আমাদের পরিবর্তন দরকার : ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন। ১০ ভাই- বোনের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। ঢাকার বকশীবাজারে অবস্থিত নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যয়নের সময় তিনি বামধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। সে সময় তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। এর পর তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিলাতে যান। ১৯৬৭ সালে বিলাতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন; কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব শেষ না হতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসেন। ব্রিটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএমএ) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি।

পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার প্রতিবাদে লন্ডনের হাইডপার্কে যে কয়জন বাঙালি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়েছিলেন, তাদেরই একজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। লন্ডন থেকে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে তিনি ভারতের আগরতলায় মেলাঘর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ডা. এম এ মবিনের (পড়ুন ড. এম এ মবিনের সাক্ষাৎকার) সঙ্গে যৌথভাবে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেন।

যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালে পর্যাপ্ত নার্স না থাকায় তিনি নিজেই নারী স্বেচ্ছাসেবীদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেন। স্বল্পসময়ে স্বেচ্ছাসেবীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরবর্তী সময়ে তার এই সেবাপদ্ধতি বিশ্বখ্যাত জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর ডা. জাফরুল্লাহ গ্রামে গিয়ে শুরু করেন স্বাস্থ্যযুদ্ধ। ফিল্ড হাসপাতালটিকেই তিনি প্রথম কুমিল্লাতে ‘স্বাধীন দেশের প্রথম হাসপাতাল’ হিসেবে গড়ে তোলেন। পরে ঢাকার ইস্কাটনে হাসপাতালটি পুনঃস্থাপিত হয়। গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুরূপে গড়ে তোলার জন্য ‘চলো গ্রামে যাই’ স্লোগান নিয়ে তিনি নতুন এক সংগ্রামের সূচনা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাতালটির নামকরণ করেন ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’। ঢাকার অদূরে সাভারে হাসপাতালটির জন্য ৩১ একর জমিও বরাদ্দ করেন।

স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনের লক্ষ্যে প্রথম বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান ছিলেন তিনি।

আজীবন প্রতিবাদী এবং দেশপ্রেমিক ডা. জাফরুল্লাহ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ সত্ত্বেও বাকশালে যোগ দেননি। জিয়াউর রহমানের দেওয়া মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন চার পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে। ফিরিয়ে দেন এরশাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবও। 

তিনি ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় আমদানিকৃত ওষুধের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২২৫টিতে। বর্তমানে ৯০ শতাংশ ওষুধই দেশে তৈরি হচ্ছে এবং বাংলাদেশ একটি ওষুধ রফতানিকারক দেশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। যদিও তাঁর প্রণীত ঔষধনীতি বর্তমান সময়ে কার্যকর নয়। 

ডা. জাফরুল্লাহ স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ১৯৯২ সালে বি এম এ তাঁর সদস্যপদ বাতিল করে। বিনা বিচারে ড. জাফরুল্লাহর ফাঁসি চেয়ে পোস্টারও সাঁটায় তারা।

দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এখন তার দুটি কিডনি প্রায় অকেজো। সপ্তাহে অন্তত তিনবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। তারপরও থেমে নেই তাঁর কর্মতৎপরতা। অনেকের কাছে তিনি বিতর্কিত। অনেকের কাছে সমালোচিত। তবু দেশের স্বার্থে তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। প্রায় আশি বছর বয়সেও কেবল বিবৃতিসর্বস্ব বুদ্ধিজীবীতার বদলে তিনি পালন করে যাচ্ছেন একজন সৎ, সাহসী ও সক্রিয় দেশপ্রেমিক পথপ্রদর্শকের ভূমিকা। 

সাম্প্রতিক দেশকাল এ মানুষটির জীবনব্যাপী ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিবৃত্ত জানতে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। সাম্প্রতিক দেশকালের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন আরশাদ সিদ্দিকী।

ছাত্রজীবন থেকে এখন পর্যন্ত আপনি আত্মপরতার ঊর্ধ্বে দেশ, সমাজ ও মানুষের জন্য কাজ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরেও আপনি দেশ, সমাজ ও মানুষের প্রতি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ, এখনো রয়েছেন। এর পেছনে কি কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল?

এ ক্ষেত্রে দুটি কারণ ছিল। প্রথম হলেন আমার মা। তিনি মৌলভীর মেয়ে ছিলেন। তার এক ভাই জজ হয়েছিলেন। আমার মা মহিলা বলে বা মুসলমান নারী হওয়ার কারণে পড়াশোনা করতে পারেননি। প্রাচীন প্রথার জন্য স্কুলেও যেতে পারেননি। ঘরে বসে বসে ভাইয়ের কাছে বাংলা পড়া শিখেছিলেন। কোনো ক্লাসের ডিগ্রি নেই। তখন সব স্কুলে যেমন- প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত বছরে একবার ইনস্পেকশন হতো। তখন এক প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমার মাকে ধার করে ক্লাসে বসিয়ে দিয়েছিল। তিনি বুদ্ধিমতীও ছিলেন; কিন্তু ইন্সপেক্টর মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।

আমার মা তেমন লেখাপড়া জানতেন না। তবে পড়তে পারতেন। আর তার নিজের ভাইসহ চাচাতো ভাইরা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। আমার বাবার পরিবারের লোকজন ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। জায়গা জমির মালিক ছিলেন। চট্টগ্রামের প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার আমার মায়ের ভাই। আবার তার নিকট আত্মীয় হলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। তাদের পরিবার পড়ালেখায় অনেক এনলাইটেন্ড ছিলেন।

আমার মায়ের মধ্যে ছিল মানব সেবার মন। ছোটকালে তেতাল্লিশের মন্বন্তর দেখেছিলেন। ওই মন্বন্তরের গল্প আমাদের প্রতি সপ্তাহে শুনতে হতো। বলতেন, লোকে ভাত চাইতো না, ফ্যান চাইতো। এইটা একটি ঘটনা।

দ্বিতীয় কারণ হলো- বিলাতে থাকা। এর একটি সুবিধা হলো- পাশ্চাত্যের উন্মুক্ত ময়দানে এক রানীকে ছাড়া প্রধানমন্ত্রীসহ সবাইকে সমালোচনা করা যায়। তার ছোট পোশাক নিয়েও সমালোচনা করা যায়। সেখানে কার্ল মার্ক্সের সমাধি আছে। এই সবকিছুতে একটি বড় সুযোগ এসেছে, জানার জন্য। আসলে বিষয়টি কী- ব্রিটিশ শ্রমিকদের জীবন যাত্রার উন্নতি হয়েছে, কোল মাইনারের (কয়লা শ্রমিক) মেয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছে। আমরা ডাক্তাররা সেখানে একটি স্ট্রাইক করেছি। আমরা একটি পাবলিক ডিবেটে গিয়েছিলাম আমাদের কনসালট্যান্টদের সঙ্গে। আমাদের বেতন বাড়ানোর কথা বলেছিলাম। আমাদের অভাবের কথা বলেছিলাম। উত্তর আসে, ‘সাত দিনে আমি একদিন গোসল করি। আই অ্যাম ডটার অব আ কোল মাইনার। আমার বাবা কয়লা খনিতে কাজ করে এসে পানি পায়নি। পানি দাওনি তোমরা। আজকে তোমরা এই কথা বলো। তুমি চিন্তা করে দেখো- শ্রমিকের গোসল করার পানি দেবো আগে, না বেতন বাড়াব আগে।’

আমি প্রথম থেকেই ডিটারমাইন্ড ছিলাম, দেশে ফিরে আসব। আমার মা বলেছিল, তোমার দায়িত্ব হলো- গরিব মানুষকে দেখা, এ দেশকে দেখা। তাদের পয়সায় তুমি পড়েছ। আমি বললাম, তারা তো আমাদের ভাতের ফ্যান খেয়েছে। তখন তিনি বললেন, আমাদের মাঠের কাজটা কে করেছে। তোমরা ধান পেতে, তোমার দাদার দোকান কে চালিয়েছে? রনো, মেনন, আমি এক সঙ্গে দল করতাম। তখন আমাদের স্বপ্ন হলো- পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করা। এই কারণে যত ডিসিডেন্ট গ্রুপের সঙ্গে আমার একটি যোগাযোগ ছিল। 

একাত্তর সালে তো আমরা ছয় ঘণ্টা পরে খবর পেতাম। যখন আমরা দেখেছি শেখ সাহেব বলছেন, পাকিস্তান ফিনিস। তখন আমরা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিলাম। এপ্রিল মাসে আমি ডাক্তারদের সংগঠন মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করি, সব ডাক্তারদের নিয়ে। সংগঠন ছাড়া কিছু হবে না। আর ডাক্তারদের বললাম, প্রত্যেকে দশ পাউন্ড করে দিবে। তখন কিন্তু দশ পাউন্ড অনেক টাকা। আমি একটু চালাক ছিলাম। আমি জানতাম, বাঙালির চরিত্র একটু খারাপ হয়, একটু কিপটা হয়। তাই বললাম, ব্যাংকে স্ট্যান্ডিং অর্ডার দিয়ে দাও। ব্যাংকে একটি চিঠি দিয়ে দাও। প্রত্যেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ পাউন্ড কেটে নেওয়া হতো; কিন্তু এই দশ পাউন্ডের জন্য আমার পাঁচ পাউন্ড টেলিফোন বিল চলে যেত।

মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিলাতে প্রথম সংগঠন হলো মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। অন্য কারও তেমন ভূমিকা নেই। আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব সে সময় লন্ডনে ছিলেন। তার কারণ উনি জেনেভা মিটিংয়ে গিয়েছিলেন। উনাকে আমি চিনতাম। আমার ভাইয়ের শ্বশুর ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্টের চিফ জাস্টিস। আমরা তাকে পছন্দ করতাম না। তখন সবাই তাকে দাওয়াত করার পক্ষে। আমি তাকে আনার পক্ষে ছিলাম না। তাহলে কী করা যায়। আবু সাঈদ চৌধুরীকে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে দাওয়াত করে আনা হলো। সেই থেকে তার সঙ্গে পরিচয়। তখন তিনি ঢাকায় ফেরার কথা বললেন। বললাম, ঢাকায় ছাত্রদের মেরেছে। ঢাকায় এত কিছু হচ্ছে, তিনি কিছুই জানেন না। বললাম, ‘আপনি অ্যাক্টিভিস্ট, আর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনাকে দরকার। আপনি কারো সঙ্গে যাবেন না। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ কারও সঙ্গে যাবেন না। আপনার মতো একজন নিরপেক্ষ লোক আমাদের দরকার।’ উনি আমাদের সাপোর্ট করেছিলেন। উনার সাপোর্ট আমাদের ভালো কাজ দিয়েছিল। উনি আমাদের কিছুটা প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। উনি বললেন, ‘আপনি তো পটিয়ে ফেললেন।’ বিলাতে আমি তখন হাইফাই লাইফ লিড করি। আমি মদ খাই না। মেয়েদের পেছনে পয়সা খরচ করি না। প্রতিদিন ১৬-১৮ ঘণ্টা কাজ করি। আমার প্রাচুর্য ছিল। আমার গাড়ি ছিল, মার্সিডিজ বেঞ্জের চেয়েও দামি। আর আবু সাঈদ চৌধুরী আমার গাড়ি খুব পছন্দ করতেন। তাঁকে বললাম এখানে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। জবাবদিহি থাকতে হবে। 

মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের যখন সেক্রেটারি ছিলাম, তখনো দশ টাকার হিসাবের হেরফের হলে ব্যাখ্যা থাকতে হতো। আইয়ুব খানের আমলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে; কিন্তু আমার সব হিসাবপত্র ঠিক ছিল। অফিসাররা বলল, এ বুদ্ধি কী করে হলো তোমার। বললাম, কারণ, আপনারা খুব খারাপ মানুষ। 

আমাদের একটি ভুল ধারণা ছিল- সমাজতন্ত্রের যুদ্ধটা অনেক দিন চলবে। ভারত আমাদের চেয়েও চালাক। তারা বুঝেছে, এ যুদ্ধ যদি বেশি দিন চলে, তাহলে চারু মজুমদার গ্যাং সব নিয়ে নেবে। এ কারণে আমাদের যুদ্ধটা নয় মাসে শেষ হয়ে গেছে। যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে জনগণের হাতে ক্ষমতা থাকত।

যা-ই হোক, বিলাতের মুক্ত আবহাওয়া মানুষকে খুব এনলাইটেন্ড করে। এখানে আমার যে সময় বরবাদ হয়েছে, সেখানে আমার বন্ধু-বান্ধবদেরকে ডিঙিয়ে গেছি। ওদের আগে আমি পরীক্ষায় পাস করে ফেলেছি। যেহেতু অমি খাটনেওয়ালা। খালি কাজ করো, কাজ। এপ্রিল মাসে আমার ফাইনাল এফআরসিএস পরীক্ষা ছিল। আমি প্রাইমারি এফআরসিএস অনেকের চেয়ে আগে পাস করেছি। আর যখন রয়েল কলেজে পড়ি, আমি ডিটারমাইন্ড যে, আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। আমার ভেতরে পুঁজিবাদের চরিত্র তখনো পুরোপুরি বিনষ্ট হয়নি। আমার স্বপ্ন যে, পাকিস্তানের এক নম্বর ডাক্তার হবো। আই বিকেম এ ভাসক্যুলার সার্জন। আমি তো হার্ট বদলাতে পারি। আমি এমন একটি সাবজেক্টে স্পেশালিস্ট হয়েছি যে, আমাকে ছাড়া পাকিস্তান চলতে পারত না, যদি পাকিস্তান থাকত। সবাই আমার কাছে আসত। এটি একটি মধ্যবিত্তিয় চিন্তা ছিল। এখন এটি আমার কাছে ভুল চিন্তা মনে হয়। 

তারপর তো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লাম। হাইড পার্কে যেহেতু অরগানাইজ করি। আবু সাঈদ চৌধুরীকে দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করালাম। যুদ্ধ কতটা হচ্ছে, তা জানার জন্য ভাসানী সাহেবকে একটি চিঠি লিখলাম। চিঠির উত্তর না পাওয়াতে আরও বেশি চিন্তিত হলাম। ভাসানী কী মুক্ত না বন্দি?

আপনি জীবনের দীর্ঘ একটি সময় পেরিয়ে এসেছেন। যে স্বপ্ন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ধারণ করে ক্যারিয়ার, শিক্ষাজীবন সব কিছু বিসর্জন দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আপনার স্বপ্ন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়েছে বলে কি মনে করেন?

কিছুটা পেরেছি; কিন্তু আমার যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিল, আরও বেশি দেওয়া উচিত ছিল। দেশকে আরও বেশি পরিবর্তন করা উচিত ছিল। সেটি করার সুযোগ পাইনি। 

আপনার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। নামটিও তাঁরই দেওয়া। তিনি এ সংস্থাটিকে জমিও দিয়েছিলেন। 

বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও মহানুভবতার একটি প্রতীক। তিনি নিজে মাথা খাটাতেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে মাথা খাটাতেন। তিনি দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। তার কন্যার সমস্যা হলো, তিনি স্বাধীনভাবে ভাবতে পারেন না। এমনিতে ভালো মানুষ তিনি। আমি বলব, তিনি সজ্জনই আছেন; কিন্তু আমাদের বিবেচনা মোতাবেক ‘অন্তরীণ’ আছেন। স্বাধীনভাবে চলাফেরাও করতে পারেন না। তিনি অনেকটা নিয়ন্ত্রিত।

যেখানে বঙ্গবন্ধু ছিলেন এর বিপরীত। তিনি বলতেন, আমাকে ভারত থেকে সাবধান থাকতে হবে। পাকিস্তান আমাকে ডিস্টার্ব করতে পারবে না। আর ভারত তাকে মুসলমান হিসেবে বিশ্বাসও করতো না। যে কারণে বঙ্গবন্ধু দিল্লি থেকে ভারতের প্লেনে না এসে, ব্রিটিশ প্লেনে এসেছিলেন। তারা তাকে অনুরোধ করেছিল, কলকাতা দিয়ে আসতে; কিন্তু তিনি সরাসরি দেশে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু একজন ইনডিপেনডেন্ট নেতা ছিলেন। আর ভারত বুঝতে পেরেছিল তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে। তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবীর এ মঞ্চে তারও একটি বিরাট ভূমিকা আছে।

ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার আমাদের প্রতি ক্ষোভ নেই। থাকলে তো আমাদের জমি দিতেন না। বঙ্গবন্ধু ৩১ একর জমি দিয়েছিলেন। আমরা তার জন্য টাকা দিয়েছি। হাসিনাও ১৭ কি ১৮ একর জমি দিয়েছিলেন; কিন্তু দখল পাইনি। তিনি ওই জমিটুকু দিলে আমরা ক্যান্সার হাসপাতাল করতাম। তিনি সেটি উদ্বোধন করতেন। 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হাসিনার এটিই পার্থক্য। শেখ হাসিনার চারদিকে ব্যবসায়ীরা দখল করে আছে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কেউ দখল করে রাখতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে ব্যবসায়ীরা কন্ট্রোল করতে পারেনি। তিনি ব্যবসায়ীদের বলতেন, ‘তোমরা চাঁদা দিবা। তোমাদের যতটুকু দেখা দরকার, সেটা আমি দেখব। তোমরা দেশ নিয়ন্ত্রণ করবা না।’ বঙ্গবন্ধুর আমলে ব্যবসায়ীরা দেশ নিয়ন্ত্রণ করেনি। তফাৎগুলো বুঝতে হবে। বঙ্গবন্ধুর দরজা সবার জন্য খোলা ছিল। আমি তার পক্ষের লোক না। আমি আওয়ামী লীগ করি না। ছাত্রলীগ করিনি। আমি তার সমালোচনা করেছি। তিনি যত বড় লোক হোন কেন, তার ভুলের কথা মুখের ওপর বলে দিয়েছি। বেয়াদবি করিনি। তবে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলেছি, বাকশাল গঠনের ব্যাপারে। বলেছি যে, মুজিব ভাই এটি ভুল কাজ করছেন। এটি করবেন না। এরপরও আমি জীবিত আছি, বেঁচে আছি। তার একটি স্নেহের ব্যাপার ছিল। এ কারণে তিনি একজন বড় নেতা ছিলেন।

এখন অসুবিধা হলো- হাসিনার চারদিকে এত রকম প্রাচীর তুলেছে যে, সহজে কেউ দেখা করতে পারে না। আজকে তাকে আমি ফোন করলে, তার লোকেরা তাকে ফোনটা দেয় না। সামনাসামনি হলে বুঝিয়ে বলা যেত। তিনি যদি বিষয়গুলো বুঝতেন, তাহলে আমার নামে পুকুরের মাছ চুরির মামলা হতো না। ৫০ বছরের গণস্বাস্থ্যের সম্পদের চুরির মামলা হতো না। কারণ গণস্বাস্থ্যের জমির এক কাঠা মালিকানাও আমার নয়। সম্পূর্ণটা গণস্বাস্থ্য ট্রাস্টের। আজ আমার বয়স ৭৯ বছর। এ বয়সেও আমাকে আদালতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আমি নিশ্চিত তিনি যদি বুঝতেন পারতেন, তাহলে এ কাজ করতে দিতেন না।

আপনি একটি সময়ে এসে উপলব্ধি ও বিশ্বাস করেছেন, রাজনীতি ছাড়া পরিবর্তন সম্ভব নয়। আপনি কিন্তু সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হননি। বিভিন্ন সময় আমরা আপনাকে পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হতে দেখেছি। আপনি কি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা অনুভব করেননি কখনো?

আমি বিশ্বাস করি যে, অন্যদের করতে হবে। আমি জ্ঞান দিতে পারি। সব আমাকে করতে হবে কেন? প্রত্যেকের কাজের ডিভিশন থাকে। কারণ আমি তো সমাজতন্ত্রের জন্য রাজনীতি করে আসছি। আমি পার্টি ক্যাডার ছিলাম না। আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেছিলাম। এরশাদ সাহেব আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘এত জন এত কিছু চাইলেন; কিন্তু আপনি তো কিছু চাইলেন না।’ আমি তখন বললাম, ‘আমি কী চাইব? আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি কি ভিখারির বাড়ি থেকে এসেছি?’ তিনি বললেন, ‘এখানে কাগজ আছে, আপনি সাইন করে দেন।’ বারিধারায় আমাকে দশ কাঠা জমি দেবেন। আমি তখন বললাম, ‘আমি এটি দিয়ে কী করব? আপনি কী মনে করেন যে, আমার মাথা গোজার ঠাঁই নেই।’

আমার বাবা পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ওসি। সত্যি কথা বলতে কী, তখনকার ঢাকার মালিক! লালবাগ থানা ছিল- কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গার এপাড় থেকে সিদ্ধেশ্বরী, মিরপুর নিয়ে সব তার এলাকা। সম্পূর্ণ তার জমিদারি! সেখানে আমাদের কোনো বাড়ি-ঘর নেই, কোনো কিছু নেই। ওদিকে আমাদের কোনো আকর্ষণই জন্মায়নি। আমার বাবা বলতেন, ‘মালিক-টালিক হতেই পারতাম। তখন তোমাদের বউরা হয়তো বলতো- বাবা, আপনার ছেলে তো কাল রাতে বাসায় আসেনি। খুঁজে পেলাম নর্দমার পাড়ে, পতিতালয়ে, বা অন্য কোনো গুন্ডার বাড়িতে; বরঞ্চ আমার প্রত্যেক ছেলে-মেয়েকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করেছি।’

আপনি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। আপনার সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়নি?

আমার বড় দুর্বলতা হলো- আমার কোনো পার্টি নেই, এক ব্যক্তি ছাড়া। আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তারা লোভে পড়েছিল। হঠাৎ তারা দেখলো, আমরা ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। তখন যে ঢেউটা এনেছিলাম, সেটি ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে গিয়েছিল; কিন্তু তখন তারা কী করলো? আমার পার্টনাররা শুরু করলো ব্যক্তিগত দরকষাকষি। এটিই তো ভুল। ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে। আমি যে কথাটি বলেছিলাম, ৭০টি আসন পাবে ঐক্যফ্রন্টের অন্যরা আর বাকিগুলো পাবে বিএনপি। বিএনপির সঙ্গে চুক্তি হবে, প্রথম টার্মে নেতৃত্বে থাকবে কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তিরা। তারপরে তোমরা যদি জিঘাংসা না করো, তোমরাই তো বড় পার্টি। আমি বিশ্বাস করি- আজ যদি ঐক্য ফ্রন্ট আসতো- তাহলেও পরিবর্তন হতো না। আমাদের মধ্যে কোহেসিভনেসটাই (সংহতি) হয়নি। তারপর তারা লোভে পড়ে গেলেন। তারা নিশ্চিত হয়েছিল, যেভাবে বাতাস বইছিল, পাল উড়ছিল- তারা ভাবলো যে ক্ষমতায় প্রায় চলে গেলাম। যে কথা দিয়ে তাদের একত্র করেছিলাম, সেদিক থেকে উৎসাহ অন্যদিকে চলে গেল। সে কারণে আমরা ব্যর্থ হলাম। আমি আজ অংক কষে হিসাব করে দেখিয়ে দিতে পারি- আমাদের মধ্যে কোহেসিভনেস তৈরি হলে আমরা সফল হতাম, ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশের গোটা চেহারা পরিবর্তন হয়ে যেত।

১৫ দিনের মধ্যে সবকিছুর দাম কমিয়ে দিতাম। ১৫ দিনের মধ্যে আইন সংস্কার করে দিতাম। জজ সাহেবদের এত ঘুমাতে দিতাম না। ৬ মাসের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৭টি স্টেটে ভাগ করে ফেলতাম। সবাই নির্বাচিত হলে, আরও বেশি কর্মসংস্থান হবে। ডিসেন্ট্রালাইজেশন হবে, প্রতিযোগিতা হবে। এক মাসের মধ্যে সব ওষুধের দাম অর্ধেক হয়ে যাবে। ওষুধের দাম কমে যাবে; কিন্তু কর্মচারীর বেতন বেড়ে যাবে। লাভও বাড়বে; কিন্তু ওষুধের দাম কমে যাবে...

কীভাবে সেটি সম্ভব- ওষুধের দাম কমে যাবে; কিন্তু কর্মচারীর বেতন বেড়ে যাবে?

তার কারণ হলো- খরচটাই তো কম লাগে। যে অংকটা কেউ বুঝতে পারছে না। এতো বছরে আমি যে কাজ করেছি, সেটি সিরিয়াসভাবে করেছি। আমি বোঝার চেষ্টা করেছি যে, এতটুকু একটি বড়ির দাম এত কেন? আমি প্রথম দিনই বলেছি, এটি কাজ করবে না। আমেরিকাতে এর একটি কোর্সের দাম পড়ছে ২৪ ডলার আর আমাদের এখানে পঞ্চাশ হাজার টাকা। আমার কথা, এর দাম হওয়া উচিত এক হাজার টাকা। রিয়েলাইজ করেন, প্রফিটে কত?

এরশাদ সাহেব এমনিতেই আমার মিষ্টি কথাতে রাজি হয়নি। আমি অংক কষে দেখিয়েছি। আমি একটি কথা বলে রাখি, আমি সব সময় অংকতে ১০০ তে ১০০ পেতাম। সে জন্য যখন মানুষ বলে যে, আমি অংক বুঝি না। আমি বলি, না রে ভাই। যাদবের একটি গণিত বই ছিল, যা শেষ করতে চার বছর লাগতো। আমি এক বছরে শেষ করেছিলাম। আমি কিন্তু অংক বুঝি; কিন্তু আমার লোভ নেই। আমার একটি গুণ যে, আমার অর্থের প্রতি লোভ নেই, পদের প্রতি লোভ নেই। তবে একটি লোভ আছে, জনগণ সবাই ভালো থাকুক। তারা ভালো থেকে হেসে বলবেন যে, আপনি একটি উপকার করে গেছেন। সেই কারণে বলছি, এটি কোনো কঠিন কাজ নয়। এক মাসের মধ্যে এটি হয়ে যাবে। আমি তো ১৯৮২ সালের ওষুধনীতিতে অংক কষে সব কিছু দেখিয়ে দিয়েছি। (যেটি লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম ‘পলিটিকস অব ড্রাগস’)। এখানে দুর্ভাগ্য যে, ডাক্তারদের অর্থনীতি পড়ানো হয় না। ফলে আমাকে যে কথা বলে বোকার মতো বিশ্বাস করানো হয়- এতটুকু একটি ট্যাবলেটের দাম কেন ৩২ টাকা হবে। এটি কী সোনা।


সোনার দামের চেয়েও বেশি। কেন হবে? বাংলাদেশে হেপাটাইটিস-সি-এর একটি ট্যাবলেটের দাম পড়ে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা। আমি সেটিকে দেব ৪০০ টাকায়। তবু ২০০ টাকা লাভ আমার। আকাশ তো লাভের সীমানা হতে পারে না। আমি তো দেখিয়েছি। আমার তো বুদ্ধি বেড়েছে। হাঁটতে তো পারি না; কিন্তু বুদ্ধি তো কমেনি। আর্গুমেন্ট করা শিখেছি। ১৯৮২ সালে যখন ওষুধনীতি করেছি, তখন তো আমি আর্টিকুলেট ছিলাম না। তখন তো ঝগড়া করতাম। এখন তো ঝগড়া করি না। এখন মনে করি, কাজটা করিয়ে নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের অন্য কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন দরকার বলে আপনি মনে করেন?

ওপরের কথাগুলো স্বাস্থ্য খাতের। এখন প্রাইভেট খাত। ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য সারা পৃথিবীর দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এই ছয় মাসের মধ্যে দেশের প্রত্যেকটি ইয়াং শিক্ষিত ছেলের জন্য (যারাই বিদেশে যেতে চায়) হেলথ কেয়ারের ট্রেনিং দেওয়া হবে। কীভাবে একটি বৃদ্ধ মানুষকে টয়লেটে নিয়ে যেতে হয়। তাকে ধরে হাসি মুখে বলতে হবে- গুড মর্নিং, ড্যাড। হাউ আর ইউ? আরবিতে কথা বলতে হবে। তাকে যে কোনো একটি ভাষায় কথা বলতে হবে। এ কারণে শিখতে ও জানতে হবে। চল্লিশ লাখ শিক্ষিত বেকার ছেলের আয় তিন গুণ আয় করবে। এটা আমি ২০ বছর আগে থেকে বলছি। এর আমি একটি কারণ দেখি, সেজন্য বেকারত্ব কমে যাবে।

যেমন- পেঁয়াজের কথাই বলি। আমি পরিষ্কার দেশবাসীকে বলতাম, ছয় মাস আমাকে সময় দাও। পেঁয়াজ অর্ধেক করে খাও। তোমাদের আমি পাঁচ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছি পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য বিনা সুদে। আর এ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া হবে না। কারণে ব্যাংকের মাধ্যমে দিলে পি কে হালদারের মতো কেউ টাকা খেয়ে ফেলবে। সেখানে আমি কী করতাম, যারা মাইক্রোক্রেডিট করে, সেসব এনজিওকে বলতাম, তোমরা কৃষকদের হাতে টাকা পৌঁছাও, তোমাদের আমি ৫ শতাংশ দেব। পৌঁছানোর জন্য এবং আমার টাকা আদায় করার জন্য। আমার লাভ দুইটি- আমার খরচ কম হলো; কিন্তু লাভ বেশি হলো- সরকার বা ইনভেস্টর হিসেবে। কারণ ছয় মাস পর যখন পেঁয়াজ উঠে আসবে, তখন সে দেখবে আমার টাকাতে পেঁয়াজ উৎপাদন করেছে। তারপর একদল শিক্ষিত বেকার যুবক, যারা ঘুরে বেড়াচ্ছে; তাদের বলব, তুমি কৃষকের কাছে পেঁয়াজ ন্যায্য মূল্যে ক্রয় করে, ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ডাবল দামে বিক্রি করবে। এলাকায় পেঁয়াজ কেজি প্রতি ১০ টাকা হলে ঢাকায় সেটি ২০ টাকা হবে। এভাবে আমি এক বছরের মধ্যে দেখিয়ে দেব, আমাদের পার ক্যাপিটা ইনকাম বেড়ে গেছে। আজকে নারী নিপীড়ন, মাস্তানতন্ত্র সবকিছু তো পরোক্ষভাবে ক্ষমতা দেখানোর জন্য। এ সব না করে, তুমি যদি মন্ত্রী হও, তাহলে কী তোমার ক্ষমতা বাড়লো না!

এরশাদ সাহেব আটটি প্রদেশের কথা বলেছিলেন। না, সেটি না। আমি বলি যে, ১৭টি প্রদেশ করতে হবে। আগের সব পুরনো জেলা। সেখান থেকে সব নির্বাচিত হবে। তাদের জবাবদিহি বাড়বে। সংশ্লিষ্ট জেলার স্টাফদের ছেলে-মেয়ে নিয়ে সেখানে থাকতে হবে। তুমি সেখানে থাকবে, আর তোমার ছেলে-মেয়ে ঢাকায় পড়বে, তা কিন্তু হবে না। জনগণের ক্ষমতায়নটা খুব জরুরি। যেটি আমি শেখ সাহেবকে বুঝিয়েছিলাম। আমি নিজে রাজনীতি করিনি; কিন্তু প্রত্যেক রাজনীতিবিদকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। শেখ সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এখানেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি। তিনি বললেন, ‘কেমনে চলে? লন্ডনে অফিস না?’ আমি বললাম, ‘না না, লন্ডনে না। এডিনবরা।’ বললেন, ‘তাহলে কেমনে হবে?’ আমি বললাম, ‘প্লেন আছে না? ট্রেন আছে না? চার ঘণ্টার মধ্যে চলে আসেন।’ বললেন, ‘তাই না কি।’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ।’ আমি তাকে বললাম, আমার চাকরি লন্ডনের উইলসন দেননি। আমাকে চাকরি দিয়েছে- স্থানীয় কমিটি। আমার চাকরি ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান দিয়েছে। আমাদেরও এসব জিনিস আধুনিক করা দরকার। আমার হাজার হাজার লোক দরকার। আমার হাসপাতাল চালাতে তো লোক দরকার। এটি তো শিক্ষিতদের কথা। আর যারা কম শিক্ষিত, তাদের কারিগরি শিক্ষায় আয় বাড়িয়ে দিয়েছে। 

আমি বলি, এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ২০ লাখ লোকের চাকরি আফ্রিকাতে হবে। এগ্রিকালচারে। তোমরা এসব জানো না। আমি পৃথিবীর ১৫০টি দেশ ঘুরেছি। ওমর আল বশির যে বাজে লোক, সেও আমাকে ডেকে নিয়েছে। রাজীব গান্ধী তার প্লেন পাঠিয়ে দিয়েছে আমার বুদ্ধি নেওয়ার জন্য। আরে সর্বনাশ! যদি ইন্ডিয়ার প্লেন দিয়ে জাফরুল্লাহকে আনে, তাহলে সে চিরকালের জন্য ‘র’ হয়ে যাবে। বললাম, সর্বনাশ! এ কাজটি করবেন না আপনারা। ইন্ডিয়ান হাইকমিশন রাত ১২টা সময় আমাকে সাভারে গিয়ে ভিসা দিয়েছে। বলেছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে। এমন করাটা কঠিন কাজ না। আজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২ টাকা বেতন, আমি বেতনই উঠিয়ে দেব। এ ২২ টাকা উঠাতে কেরানিদের বেতন দিয়ে বেড়াব না। সব ফ্রি করে দেব। এসব করে দেখিয়ে দেব আমি।

প্রত্যেক গরিব মানুষ মাসে ১০০ টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ পাবে। দুটি বাতি পাবে ১০০ টাকা দিয়ে। আর কী করব- সব চুরির হিসাব নেব। কে কত চুরি করেছো- প্রথমেই বলব, তুমি যদি টাকা দিয়ে দাও, তাহলে আর তোমার বিচার করব না। যা লুটপাট করেছ, তা জমা দিয়ে দাও। ৫০ শতাংশ দিয়ে দাও। তারপর মাফ করে দেব।

যেসব পরিবর্তনের কথা বললেন, সেসব তো লেখা দরকার, মানুষের সামনে আসা দরকার...

সেটি তো রাজনীতি ছাড়া হবে না।

তাহলে কী সে রাজনীতির জন্য আপনি এগিয়ে যাচ্ছেন?

আমার মুশকিলটা হলো- আমার বয়স চলে গেছে। 

তারপরও তো আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে হবে...

স্বপ্ন দেখতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। সেজন্য আমি বলি যে, ধাপে ধাপে করতে চাই। এক মাসের মধ্যে ওষুধপত্র, হাসপাতালের দাম কমিয়ে দেব। একজন যেন দেখতে পায়, বিশ্বাস করতে পারে- এ লোক করতে পারে। তিন মাসের মধ্যে সংবিধান পরিবর্তন করে ১৭টি প্রদেশ বানিয়ে ফেলব। একমাত্র গভর্নর হবেন কেন্দ্রীয় সরকার। বাকি সব নির্বাচিত। তাই আজকে যদি আমি একশটি মেম্বার করি প্রতি প্রদেশে, তাহলে সতেরশ’ পলিটিক্যাল ওয়ার্কারের একোমোডেশন হবে। সেখানে আমি একটি ছোট কন্ডিশন দিয়ে দেব- ২৫ শতাংশ নারী কোটা থাকবে। এর বেশি নয়। কোনো আজগুবি কথা বলব না। তোমাকে নমিনেট করতে হবে। পয়সা দিয়ে নয়। তোমারটা তুমি কিনে নাও। এ পর্যন্ত আমার বউয়ের শাড়ি আমি কিনিনি, বিয়ের পরেও না। তাহলে এত শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করে আমার লাভটা কী হলো? তার জন্য যদি আমার বাজার করতে হয়। আমি চিন্তাটাই ভিন্নভাবে করেছি। আর আমি এ শিক্ষা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধ থেকে।

আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামের ভেতর দিয়ে ঢাকায় আসি। জুলাই মাসেই আমি ঢাকায় আসি। এই যে, মায়া, হাবিবুল আলমরা নানা গল্প করছে, তা কতটুকু সত্য। আমার সৌভাগ্য হলো- অনেক কিছুই দেখেছি। অনেকেই আমার সঙ্গে নেগোসিয়েশন করেছে। আন্দ্রে মারলোর সঙ্গে আমি দেখা করেছি অস্ত্র-শস্ত্রের জন্য। 

আমার সৌভাগ্য হয়েছে জীবনে অনেক কিছু করার; কিন্তু পুরোপুরি লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। এটি হলো আমার দুর্ভাগ্য। আমরা সহজে অনেক ভালো থাকতে পারতাম। আহ! যদি ১৭টি প্রদেশ হয়, তাহলে তো নিউজ এজেন্সি বেড়ে যাবে লোকালিটির জন্য। লোকাল টিভি, পত্রিকা বেড়ে যাবে। শিক্ষিত হবে। সবই হবে।

আপনি কোনো না কোনোভাবে, প্রত্যক্ষভাবে নয়, পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। আপনি কেন পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে থাকলেন?

আমি একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমাদের পরিবারের একটি ঐতিহ্য ছিল। আমার বাবা পুলিশের লোক ছিলেন। বাবা ঢাকা শহরে কোনো বাড়ি-ঘরও করেননি। সিদ্ধেশ্বরীতে একজন হিন্দু জমিদার ছিলেন। তিনি একটি মামলায় পড়েন। যেখানে এখন জাপান অ্যাম্বাসি আছে, এসবই তার সম্পত্তি ছিল। বাবাকে তিনি লিখে দিতে চাইলেন। বাবা রাগ করে বললেন, আমার কী বাড়ি-ঘর নেই। আপনার সম্পত্তি আমি নেব কেন? হয়তো বা আমরাই একমাত্র পুলিশ অফিসারের সন্তান, যাদের ঢাকা শহরে কোনো বাড়ি নেই। এটিই আমাদের ঐতিহ্য হয়তো বা।

আমার মা প্রত্যেক মেয়েকে (একজন বাদে, কারণ তিনি মানসিক প্রতিবন্ধী ছিলেন) বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন। বড় বোন তো (আমার ছোট) হাসিনার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। আলেয়া ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধি আর হাসিনা ছিলেন ছাত্রলীগের প্রতিনিধি। ছাত্রলীগ সব পদে হেরেছিল; কিন্তু হাসিনা জিতেছিলেন। আর এদিকে ছাত্র ইউনিয়ন সব পদে জিতেছিল; কিন্তু আমার বোন শুধু হেরেছিলেন। হাসিনা কিন্তু এখনো সেটি বলেন। আর রবরা বলেন, তারা বোরখা পড়ে গিয়ে হাসিনাকে ভোট দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব তখন জেলে ছিলেন, এ জন্য তিনি সিম্প্যাথি পেয়েছিলেন। এটি হলো আমাদের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড।

ছোটবেলা থেকে বৃত্তি পেয়েছি, তাই পড়াশোনা করতে পেরেছি। আমার নানা যখন মারা যান, তখন আমার জজ মামা প্রত্যেক বোনকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেই যুগে আড়াই হাজার টাকা। তখনকার আড়াই হাজার টাকা কিন্তু অনেক টাকা। সেই টাকা দিয়ে বকশি বাজারে আড়াই কাঠার একটি জমি কেনা হয়েছিল। সেটিই বাংলাদেশে আমাদের একমাত্র সম্পত্তি। তখন টিনের বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে আমরা ভাই-বোনরা লেখাপড়া করার পর বাবা অবসরে যান। অর্থের দিকে আমাদের লোভ জন্মায়নি।

আরও একটি ঘটনা বলা দরকার। যখন ছেচল্লিশ সালে দাঙ্গা হয় কলকাতায়, আমি তখন কলকাতায় ছিলাম। পাঁচ বছর বয়স অমার। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ছিলাম। আমার বাবা সর্বভারতীয় পুলিশের টিম থেকে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলেন। আমার বাবার শিক্ষক ছিলেন সূর্যসেন, মাস্টার দা সূর্যসেন। আমাদের পরিবার ছিল বর্ধিষ্ণু মুসলিম পরিবার। আমাদের বাড়িতে ‘অনুশীলন’ দলের লোকজন লুকিয়ে থাকতেন। আমার এক চাচাও এ দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই দলে মুসলমান তো খুব বেশি ছিল না। আমাদের বাড়িটা তাদের আশ্রয়স্থল ছিল। আমাদের বাড়ি আর নবীন সেনের বাড়ি পাশাপাশি ছিল। আমাদের গ্রাম কোয়ে পাড়া আর তাদেরটি নয়া পাড়া। তাছাড়া চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্য ছিল, এর অসাম্প্রদায়িকতা। আমরা বিয়েতে বৌদ্ধদের জন্য আলাদা কোনো খাবারের ব্যবস্থা করতাম না। তবে হিন্দুদের জন্য আলাদা ছাগল দিয়ে দিতে হতো। তারা অনুষ্ঠানস্থলে রান্না করে খেতেন।

তখন আমাদের গ্রামে কোনো হাই স্কুল ছিল না। আমার দাদা মহামুনি বৌদ্ধ মন্দিরে অর্থ দিয়েছিলেন। আর আমার বাবা সেখানে পালি ভাষা পড়তেন। তিনি কিন্তু উর্দু, আরবি পড়েননি। আমার দাদা এক সময় তাদের বললেন, আমাদের মুসলমান কিছু ছাত্র এখানে তো পড়ে, তাহলে আমাদের একজন প্রতিনিধি তোমরা নাও। তারা তা নেয়নি। তখন দাদা রাগ করে আমাদের গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন।

কলকাতায় আমার বাবা খালি পায়ে ফুটবল খেলে ইংরেজদের হারিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তারা তাকে টার্গেট করেন এবং বলেন, তুমি কি আমাদের দলে খেলবে? আমার বাবা তখন কলেজে পড়েন। তিনি পুলিশের টিমে খেলার জন্য কলকাতায় গিয়েছিলেন। পুলিশের চাকরি করতেন। কাজকর্ম করতেন না। শুধু ফুটবল খেলতেন। পরে তিনি সর্ব ভারতীয় হকি টিমেও খেলেছেন। বাবার জন্য আমাদের কলকাতায় যাওয়া। আমারা থাকতাম পার্ক সার্কাসে। আমার একজন ছোট ভাই ছিল। তার জন্ম কলকাতাতেই। সে পরে এম্বাসেডর হয়েছিল। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় আমরা হিন্দু-শিখদের দ্বারা আক্রান্ত হলাম। আমরা দোতালায় থাকতাম। নিচতলায় থাকত একটি হিন্দু পরিবার। তখন তারাই আমাদের বাঁচিয়েছিল। হিন্দু-শিখ গুন্ডারা তখন চলে যায়। তারপর আসে মুসলমান গুন্ডারা। তারা আমাদের নিচতলার হিন্দু পরিবারের ওপর হামলা চালাবে। আমার মা তখন বাড়ির ছাদের ওপর উঠে যান আমার ছোট ভাইটিকে নিয়ে। মুসলমান গুন্ডাদের বললেন, তোমরা যদি এই পরিবাররের ওপর হামলা চালাও তাহলে আমি এ মুসলমান বাচ্চাকে ছাদ থেকে ফেলে দেব। গুন্ডারা তখন ঘবড়ে গেল। একদিকে যেমন এ রকম কাজ করেছেন মা, তেমনি আবার ফাতেমা জিন্নাহর মিটিংয়েও গিয়েছেন তিনি। মানবতার বিষয়টি মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। ১৯৪৮ সালে বাবা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন লালবাগ থানার ওসি হয়ে। লালবাজার থেকে লালবাগ। বাবা যেহেতু কলকাতা থেকে ১৯৪৮ সালে এসেছেন- উচ্চপদস্থ না; কিন্তু থানার ওসি ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি সূত্রাপুরের ওসি। সেই সময় অলি আহাদরা ধরা পড়েন, তিনি তাদের হাজতে রাখেননি। বললেন, এত শিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কীভাবে আমি হাজতে রাখি! রাত্রিবেলা তিনি তাদের আমাদের বাসায় রেখেছিলেন। থানার পাশেই ওসির বসবাসের জন্য দুই তলা বিল্ডিং ছিল। তিনি তাদের বললেন, তোমরা রাতে এখানে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়। আর তোমরা যদি পালিয়ে যাও, তাহলে আমার চাকরি চলে যাবে। আমার ছেলে-মেয়ে না খেয়ে থাকবে। তারা পালায়নি; কিন্তু খবরটা গোপন থাকেনি। সরকারের কাছে খবর গেছে, তিনি তাদের মদদ দিচ্ছেন। এ কারণে তাকে পানিশমেন্ট দেওয়া হয়।

যখন আদমজীর দাঙ্গা হয়, তিনি ছিলেন চিফ ইনভেস্টিগেটিং অফিসার। তিনি শেখ মুজিবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। সরকার চাচ্ছে শেখ মুজিব এটির মদদদাতা দেখাতে; কিন্তু তিনি বললেন, তার কোনো ভূমিকা নেই। তবে তখনকার পুলিশ অফিসারসহ বহু সরকারি কর্মকর্তা সহযোগী ছিলেন আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের, সবার দেশপ্রেম ছিল।

আমি যখন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, তখন শেখ মুজিব বাবার কথা আমাকে বলতেন। তিনি তাকে চিনতেন। বাবা খুব সিগারেট খেতেন। দিনে একশটা। তখন সিগারেটের টিন পাওয়া যেত। আর সিগারেট যারা খায়, তারা নিজে একটি খায় আর যে সঙ্গে থাকে তাকেও খাওয়ায়। বাবার একটু সর্দি-কাশি হয়েছিল। তিনি তখন ডাক্তার এম এন নন্দীর কাছে গেলেন। নন্দী সাহেব তখনকার নামকরা ডাক্তার ছিলেন। তিনিও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন। গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উচ্চাশিক্ষার জন্য ফ্রান্স সরকারের বৃত্তি পেয়েছিলেন। তখন পার্টি তাকে ফ্রান্সে যেতে না করে বলেছিল, সামনে দুর্ভিক্ষ আসছে, তোমাকে মুন্সীগঞ্জ যেতে হবে। নন্দী সাহেব বোম্বে থেকে ফিরে আসেন। নন্দীর সঙ্গে বাবার পরিচয় ছিল। বাবা তার কাছে গেলেন চিকিৎসা করাতে। নন্দী তখন বললেন, ধোঁয়া খাওয়া তো আপনার কাছে আনন্দের বিষয়। আপনাকে আমি ওষুধ দিচ্ছি না। আপনাকে এটা ত্যাগ করতে বলছি না। তবে একটি উইল করেন। একদিন তো মরে যাবেন। উইল করলে সুবিধা হবে। কারণ বাবা হিসেবে আপনার সন্তানদের জন্য কিছু রেখে যেতে হবে। আপনি বেঁচে থাকবেন না, তাই উইল করে যান। বাবা এ কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি এক দিনের মধ্যে সিগারেট ছেড়ে দিলেন। এ থেকে আমার বাবার ডিটারমিনেশন বোঝা যায়। তিনি নিজে ৫০টি আর অন্যদের ৫০টি সিগারেট খাওয়াতেন। বাবার ডিটারমিনেশনের এ গুণটা কিছুটা হলেও আমরা পেয়েছি। 

বাবার এলাকায় মওলানা ভাসানী থাকতেন। সূত্রাপুরের দিকে। আমি যখন মেট্রিক পরীক্ষা দেব, তখন বাবা তার কাছে নিয়ে গেলেন দোয়া চাইতে। তিনি আমাকে কিছু কথাবার্তা বলে ফুঁ দিয়ে বললেন, ‘যা ভালো কইরা পড়াশোনা কর।’ যখন ভালো রেজাল্ট করলাম, তখন বাবা মনে করলেন- মওলানার ফুঁতে ভালো রেজাল্ট করেছি। বাবার এসব ঘটনা আমাদের প্রভাবিত করেছে; কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে নেতৃত্বের ভূমিকায় কখনো আসা হয়নি।

আপনি যখন লন্ডনে পড়েছেন, তখন একটি বিলাসবহুল জীবনযাপন করেছেন। নিজস্ব দামি গাড়ি ছিল। রাজ পরিবারের দর্জি আপনার স্যুট সেলাই করে দিত। তারপর নিজস্ব বিমান চালানোর জন্য আপনার প্রাইভেট লাইসেন্স ছিল; কিন্তু সেসব ত্যাগ করে আপনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন। তখন থেকে আপনার জীবনে একটি ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এরপর থেকে আপনি শুধু জনসেবা, মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। বিলাসবহুল জীবন থেকে একটি সাধারণ মানের জীবনযাপনে আপনি নিজেকে কতটা খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছেন?

পুঁজিবাদী দেশে ছিলাম, তাই পুঁজিবাদী আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছিল। আমার একটি গুণ বা যাই হোক, আমি সবসময় প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলাম। যখন যেখানে বুঝেছি যে, এখানে অন্যায় হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেছি। শারীরিক দিক দিয়ে রোগা, পটকা ছিলাম; কিন্তু সাহসটা ছিল প্রখর।

আমার মা চেয়েছিলেন- আমি শিক্ষিত হয়ে দেশের ও জনগণের সেবা করি। আমার মা আমাকে প্রভাবিত করেছেন। আমার কিন্তু ডাক্তার হওয়ার শখ ছিল না। আমি ব্যাংকার হতে চেয়েছিলাম। তাই বি. কম পড়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। আমার মায়ের কয়েকজন কাজিন ডাক্তার ছিলেন। চট্টগামের প্রথম ডাক্তার আমার মায়ের কাজিন। তাই মা আমাকে ইন্সপায়ার করেছেন। তার কারণ হলো- মা তেতাল্লিশের মন্বন্তর দেখেছেন। তিনি প্রতিদিন সেসব গল্প বলতেন- মানুষ কী রকম কষ্ট ভোগ করেছে। সুতরাং এর জন্য মুক্তি দরকার। তাই আমাদের অজান্তে যেমন- বাবার একদিনের সিগারেট ছাড়ার ঘটনা আমাদের উৎসাহিত করেছে। আমার ভাইদের কেউ কখনো সিগারেট খায়নি। আমি জীবনে সিগারেট ছুঁয়েও দেখিনি। সিগারেটে একটি টান দিয়েও দেখিনি। তেমনি লন্ডনে থাকাকালীন কোনোদিন মদ ছুঁয়ে দেখিনি। তারও কারণ আছে। যেমন- লন্ডনে ক্রিসমাসের দিনে খ্রিস্টানদের অনুষ্ঠানে যেতাম। সেখানে অনেকে মনের আনন্দে মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়তো। সেখানে আমার সহকর্মীরা মদ খেয়ে বমি করত। কারণ তাদের তো অভ্যাস নেই। আর কান্নাকাটি করে বলত যে, আমার বাবা আর বেহেস্তে যাবেন না। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে, মদ খেলে তো আমারও এই চরিত্র হবে। আমি লন্ডনে ৯ ডিসেম্বর গিয়েছি। আর ক্রিসমাস পার্টি তো ২০ দিন পর হয়েছে। আমি সেখানকার কান্ড কারখানা দেখে আমার বাবার এক দিনের মতো শত চেষ্টা করেও এক ফোঁটা মদ খাওয়াতে পারেনি। আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়েছে আমার সহকর্মীর কথা। যে বলছে, আমার বাবা তো বেহেস্তে যাবে না। আমার নামাজি বাপের কী হবে? আমি ভাবলাম, এ চেহারা তো আমারও হবে। 

আমি হার্ড ওয়ার্কার ছিলাম। ছোটবেলা থেকে বাবা-মা শিখিয়েছে। তখনকার দিনে লন্ডনে ডাক্তারের শর্টেজ ছিল। আমাদের প্রতিদিন ১৫-২০ ঘণ্টা ডিউটি করতে হতো। আমি মনে করতাম, আমি কাজ শিখতে পারছি। আমার এক কনসালট্যান্ট ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তুমি যা শিখবে, তা-ই নিয়ে যাবে। তুমি কিছু রেখে যাবে না- যেহেতু তুমি এমন এক ব্যক্তি, যে এখানে থাকতে চাও না। আরও বলেছেন, এখানে তোমার সুবর্ণ সুযোগ আছে। তোমার প্রমোশন হয়ে যাবে। তোমার কত ভালো লাইফ হবে!

আমি তখন বললাম- দেখো, আমাকে যে দেশ পড়িয়েছে। আমার মায়ের কর্তব্য তো পালন করতে হবে। সবাই জানতো যে, আমি সেখানে থাকব না। তাই কতগুলো জিনিস আমার চরিত্রের মধ্যে এসেছে। যেমন- সেখানে আমি ফ্লাইয়িং শেখেছি। তার কারণ, আমার মনে হয়েছে- আমাদের দেশটিকে একদিন স্বাধীন হতে হবে।

তার মানে আপনি স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকে এসব নিয়ে চিন্তা করেছেন?

তখনই আমি আইরিস রিপাবলিকান আর্মির (আইআরএ) সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের যারা ভ্যাটেরান ছিলেন, তাদের সঙ্গে আলাপ করতাম। মানে, কীভাবে তারা করেছে, তা ভাবতাম। তখনই খোঁজ-খবর নিতাম- ব্রিটেনে একটি ট্রেনিং নিয়েছি। এর মধ্যে কিছুটা রোমান্টিসিজম আর কমিটমেন্ট ছিল। দুটি মিলিয়ে। আর দেশপ্রেম তো ছিলই। 

আমাকে ব্রিটেনে একটি বিষয় আকর্ষণ করেছে যে, একটি পুঁজিবাদী দেশে সবাই সমান চিকিৎসাসেবা পায়। এটি আমাকে চার্ম করে দিয়েছে। তখন ভেবেছি, আমাদের দেশে কবে হবে এ রকম অবস্থা। একজন যেখানে থাকুক, ওয়েলসের একটি গ্রামে থাকুক বা লন্ডন শহরে থাকুক- সবাই হাই কোয়ালিটির চিকিৎসা সেবা পায়। আর সরকার সব ব্যবস্থা করে। আমি বোকা হয়ে গেছি- একটি পুঁজিবাদী দেশে বেকার থাকলে, বেকার ভাতা দেয়। তারা পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য এসব করে। অপরদিকে, আমি জেনেশুনেও ফাইট করেছি।

আমি যখন বিলাতে গেলাম, সেখানে রেজিস্ট্রেশন নিতে হয় ডাক্তারি করার জন্য। আমার সঙ্গে আরেকজন ডাক্তার গেলেন- মশিউজ্জামান। যাদের বাড়িতে শেখ সাহেব থাকতেন। তার বাবা-মা ইন্সপেক্টর ছিলেন। তারা সিদ্ধেশ্বরীতে থাকতেন। পুকুর পাড়ে একটি টিনের বাড়ি ছিল। লোকে তো রাজনীতিবিদদের বাড়ি ভাড়া দিত না, ভাড়া দিতে পারত না বলে। তিনিও ফরিদপুরের, শেখ সাহেবও একই এলাকার ছিলেন। ওই যে আগেই বলেছি, অনেক অফিসার ছিল, যারা মনে মনে সমর্থন করত। ওই ভদ্রলোক শেখ সাহেবের পরিবারকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন। শেখ সাহেব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়ি ভাড়া শোধ করতে পারেননি। তারা তো আজকের মতো টাকা-পয়সা লুটপাট করতেন না। জনগণের জন্য ব্যয় করতেন। তার ছেলেটি আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন। তিনি ফার্স্ট হয়েছিল। আমি তো হইনি। আমি যে এমবিবিএস পাস করেছি, তার মূল সার্টিফিকেট ছিল না। তার কারণ হলো, মোনায়েম খানের হাত থেকে সার্টিফিকেট নিতে হয় কনভোকেশনের দিনে। আমি তো নেব না তার হাত থেকে। প্রিন্সিপালকে বলেছি, স্যার, তার কাছ থেকে আমি সার্টিফিকেট নেব না। তা সার্টিফিকেট ছাড়া আমি ওখানে গিয়েছি। তখন তারা বললেন, সার্টিফিকেট ছাড়া কীভাবে? আমি বললাম, আমি তো পরীক্ষা দিয়েছি। তার কাগজ আছে। প্রভিশনাল সার্টিফিকেট আছে, যেটি প্রিন্সিপাল দিয়েছেন। তখন একজন মহিলা সেক্রেটারি বললেন, ‘ইয়াংম্যান, ইউ ডিসায়ার সামথিং ফর হুইচ ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ।’ আমি বললাম, ‘হোয়াট? হাউ ডেয়ার ইউ টক মি টু লাইক দ্যাট। ইট ইজ আ র‍্যাসিয়াল ডিসক্রিমিনেশন। আই উইল টেক ইউ টু দ্য কোর্ট।’ মাত্র বিশ দিন হলো বিলাতে গেছি। আমি জানতাম, জাস্টিস পাবো। ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের সব ডাক্তারদের অরগানাইজ করব। তারপর হোল সিস্টেম কলাপস করে দেব। যখন এসব বলে ফিরে যাচ্ছি, তখন একজন পেছন থেকে ডাকছে- ‘স্যার স্যার স্যার।’ আমি ভাবলাম কে ডাকে? পেছন ফিরে দেখি একটি লোক দৌড়ে আসছে, বলে আমাদের সেক্রেটারি তোমাকে ডাকছে। তখন আমার মনে হলো যে, শুনতে আপত্তি কোথায়? যাই না, দেখি। চাকরি-বাকরি না করলে খাবোটা কী? কারণ মাত্র ১০ পাউন্ড নিয়ে বিলাতে গিয়েছি। যাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘ইয়াং ম্যান ওয়েল কাম টু ব্রিটেন।’ আমি বললাম, না না, আমাকে ইনসাল্ট করেছে। তিনি বললেন, ‘প্লিজ, ট্রাই টু অনডারস্ট্যান্ড, হি ইজ আ ইয়াং লেডি। ডু নট নো হাউ টু বিহ্যাভ। উই হ্যাভ রুল, বাট এভরি রুল হ্যাজ এক্সেপশন। লেট মি সি, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?’ তখন মনে হলো, দুই দিন অপেক্ষা করে দেখি না! 

তখন আমার একটি সিনিয়র পজিশন হলো। আর আমার বন্ধু, যে ফার্স্ট হয়েছিল, তাকে জুনিয়র পোস্টে কাজ দিয়েছে। এটি আমার ফাইট করার কারণে হলো। এটি আমার চরিত্রের একটি বিশেষ দিক। আরেকটি ঘটনা বলি- আমি যখন ছাত্র ছিলাম, গো-বেচারা টাইপের ছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন আজম খান। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আসলেন। তখন তো মেডিক্যালে বড় করিডোর ছিল। দুই পাশে ছাত্ররা দাঁড়িয়ে আছেন আর তিনি যাচ্ছেন। যখন তিনি আমার কাছে এসেছেন, আমি পট করে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। তিনিও হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি হাত ধরেই বলেছি- ‘মিস্টার গভর্নর, ইউ হ্যাভ কাম টু টেল আস।’ ভালো উর্দুতেই বললাম- ‘তুমি কী জানো, আমার ভাইস প্রেসিডেন্টকে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে।’ তিনি ডাক্তার হওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। তিনি আমার দিকে তাকাই থাকলেন। আমি বললাম- তোমার কথার কী দাম আছে? ডাক্তার হতে দিচ্ছো না। আমি এসব বলার পর পরই অন্যরা বলতে লাগল, ‘ওদের তো ওয়ারেন্ট আছে। এবার তোমাকেও ধরে নিয়ে যাবে। বেকুব কোথাকার? কে তোমাকে এসব বলতে বলেছে।’ আমি গ্যালারিতে গিয়ে দেখি তিনি গ্যালারির দিকে তাকিয়ে আছেন- দেখছেন, আমি কোথায় আছি। সেখানে তিনি বললেন, তোমাদের নিয়ম মানতে হবে, ইত্যাদি। বক্তৃতা হলো। তিনি যখন বক্তৃতা শেষ করলেন, আমি পেছন দিক দিয়ে সটকে পড়লাম। অন্যরা বলল, ‘ভাগো। নতুবা তোমার রেহাই নেই।’ তিনি পিন্সিপালের রুমে চা খেতে ঢুকলেন। বললেন, ‘ওই ছেলেটাকে ডাকো, যে আমার হাত ধরেছিল।’ আমি তো বাইরে ছিলাম। সবাই বলছে- ‘পালা পালা পালা।’ আমি তখন বললাম, ‘আমি পালাব কেন? আমি কী করেছি?’ তখন পিয়ন এসে বলে, ‘স্যার আপনাকে ডাকে।’ গেলাম। তিনি বললেন, ‘বসো।’

তারপর আমাকে তাদের সঙ্গে চাও খাওয়াল। আজম খান বললেন, তাকে পরীক্ষার সময় ধরবে না। তারপর আমার একটি বিশ্বাস হলো যে, তারা ধরবে না। আমি তখন তাকে বললাম, ভালো করে পরীক্ষা দিয়ে দেন। পরে সব ছেলেরা থ মেরে গেল যে, এর এত সাহস! এরপর কী হলো, তারা সবাই আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি বানিয়ে দিল। তারা সবাই বলল, ‘তুমিই উপযুক্ত এ পদের জন্য।’ তা আমার একটি ব্যাপার হলো- আমি যেটিকে সঠিক মনে করি, আমি সেটিই করি। আমাদের সময় একবার হলো কী? মাস্টাররা তো সাজেশন দেয়। তা পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। হঠাৎ একজন দেখে কিছুই মিলেনি সাজেশনের সঙ্গে। সবাই পরীক্ষা না দিয়ে কাগজপত্র জমা দিয়ে হই হই করে বের হয়ে গেছে। তখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বয়সও কম ছিল, বরং আমাদের বয়স বেশি ছিল; কিন্তু এক ছেলে প্রশ্ন নিয়ে চলে এসেছে। ক্যান্টিনে এসে দেখে যে, সাজেশনের পাঁচটির মধ্যে চারটিই কমন পড়েছে। এখন আমরা তো কাগজপত্র জমা দিয়ে চলে এসেছি। আবার পরীক্ষা হতে আরও ছয় মাস বাকি। তখন ছাত্রলীগ ক্ষমতায়। ছাত্রলীগের নেতারা বুঝাল, এটা নিয়ে কিছু হবে না। সুতরাং ছাত্র ইউনিয়নকে ডুবিয়ে দাও। এখন কী করা যায়। সর্বদলীয় কমিটি কর এবং জাফরুল্লাহকে কনভেনার বানিয়ে দাও। তার দেখল যে আমি একটু এগিয়ে। ছাত্ররা তো এসব জানত। আমাকে কনভেনার করা হলো। এখন যে কাজ করা যাবে না, সেই কাজেরই কনভেনার হলাম। মানে আমার ভবিষ্যৎ খতম, ছাত্র ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ খতম। কারণ এটি তো সর্বদলীয় কমিটি। তখন ভাবছি কী করা যায়? তখন মাহমুদ হোসেন সেলিম ভাইস চ্যান্সেলর। তখন ভাবছি, দায়িত্ব যখন দিয়েছে তো কিছু একটা করতে হবে। ভাইস চ্যান্সেলারের বাসায় কাউকে ঢুকতে দেয় না। আমি তো চেহারায় হ্যাংলা-পাতলা ছিলাম এ কারণে কেউ আমাকে পাত্তাই দেয় না। যতই সেক্রেটারিকে বলি, আমাকে ঢোকার অনুমতি দেন, তখন বলে- তুমি প্রিন্সিপালের সার্টিফিকেট নিয়ে আসো। এভাবে দেখা হবে না। আমি বয় স্কাউট করতাম। ভাবলাম, চাকর-বাকররা যে বাজার করে কোন দিক দিয়ে যায়। তারা তো সামনে দিয়ে যায় না। তাহলে পেছন দিকে রাস্তা আছে। আমি তখন পেছনের রাস্তা দিয়ে ঢুকলাম। ভাইস চ্যান্সেলর দেখে বলে, ‘তুম কোন হ্যায়? কেয়া বাত? কেয়া বাত?’ আমি তখন বললাম- আমি মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। তিনি তো ঘটনা জানতেন। বললেন, ‘কুছ নেহি হোগা। ইয়ে কিউ কিয়া?’ আমি সত্য কথাটি বললাম। আমরা তো এটি ভুল করে করেছি। তখন তিনি হেসে দিয়েছেন। বললেন, ‘কেয়া করেগা। কুছ নেহি হোগা।’ আমি তখন বললাম, স্যার, ছয় মাস নষ্ট হবে। তিনি বললেন, ‘প্রথম কথা, তুমি কখনো পেছনের দরজা দিয়ে আসবে না।’ সেক্রেটারিকে ডেকে বললেন, ‘ডাক্তার সাহেব যখন আসবেন, তাকে আসতে দেবে।’ এরপর বলেছেন, ‘দেখো, এটি তো একাডেমিক কাউন্সিলে যাবে, সেখানে দু’জন ঊর্ধ্বতন আছেন, যাদের কোনো মায়া-দয়া নেই। একজন ইসলামিক স্টাডিজের হেড, তিনি আবার ডিনও; আর তোমার প্রিন্সিপাল শামসুদ্দিন সাহেব। তাহলে একটি কাজ করি, আমি ডিনকে হ্যান্ডেল করব আর তুমি তোমার প্রিন্সিপালকে হ্যান্ডেল করবে।’ আমি তখন বললাম, ‘আপনি এটি কীভাবে করবেন?’ তিনি বললেন, ‘একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিংয়ের সময় টিম ইন্সপেক্টর হিসেবে আমি তাকে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেব। যাতে মিটিংয়ে না থাকতে পারে। তুমি তোমার পিন্সিপালকে ম্যানেজ কর। তা করতে না পারলে তো হবে না। ঠিক আছে?’ আমাকে চা-টা খাইয়ে খুব স্নেহ করলেন, যেহেতু আমি সত্য কথা বলেছি। আমি আর কাউকে বলিনি যে, আমি দেখা করে ফেলেছি।

তারপর আমি গেলাম প্রিন্সিপালের কাছে। প্রিন্সিপাল তো কথা শুনতে চায় না। বললেন, তুমি তো আমার ছেলেকে মেরেছ। ছেলেরা তাকে মেরেছে, যেহেতু সে পরীক্ষা দিতে চাইছে। অমল সরকারকে আবু সাইয়্যিদ চৌধুরীর বাবা আব্দুল হামিদ ফাইন্যান্স করত। এ জন্য তার প্রতি একটি দুর্বলতা ছিল। ছেলেরা সব বাইরে দাঁড়িয়ে। আমি তাদের বললাম, তোমরা কেউ হৈ-হুল্লোড় করবে না কিন্তু। আমি যেহেতু কনভেনার, সেহেতু আমাকে হ্যান্ডেল করতে দাও। প্রিন্সিপাল স্যার বলেন, ‘তুমি জানো, আমি কিছু করতে পারব না। ওটা বাঘ, বাঘ। মাহমুদ হোসেন, জাকির হোসেনের ভাই। তিনি পণ্ডিত মানুষ। এ সব অনাচার সহ্য করেন না।’ আমি তো জানি, আমি ব্যবস্থা করে এসেছি। কিচ্ছু হবে না। স্যার, আপনি রিকমান্ড করলেই হবে। নাহ। ‘তোমরা আমার ছেলেকে মেরেছ।’ বললাম, স্যার, আপনি একটু ভুল কথা বললেন। ‘কী ভুল বলেছি?’ আপনার ছেলেকে কে মেরেছে? আমি বললাম, অন্য ছেলেরা মেরেছে? মানে, আপনার বাকি ছেলেরা মেরেছে। আমরাও তো আপনারই ছেলে। আমাদের শাস্তি দিতে হলে, আপনার ভালো ছেলেটা শাস্তি পাবে। সেও পরীক্ষা দিতে পারবে না। তার চেয়ে আপনি একটি রিকম্যান্ড করেন। তিনি বলেন, ‘রিকম্যান্ড করে কোনো লাভ হবে না।’ আমি তো চুপ করে আছি। আমি তো জানি, ব্যবস্থা করে এসেছি। এরপর লিখে দিয়েছে- ‘কনসিডার করা হলো।’ আমি কাগজ নিয়ে মাহমুদ হোসেনের কাছে গিয়ে হাজির। তিনি বললেন, ‘করলে কেমন করে? তিনি তো এটি করেন না।’ বললাম, ‘তাহলে আপনি কি না করার জন্য পাঠিয়েছেন।’ বললেন, ‘না, না! তিনি তো এটি করার কথা না। কেমন করে করলে?’ আমি কাহিনি বললাম। বললেন, ‘তুমি তো মহা পলিটিশিয়ান। সময় কিন্তু বেশি দেব না। শুধু দুই সপ্তাহ দেব।’ বললাম, ‘তা-ই হবে স্যার। দুই সপ্তাহের মধ্যে হলে আমরা পরীক্ষা দিয়ে দেব।’

এসে বললাম, ‘দেখো, আমি ফাইট করেছি- সময়-টময় এক গাদা করা যাবে না। দুই সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা হবে। কোনো হৈ-হুল্লোড় করা যাবে না।’ মিটিং করলাম। একটি কঠিন কাজ। যত না কাজটা কঠিন, তারচেয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে দেখা করা কঠিন। ঠিকই তিনি দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে দিলেন। সময় দেওয়ার পরে সব সিনয়ররা থ মেরে গেল। বলে কী ছেলে, কেমন করে করল এটা! আমি যেটি বলতে চাই, আমাকে কেউ দায়িত্ব দিলে আমি সেটি করার চেষ্টা করি।

স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আপনার যে চিন্তা-ভাবনা- ৮২ সালে ওষুধনীতি করার জন্য যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলা হয়ে থাকে। তার পরবর্তীতে আমরা দেখেছি যে, আপনার সেই ওষুধ নীতির প্রতিফলন আর সেভাবে ঘটেনি। এটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

হঠাৎ যে কিছু করেছি, সে রকম কিছু না। এটি বলতে গেলেও ইতিহাস বলতে হবে। আমি যখন বিলাতে তখন তারা মনে করত, আমি বোকা। ১৬ ঘণ্টা খাটায়, আমি আপত্তি করি না। আর ভাবি যে, কাজ শিখতে পারছি। আর আমার যে বস ছিল, যুদ্ধের সময় ওই ভদ্রলোক এই দেশে ছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তিনি বলতেন- দেখো জাফরুল্লাহ, তুমি এখানে যত রোগী মারবে, ইচ্ছে করে মারো না। তুমি একটি কথা মনে রাখবে, কোনো সার্জন যদি বলে, তার হাতে কোনো রোগী মরেনি, তাহলে বুঝবে সে একটি বড় মিথ্যুক। নতুবা সে পর্যাপ্ত জানে না সার্জারি সম্পর্কে। পর্যাপ্ত কাজ করেনি, তাই রোগী মরেনি। আর এজন্য সে মিথ্যা কথা বলছে। তুমি আসছো অন্য একটি দেশ থেকে। এখানে তুমি যা শিখবে, বদনাম সব আমার হবে; কিন্তু তোমার হাত পাকা হবে। ফলে সার্জারি নিজে না করলে তো শেখা যায় না। ওদের তো তেমন ডাক্তার নেই, তাই আমাকে খাটাত।

বিলাতে তখন তো আমরা যেতাম কলোনিয়াল শাসনের কারণে আমাদের মনে হতো এর চেয়ে বড় কোনো দেশ নেই। একদিন রবিবারে অন কল ডিউটিতে আছি, একটি পত্রিকায় হঠাৎ একদিন দেখি বিলাতে যে টেট্রাসাইক্লিন যে আসে, সেটি বিলাতের তৈরি না। সেটি একটি গরুর ফার্মে তৈরি হয় কমিউনিস্ট দেশ আলবেনিয়ায়। হায়, আমাদের চোখ বড় আছে না কি- কমিউনিস্ট দেশে তৈরি হয়! এটা হলো- প্রথম ধাক্কা খেলাম। তখন আমার আগ্রহ তৈরি হলো। তখনই আমি খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম। পরের সপ্তাহে আরেকটি খবর দেখলাম- ওষুধ কোম্পানি রশ ডায়াজিপাম তৈরি করে। এটি এতটুকু একটি ট্যাবলেট, যার আন্তর্জাতিক মূল্য ৬ ডলার আর তারা ৫০ ডলারে ব্রিটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে বিক্রি করে। এটি নিয়ে মনোপলিস কমিশনে কেস হলো, এই প্রতারণার জন্য। দুই মিলিয়ন পাউন্ড জরিমানা হলো। তখনই মনে হলো, এরা তো ভদ্রলোক নয়। সবাই চুরি করে। এটি থেকেই আমি ওষুধের খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করলাম। তারপর দেখলাম কলম্বিয়া নামে একটি ছোট দেশ, সেখানে রশ কোম্পানির একটি ফ্যাক্টরি আছে। সেই কোম্পানি তাদের ইনভেস্টমেন্ট বাড়াতে চাইল। তারা দরখাস্ত করেছে। তাদের দেশের অর্থমন্ত্রী হারভার্ড থেকে পাস করা। আমি বললাম, লাভ কেমন হয়? জানায়, তেমন লাভ হয় না। লাভ হয় না, তাও ইনভেস্ট করতে চায়, ব্যাপারটা কী? ট্যাক্স দেয়, শ্রমিকদের বেতন ঠিক মতো দেয়, তাহলে লাভ কেন হয় না? অংক তো মেলে না। তখন ওই অর্থমন্ত্রীর হারভার্ডের যে প্রফেসর ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি অন্য জায়গায় খোঁজ নিতে বলেন- কাঁচামাল কোথা থেকে আসে। তখন জানা যায়, তারা ইমপোর্ট করে। সমুদ্র পথে ইমপোর্ট হয়। তখন দেখা যায়, সে যদি এক টন আনে, তাহলে ডিক্লেয়ার করে দুই টন। দুই টনের জন্য ট্যাক্স বেশি লাগে। সেটিও তিনি দেন। আসলে সে করেটা কী? দুই টনের জায়গায় আনে আধা টন; কিন্তু এখান থেকে যে লাভ করে, সেটি ট্রান্সফার করে দেয়। এটিকে বলে ট্রান্সফার প্রাইসিং। বিষয়টি একটু স্পষ্ট করি, যেমন- সে এলসি করেছে দুই টনের, ট্যাক্স দিয়েছে দুই টনের; কিন্তু মাল এনেছে আধা টনের। দুই টনের টাকা বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। মানে কায়দা করে প্রফিটটা কলম্বিয়া সরকারকে না দিয়ে তার দেশে পাঠিয়েছে। এটির নাম ট্রান্সফার প্রাইসিং।

প্রথম সমস্যা হলো এটি আর দ্বিতীয়টি হলো- সে মাল আনছে যুগোস্লাভিয়া থেকে কিন্তু সমুদ্রের মধ্যপথে কাগজ বদলাচ্ছে, সেখানে যুগোস্লাভিয়ার নাম না থেকে আমেরিকার কোম্পানির নাম রাখছে। এটি তো চিটিং। এসব ধরার পর তার চাকরি চলে গেল। মানে, ওই দেশের ব্যবসায়ীদের পথে বসাচ্ছে। এ কারণে অর্থমন্ত্রীকে অন্য সেক্টরে দায়িত্ব দেওয়া হলো। এ কাহিনি যখন শুনলাম, তখন বুঝলাম- এরা তো মহাধূর্ত মানুষ।

আমি বিলাতে বসে অবসর সময়ে এসব দেখছি। আমার সময় কাটতো প্লেন চালনা শিখে- এটা আমার শখ ছিল আর দামি গাড়ি আর রানির দর্জি এসে আমার স্যুট বানাতো। এসব ছিল মধ্যবিত্তের একটি উন্নাসিকতা। এখন এসব ভাবলে হাসি পায়, ছেলে মানুষি মনে হয়। কনসালট্যান্টরা আমার স্যুট পরা দেখে তাকিয়ে থাকত। মনে হতো, আমিও ওখানকার জমিদার। তবে এই জ্ঞানগুলো থেকে মনে হয়েছে- জীবনে কখনো যদি সুযোগ পাই- আমি বিশ্বাস করি, আমি পরিবর্তন করব। প্রথম আমি শেখ সাহেবকে বুঝালাম। তিনি প্রথম ইস্টার্ন ইউরোপ থেকে ওষুধ আমদানি করলেন। এর আগে পাকিস্তান আমলে কোনো দিন হতো না। এসব হলো তার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে। তাকে আমি গল্প করে বুঝাতাম। শেখ সাহেব গল্প করতে এবং শুনতে ভালোবাসতেন। তিনি আমাকে কমিউনিস্ট বলতেন আর আমি বলতাম- হওয়ার তো শখ ছিল; কিন্তু হতে তো পারিনি; কিন্তু তিনি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন।

যখন এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় এলেন, তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। তখন তিনি কিন্তু প্রধান হননি। চিফ অব স্টাফ অফিসার। তিনি আমাকে বললেন, “জাফরুল্লাহ, আপনার লেখা ‘ঝগড়াপুর’ বইটি জিয়াউর রহমানকে পড়ান। তাকে ইংরেজিটা পড়ান।” এভাবে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক। তিনি চিফ অব স্টাফ হওয়ার পর রওশন আমাকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ালেন। নিজে রান্না করে বাতাস করে খাওয়ালেন। নুরুল ইসলাম শিশু আমাকে যোগাযোগ করে দেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। তিনি মন্ত্রী হতে বললেন, আমি তো হলাম না। তারপর তিনি মারা যাওয়ার পর এরশাদ সাহেব প্রথমেই বললেন, ‘আপনাকে কাজ করতে হবে।’ আমি বললাম, ‘আমি তো আপনার লোক না।’ তিনি বললেন, ‘জাফরুল্লাহ আপনাদের কী সমস্যা জানেন? আপনি তো কমিউনিস্ট। আপনারা খালি কথা বেচে খান, কাজ চান না।’ বললাম, ‘তা না। আপনার করার ক্ষমতা নেই।’ তিনি বললেন, ‘আমি করতে না পারলে, আপনার লাভ আছে।’ বললাম, ‘আমার কীভাবে লাভ আছে?’ তিনি বললেন, ‘আপনি বলতে পারবেন, সামরিক বাহিনীর লোকজন কিছু করতে পারে না। আর যদি কিছু করতে পারি, তাও আপনাদের লাভ আছে। আপনি তো কমিউনিস্ট। আপনি মানুষের ভালো চান।’ এটি হলো তার বক্তব্য। বুঝলাম, লোকটা তো মহাচালাক। 

তখন আহমদ শরীফ বেঁচে ছিলেন। তাঁর কাছে গিয়ে বললাম ঘটনাটি। তিনি বললেন, ‘সর্বনাশ! তুমি যেও না। তোমার একটি নাম আছে। যুদ্ধ করেছ। অকারণে তোমার দুর্নাম হবে।’ আমি বললাম, ‘চেষ্টা করতে অসুবিধা কী?’ বললেন, ‘তুমি বিপদে পড়বে।’ বললাম, ‘আপনারা থাকলে আমি বিপদে পড়ব কেন? আচ্ছা, এক কাজ করেন। আমি এটি করব আর আপনারা একটি স্টেটমেন্ট করবেন যে, এটি করার ক্ষমতা তার নেই। আমি এটি ভেতরে বসে করব।’ তিনি বললেন, ‘তোমার ছেলেমানুষী গেল না।’

এরপর এরশাদ সাহেব বললেন, ‘জাফরুল্লাহ, আমরা আর্মির লোক, আমাদের বুদ্ধিশুদ্ধি নেই।’ আমি তাকে বোঝালাম, এটি আমেরিকা করতে দেবে না, কেন করতে দেবে না এই সব ব্যাপার-স্যাপার। উনি বললেন, ‘আপনি দেখেন না করে।’ তারপর তিনি আমাকে একটি খোঁচা দিয়ে কথা বললেন, ‘জাফরুল্লাহ, ধরেন আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে একটি পুকুরের পাড় দিয়ে হাঁটছেন। আপনার মেয়ে পা পিছলে পুকুরে পড়ে গেছে। আপনি সাঁতার জানেন না। আপনার মেয়ে চিৎকার দিচ্ছে- বাবা, বাঁচাও বাঁচাও। পাশ দিয়ে আমি যাছিলাম। তখন আমি লাফ দিয়ে আপনার মেয়েকে বাঁচাকে গেলে আপনি কী আমাকে নিষেধ করবেন- আপনি খারাপ, আর্মির লোক, আপনি আমার মেয়েকে ছোঁবেন না। খারাপ মানুষ কী ভালো কাজ করতে পারে না?’ তিনি তো যথার্থ যুক্তি দিয়ে আমাকে কনভিন্স করলেন। আমার পরিকল্পনা মোতাবেক পরে বসা হলো। সবশেষে আমেরিকান অ্যাম্বাসি বুঝল, এটি তো পৃথিবীতে পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সবকিছু উত্তরণ করে এ পলিসি হলো। এটি আহামরি কিছু না। আমি তো গেছি, আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা এ সবের কারণে। কে কীভাবে করে। এক নাম্বার কাজটা করলাম, পলিসি নিয়ে কেউ কিছু জানতে পারবে না। তাহলে খবরটা লিক হয়ে যাবে। আর লিক হয়ে গেলে তারা পয়সা দিয়ে বন্ধ করে দেবে। এটির টাইপ সব আমার অফিসে হলো। এরশাদ সাহেব বললেন, ‘আমাদের এখানে হলে এটি কোনোভাবেই গোপন করা যাবে না। তাই এটি আপনিই করেন।’ 

ওষুধের বিষয়টা তো সবাই বোঝে না। ধরুন, ছোট একটি ট্যাবলেটের ভেতরে কী আছে, তা তুমি দেখতে পাও না। এর দাম ৫ টাকা। এটি কি সোনা যে, এর দাম এত। কেন এর দাম ৫ টাকা হবে? আমার তো পূর্বের ইনভেস্টিগেশন আছে। ট্যাবলেটের মূল দাম এত না। এর দাম বেশি হয় ট্যাবলেট রাখার পাতার কারণে। 

এ কারণে ১৭০০ ওষুধকে বাতিল করে দিলাম। প্রত্যেক কোম্পানিকে বলা হলো- ওষুধের মাল টেন্ডার করে নিয়ে আসতে হবে। সে কারণে ওষুধের দাম কমে গেল, মান বেড়ে গেল। সারাপৃথিবী চমকে গেল, কী করলো বাংলাদেশ! আমেরিকান ডকুমেন্টস আমি পরে পেয়েছি। তারা এটিকে ‘বিপদ’ মনে করেছে- সারাপৃথিবী এখন প্রশ্ন করবে। এই লোক সব লিক করে দিয়েছে। তথ্য লিক করে দিয়েছে। এভাবে ওষুধনীতি হলো।

এ নীতির ফলাফল হলো- বেক্সিমকোর সারাবছরের বিক্রি ছিল ৩৪ লাখ টাকা আর আজ তার ঘণ্টায় ৩৪ লাখ টাকা বিক্রি হয়। তাই বলেছি যে, লাভ কম হবে; কিন্তু বিক্রি বেশি হবে। এটি আমার বিলাতের শিক্ষা। বিলাতে দুটি কোম্পানি ছিল। একটি- হ্যারোস, এখানে রাজা-বাদশাহরা শপিং করে। সেখানে বেশি টাকা লাগে। আরেকটি হলো- মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার। এখানে সাধারণ মানুষ ক্রয় করেন। তাদের খালি ডিভেডেন্ট বাড়ে। তাদের অনেক বিক্রি হয়। আর হ্যারোসের কম বিক্রি হয়। তার মানে হলো- আমি যদি মার্কেট বড় করে দেই, তাহলে লাভ বেশি হবে। যে কারণে একেকজনের বেশি বিক্রি হয়েছে। সাধারণ মানুষ অল্প দামে ওষুধ পাচ্ছে। এটিই হলো ওষুধ নীতির পেছনের কারণ।

এখন তো ওই ওষুধনীতি কার্যকর নেই...

কার্যকর নেই। এটি একটু বলি। দুটি কারণে। আমি একমাত্র ব্যক্তি যে কারো কোনো সুবিধা নেইনি। এরশাদ সাহেব একদিন ডেকে নিয়ে বললেন, ‘জাফরুল্লাহ সাহেব, আমার কাছ থেকে অনেকে অনেক ধরনের সুবিধা নিয়েছেন; কিন্তু আপনি কখনো কিছু চাইলেন না।’ বললাম, ‘আমি কী চাইব। আমি কী না খেয়ে থাকি!’ তিনি বললেন, ‘না না, পাগলামি করবেন না। আপনার একটি মেয়ে আছে। আপনার জন্য আমি ১০ কাঠা জমি ঠিক করে রেখেছি বারিধারাতে। আপনি এই কাগজটিতে সাইন করে দেন।’ বললাম, ‘আরে, আপনি কি মনে করেন, আমার বাড়ি-ঘর নেই? আমার গ্রামের বাড়িতে যে জায়গা জমি আছে, আমার মেয়ে সপ্তাহে একদিন খেলেও এ সুবিধা নেব না।’ আমি তার কোনো সুবিধা নেইনি। আমাকে নিয়ে প্রত্যেক সরকারেরই অসুবিধার কারণ হলো- আই অ্যাম আ সোশ্যালিস্ট। আমার বাবার কথা বললাম, যার ঢাকার অর্ধেক মালিক হওয়ার সুযোগ ছিল; কিন্তু তার কোনো বাড়ি ছিল না। আমাদের চরিত্রেও সেই লোভটা আসেনি। আমরা কী খারাপ আছি না কি?

ওষুধনীতি ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ভালো কার্যকর ছিল। পরে ওষুধের দামটা উঠিয়ে নেওয়ায় তা আর কার্যকর থাকেনি।

আপনি ভালো জানেন কী অবস্থায় চলছে দেশের স্বাস্থ্য খাত। এখান থেকে কীভাবে পুরো স্বাস্থ্য খাতের উত্তরণ ঘটানো সম্ভব?

আসলে সবকিছু নির্ভর করে রাজনীতির ওপর। রাজনীতির লোকজনের লেখাপড়া জানা না থাকলে যা হয়, আর কী! আর ঢাকা-কেন্দ্রিকতা থেকে না সরলে সমস্যার সমাধান হবে না। শেখ সাহেবকে যেটি বোঝাতে পেরেছিলাম- তার শেখার ও জানার ইচ্ছা ছিল। এটি এরশাদ সাহেবেরও ছিল। এখন আমি যেটি দেখি, প্রত্যেকেই তাদের রাজনীতিতে আমাকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমি যাইনি। ফলে অন্যের মাধ্যমে করা, অর্থাৎ আমি নিজে থাকলে যতটা ডাইনামিক হতাম, সেটি হয়নি। জিয়াউর রহমানের একজন মন্ত্রী ছিলেন- সাইয়িদ। ইয়াং ছেলে। সে আমাকে একদিন বলেছিল- জাফর ভাই, আপনি যা কিছু করেন, রাজনীতিবিদদের গালি দেবেন না। আপনি কেন হননি? আপনার তো সুযোগ ছিল।

রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনোদের সঙ্গে রাজনীতি করেছি, তাদের শেখাতে পারলাম না। তুমি যদি একটি জায়গায় দেখাতে পার, তাহলে সেটিই তোমার সফলতা। আমি ক্ষমতায় যখন যাকে পেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়েই কাজ করেছি। ওষুধনীতির মতো যদি স্বাস্থ্যনীতি চালু হতো, তাহলে দেশ ভয়াবহভাবে উপকৃত হতো। হাসিনা অর্ধেক পারে, অর্ধেক পারে না। যেমন- তোমার মতো একটি লোক দরকার, সেটা তো সঙ্গে সঙ্গে মেশিন দিয়ে তৈরি করা যাবে না। সেখানে আমাকে পরীক্ষা করতে হবে। এসব আমি এদের বুঝাতে পারি না। 

আমার ব্যর্থতাটা হলো, রাজনৈতিকভাবে কাউকে বুঝাতে পারি না- বাংলাদেশ একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হতে পারে। আমি ডিস্টার্বড আছি, কীভাবে নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন হচ্ছে। এসব থেকে কী আমার মেয়ে, বোনটা রেহাই পাবে। এটি তো তোমার স্ত্রীর ওপর হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সবার চেষ্টা দরকার।

আমি আজ মনে করি, সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে, রাজনীতিবিদরা যদি বলেন- আসেন রাস্তায় নেমে পড়ি। সন্ত্রসীরা তখন ভয় পাবে- তারা তো রাস্তায় আছে। আজ যদি হাসিনা বলেন, আসেন সবাই। আমার সঙ্গে পদযাত্রায় আসুন। এটি তো এভাবে চলতে পারে না। এটি এখানেই শেষ হতে হবে। এটা শেষ করা কোনো কঠিন কাজ না। তাদের সঙ্গে আমার তফাৎটা হলো- আমি বিষয়গুলোকে সহজভাবে নেই। আমি এত মারপ্যাঁচ বুঝি না। সোজা-সরল, লুকোচুরি করি না। আজ যদি সরকার চায়, কাল থেকে সবাইকে নিয়ে প্রসেশন করে কয়েকবার, কারও কোনো রেহাই নেই। প্রসেশন নিয়ে যদি হাসিনা নোয়াখালী গিয়ে মাফ চান আমাদের সবার পক্ষ থেকে- তোমায় নিরাপত্তা দিতে পারিনি। আমরা যদি সিলেটে গিয়ে মাফ চাই- এটি আমাদের ব্যর্থতা।

আমরা যদি এসব ঘটনার আইন বদলাই। মানে, ঘটনার সাত দিনের মধ্যে চার্জশিট হবে। এক মাসের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে হবে। নাথিং ডু। নো বেইল, নাথিং- সময় ক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। মিনিমাম পাঁচ বছরের জেল। আমি ফাঁসি-টাসি চাই না। রেডিও, টেলিভিশনে শিক্ষা দেওয়া। আরও অন্য পদ্ধতি থাকতে পারে। এগুলো করে কমাতে হবে। আমি এভাবেই ভাবি। 

যেমন ধরো, আমার কষ্ট লাগে- সৌদি প্রবাসীরা কিন্তু তোমার-আমার চাকরির ব্যবস্থাও করছে। তারা টাকা পাঠিয়েছে বলে এতগুলো টিভি চ্যানেল হয়েছে, প্যান্ট-শার্ট পড়া শিখেছি আমরা। সেই লোকগুলো আজ রাস্তায় বসে আছে। সরকার কী বলতে পারে না, তোমাদের রাস্তায় থাকতে হবে না। হোটেলে থাকবা আমার পয়সায়। তুমি এত দিন দিয়েছ, আজ আমরা তোমাদের দিলাম। আজকে কল্যাণকর চিন্তাগুলো আমাদের রাজনীতিবিদরা করে না। আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি কিছু দিতে পারলাম না।

আপনার যদি আর কোনো বক্তব্য থাকে...

পরিবর্তন। আমাদের পরিবর্তন দরকার, যেন সবাই ভালো থাকি। জনকল্যাণকর বাংলাদেশ, যেটি পৃথিবীর আদর্শ হবে। আমরা পৃথিবীর সবার কাছে আদর্শ হবো। এখন তো পুঁজিপতিরা আমাদের পিঠ থাপড়ায়। আমাদের ভুল কাজে প্রবাহিত করে। আমাদের তা পরিবর্তন করতে হবে। তরুণরা সে পরিবর্তন আনবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //