‘জ্বালানি সংকটের মূলে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা’

সম্প্রতি দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ আর অকটেন-পেট্রলে বেড়েছে ৫১ শতাংশ। তেলের দাম বৃদ্ধি বাজারের সব পণ্যেই প্রভাব ফেলেছে। চলমান জ্বালানি সংকট, এর কারণ ও উত্তরণের পথ নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে কথা বলেন পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বি ডি রহমতউল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহেরীন আরাফাত।

জ্বালানি তেলের রেকর্ড দামবৃদ্ধির বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

আন্তর্জাতিক বাজার বা দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধি কোনোভাবেই যৌক্তিক না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশে অকটেন-পেট্রলের কোনো ঘাটতি নেই। যদি তা-ই হয়, তাহলে তো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কোনো কারণ থাকে না। সে ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের দাম ৩০ থেকে ৪০ টাকা হওয়ার কথা। আর যদি বিদেশ থেকে কিনতেও হয়- আন্তর্জাতিক বাজারে কিন্তু অনেক ওঠানামার পর এখন দাম ৯৩ ডলার প্রতি ব্যারেলে স্থিতিশীল রয়েছে। হিসাব কষলে দেখা যাবে- অকটেন-পেট্রল-ডিজেলের গড় লিটারপ্রতি মূল্য ৬৫ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। আবার এমনও নয় যে এই তেল শুধু এমন দেশে উৎপন্ন হয় যাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং মধ্যপ্রাচ্যসহ বাংলাদেশের মিত্র দেশগুলোতে এ তেল পাওয়া যায়। সুতরাং এ দামবৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ দেখছি না। কার্যত এর মধ্য দিয়ে জনগণের উপর একটি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কোনো কোনো দেশে জ্বালানি তেলের দাম আরও বেশি বলে দাবি করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে...

কয়েকটা দেশে জীবনযাত্রার মানের উপর নির্ভর করে তারা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে রাখে। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন- সিঙ্গাপুরে জীবনযাত্রার মান অনুযায়ী অনেক পণ্যের দাম আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। সেখানকার সরকার এভাবে ভ্যাট বা ট্যাক্স আদায় করে। আবার জনগণকে ওইভাবে বেতনও দেওয়া হয়। ভারতে জ্বালানি তেল উৎপাদনও হয় বেশ ভালো পরিমাণে। তাদের জ্বালানি তেলের দামও বেশি। আবার থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো অনেক দেশে তো তেলের দাম কম। সেসব দেশের কথা কিন্তু বলা হয় না। এটি মূলত নির্ভর করে কোনো দেশের শাসন কাঠামো ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর।

অকটেন-পেট্রল কি দেশে উৎপাদন করা হয়

গ্যাসক্ষেত্র থেকে উপজাত (কনডেনসেট) হিসেবে যে তেল পাওয়া যায়, সেখানে ন্যাফথা, অকটেন ও পেট্রল থাকে। ন্যাফথা পেট্রলের চেয়ে কম পরিশোধিত তেল। ন্যাফথা বিভিন্ন কারখানায় জ্বালানি ও কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং কিছু পরিমাণে রপ্তানি হয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী আমাদের দেশে যে পরিমাণে অকটেন ও পেট্রল উৎপন্ন হয় তা চাহিদার তুলনায় বেশি। এই অনুযায়ী অকটেন এবং পেট্রল আমাদের উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু হঠাৎ করে রিজার্ভ সংকটের নামে দাম বাড়িয়ে দেওয়ার পেছনে দুর্নীতির বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। উপজাত হিসেবে প্রতিবছর মোট উৎপন্ন তেলের পরিমাণ ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৩৯ মিলিয়ন লিটার। এর মধ্যে পেট্রল-অকটেনের পরিমাণ ২ লাখ ৮২ হাজার ৯৮৮ মিলিয়ন লিটার, যেখানে এর চাহিদা রয়েছে ৮৭ হাজার ৩শ ৫৭ মিলিয়ন লিটার। ডিজেল উৎপন্ন হয় প্রায় ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৯৪ মিলিয়ন লিটার, যেখানে চাহিদা রয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৮৯৭ মিলিয়ন লিটার।

অনেকে বলছেন, উন্নতমানের তেল শোধনাগার স্থাপন করলে জ্বালানি তেলের চাপ কমিয়ে আনা সম্ভব। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কী

আমাদের যে তেল শোধনাগার রয়েছে, তা অনেক পুরনো। একমাত্র সরকারি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) তৈরি করা হয় ১৯৬৮ সালে। এটির বছরে তেল শোধনের সক্ষমতা ১৫ লাখ টন, যা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। তবে আমাদের আসলে দরকার উন্নত প্রযুক্তির তেল শোধনাগার। এর মাধ্যমে ইঞ্জিনের সক্ষমতা বেড়ে যাবে। ফলে তেল কম লাগবে। উন্নত প্রযুক্তির বেশি সক্ষমতাসম্পন্ন পণ্য ব্যবহার করলে সক্ষমতা গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। অথচ উন্নত তেল শোধনাগার স্থাপনের বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এখানে যে শুধু অর্থের অপচয় হচ্ছে, তা-ই নয়। বেশি তেল পুড়লে বেশি কার্বন-ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হবে- এতে উল্লেখযোগ্যমাত্রায় পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। 

কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যদি কিছু বলেন...

কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মূলত দায়ী বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার। তারাই এটিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। তবে তারা একটা কেন্দ্রও স্থাপন করতে পারেনি। তখন আমি পাওয়ার সেলের ডিজি ছিলাম। আমি সিরিয়াসলি এর বিরোধিতা করলাম। তবে তা টিকল না; বরং আমাকে ডিমোশন করা হলো। এর মধ্যে আমি অবসরে চলে যাই। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদে একটি দায়মুক্তি বিল উত্থাপন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বিদ্যুতের চাহিদাকে জরুরি বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে টেন্ডার ছাড়া কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন নেওয়া হয় এবং এর বিরুদ্ধে কেউ কোনো আদালতে যেতে পারবেন না উল্লেখ করে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর তারা ইচ্ছামতো কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন শুরু করল। তারা তখন ১৪ টাকা থেকে ১৬ টাকা পর্যন্ত রেটে বিদ্যুতের চুক্তি করে। সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে ব্যাপক অনিয়ম ও হরিলুট চলেছে। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে।

আমাদের দেশে যে জ্বালানি সংকট চলছে, এর মূল কারণগুলো কী

‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান’ নামে খুব ভালো একটা প্রকাশনা আছে। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর পরপর এই পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান নবায়ন করা হয়। বাংলাদেশে কিন্তু খুব চমৎকার কিছু প্রকাশনা বের হয়; কিন্তু এর বাস্তবায়ন হয় না। বাস্তবায়ন হয় ক্ষমতাকেন্দ্র বা সিন্ডিকেটের ইচ্ছায়। বর্তমানে যে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে, এর মূলে রয়েছে মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন না হওয়া। এর পেছনে রয়েছে লুটপাট, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও টাকাপাচার। সেই সঙ্গে রয়েছে অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। মাস্টার প্ল্যানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা বলা হয়েছে, ভারত ও নেপালের সঙ্গে হাইড্রো পাওয়ারের কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। হাইড্রো পাওয়ারে ভুটান ও মিয়ানমারকেও যদি যুক্ত করা যায়, তাহলে আমরা পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি পেতে সক্ষম হতাম এবং আমাদের চাহিদার সবটুকুই এ থেকে আমরা পূর্ণ করতে পারতাম। অথচ সেদিকে না গিয়ে সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার অনুমতি দিচ্ছে। এতে পরিবেশের যেমন ক্ষতি, তেমনি কয়লা আমদানির জন্য অন্য দেশের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ে। কয়লাকে সাশ্রয়ী বলা হলেও বাস্তবতা হলো- কয়লার দাম এখন অনেক বেশি। সেই সঙ্গে রয়েছে সরবরাহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ঝক্কি।

এখন যে জ্বালানি সংকট এবং এর সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকট দেখা যাচ্ছে- এটি কতদূর এগোতে পারে

সরকার দাবি করেছে, আমাদের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অথচ এখন আমরা দেখছি, লোডশেডিং হচ্ছে ৩ থেকে ১০ ঘণ্টা। কোনো কোনো জায়গায় আরও বেশি সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। আবার ব্যাংকের রিজার্ভ কমে আসছে। আমাদের এ অবস্থা যে আজ তৈরি হলো, তা নয়। ইউক্রেন যুদ্ধের আগেও এমন অবস্থাই ছিল। বলা হচ্ছে এর কারণে সবকিছুর দাম বাড়ছে। অথচ আমরা রাশিয়া বা ইউক্রেনের উপর নির্ভরশীল নই কোনো পণ্যের জন্য। বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, দেশ থেকে টাকাপাচার আরও বেড়েছে। তার মানে যে টাকা অবৈধ উপায়ে বা দুর্নীতির মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে, তা দেশে থাকছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থচুরির পর ফিলিপাইন ও শ্রীলংকার ব্যাংক যেসব তথ্য দিতে বলেছিল, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। একইভাবে সুইস ব্যাংকে যে বাংলাদেশিরা অবৈধ অর্থ জমা করেছেন, তাদের তালিকাও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চাওয়া হয়নি বলে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত দাবি করেছেন। 

আরেক দিকে আছে বিদেশি ঋণ। বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার ৬০০ টাকা। আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথায়ও সমপরিমাণ ঋণের দায় চাপবে। গত এক বছরে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৮৩০ টাকা। এ ঋণের প্রভাব সরাসরি পড়ছে অর্থনীতিতে। আমাদের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াটা এই ঋণেরই প্রতিক্রিয়া। নীতিনির্ধারকরা ঋণ নিয়েছে জনগণের কাঁধে ভর করে। বোঝাটা জনগণের ঘাড়েই পড়েছে। 

এ সংকট মোকাবিলার পথ কী হতে পারে

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বায়ুশক্তির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি গবেষণা চালিয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা এনআরইএলের অধীন কয়েকটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান এ গবেষণাটি করে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়- বাংলাদেশে বায়ুশক্তি খুবই সম্ভাবনাময় একটি খাত। বাতাসের শক্তি কাজে লাগাতে মূলত ৩০ মিটার, ৮০ মিটার ও ১০০ মিটার উচ্চতায় টারবাইন বসানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮০ মিটার উচ্চতায় টারবাইন বসানো হলে বাংলাদেশে প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট এবং ১০০ মিটার টারবাইন বসানো হলে ৬৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। 

প্রতি মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় ৫ কোটি টাকা, সৌরশক্তির ক্ষেত্রেও ৫ কোটি টাকা। তবে সৌরশক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যাটারির দাম কমলে এ খরচ আরও কমে আসবে। এনআরইএলের এক গবেষণায় বলা হয়, এখন আমরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করছি, তাতে মাত্র ২০ শতাংশ সক্ষমতা রয়েছে। তবে তা বাড়িয়ে ৪৮ শতাংশে নিয়ে আসা সম্ভব। সৌরশক্তি যে কোনো স্থানেই ইনস্টল করা সম্ভব। ভবিষ্যতে বায়ু ও সৌরশক্তিই বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাজত্ব করবে।

এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ হলো- অন্তত ৬০ ভাগ নবায়নযোগ্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানির দিকে যেতে হবে, সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে হবে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ী পণ্য ব্যবহার করতে হবে, নতুন ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে হবে। তবে সবার আগে দরকার অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধ করা। এ বিষয়গুলোতে উদ্যোগী না হলে সংকট সমাধানের পথে এগোনো সম্ভব হবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //