অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

দেশটার মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে : হাসান আজিজুল হক

গত ১৫ নভেম্বর প্রয়াত হয়েছেন কথাসাহিত্যের কিংবদন্তি হাসান আজিজুল হক, যিনি এমন একজন লেখক তার পুরো সাহিত্য জীবন পার করেছেন শুধু ছোট গল্প লিখে! এমন ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৩৯ সালে ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের বর্ধমান জেলার যব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে অনেক কালজয়ী ছোট গল্প। 

ছোট গল্পের পাশাপাশি তাঁর লেখা উপন্যাসও সমানভাবে পাঠকের নিকট আদৃত। লিখেছেন কিশোরদের জন্য কয়েকটি আনন্দময় রচনা। এ ছাড়া রয়েছে হাসান রচিত প্রবন্ধ- যা সাধারণ ভাবনাকে আমূল পাল্টে দিতে পারে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, আগুনপাখি, নামহীন গোত্রহীন ইত্যাদি। সাহিত্যে অসামান্য কীর্তির জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক এবং কলকাতার আনন্দ পুরস্কার। ২০১৬ সালে হাসান আজিজুল হকের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- ইমরান মাহফুজ 

আপনার লেখায় দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা এসেছে নিপুণভাবে। বাস্তবজীবনে দেশভাগ কোনো প্রভাব ফেলেছে কি আপনার জীবনে?
দেশভাগের ফলে নানাভাবে মানুষকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনে কিছু হয়নি। পারিবারিক কারণেই এই দেশে- বাংলাদেশে এসে লেখাপড়া শুরু করি। তাছাড়া আমার দিদি থাকতেন খুলনায় তাঁর কাছেই আসি। আর তখন ওভাবে কিছু বুঝিনি, পাকিস্তান নামক একটা দেশ আলাদা হয়েছে; কিন্তু পরে আমার মনে হলো দেশভাগ একটি ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। এর জন্য পুরো বাঙালি, বাংলা, চিরকালের জন্য ভেঙে গেছে।

আপনার জীবনকালে দেখেছেন দেশভাগ, স্বাধীনতাসহ অনেক কিছু। পেয়েছেন দেশের জল-মাটির গন্ধ। এসব যে ধরনের সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি বলে আপনি মনে করেন?
হিন্দু মিথের একটা গল্প বলি- পার্বতীর সঙ্গে তার শ্বশুরকুলের খুব গণ্ডগোল। শিবের পোশাক-আশাক, চলাফেরা এসবের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। প্রায় লেগে থাকে তাদের ঝগড়া। একদিন শিব পার্বতীকে চক্র দিয়ে কেটে ৫০ টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দিল। এক পর্যায়ে দেখা গেল, প্রত্যেকটি টুকরো এক-একটা ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেল। এইসব মিলে আলাদা একটা ইতিহাসও তৈরি করে ফেলল। আমাদের অবস্থা হচ্ছে এমন- দেশভাগ, স্বাধীনতা অঞ্চলভেদে এক-একটা ঐতিহ্য যেমন আছে, সব মিলিয়ে সম্মিলিত সংস্কৃতির ভেতরে আছি আমরা।

সংস্কৃতির আবহে আমাদের উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের জীবন কেমন? অথবা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে?
বর্তমানে এদের কোনো স্থিরতা নেই, দৃঢ়তা নেই। তারা কেবল ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। জিভ চাটে। এই সময়কালে একটা অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। বাঙালির স্বতন্ত্র কালচার বলে কিছু থাকছে! অতীত ভুলে তারা কেবল দৌড়াচ্ছে। দেশটার মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে।

কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে ইমরান মাহফুজ

আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ ও ‘আগুন পাখি’ পড়ে দেখলাম দেশভাগের যন্ত্রণা, হাহাকার এসব গল্প-কাহিনীতে। দর্শনের জায়গা থেকে দেশভাগ নিয়ে কিছু বলুন...
দেশভাগ নিয়ে ভেবেছি অনেক, এখনো ভাবি। একটা কথা তোমাকে বলি- দেশভাগ নিয়ে এখানকার মুসলমানের অনুভূতি আর পশ্চিমবঙ্গের  ‍মুসলমানের অনুভূতি কখনো এক নয়।

আমরা যতদূর জানি আপনি প্রথম জীবনে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে কারণে তৎকালিন সরকারের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে আপনাকে। সে সম্পর্কে জানতে চাই।
এসব নিয়ে কখনো ওভাবে লিখিনি। সামান্য ঘটনা। এই সমাজ, এই রাষ্ট্র নিয়ে ভাবছিলাম। মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র ভাবাটা একটা ব্যাপার। তবে এসব নিয়ে যে মানুষ ভাবে না, সে মানুষ না। মানুষমাত্রই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

স্মৃতি মানুষকে তাড়া করে। লেখক সে স্মৃতি নিয়ে লেখেন আত্মজীবনী। আপনার সে ধরনের কিছু কি আছে?
ক’বছর আগে বেরিয়েছে ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ আমি এটাকে আত্মজীবনী বলি না, বলি- আমার স্মৃতিকে অবলম্বন করে সময়টাকে ধরার চেষ্টা করেছি। আর সময় তো ফাঁকা বস্তু নয়, সময়-দেশ-কাল, মানুষ, সবকিছু দিয়ে পূর্ণ থাকে। তার অর্থ- পারলে কিছু সূত্র বের করা, এগিয়ে যাওয়া, পিছিয়ে যাওয়া, মানুষের বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকার ধরন, আর এ বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে জীবনের কোনো অর্থ বের করা। আর যে সমাজটাকে চোখের সামনে দেখি- সে সমাজটাকে সুস্থ বলব, কতটুকু অসুস্থ বলব, তার একটা চেহারা তুলে ধরা। জীবন কথা বলেই এটা লেখা, তার ছোট একটা অংশ যেটা প্রকাশিত হয়েছিল ‘ভোর বেলাকার চোখে’। দ্বিতীয় অংশটা বের হবে সামনে।

আপনার এক জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন শিক্ষকতায়। অন্য পেশায় যাননি, না যাওয়ার আগ্রহ হয়নি?
১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাসহ দুটি চাকরির সুযোগ আসে। আমি দৃঢ়ভাবে বেছে নিলাম শিক্ষকতাকে। কেননা আমার মনে হয়েছিল লেখালেখির জন্য সবচেয়ে ভালো সময় পাওয়া যাবে অধ্যাপনা করলে। ওখানে মাথার ওপরে চোখ-রাঙানিটা নেই। একটা স্বাধীনতা আছে। ফলে যখন পেছনের দিকে তাকাই, তখন মনে হয় না যে- আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

দেশের খ্যাতিমান একজন লেখক হিসেবে নিশ্চয়ই আপনিও ভাবেন দেশ নিয়ে। নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বলতে হলে, এই সময়ের কী ধরনের মূল্যায়ন করবেন?
নিজের অবস্থান থেকে বলতে গেলে বলা যায়- মুক্তিযুদ্ধের পরের যে সংবিধান রচিত হয়েছে, এতে আমাদের দেশকে পেয়েও পাইনি। এর ইতিহাসও খুবই হতাশাজনক। বাংলাদেশের মানুষ যে এত রক্ত দিল, আমরা যে কেঁদে ভাসালাম, গান গাইলাম- ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ এর সবই আমাদের ভণ্ডামি হলো নাহ? এ রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে দেশের জনগণের কাছে যেভাবে তুলে ধরেছে, তা রাষ্ট্র কতিপয়ের ভোগের বস্তু নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের প্রচুর সম্পদ আছে; কিন্তু এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। যে পর্যায়ের উন্নয়ন হচ্ছে, এর সুবিধাভোগী জনগণ হতে পারছে না। যেহেতু এটা একটি গণতান্ত্রিক দেশ, সেহেতু এখন সবাই দাবি করছে- আমরা জনগণের প্রতিনিধি। সত্যিকারের গণতন্ত্র এখানে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত বা কার্যকর করতে গেলে রাজনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণ।

বয়সের দিক দিয়েও আপনি অভিভাবকতুল্য। অস্থির সময়ে আমাদের চলার বিষয়ে কোনো পরামর্শ যদি দেন...
এটুকু তোমাকেই বের করতে হবে। কি করবে? যে কাজটা মনে হবে এটা অন্ততপক্ষে আমার শক্তির মধ্যে দক্ষতার সঙ্গে সার্থকতার জন্য কাজটা করা দরকার। অজস্র কাজের মধ্যে এটা যদি তুমি এক ঘণ্টা করতে পার যে, দিস ইজ মাই ওয়ার্ক, তাহলেই তুমি সুখি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //