্যমটি আরও বিকশিত হতো।


সংগীতে আপনার আইডল কারা?
ছোটবেলায় মান্না দে ও নিলুফা ইয়াসমিনের গান শুনতাম বেশি। তবে আমার নির্দিষ্ট কোনো আইডল নেই। আমি সবার গান শোনার চেষ্টা করি। বিশেষ করে সিনিয়রদের মধ্যে- রুনা ম্যাডাম, মমতাজ আপাসহ আরও অনেকের। এখন কনা আপার গান বেশি শুনি।

শোবিজে নতুন প্রজন্মের নারী শিল্পীদের নিয়ে নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য শোনা যায়; কিন্তু কেন?
সাধারণ মানুষকে কেউ ফলো করে না। শোবিজের মানুষদের সবাই অনুসরণ করে। সাধারণ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে; কিন্তু তাদের পেইজ নেই। কিংবা তাদের লক্ষ বা তার অধিক ফলোয়ার নেই। এটি শুধু শোবিজের তারকাদের আছে। যার কারণে তাদের ভালো মন্দ সব খবর সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে। শোবিজের মানুষদের যেমন বিয়ে-ডিভোর্স হচ্ছে, একই রকম অন্য পেশার মানুষদেরও হচ্ছে। পার্থক্য হলো, তাদের ফলোয়ার না থাকার কারণে অন্য পেশার লোকজনের ত্রুটিগুলো চাপা পড়ে যায়। শোবিজের মানুষদের সব কিছু প্রকাশ্যে আসে।

একটা সময় গান ক্যাসেট-সিডিতে প্রকাশ হতো। এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছার সুযোগ কতটুকু আছে?
আমার প্রথম অ্যালবামটি সিডিতে প্রকাশ হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু গান করেছি সিডিতে। এখন আর সেই যুগ নেই। গান প্রকাশের মাধ্যম পুরো বদলে গেছে। তবে শুধু ইউটিউবে গান প্রকাশ করলেই, এখন আর কারও শিল্পী হবার সুযোগ আগের মতো নেই। যদি সেই গান শ্রোতাদের পর্যন্ত না যায়। শ্রোতাদের কাছে গান শোনানোর জন্য ডিজিটাল আরও প্ল্যাটফর্ম আছে, সেগুলোতে গানকে প্রমোট করতে হবে। স্টেজ ও টেলিভিশনে গান করতে হবে। তারপর এটি সবার কাছে পৌঁছাবে।

স্টেজে কি ধরনের গান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
আমি বরাবরই মৌলিক গান করার চেষ্টা করি। পাশাপাশি জনপ্রিয় গানগুলো করা হয়ে থাকে। স্টেজের গান নির্ভর করে শ্রোতাদের ওপর। যখন গান করি, তখন মাথায় রাখি কোন ধরনের শ্রোতাদের সামনে আমি আছি। তাদের রুচির ওপর গান গাওয়ার চেষ্টা করি।


অনেকে আজকাল শুধু কাভার গান করছেন। অন্য শিল্পীদের গান দিয়ে কি টিকে থাকা সম্ভব?
একজন শিল্পীর জন্য মৌলিক গানের বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। অন্যের গান দিয়ে নিজের পরিচয় বহন করা যায় না। নিজের অস্তিত্ব টিকে রাখার জন্য প্রত্যেক শিল্পীকে মৌলিক গানে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নিজের পাশাপাশি অন্য শিল্পীর গান করাতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে যদি নিজের কোনো গান না থাকে, তাহলে কাভার গান দিয়ে লম্বা সময় যাওয়া সহজ নয়।

নিজেকে নিয়ে আপনার মূল্যায়ন  কী?
সাধারণ শ্রোতার দিক থেকে যদি শিল্পী লুইপার কথা বলি, তাহলে বলব- তার আরও অনেক দূর যাওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে তুলে ধরতে হবে। তবে শিল্পী হিসেবে নিজেকে নিয়ে আমি বলব কোনো স্বপ্ন দেখি না। যতটুকু যেতে পারি সেটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাই। মানুষের অনেক ভালোবাসা পাচ্ছি। এই ভালোবাসার বিনিময়ে সব সময় ভালো গানের সঙ্গে থাকতে চাই। ভালো কথা ও সুরের আরও কিছু গান করতে চাই। যে গানগুলো শ্রোতাদের কাছে আমাকে নিয়ে যাবে। এ ছাড়া আমি খুব সাধারণভাবে চলতে পছন্দ করি। কারণ একদিন সব কিছুর শেষ আছে। তাই এই অল্প সময়ে অহংকারের কিছু নেই।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //