লিখছি, কাটছি, আবার লিখছি: কাজী আনোয়ার হোসেন

কাজী আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশের পাঠককে রহস্য-সাহিত্যমুখী করেছেন। পাঠকের হাতে বাংলা ভাষায় তুলে দিয়েছেন নানা দেশের নানা ভাষার রহস্য ও রোমাঞ্চকর সব কাহিনী। এর মধ্যে ‘মাসুদ রানা’ জনপ্রিয় সিরিজ। পিছিয়ে ছিল না ‘কুয়াশা’ও। তিনি প্রায় এক হাতেই আমাদের দেশে দাঁড় করিয়েছেন রহস্যধর্মী রোমাঞ্চকর গল্পের জনপ্রিয় সাহিত্যধারা। 

কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রকাশনী পাঠক তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে এখানে। ১৯৬৪ সালে সেগুনবাগিচার এক ছোট ছাপাখানা থেকে সেবা প্রকাশনীর যাত্রা। এখন এর গ্রন্থের তালিকা ঈর্ষণীয়। প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক ধরে নিপুণ বাস্তবতায় চিত্রিত মাসুদ রানা পড়ে পাঠক কখনো শিউরে উঠেন, কখনো আতঙ্কে দমবন্ধ করে পরের পৃষ্ঠায় যান। গল্প শেষে মাসুদ রানার সঙ্গে সঙ্গে যেন পাঠকও জয়ী হন। মনে হয় মাসুদ রানা নয়, যা করার পাঠক নিজেই করলো। মাসুদ রানা’র লেখকের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করেছেন সুলতান মাহমুদ সোহাগ।

মৌলিক কাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ। পাঠক তখনও  গোয়েন্দাকাহিনীর সঙ্গে খুব বেশি পরিচিত হয়নি। এ রকম একটি শাখায় জীবনের প্রথম কাজটি কীভাবে করলেন? একইসঙ্গে সিরিজের প্রিয় বইগুলো নিয়ে কিছু বলবেন?  

১৯৬৫ সালের শেষদিকের কথা। তখন মাত্র ‘কুয়াশা’ লেখা শুরু করেছি। কয়েকটি বইও বেরিয়েছে। ওই সময় ইয়ান ফ্লেমিংয়ের ‘ডক্টর নো’ বইটি পড়ি। এটা পড়ার পর লজ্জাবোধ করছিলাম। আমরা কতটা পিছিয়ে আছি তা বুঝতে পেরেছিলাম। ঠিক করলাম, বাংলাতে ওই মানের থ্রিলার লিখব। শুরু হলো বিদেশি বিভিন্ন বই পড়া। নিজের খরচে বাইক নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরলাম। এরপর কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম। লিখছি, কাটছি, আবার লিখছি, পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলছি, আবার লিখছি। এ ধরনের লেখা বাংলা সাহিত্যে তখন ছিল না। ভাষা ও বিষয় কোনোটিই নয়। সে জন্যই চেষ্টা করতে হলো। এভাবে চেষ্টা ও পরিশ্রম করে সাত মাস ধরে লিখলাম মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই ‘ধ্বংস-পাহাড়’। ১৯৬৬ সালের মে মাসে বাজারে এল বইটি। প্রশংসা-সমালোচনা, নিন্দা-অভিনন্দন সবই জুটল। এরপর সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘ভারতনাট্যম’ প্রকাশিত হলো। এটা লিখতে প্রায় ১০ মাস সময় লেগেছিল। তখন লিখতাম বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে। প্রিয় বইগুলোর মধ্যে রয়েছে শত্রু ভয়ংকর, মুক্ত বিহঙ্গ, আই লাভ ইউ, ম্যান ও অগ্নিপুরুষ।

মাসুদ রানার মাধ্যমে কিছুটা খোলামেলা যৌনতা নিয়ে এলেন। রক্ষণশীল সমাজে তখন এটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল। সমালোচনা সামলিয়েছেন কীভাবে? 

প্রায় প্রতিটি বিদেশি থ্রিলার বইতে কাহিনীর পাশাপাশি চাটনি হিসেবে কিছুটা যৌনতা থাকে, এবং সেটা পড়তে ভালোই লাগে। বিশ্বমানের থ্রিলার লিখতে চেয়েছিলাম। মোটামুটি ওদের কাঠামোই গ্রহণ করেছিলাম; তাই মাসুদ রানায় স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা যৌনতা এসেছিল। সিরিজ লিখছি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, কাজেই লেখার সময় ভাবিনি কেউ আবার এ নিয়ে আপত্তি তুলতে পারে।  কিন্তু দু’চারটে বই বেরোতেই এ নিয়ে চারদিক থেকে কেউ কেউ যেভাবে মার মার করে উঠেছিল তাতে মনে হতে পারে বাংলা সাহিত্যে আগে কখনো যৌনতা ছিল না। যারা নিজেদের বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক ও অভিভাবক মনে করতেন, তাদের ভেতর থেকেই প্রতিবাদ-সমালোচনা বেশি এসেছিল। অথচ আমরা দেখেছি সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখায়ও যৌনতা ছিল। আমি যে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ উল্লেখ করে দিয়েছি, সেটাও আমার দোষ হিসেবে বিবেচিত হলো। উল্টো বলা হলো, এজন্যই ছোটরা আরো বেশি পড়ে। সেই নিষিদ্ধ আপেলের প্রতি স্বভাবজাত আকর্ষণ! মাসুদ রানার তৃতীয় বই ‘স্বর্ণমৃগ’ প্রকাশিত হওয়ার পর সচিত্র সন্ধানী পত্রিকায় তীব্র সমালোচনা প্রকাশিত হয়।

আমরা জানি, একাধিক অতিথি লেখক মাসুদ রানা লেখেন। তাদের নামগুলো যদি বলেন? বইয়ের নাম নির্বাচন করা থেকে লেখার পুরো প্রক্রিয়াটি বলবেন? 

আড়াল থেকে মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজের বই লিখতে অনেকেই আমাকে অতীতে সাহায্য করেছেন, এখনও করছেন। সাহায্যকারীরা সকলেই কমবেশি প্রাপ্তিযোগের প্রত্যাশাতেই লিখেছেন। তাই এখন আর তাদের নাম বলে দেয়া ঠিক হবে বলে মনে করি না। রচনায় সাহায্য করতে আগ্রহী প্রথমে আমার বাছাই করা একটি ইংরেজি বইয়ের কাহিনী-সংক্ষেপ জমা দেন। আমার পছন্দ হলে আলোচনার মাধ্যমে তাকে বুঝিয়ে  দিই কীভাবে কাহিনী এগোবে, রানা কীভাবে আসবে, কী করবে ও কী করবে না। মাসখানেক পরিশ্রমের পর তার খসড়া শেষ হলে আমি পাণ্ডুলিপিটি পড়ি। যেখানে যেখানে সংশোধন ও পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে সেগুলো চিহ্নিত করে লেখককে ফেরত দিই। তিনি আবার ঠিকঠাক করে দিলে চূড়ান্তভাবে আমি আরো একবার দেখি ও সম্পাদনা করি। এসব করতে আমার পনেরো দিনের মতো সময় লাগে। এরপর বই আকারে ছাপা হয় সেবা প্রকাশনী থেকে।

কোনো লেখকের পাণ্ডুলিপিই সম্পাদনা ছাড়া সেবা প্রকাশনী থেকে বই হিসেবে প্রকাশিত হয় না। এজন্য সম্পাদকমণ্ডলীর একটি গ্রুপও আছে। সম্পাদনার বিষয়টি কেন এতো গুরুত্বসহকারে নিয়েছিলেন?

সম্পাদনার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। সকলের লেখাতেই ভুল-ভ্রান্তি থাকে, আমারটাতেও। একজনের লেখা আরেকজন পড়লে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ে, ও তা শুধরানো যায়। কিন্তু আমার একার পক্ষে সব পাণ্ডুলিপি দেখা ও সংশোধন করা একটা পর্যায়ে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অথচ ভাষাসহ বইয়ের সার্বিক একটি মান ধরে রাখা প্রয়োজন। সে জন্যই সম্পাদক খুঁজতে হয়েছিল। তবে এখন আর সেভাবে সম্পাদনা হচ্ছে না। কারণ আগের পারিশ্রমিকে অনেকেই কাজ করতে চান না, আবার আমি এর বেশি দিতেও পারি না। সেইসাথে কাজটা সম্পাদনা নির্ভর থাকলে লেখকও যথেষ্ট যত্নবান হন না। অনেকে আবার অন্যের সম্পাদনায় সন্তষ্টও হতে পারেন না। তাই এখন সেবায় রানা ও তিন গোয়েন্দা ছাড়া অন্য লেখা যিনি লিখছেন, তাঁকে যথেষ্ট শ্রম দিয়ে নির্ভুলভাবে লেখার চেষ্টা করতে বলি। তবে আমি একবার চোখ বুলিয়ে দিই। বই প্রকাশ হওয়ার পর পাঠকের প্রতিক্রিয়াই লেখকের পরবর্তী বই ছাপা হবে কি হবে না, তা নির্ধারণ করে। একসময় যারা পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করেছেন তাদের মধ্যে আছেন কবি আবু কায়সার, কবি সাযযাদ কাদির, রওশন জামিল, আসাদুজ্জামান, সেলিনা সুলতানা, কাজী শাহনুর হোসেন প্রমুখ।

সেবার ব্যবসাপদ্ধতি ও লেখক সম্মানীর ব্যবস্থা ৫৪ বছর আগে যেমন ছিল এখনও তা প্রায় একই রকম আছে। ১৫-২০ বছর পরও লেখক এসে তাঁর জমে থাকা অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন। তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে?  

আমরা এ ব্যবস্থাগুলো ধরে রেখেছি। কোনো বাকির কারবার করি না। কালি-কাগজ কেনা, ছাপা, বই বাঁধাই ইত্যাদি সব কাজেই নগদ লেনদেন। শুধু জিনিসগুলোর চালান আসার পর দেখে-শুনে-বুঝে নিতে যেটুকু সময় যায়, তারপর পাওনাদার তাঁর পাওনা টাকা পেয়ে যান। একইভাবে আমাদের প্রকাশিত বইয়ের দাম কম, কমিশনও কম। এ নিয়মেরও কোনো হেরফের না হওয়ায় কাগজ বিক্রেতা থেকে শুরু করে বইয়ের ডিলার, লেখকসহ সকলের মধ্যেই সেবা’র ওপর একটা আস্থা চলে এসেছে। তারাও সহযোগিতা করতে দ্বিধা করেন না। বই বের হওয়ার এক মাস পর বেচাকেনার হিসাব কষে নির্দিষ্ট হারে লেখককে রয়্যালটি দিয়ে দিই। এরপর তিন মাস অন্তর বিক্রির হিসাবে তাঁর পাওনা জমা হতে থাকে। লেখক সুবিধামতো সময়ে সেই অর্থ তুলে নেন। যতদিন বই গুদামে থাকবে এবং বিক্রি হবে ততদিন তিনি কিস্তি পেতেই থাকবেন। রিপ্রিন্ট হলে একই নিয়মে আবার শুরু হবে কিস্তি। এ নিয়ম আমাদের সিরিজ মাসুদ রানা, কুয়াশা ও তিন গোয়েন্দা ছাড়া অন্যান্য বইয়ের ক্ষেত্রেও। তবে যদি পারিশ্রমিকের টাকা তিন মাস অন্তর কিস্তির বদলে কেউ সবটুকু একবারে পেতে চান, তা হলে কারও কারও ক্ষেত্রে আমরা তা-ও দিয়ে থাকি। সেক্ষেত্রে রিপ্রিন্ট হলেও ওই বই বাবদ তাঁর আর কোনোও টাকা প্রাপ্য থাকে না।

বর্তমানে সেবা প্রকাশনী দেশের বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার কথা। সেবা অনুরাগীরাও সে স্বপ্ন দেখে। এমন না হওয়ার কারণ কী?

স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে অনেক ফারাক থাকে। হাতে টাকা থাকতে হবে, মানুষ আগে খেয়ে-পরে বাঁচবে, তারপর না বই কিনবে। সব টাকা যদি খাওয়া-পরা-ওষুধ ও নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসের পিছনেই চলে যায় তখন ইচ্ছে থাকলেও বই কেনা যায় না। প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হলে সেবা অনেক বড় হতো। সেটি হয়নি। সে জন্য আক্ষেপও নেই। বই কেনে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত মানুষেরা। পরিসংখ্যান যা-ই বলুক, জনপ্রতি গড়পড়তা আয় যাই দেখানো হোক, সবাই জানি সেটা কাগজ-কলমের হিসাব। একজনের মাসিক রোজগার যদি দশ হাজার টাকা হয়, আর অপরজনের হয় দশ কোটি টাকা; তা হলে এই দু’জনের প্রত্যেকের গড়পড়তা আয় দাঁড়ায় পাঁচ কোটি পাঁচ হাজার টাকা। হিসাব তো ঠিকই আছে, কিন্তু বাস্তব অবস্থা আলাদা। তবে বর্তমান অবস্থা যা-ই হোক, বাংলাদেশে সুখ-সমৃদ্ধি আসবে, মানুষের সচ্ছলতা-প্রাচুর্য আসবে সেই স্বপ্ন দেখতে দোষ কী? একদিন সেটা সত্যি হতেও তো পারে!   

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //