এই পত্রিকা ছিল তাঁর কাছে প্রাণসর্বস্ব: নূরজাহান বেগম বকসী

ব্যক্তিসর্বস্ব পত্রিকা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের যুগে হিকি সাহেব বের করেছিলেন নিজের নামেই ‘হিকিস গেজেট’, বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে রমাপদ চৌধুরী সম্পাদিত ‘রমাপদ চৌধুরীর পত্রিকা’ প্রকাশিত হয় এবং সব শেষে ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক’ সম্পাদক মীজানুর রহমান ১৯৮৩ সাল থেকে প্রকাশ করতে শুরু করেন।

পত্রিকার এরকম নামকরণের কারণে নানা প্রশ্নবাণ তাকে সামলাতে হয়েছে বেশ কয়েক বছর। কেননা নামকরণের এই বাস্তবতাকে ঢাকার পাঠক সমাজের মেনে নেওয়াটা সহজ ছিল না। এ নিয়ে অবশ্য সম্পাদকের কোনোরকম অস্বস্তি ছিল না। পাঠকসমাজ একদিন ঠিকই মেনে নিয়েছিলেন মীজানুর রহমানের পত্রিকার গুণেই। মীজানুর রহমান এমনই একজন সম্পাদক, যিনি কিনা শত শত পৃষ্ঠা নিজেই সম্পাদনা, বানান, অলংকরণ, লেখা সংগ্রহ সমস্ত কাজ একহাতে সামলাতেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা ছিল ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে। এরমধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- পক্ষী সংখ্যা, নদী সংখ্যা, বৃক্ষ সংখ্যা, গণিত সংখ্যা, কৃষ্ণদয়াল বসু সংখ্যা, কামরুল হাসান সংখ্যা, রশীদ চৌধুরী সংখ্যা, শামসুর রাহমান সংখ্যা, বিদ্যাসাগর সংখ্যা। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি এই গুণী সম্পাদকের ৯২তম জন্মদিনকে সামনে রেখে তাঁর স্ত্রী, সহযোদ্ধা নূরজাহান বেগম বকসী’র সাক্ষাৎকার নেন অলকানন্দা রায়।

করোনার এই সময়টায় কেমন কাটছে আপনার?

এইতো মোটামুটি কাটছে। দেড় বছর টানা বাইরে যাইনি। তারপর পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হলে লকডাউনের কড়াকড়ি কমলে নিউইয়র্ক গিয়েছিলাম মেয়ের কাছে। মেয়ের ওখান থেকে ফেরার পর ফের করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে থাকলেও এখন মাঝে মাঝে প্রয়োজনে বের হই। না হলে তো সেই ঘরবন্দি।

সম্পাদক মীজানুর রহমান একটি বিশেষ নাম। এই মানুষটির সঙ্গে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। তিনি আজ নেই আমাদের মাঝে। সামনেই তাঁর ৯২তম জন্মদিন। এমন সময় সম্পাদক মীজানুর রহমানকে আপনার কীভাবে মনে পড়ছে?

এই পত্রিকা ছিল তাঁর কাছে প্রাণসর্বস্ব। এক একটা সংখ্যা করার সময় দিনরাত এক করে কাজ করতেন। বিশেষ করে গণিত সংখ্যা করার সময়। নিবিষ্ট মনে কাজ করেছেন। গণিতের প্রতিটা খুঁটিনাটি বিষয় নিজ হাতে করেছেন। একটু এদিক-ওদিক হলেই তো অঙ্কটা ভুল হয়ে যাবে। রাত তিনটা চারটা পর্যন্ত প্রুফ দেখতেন উনি। আমিও তাঁর সঙ্গে রাত জেগে কাজ করতাম। আমাদের বড় ছেলে তারেক প্রেসে যেত, কাগজ কিনে আনত। আমিও যেতাম প্রেসে, বাইন্ডিংখানায়, পত্রিকা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া। একদম বন্ধুর মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি যতটা সম্ভব। এই গণিতসংখ্যা করতে ওনাকে এতো বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে যে উনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি যে ছেলেটা কম্পোজ করত সেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। 

পত্রিকা করতে গিয়ে এই মুহূর্তে বলার মতো কোনো ঘটনা মনে পড়ছে আপনার?

হ্যাঁ, বৃক্ষ সংখ্যা করার সময়ের ঘটনা- মীজান সাহেবের পত্রিকার খুব ভক্ত ছিলেন যশোরের এক ভদ্রলোক। উনার দুই ছেলে ছিল, একজনের নাম হাবীব। উনী যশোরের বহু পুরনো একটা বটগাছের ছবি তুলে নিয়ে এসেছিলেন। সেই ছবিটিই বৃক্ষ সংখ্যার প্রচ্ছদে মীজান সাহেব ব্যবহার করেছিলেন। 

১৯৮৩ সালে নামস্বর্বস্ব পত্রিকা বের হবার পেছনের কারণ কী ছিল? 

মীজানুর রহমান ছিলেন একজন নীতিবান সৎ মানুষ। তিনি ঘুষ দেওয়া নেওয়ার বিষয়টি মনে প্রাণেই ঘৃণা করতেন। তাঁর শক্ত অবস্থান ছিল এর বিরুদ্ধে। তিনি চাইতেন, যেখানে ঘুষ দেওয়া-নেওয়া চলে সেখানে তিনি কাজ করবেন না। সে সময় বাংলাদেশ অবজারভারে কাজ করতেন তিনি। সেখানে এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি ছেড়ে দেন। তারপরেই পত্রিকাটি বের করার কথা ভাবেন। নাম নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন- কেউ কেউ বলেছেন এই বয়সে নিজের নামে পত্রিকা করা ঠিক হবে না; কিন্তু তিনি অনড় ছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর আদর্শ ছিলেন বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের রমাপদ চৌধুরী সম্পাদিত ‘রমাপদ চৌধুরী পত্রিকা’। কলকাতায় সে সময় এই পত্রিকাটি বের হওয়ার আগে যে মিটিং হয়, সেই মিটিংয়ে মীজানুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। ১৯৮৩ সালে যখন পত্রিকাটি বের হয় তখন বাংলা একাডেমিতে বইমেলা চলছিল। বইমেলায় আমরা যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান, রশীদ চৌধুরী, শহীদ আল বুখারিসহ আরো অনেকে। দারুণ একটা সময় কেটেছিল আমাদের। 

মীজানুর রহমান পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেছিলেন স্কুলজীবন থেকেই। ১৯৪৬ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়েসে। তখন তিনি স্কুলের গণ্ডিও পেরোননি। সেই সময়ই ‘মুয়াজ্জিন’ নামে হাতে লেখা পত্রিকা বের করেন। এর কয়েক বছর পরে ১৯৪৯ সালে, পাকিস্তানের প্রথম কিশোর-মাসিক পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘ঝংকার’। এর দু’বছর পর ‘রূপছায়া’ পত্রিকা বের করেন। সিনেমাবিষয়ক পত্রিকা হলেও সাহিত্যও ছিল প্রবলভাবে। সৈয়দ শামসুল হক এবং আনিস চৌধুরীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস রূপছায়া পত্রিকাতে প্রকাশ পেয়েছিল। এরপর ফায়ার সার্ভিসের পত্রিকা ‘ফায়ার ফাইটার’ সম্পাদনা করেছেন কিছুকাল তারপর তো ১৯৮৩ সালে থেকে শুরু হলো ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’। এই যে এতো গুরুত্বপূর্ণ সব পত্রিকা করলেন তিনি, অথচ এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর পত্রিকার কোনো কপি পাওয়া যাচ্ছে না। এর পেছনের কারণ কী বলে মনে করেন? 

পত্রিকাগুলোর এতো বেশি জনপ্রিয়তা ছিল যে প্রকাশের পর পরই সব বিক্রি হয়ে যেত। আর খুব ভেবেচিন্তেই ঠিক করতেন কতগুলো কপি প্রকাশ করা হবে। নিজের একটি খাতা ছিল, মীজান সাহেবের পত্রিকার গ্রাহক খাতা। তিনি নিজেই সব জায়গায় চাহিদা মতো পত্রিকা পাঠাতেন। সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ছিল এটা, ফলে বিক্রি হতো। এখনো সমান গুরুত্বপূর্ণ এ পত্রিকা। 

কাদের লেখায়, বন্ধুত্বে পত্রিকাটি সমৃদ্ধ হয়েছিল?

কে লেখেননি, সকলের কথা তো মনে করা মুশকিল হবে- শামসুর রাহমান, কলিম খান, ওয়াহিদুল হক, রশীদ চৌধুরী, সমীর রায় চৌধুরী, শহীদুল্লাহ মৃধা, রশীদ হায়দার প্রমুখ প্রখ্যাত লেখকরা লিখেছিলেন এই পত্রিকায়।

এদেশের শিল্পাঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ সম্পাদক মীজানুর রহমান। অথচ তাঁকে কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়নি। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন? 

আজকাল সম্মান বিষয়টি একটু অন্যরকম। মেধা, গুণ, কর্ম, গুরুত্বের বাইরেও কিছু বিষয় থাকে। এই সময়ে এসে সেসবই গুরুত্ব পায় বেশি পুরস্কারের ক্ষেত্রে। আমি সে সব নিয়ে বলতে চাই না। সরকার বা রাষ্ট্র কাকে পুরস্কার দেবে তার সম্পর্কে জানা থাকা দরকার। ওই ব্যক্তি সম্পর্কে সঠিক তথ্য পৌঁছানোর দরকার সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছে। এসব যদি তারা না জানেন তবে তো পুরস্কারের জন্যে সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন সম্ভব না। 

আপনি ছিলেন মীজানুর রহমানের জীবনসঙ্গী এবং তাঁর কাজেরও সঙ্গী, সেই সময়ের কিছু ঘটনা যদি আমাদের বলতেন...

জীবনসঙ্গী হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ একজন মানুষ। তাঁর মতো মানুষ বিরল। আমি হলাম সেই বিরল মানুষটির সঙ্গী সেটা আমার সৌভাগ্য। উনি সকালে ঘুম থেকে উঠেই সারা বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতেন। আমাদের আগের বাড়ির সামনে ছিল বাগান। তিনি একটা একটা করে গাছের ঝরা পাতা কুড়িয়ে নিতেন। নিজেদের রুম সযত্নে পরিষ্কার করে সুন্দর পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখতেন। বাড়িতে কত মানুষজন আসতো, কত আড্ডা হতো। কখনো কখনো রাতভর আড্ডা চলতো। উনি ক্রিকেট ভালোবাসতেন। টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখার সময় উনি ভীষণ উত্তেজিত থাকতেন। হইহই করতেন। মীজান সাহেব খুব বাইরের খাবার পছন্দ করতেন। সিঙ্গারা, সমুচা, পরোটা, নান, চটপটি, ফুচকা। মুখরোচকসবই ছিল তাঁর পছন্দের। আরও একটা মজার বিষয় বলি, তিনি ঢাকা শহরের দ্বিতীয় অ্যাকুরিয়াম করেছিলেন। মাছ পালতে ভালোবাসতেন তো খুউব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //