একান্ত সাক্ষাৎকারে রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক

মুজিবের প্রতি আমার হৃদয়ে যে ভালোবাসা-শ্রদ্ধা, সেখান থেকেই ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির জন্ম

১৯৬৯ সাল। ২২ ফেব্রুয়ারি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। শেখ মুজিবুর রহমানসহ এই মামলায় মোট আসামি ছিলেন ৩৫ জন। সবাইকে মুক্তি দেয়া হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ডাকসু’র তৎকালীন ভিপি তোফায়েল আহমেদ এই সভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ঘোষণা করেন। সবাই এটাই জানলো যে, শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ। আজও সবাই সেটাই জানেন। কেউ জানলো না, আসলে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির স্রষ্টা ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে এক লেখায় তিনিই প্রথম শেখ মুজিবের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের মতো শেখ মুজিবের জন্য তিনি মূলত একটা উপযুক্ত শব্দ বা উপাধি খুঁজছিলেন। তার সেই ভাবনা থেকেই ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দের উৎপত্তি, যা পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি নিয়ে ২০১৯ সালে সাম্প্রতিক দেশকালের মুখোমুখি হয়েছিলেন রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন আনোয়ার পারভেজ হালিম...

১৯৬৮ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কলেজ শাখা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্যাডে ‘আজব দেশ’- শিরোনামে ও ‘সারথী’ নামে একজনের একটি লেখায় প্রথম শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। এই সারথী ছিলেন আপনি নিজে, ছদ্মনাম ব্যবহারের বিশেষ কোনো কারণ ছিল?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: ১৯৬৭-৬৮ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ঢাকা কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। নিয়মিত লেখাপড়ার পাশাপাশি আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফার আন্দোলনের ছোঁয়ায় আমি দারুণভাবে উজ্জীবিত হই। ছয় দফা আন্দোলনের ঢেউ ততদিনে পূর্ব বাংলার টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনরত নেতা-কর্মীদের সাথে ছাত্র-জনতাও একীভূত হয়ে পড়ে। আমি একজন সচেতন ছাত্র হিসেবে এবং ছাত্র রাজনীতির একজন কর্মী হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই মূলত আমি একটি প্রবন্ধ লেখার তাগিদ অনুভব করি। আমি প্রবন্ধটির শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘আজব দেশ’। লেখক হিসেবে নাম দিয়েছি ‘সারথী’। এটি একটি ছদ্ম নাম, আমারই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের, ঢাকা কলেজ শাখার প্যাডেই আমি প্রবন্ধটি লিখেছিলাম। প্রবন্ধটি লিখে আমি কিছুটা সংশয়ে ছিলাম। কারণ, তৎকালীন সময়ে দেশের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমার এই প্রবন্ধটি আমার নিজের এবং আমার সংগঠনের উপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে কিনা, এ রকম একটা অজানা শঙ্কা আমার মনের মধ্যে বিরাজ করেছিল। এ ধরনের লেখা তৎকালীন সময়ে একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। মূলত এজন্যই ‘আজব দেশ’ প্রবন্ধে আমি ‘সারথী’ ছদ্মনাম ব্যবহার করি।

আপনার ভাবনায় হঠাৎ ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির উদয় হলো কীভাবে? বিষয়টি যদি একটু ব্যাখ্যা করে বলেন...
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, পরবর্তীতে আন্দোলন-সংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের কাছাকাছি পৌঁছে যান। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে পাকিস্তানি সামরিকজান্তার বন্দিশালায় থাকাকালে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। বস্তুত তাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। তিনি ছিলেন এর মূল প্রেরণাশক্তি এবং তাকে ঘিরে বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এই স্বপ্ন বাংলার সংগ্রামী ছাত্রসমাজের মাঝে খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিলেন বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মহানায়ক। বাঙালি জনমানসে শেখ মুজিবুর রহমান তখন সবার প্রিয় ‘মুজিব ভাই’ হিসেবে সমাদৃত। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন সরকার শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে। কারাগারে থাকাকালে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে মুজিবের নামের আগে ‘বঙ্গশার্দুল’, ‘সিংহশার্দুল’ প্রভৃতি খেতাব জুড়ে দেন। যেমনটি মোহনদাস করমচাদ গান্ধীকে ‘মহাত্মা’ ও ‘বাপুজী’, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ‘কায়েদে আজম’, চিত্তরঞ্জন দাশকে ‘দেশবন্ধু’, সুভাষচন্দ্র বসুকে ‘নেতাজী’, ফজলুল হককে ‘শেরেবাংলা’ প্রভৃতি উপাধি দেয়া হয় এবং এসব উপাধি তাদের নামের সমার্থক হয়ে উঠেছিল। কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবকে ‘শেখ সাহেব’, ‘মুজিব ভাই’, ‘বঙ্গশার্দুল’, ‘সিংহশার্দুল’ বলাটা যথার্থ তাৎপর্য ও গুরুত্ববহ বলে মনে করতে পারছিলাম না। আমি তখন তাঁকে একটি যুৎসই উপাধি দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেছিলাম। বিশেষ করে ১৯৬৮ সালের ৮ আগস্ট আমি যখন শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে গিয়েছিলাম, সেদিন থেকেই বাঙালির অবিসংবাদিত এই নেতার জন্য একটি যুৎসই উপাধি আমি মনে মনে খুঁজছিলাম। এর কিছুদিন পর ‘আজব দেশ’ প্রবন্ধে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সাথে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি সংযুক্ত করি এভাবে- ‘পূর্ব বাংলার নয়নমণি মুক্তির দিশারী-বঙ্গবন্ধু-সিংহশার্দুল জনাব শেখ মুজিবুর রহমান।’

এই প্রথমবার শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ব্যবহার করলেন। বিষয়টি কি শুধু ঢাকা কলেজে সীমাবদ্ধ ছিল, নাকি কলেজের বাইরেও সমগ্র ছাত্রলীগ এবং মূল রাজনৈতিক অঙ্গনেও বার্তাটি পৌঁছেছিল? ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা কি তখন আপনার এই উদ্যোগের কথা জানতে পেরেছিল?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: না, উপাধিটি ব্যবহারের পর এটি শুধু ঢাকা কলেজে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং কলেজের বাইরেও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হন এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন লিফলেট ও প্রচারপত্রেও ব্যবহৃত হতে থাকে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও বিষয়টি জানতেন। বিশেষ করে তৎকালীন ছাত্রলীগকে নেপথ্যে থেকে যাঁরা পরিচালনা করতেন, তাঁদের মধ্যে সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রাজ্জাকের বিষয়টি জানা ছিল।

এরপর ১৯৬৮ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন উপলক্ষ্যে ‘প্রতিধ্বনি’ নামে চার পৃষ্ঠার একটি বুলেটিন প্রকাশিত হয়, যার সম্পাদক ছিলেন আমিনুর রহমান। সেখানেও শেষ পৃষ্ঠায় পুনরায় ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। প্রশ্ন হলো- আমিনুর রহমান কি তখন ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন? উনি এখন কোথায় আছেন, কী করেন? নাকি, এটাও ছদ্মনাম ছিল?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: ১৯৬৮ সালের শেষদিকে ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ছাত্রলীগের খবরাখবর প্রকাশ, বিগত ছাত্র সংসদের (১৯৬৭) উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম ও বিকাশমান বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে শেখ কামালকে একটি প্রচারধর্মী বুলেটিন প্রকাশ করার জন্য আমি প্রস্তাব করি। আমার ধারণা ছিল চট্টগ্রাম কলেজ থেকে প্রকাশিত ‘যাত্রিক’ (তৎকালীন ছাত্রলীগের ছায়া সংগঠন) এর মানসম্মত, বহুল আলোচিত প্রশংসিত বুলেটিন ও সাময়িকীগুলো সম্পর্কে। আমার প্রস্তাবনায় শেখ কামাল সাথে সাথে সম্মতি প্রকাশ করেন এবং সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাসও দেন। বুলেটিনের নামকরণ করি ‘প্রতিধ্বনি’। কামাল এতেও সম্মতি জানিয়ে বলেন- ‘তুমি যা ভালো মনে করবে তাই করো, আমি তোমার প্রস্তাবের সাথে আছি। অর্থের ব্যাপারে চিন্তা করো না।’ বুলেটিনের সামগ্রিক পরিকল্পনা, লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন এবং আমার নিজের নাম উল্লেখ না করে সম্পাদকের জায়গায় ছদ্মনাম হিসেবে ‘মো. আমিনুর রহমান’ নামটি ব্যবহার করি। তবে ‘প্রতিধ্বনি’ সম্পাদনার কাজে আমাকে সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন আমার অকৃত্রিম বন্ধু মুখতার আহমেদ (নটর ডেম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক)। এছাড়াও ‘না মা তুমি কেঁদো না’ শিরোনামে ‘মুহাম্মদ ফেরদাউস’-এর একটি কবিতা প্রকাশ করি এবং সেখানেও ছদ্মনাম ব্যবহার করি। মুহাম্মদ ফেরদাউস ছিলেন আমার স্কুলের সতীর্থ রায়হান ফেরদাউস মধু। পুলিশি রোষানল এড়ানোর জন্যই আমরা মূলত ছদ্মনামগুলো ব্যবহার করেছিলাম।

‘প্রতিধ্বনি’ বুলেটিনটি কি প্রেসে ছাপা হয়েছিল? 
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: ‘প্রতিধ্বনি’ বুলেটিনটি প্রেসেই ছাপানো হয়েছিল এবং প্রেসটি ছিল পুরান ঢাকার কোর্ট হাউস স্ট্রিটের কায়েদে আযম কলেজ (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ) ছাত্র সংসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মো. ইব্রাহীমের বড় ভাইয়ের মোহাম্মদী প্রেস। বর্তমানে সেই বুলেটিনের একটি কপি আমার সংগ্রহে আছে। সেটার নিচের দিকে লেখা ছিল ‘প্রকাশনায়- পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ঢাকা কলেজ শাখার কর্মীবৃন্দ। প্রচারে- ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ প্রচার দফতর’। সাধারণত প্রচারে প্রচার সম্পাদকের নাম ব্যবহৃত হয়। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালীন প্রচার সম্পাদক ছিলেন ক্রিকেটার তানভীর মাজহার ইসলাম তান্না। কিন্তু উপরোল্লিখিত কারণে তার নামটিও সেখানে উহ্য রাখা হয়। 

ঢাকা কলেজে শেখ কামাল কি আপনার সহপাঠী ছিলেন, নাকি সিনিয়র অথবা জুনিয়র? তখন উনি কি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কোনো পদ হোল্ড করতেন? 
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: শেখ কামাল আমার সহপাঠী ছিলেন। আমরা দুইজন একই ক্লাসে পড়তাম। তিনি একজন চৌকস সংগঠক ছিলেন। নিজে কোনো পদ-পদবিতে না থেকে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার জন্য দিনরাত কাজ করতেন। সে সময় ঢাকা কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের ব্যাপক প্রভাব ছিল। যদিও বা ১৯৬৭ সালের ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ বিপুল ভোটাধিক্যে বিজয় লাভ করে। নির্বাচনের আগে শেখ কামালের সাথে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা করি। আলোচনার একপর্যায়ে আসন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) পদে প্রার্থী হতে বলেন শেখ কামাল। আমি দ্বিমত প্রকাশ করলে কামাল আমাকে পাল্টা প্রস্তাব করে বলেন- ‘তাহলে তুমি ছাত্রলীগের কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নাও। ছাত্রলীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে।’ আমি এতেও সম্মতি না জানিয়ে কামালকেই এই দায়িত্বটি গ্রহণ করতে বলি। কামাল বললেন- ‘আমি তো রয়েছিই, তুমিই ছাত্রলীগের কলেজ শাখার দায়িত্ব গ্রহণ করো।’ তারপর আর কোনো কথা চলে না। কামালকে কোনো পদ গ্রহণের প্রস্তাব করলেই তিনি এড়িয়ে চলতেন এবং বলতেন- ‘আমি তো মুজিবের পোলা। সবসময় তোমাদের সাথেই আছি।’ 

রেসকোর্সে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে আপনার উদ্যোগে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির বিষয়ে শেখ কামাল কি অবহিত ছিলেন? জানা থাকলে উনার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: ‘আজব দেশ’ শিরোনামে আমার প্রবন্ধ রচনা, ‘প্রতিধ্বনি’ বুলেটিনে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির প্রথম প্রকাশ সব বিষয়েই শেখ কামাল অবহিত ছিলেন। তিনি আমাকে উৎসাহ দিতেন, প্রশংসা করতেন। সর্বোপরি উপরোল্লিখিত মহিউদ্দিনের বইতে সিরাজুল আলম খানের সাক্ষাৎকারেও এর সত্যতা মিলে। 

একটা কথা শোনা যায়- আপনার উদ্ভাবিত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির খবরটি সিরাজুল আলম খানের কাছে পৌঁছানোর পর তিনি নাকি বিষয়টি সমর্থন করেছিলেন, মানে আপনাদেরকে উপাধিটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন। উনার সঙ্গে এ নিয়ে আপনার সরাসরি কোনো কথা হয়েছিল?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: ‘আজব দেশ’ প্রবন্ধটি লেখার পর সিরাজুল আলম খানের সাথে এ ব্যাপারে আমার কথা হয়েছে। আপনি ঠিকই শুনেছেন, তবে তিনি তখনই এটা না ছাপানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওই প্রবন্ধে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির ব্যবহার এবং ‘প্রতিধ্বনি’ বুলেটিনে ছাপার অক্ষরে প্রথম প্রকাশের ব্যাপারটি তিনি জানতেন। 

বঙ্গবন্ধু শব্দটি আপনি প্রথম ব্যবহার করলেন ১৯৬৮ সালের ৩ নভেম্বর। আর রেসকোর্সে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ঘোষণা করা হলো ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। এই সময়টাতে দেশ ছিল আন্দোলন-সংগ্রামে বেশ উত্তাল। নিয়মিত মিছিল-সভা হতো। সেসব মিছিলে বিভিন্ন স্লোগান হয়েছে। জানতে চাচ্ছি- আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে ওইসব মিছিল বা জনসভায় আপনারা কি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ব্যবহার করেছেন?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: না, সেইভাবে আমরা ব্যবহার করিনি। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবকে দেয়া সংবর্ধনায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ডাকসু’র তৎকালীন সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদ ঘোষণা দেওয়ার পর সারা দেশে ব্যাপকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটি ব্যবহৃত হতে থাকে। বলা যায়, তখন থেকেই ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।

২৩ ফেব্রুয়ারির সংবর্ধনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে যে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হবে, এটা কি আগে থেকে আপনারা জানতেন? সিদ্ধান্তটা কোথায় এবং কীভাবে নেয়া হয়েছিল? কারা নিয়েছিলেন? কারণ, সিরাজুল আলম খানের দাবি- শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল তার।
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: উপাধি হিসেবে কল্পনা করলে তো ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসেই ‘আজব দেশ’ প্রবন্ধ ও ‘প্রতিধ্বনি’ বুলেটিনে ছাপা হয়েছিল। আর রেসকোর্সে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সে ব্যাপারে বরং আমি মহিউদ্দিন আহমেদের ‘আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বইয়ের ১৯৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বর্ণিত সিরাজুল আলম খানের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। তাঁর বর্ণনায় এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। সেখানে তিনি বলেছেন- ‘২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্সে যাচ্ছি। গাড়িতে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমি আর তোফায়েল। সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এসে লিডার কানের কাছে মুখ এনে বললেন যে কী বলবেন-টলবেন। বললাম, আমাদের সব ঠিক আছে। তোফায়েল বলল, ‘কী বলব?’ আমি বললাম যে, ভাই, তুমি একটা টাইটেল দিবা। আমি বাঁয়ে ঝুঁকলাম লিডারকে বলার জন্য। তোফায়েল একটা জিনিস দেবে আপনাকে। উনি এটি বুঝলেন, সেন্স করেছেন। জিজ্ঞেসও করলেন না।’

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে ডাকসু’র ভিপি তোফায়েল আহমেদ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ঘোষণা করলেন। কিন্তু উপাধিটি কীভাবে সৃষ্টি হলো, কে সৃষ্টি করলো, তিনি তা বলেননি। আপনি কি সেদিন ওই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন? আপনার সেদিনকার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: ১৯৬৯ সালে তিনি আমার নাম উল্লেখ না করলেও সম্প্রতি নাগরিক টিভি’র সাংবাদিক রাজীব দাসের সঞ্চালনায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির সুবর্ণজয়ন্তি উপলক্ষ্যে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন- ‘এই শব্দটা কিন্তু আগেও ঢাকা কলেজের রেজাউল মুশতাক নামে আমাদের এক কর্মীর একটা লেখার মধ্যে ছিল। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতা তো পায় নাই, আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছি।’

রেসকোর্সের সেই গণসংবর্ধনায় সেদিন আমিও উপস্থিত ছিলাম। আমি তখন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রকাশ্য জনসভায় হাজার হাজার ছাত্র-জনতার সামনে আমার উদ্ভাবিত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে তাকে ভূষিত করা হলো- স্বাভাবিকভাবে আমার তো ভালো লাগারই কথা। ১৯৬৮ সালের ৮ আগস্ট ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবকে দেখার পর থেকে আমার হৃদয়ে তাঁর জন্য যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধার জন্ম হয়েছিল, সেখান থেকেই ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির জন্ম। আমার চিন্তাপ্রসূত শব্দটি সেদিন (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) হাজার হাজার ছাত্র-জনতার মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে, উত্থাল জনসমুদ্রের ঢেউ খেলে যাচ্ছে- এই অভূতপূর্ব দৃশ্য শুধুই উপলব্ধি করা যায়, বর্ণনা করা যায় না।

তোফায়েল আহমেদ টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির বিষয়ে আলাপ করতে গিয়ে আপনার নাম উচ্চারণ করেছেন। তার ভাষায়- তখন আপনি ছিলেন ছাত্রলীগের একজন কর্মী, কিন্তু আমরা যতটা জানি, ১৯৬৮ সালে আপনি ছিলেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আপনার তখনকার পদ-পদবি সম্পর্কে তিনি কি জানতেন না? তাছাড়া উনি বলেছেন- আপনার দেয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির কোনো অনুমোদন বা স্বীকৃতি ছিল না। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্সের গণসংবর্ধনায় মঞ্চের খুব কাছাকাছি জায়গায় আমি অন্য ছাত্রনেতাদের সাথে অবস্থান করেছিলাম। তোফায়েল আহমেদ সে সময় ডাকসু’র ভিপি ছিলেন, স্বাভাবিকভাবে তিনি আমাদেরও নেতা ছিলেন। আমার তখনকার পদ-পদবি সম্পর্কে তিনি জানতেন কি না, সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমি ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি চয়ন করি, কোনো অনুমোদন বা স্বীকৃতির জন্য করিনি।

২৩ ফেব্রুয়ারি সবাই জানলো- তোফায়েল আহমেদ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির ঘোষক। এটা হতেই পারে, ঘোষণা যে কেউ দিতে পারে। তবে এখনো অনেকের ধারণা, তোফায়েল আহমেদই এই উপাধি দিয়েছিলেন। নেপথ্যের ঘটনা আড়ালেই থেকে গেলো। অথচ আপনি ছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির আবিষ্কার কর্তা। তাছাড়া বিষয়টি যেহেতু ইতিহাসের অংশ- সেই ইতিহাস সর্বসাধারণের আজও অজানা। ছাত্রলীগের তৎকালীন সিনিয়র নেতারা, কিংবা আপনার বন্ধু শেখ কামাল- উনারা কি এজন্য আপনাকে কখনো সাধুবাদ দিয়েছিলেন?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: ছাত্রলীগের তৎকালীন সিনিয়র নেতাদের অনেকেই বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন। আর আমার সতীর্থ বন্ধু শেখ কামাল তো শুরু থেকেই সব জানতেন- একেবারে প্রবন্ধ রচনা থেকে ‘প্রতিধ্বনি’ বুলেটিনের প্রকাশ পর্যন্ত। উপাধিটি যে আমার লেখা, পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও সেটি জেনেছিলেন। যে কারণে তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।

পরববর্তীতে তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে এ নিয়ে আর কখনো কোনো কথা হয়েছে?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: তোফায়েল ভাইয়ের সাথে আমার সবসময় ভালো সম্পর্ক ছিল, এখনো আছে। আমি অবশ্যই তাঁকে নেতা হিসেবে সম্মান করি। তিনিও আমাদের স্নেহ করতেন। তাঁর সাথে দেখা হলে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির বিষয়টি স্মরণ করেন। কারো সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে অনেকবার তিনি বলেছেন ‘আমি যে বঙ্গবন্ধু উপাধিটি দিয়েছিলাম- এটা কিন্তু ও প্রথমে লিখেছিল।’

২৩ ফেব্রুয়ারির জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া নিয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপের মন কষাকষি হয়েছিল বলে দাবি করা হয়, এ বিষয়ে আপনার কিছু জানা থাকলে বলুন।
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি একটি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে উক্ত বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘আমরা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় এ নিয়ে আলোচনা করিনি। কিন্তু পেছনে আমাদের যারা সাবেক ছাত্রনেতা ছিলেন, তারা বসে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, তাকে (শেখ মুজিবকে) একটা উপাধি দেবো।’

বঙ্গবন্ধুর যখন সবকিছু জানতে পারলেন, আপনাকে কি ডেকেছিলেন, কিছু বলেছিলেন?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: বঙ্গবন্ধু উপাধির নেপথ্য কথা ‘বঙ্গবন্ধু’ নিজেও জানতেন। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ৮ আগস্ট ১৯৬৮ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে আমি যখন তাঁকে দেখতে যাই, তখন তিনি মামলার কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মশিউর চাচার কাছে আমার পরিচয় জানতে চান। মশিউর চাচা যখন বললেন- ‘কামালের বন্ধু, ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের জেনারেল সেক্রেটারি’, তখন বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘এত ঝুঁকি নিয়ে তার এখানে আসা উচিত হয়নি।’ তিনি অ্যাডভোকেট মশিউর চাচাকে আরো বলেছিলেন- তিনি যেন আমাকে নিরাপদে পৌঁছে দেন। 

আপনি ‘এই দেশেতে জন্ম আমার’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন, সেটা কি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছিল?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশের চিন্তা করেছিলাম। এরপর দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত ফজলে লোহানীর ধারাবাহিক কলামকে সংকলন করে ‘এই দেশেতে জন্ম আমার- শিরোনামে দেড় ফর্মার একটি পুস্তিকা আমি প্রকাশ করি, আমার ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু রায়হান ফেরদাউস মধু ও বন্ধুবর সাংবাদিক বদিউল আলমের সহযোগিতায়। সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জীবনীভিত্তিক ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত প্রথম পুস্তিকা। ওই পুস্তিকাটি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে যখন বঙ্গবন্ধুর হাতে দিলাম, তখন তিনি খুশিতে জড়িয়ে ধরে আমাকে অনেক্ষণ আদর করলেন। জীবনীটি হাতে পেয়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন- ‘ছাত্রলীগের ছেলেরা এত সুন্দর প্রকাশনা প্রকাশ করতে পারে, আমার ধারণাই ছিল না।’ তিনি সাথে সাথে পকেট থেকে একটি নতুন ৫০০ টাকার নোট বের করে দিয়ে বললেন- ‘এটি প্রকাশ করতে তোর অনেক টাকা খরচ হয়েছে, এটি তোর কাছে রাখ।’ বঙ্গবন্ধুর স্নেহমাখা কথা, আমার পিঠে তাঁর স্নেহমাখা হাতের পরশ আমার জীবনের পরম পাওয়া। 

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আর কোনো স্মৃতি?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: শেখ কামাল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তাঁর সাথে অনেকবার আমি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় গিয়েছি। ওই বাড়িতে কামালের সাথে কয়েকবার খাবারও খেয়েছি। ধানমন্ডির বাসায় বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। দেখা হলে তিনি কুশলাদি জানতে চাইতেন এবং সাংগঠনিক খোঁজ-খবর নিতেন। ছাত্রলীগের কর্মীদেরকে নিয়ে একবার উনার সাথে দেখা করতে গেলে উনি আমাকে কাছে ডেকে বলেছিলেন- ‘রাত তো অনেক হলো, তোদের তো কিছু খাওয়াতে পারলাম না, এটা নে।’ এই বলে ৫০০ টাকার নোট দিয়ে বললেন- ‘সবাইকে নিয়ে একসাথে তোরা খেয়ে নিস।’

কাছের একজন বন্ধু হিসেবে শেখ কামালকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: একজন বন্ধু হিসেবে শেখ কামালকে মূল্যায়ন করতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। শেখ কামালকে নিয়ে আমার এত স্মৃতি, তা এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে বললে শেষ হবে না। শেখ কামালের সাথে আমার পরিচয়ের যোগসূত্র হলো চট্টগ্রামের প্রয়াত জননেতা এম এ আজিজ। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু ঢাকা কলেজে আমার মন টিকছিল না, সব সময় আমি বিষণ্ণতায় ভুগতাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম- ঢাকা কলেজে পড়বো না। চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে ভর্তি হবো, সেখানে আমার বন্ধুরা পড়ে। কলেজ ছুটি হলে আমি চট্টগ্রামে গেলাম, কয়েকদিন থাকলাম। একদিন সন্ধ্যায় আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে যাই, সেখানে দেখা হয় জননেতা এমএ আজিজের সাথে। মুসলিম হাইস্কুলে পড়াকালীন সময়ে আমি ছাত্রলীগ স্কুল শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং নগর ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম। সেই সূত্রে এমএ আজিজের সাথে আমার পরিচয় ছিল। এছাড়াও তিনি আমার আত্মীয় ছিলেন।

সেই সন্ধ্যায় ঢাকা কলেজে আমার পড়ালেখায় অনাগ্রহ এবং চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছার কথা জানালে এমএ আজিজ আমাকে বারণ করে বলেন- ‘ঢাকায় আমাদের লোক প্রয়োজন। তাছাড়া, ওখানে (ঢাকা কলেজে) মুজিব ভাইয়ের ছেলে কামালও পড়ে। তোমার কোনো সমস্যা হবে না। আমি কামালকে বলে দেবো।’ তিনি আগে থেকেই জানতেন যে শেখ কামাল ঢাকা কলেজে পড়ে। এই বলে এমএ আজিজ শেখ কামালের উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে আমার হাতে দিলেন। আমি ঢাকায় ফিরে এসে শেখ কামালকে চিরকুটটি দিলাম। এমএ আজিজের চিরকুট পেয়ে শেখ কামাল আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই থেকে কামালের সাথে আমার বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা। 

এমএ আজিজের চিঠি আর আমার সাংগঠনিক পরিচিতি সব মিলিয়ে শেখ কামালের সাথে আমার সম্পর্ক নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় দুপুরের খাবার খাওয়া, ক্লাস ছুটির পর বলাকা সিনেমা হলে ম্যাটিনি শো-তে সিনেমা দেখতে যাওয়া, বানচিং চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ও ঢাকা কলেজের সামনে চিটাগাং রেস্টুরেন্টে খাওয়া, গল্প করা, কত স্মৃতি কামালকে ঘিরে! কামালের অসম্ভব সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। দারুণ সেতার বাজাতেন, খেলাধুলা, সংগীত সব বিষয়ে সমান পারদর্শী ছিলেন। আমার সাথে দুষ্টুমী করে চাটগাঁর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করতেন, চাটগাঁর আঞ্চলিক ভাষার কয়েকটি শব্দও রপ্ত করেছিলেন। কামালের স্ত্রী সুলতানা খুকির সাথেও আমার পরিচয় ছিল। আমি যখন ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, তখন বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের ছাত্রলীগের একটি সাংগঠনিক সভায় খুকির সাথে পরিচয়। সভাটি হয়েছিল খুকিদের বাসায়। সেই কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল খুকি। সে ছিল একজন দক্ষ ক্রীড়াবিদ।

আপনি শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আবার ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির কারিগর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি এসব বিষয়ে জানেন? 
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক: বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী জানেন কিনা, বা এই বিষয়ে অবগত আছেন কিনা, আমার কোনো ধারণা নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //