‘ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস রচিত হয়নি এখনো’

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন। এ আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের প্রাণের ইতিহাস। সে সময়ে এ আন্দোলন যেমন ঢাকাকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছিল-ঠিক একইভাবে গ্রামাঞ্চলেও এর একটি প্রভাব পড়েছিল। নেমেছিল আন্দোলনের ঢল।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম স্তরের ভাষাসৈনিক ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের তখনকার সময়ের শিক্ষার্থী আহমদ রফিক। এখনো যিনি ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ করছেন, লিখছেন সমানতালে।

ভাষা আন্দোলনের ৭১তম বছর পালিত হচ্ছে এ বছর। এ উপলক্ষে ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক-এর সঙ্গে কথা বলেছেন সাম্প্রতিক দেশকালের সাহিত্য সম্পাদক এহসান হায়দার

সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হলো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, এরপর পাকিস্তানে বাংলা ভাষার প্রতি বিদ্বেষের সূচনার দিকটি ঠিক কীভাবে শুরু হয়েছিল?  

ভাষা আন্দোলনের সূচনা মূলত পাকিস্তান জন্মের পরিপ্রেক্ষিতেই হয়েছিল; কিন্তু এ প্রক্রিয়া চলছিল পাকিস্তান হওয়ার আগে থেকেই। এ প্রসঙ্গে আমি বরাবরই বলি, বাঙালি মুসলমান পশ্চাৎপদ থাকার কারণে তারা ১৯৪৬ সালে চোখ বন্ধ করে মুসলিম লীগের বাক্সে পাকিস্তান হওয়ার পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল-প্রকৃতপক্ষে এই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই হলো অখণ্ড ভারত দ্বিখণ্ডিত করা, বঙ্গভাগ এগুলোর জন্য দায়ী।

মুসলিম লীগ মুসলমানদের জন্য একটি প্রধান প্রতিষ্ঠান হলেও এর কেন্দ্রীয় দলগত প্রাধান্য ছিল উর্দুভাষীদের হাতে। এমনকি প্রভাবশালী বাঙালি মুসলমান এ কে ফজলুল হক সাহেব চেষ্টা করেও মুসলিম লীগের হাই কমান্ডে ঢুকতে পারেননি, পরে জিন্নাহ কর্তৃক তিনি বহিষ্কৃতও হন সদস্য পদ থেকে। এমন অবস্থায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, সহিংসতা এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতেই দেশভাগ নিশ্চিত হয়। তখন ১৭ মে ১৯৪৭, উত্তর প্রদেশের একজন খ্যাতনামা মুসলিম লীগ নেতা খালেকুজ্জামান বলেন-পাকিস্তান হতে যাচ্ছে, আর যার রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।

ওই সময়ে বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান নিয়ে এতটাই আচ্ছন্ন ছিল যে, কেউ কোনো কথা বলেননি। সেই সময়ে ইত্তেহাদ সংবাদপত্রে যারা কাজ করতেন, তারা ছিলেন প্রগতিশীল বাঙালি মুসলমান-তাদের কেউ কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন। সামান্য নিঃসঙ্গ কণ্ঠস্বর বলা চলে-আবদুল হক সাহেব, মাহমুদুল হক মুজাহিদী তারা কয়েকজন আজাদ এবং ইত্তেহাদ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ করলেন। তাদের মূল দাবি ছিল উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।

তাহলে বলতে হবে পাকিস্তানিদের আগে থেকে ভাষার ওপর আগ্রাসন চালানোর পরিকল্পনা করা ছিল?

আবার ১৯৪৭ সালের জুন-জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছিলেন, ভারত চিন্তা করছে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য, সে হিসেবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে প্রবন্ধ লিখলেন। এই সময়কেই অনেকে বলেন ভাষা আন্দোলন; কিন্তু আমি বলি না, আমি বলি, এটা ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক পর্যায়।

স্যার ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক পর্যায় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলবেন কি?

আমি ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক পর্যায় বলছি কারণ-শুরুতে বাঙালিরা মৌখিকভাবে, লিখে প্রতিবাদ করেছেন; কিন্তু আন্দোলন করেননি, রাজপথে নামেননি, স্লোগান দেননি। এর ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পরেই সেপ্টেম্বর মাসে তমদ্দুন মজলিস গঠিত হয়। তমদ্দুন মজলিস একটা পুস্তিকা প্রকাশ করে-‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু না বাংলা’। সেখানে ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, ড. আবুল কাশেম প্রবন্ধ লিখলেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে ‘কৃষ্টি’ নামে আরও একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, অধ্যাপক ড. এনামুল হক ওই পত্রিকায় বাংলা ভাষার পক্ষে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই ব্যাপারগুলো ওই তাত্ত্বিক পর্যায়েরই বলে থাকি।

তাহলে সাংগঠনিকভাবে ভাষা আন্দোলনের শুরু ঠিক কবে থেকে হয়েছিল?

ভাষা আন্দোলন সাংগঠনিকভাবে শুরু হলো ১৯৪৮ সালে। ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চে যে আন্দোলন রাজপথে সংগঠিত হয় তা ছিল মূলত ছাত্রদের। সূচনা হয়েছিল পাকিস্তানের গণপরিষদে। প্রথম অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটা প্রস্তাব তুলেছিলেন-গণপরিষদে মাতৃভাষায় বক্তৃতা করবেন আর ব্যবহারিক ভাষা উর্দু এবং ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা গ্রহণ করা হোক।

এরপর কী ঘটেছিল গণপরিষদে, যে কারণে ছাত্ররা নেমে পড়ে রাজপথে?

এটা একটা বাস্তব সত্য যে, কয়েকজন উচ্চ শ্রেণির বাঙালি মুসলমান উর্দু বা ইংরেজিতে সড়গড় করে বক্তব্য দেওয়া ব্যতীত ওই ভাষা সাধারণের মধ্যে খুব একটা অভ্যস্ত ছিল না। গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব ছিল অত্যন্ত বাস্তব; কিন্তু তার সেই বাংলা ভাষার পক্ষের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে তখনকার পূর্ব বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনসহ মুসলিম লীগের সবাই। বিরোধিতা এমন অবস্থায় পৌঁছায়-প্রস্তাবটিকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া হলো।

৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতেই খবরটি ঢাকায় প্রকাশের পর ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুসলিম লীগের এই বিরোধিতার প্রতিবাদে রাজপথে নামে। সভা সমিতি মিছিল শুরু হয় চারদিকে, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন, তমদ্দুন মজলিস পুরোপুরি ইসলামপন্থি একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন-তাই তাদের প্রাধান্যও ছিল। তারা ওই ইসলামপন্থি রাজনীতির কারণেই বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রচার করেছে, কাজ করেছে। সংগ্রাম কমিটিতেও ছিল তাদের প্রাধান্য।

এ বিষয়ে ছাত্র সমাজে তখন কাদের ভূমিকা ছিল? 

তখনকার সময়ে মুসলিম লীগের প্রভাব ছিল বাঙালি মুসলিম সমাজে এবং ছাত্র সমাজেও। অন্যদিকে তখন ছাত্রলীগ বিভাজিত ছিল। মূল ছাত্রলীগের পাশাপাশি পূর্ব বঙ্গ ছাত্রলীগ শুরু হয়-যেটাকে নইমুদ্দিন ছাত্রলীগ বলত সকলে। নইমুদ্দিন সাহেব, শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে অনেকেই এর মধ্যে ছিলেন।

সেদিন ১১ মার্চ ঢাকায় আন্দোলন কীভাবে সংগঠিত হয়েছিল?

এ সময় ছোট ছোট দল, যেমন-কামরুদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে গণ আজাদী লীগের মতো দু-চারটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া, প্রতিবাদী প্রতিষ্ঠান খুব একটা ছিল না। কাজেই ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনটি মূলত সামান্য কয়েকজন রাজনৈতিক লোকসহ ছাত্র সমাজেরই আন্দোলন। যদিও ১১ মার্চের আন্দোলন ডাকা হয়েছিল দেশব্যাপী। ঢাকায় পিকেটিং অর্থাৎ সচিবালয়, প্রধান অফিসগুলো-পোস্টঅফিস, টেলিগ্রাফ অফিস, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ঘেরাও করার মতো পরিকল্পনা হয়েছিল।

কিন্তু সরকারের পুলিশ বাহিনী বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। অনেকেই গ্রেপ্তার হন। সেদিন মুহাম্মদ তোহাসহ বেশ কয়েকজন নেতা আহত হয়েছিলেন, আর শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাকিরা ছিলেন জেলে। তখন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন। পাকিস্তান হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রথম ঢাকা সফর করার কথা, স্বভাবতই নাজিমুদ্দীন সাহেব চাননি হট্টগোল আর প্রতিবাদের মাঝে জিন্নাহ সাহেব আসুক এখানে।

এই অবস্থায় তিনি সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ৮ দফা চুক্তি করলেন। যার প্রধান দুটি দফা ছিল-বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি এবং রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। ৮ দফা চুক্তি হয় এবং ১৫ মার্চ থেকে আন্দোলন স্থগিত, সঙ্গে সঙ্গে রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু সাধারণ ছাত্রসমাজ চুক্তি মানতে চায়নি। অনেক কষ্টে তাদের বুঝিয়ে রাজি করানো হলো-তমদ্দুন মজলিসের প্রাধান্যের কারণে একক সিদ্ধান্ত হয়েছিল। 

তারপর কী হয়েছিল?

১৯ তারিখে জিন্নাহ সাহেব আসেন, ২৩ তারিখে রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় তিনি বক্তব্য রাখলেন। পাকিস্তানে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় নেতা সে সময়। এমনকি পূর্ব বঙ্গের বাঙালি মুসলমান সমাজেও, বিশেষত ঢাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন; কিন্তু তিনি সেই জনসভাতেই রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বললেন, ‘রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আমার বক্তব্য হলো-উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, অন্য কোনো ভাষা নয়। এ ব্যাপারে যারা বিরোধিতা করেন, তারা পাকিস্তানের দুশমন।’ এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে যে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেখানেও তিনি অনেক কথার মাঝখানে ভাষার প্রশ্নে ওই একই কথা বললেন, তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে কিছুসংখ্যক ছাত্র নো, নো, বলে প্রতিবাদ করেছিলেন। এটা ছিল খুব সামান্য সংখ্যার ছাত্র, ক্ষীণ কণ্ঠস্বর। তিনি তা গ্রাহ্য করলেন না।

মুহম্মদ আলী জিন্নাহ তখন ৮ দফা চুক্তি নিয়ে কী বলেছিলেন? 

জিন্নাহ সাহেব এরপর যখন ঢাকা ছেড়ে যান বলে গেলেন, ‘৮ দফা দাবি জোর করে নেওয়া হয়েছে, ওটা আমি বাতিল করে গেলাম।’ এই বিষয়ে আমার মত, চুক্তির মাধ্যমে সেই সময় আন্দোলন বন্ধ করাটা সঠিক ছিল না। কারণ দেখা গেল যে জিন্নাহ সাহেবের প্রভাব, তমদ্দুন মজলিসের পিছুটান, ছাত্রলীগের কিছুটা নীরবতা, বিশেষত জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতার পর তারা যে জোর করে প্রতিবাদ করবেন, তা করেননি, তার প্রমাণটা হলো-১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের দিনটিকে ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ ভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য কেউ কোনো চেষ্টা করেননি। ছাত্রলীগ তখন বড় সংগঠন, একটা মিছিল বা প্রতিবাদ সভা করতে পারত খুব সহজেই, কিংবা তমদ্দুন মজলিসও সেটা করেনি। সেই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল ছাত্র ফেডারেশন।

তখনকার দিনে ছাত্র ফেডারেশন কোনো কাজ করতে পারত না, রাস্তায় নামলেই পুলিশ বেধড়ক পেটাত। নেত্রী নাদেরা বেগম এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের নাসির আহম্মদ, সৈয়দ আফজাল হোসেন, আবদুস সালামসহ ছাত্র ফেডারেশনের কয়েকজন মিলে সেদিন ছোটখাটো একটা মিছিল বের করেছিলেন। তাতে পুলিশ বেধড়ক পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়, গ্রেপ্তার করে, শেষে আন্দোলন বন্ধ করে দেয়। কেননা জনসাধারণের ওপর জিন্নাহ সাহেবের প্রভাব ছিল।

তারপর তো ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলো?

তারপর প্রায় সাড়ে ৩ বছর লেগে গেল নতুন করে আন্দোলন শুরু করতে। এর মধ্যে ১৯৫০ সালে যে দুটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলো আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে (আমাদের বন্ধু মানুষ, যিনি পরে ‘ভাষা মতিন’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন)। উনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন এই সংগঠনটি নিয়ে, আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন, ‘মিটিং ডাকি, কেউ আসে না, ফলে আমি একাই যা করার করি।’

১৯৫০ সালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বেসিক প্রিন্সিপালস কমিটি বা মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট। ওই কমিটির সুপারিশেও বলা হলো, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। মূলনীতি কমিটির এই দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতিকদের স্পর্শ করেছিল, ১৯৫০ সাল তখন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের আতাউর রহমান এবং গণ আজাদী লীগের কামরুদ্দিন সাহেবরা মিলে একটা প্রতিবাদের ব্যবস্থা করলেন। 

আপনিও তো ওই মিছিলে ছিলেন স্যার, তখনকার সময়টা নিয়ে বিস্তারিত বলবেন কি?

আমি তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। নবাবপুরের ওই মিছিলে আতাউর রহমানের পেছনে পেছনে হেঁটেছি, এটা আমার স্মৃতিতে আজও স্পষ্ট। আতাউর রহমান সাহেবের গায়ে ছিল কালো শেরওয়ানি, পরনে চুড়িদার পাজামা, হাঁটছেন মিছিলে। বিকেলে পুরান ঢাকায় বার লাইব্রেরিতে সভা, সেখানে উপস্থিত ছিলাম আমি কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে।

আপনারা আন্দোলন করছিলেন, অন্যদিকে তৎকালীন সরকার দমন নীতি অনুসরণ করেছিল, জিন্নাহর বক্তব্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য...

হ্যাঁ, এই আন্দোলনের কারণ ছিল একটাই-মুসলিম লীগের প্রচণ্ড দমন নীতি। ১৯৪৮ সালের পর ধীরে ধীরে সাংগঠনিক কাজগুলো হচ্ছিল, ছাত্রসমাজের মধ্যে সচেতনতাও বাড়ছে। এই পরিবেশে একটা বিষয় আমি বরাবরই বলি। এই আন্দোলনটি যতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়েছে নিজেদের গরজে, তার চেয়ে বেশি উসকানি ছিল সরকার পক্ষের। যেমন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব ছিল, সাধারণভাবেই আমি আমার নিজের ভাষায় বক্তৃতা করব, এটা মেনে নিলেই হয়ে যেত। তাহলে এই আন্দোলন আর হতো না। তেমনি সাড়ে তিন বছর পর তখন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন সাহেব আর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন সাহেব।

তখন মুসলিম লীগের কার্য উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এসে বক্তৃতা দিয়ে বললেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হতে যাচ্ছে।’ যথারীতি বললেন যে, ‘কায়েদে আজম অর্থাৎ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলে গেছেন, যারা এর বিরোধিতা করেন, তারা পাকিস্তানের দুশমন, এটা আমার কথা না কায়েদে আজমের কথা।’

সময়টা ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি। এটা বুঝতে তাদের ভুল হয়েছিল, রাজনীতিক পরিস্থিতি বিচারেও হিসাব-নিকাশটা সঠিক ছিল না। ছাত্র সমাজে যেন প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তৃতার পরই মৌচাকে ঢিল ছোড়ার মতো অবস্থা হলো! মেডিক্যাল কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, এমনকি এই বাংলাবাজারের কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল, অর্থাৎ ঢাকার যত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, সর্বত্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। বলাবাহুল্য ফজলুল হক হল, ঢাকা হল, সলিমুল্লাহ হলে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলো। ছাত্রদের উদ্যোগে ধর্মঘট, সভা মিছিল শুরু হলো।

তারপরই তো মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে একটি সভা হয়েছিল?

৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি বার লাইব্রেরিতে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সুষ্ঠুভাবে আন্দোলন পরিচালনার জন্য কর্মিসভার আহ্বান করা হয়েছিল। সেখানে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আহ্বায়ক হলেন ছাত্রলীগের নেতা কাজী গোলাম মাহবুব। এই কমিটিতে সব দল এবং হলগুলো থেকে ছাত্র, যুব এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধি নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল।

ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে গেল, ৪ ফেব্রুয়ারির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি-আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গণে, এখন যেটা ঢাকার ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্স, ওখানে বেলতলায় মিটিং হলো। ছাত্রদের এই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়-আন্দোলন সক্রিয়, বেগবান এবং গতিশীল করতে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হবে, সভা-সমাবেশ, মিছিল, স্লোগান ইত্যাদির মাধ্যমে। এটা সংগ্রাম কমিটিও সমর্থন করল। মওলানা ভাসানী আলাদাভাবে বিবৃতি দিয়েও এর সমর্থন করলেন।

একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন প্রতিবাদের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল?

২১ ফেব্রুয়ারি এই প্রতিবাদের সিদ্ধান্তের কারণ হলো, ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বঙ্গ আইন সভার প্রথম বাজেট অধিবেশনের দিন। উদ্দেশ্য ছিল বাজেট অধিবেশন ঘেরাও করা। এখন যেটা জগন্নাথ হল, সেটা ছিল পরিষদ ভবন। এখানে পরিষদ সদস্যদেরকে ঘেরাও করে ওই প্রস্তাব যেন তারা নেন এবং গণপরিষদে পাস করে এই দায়িত্বটুকু তারা পালন করেন এই বিষয়ে তাদের দিয়ে মুচলেকা নেওয়া। [এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, তখনো পূর্ব বাংলার নাম ‘পূর্ব বঙ্গ’, কারণ পাকিস্তান নামটি এসেছে এটা অনেকে বলেন] ভুল করে, পূর্ব পাকিস্তান নামটি এসেছে ৫৬ সালের গণপরিষদের অধিবেশনে। যখন প্রথম সংবিধানে অধিবেশন তৈরি হলো, ওই সংবিধানেই বলা হলো পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান। এর আগে নাম ছিল‘পূর্ব বঙ্গ’, আইন সভার নাম ছিল-‘পূর্ব বঙ্গ পরিষদ’ বা ‘ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি’।

তারপর তো আন্দোলন নিয়ে পরিকল্পনা হচ্ছিল ২১ ফেব্রুয়ারিতে কীভাবে কী করা হবে?

তখন আন্দোলন নিয়ে দেশব্যাপী প্রস্তুতি চলছে। এ সময়ে এক সমস্যা দেখা দিল। আওয়ামী মুসলিম লীগের আতাউর রহমান এবং গণ আজাদী লীগের কামরুদ্দিন সাহেবের মতো নেতারাও মনে করলেন, সামনেই পূর্ব বঙ্গ প্রাদেশিক নির্বাচন। প্রাদেশিক নির্বাচন মানেই তো ক্ষমতা। রাজনীতিক নেতারা চাইছিলেন, এখনই যদি আমরা সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে যাই, সংঘাতে যাই তাহলে হয়তো পাকিস্তান সরকার নির্বাচন বন্ধ করে দেবে।

আমার এখনো মনে আছে, সংগ্রাম পরিষদের আয়োজন প্রস্তুতি লক্ষ করে পূর্ব বঙ্গ প্রশাসন, নূরুল আমিন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি বিকালে সেক্রেটারি রোড ধরে আসা ঘোড়ার গাড়িতে ঘোষণা করছিল, ঢাকা শহরে ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি এবং এখানে কোনো সভা-সমাবেশ, মিছিল চলবে না। এই অবস্থায় ২০ তারিখ রাতে সর্বদলীয় কমিটি নবাবপুরে সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়, এই মুহূর্তে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়া ঠিক হবে না, কাজেই ১৪৪ ধারা ভাঙা সঠিক হবে না। সেখানে ছাত্র প্রতিনিধি, যুব প্রতিনিধি হিসেবে তিনজন ছিলেন-ওলি আহাদ, আবদুল মতিন এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র ও কলেজ ইউনিয়নের ভিপি গোলাম মওলা। তারা প্রতিবাদ করে বললেন, সাধারণ ছাত্ররা এ সিদ্ধান্ত মানবে না। তখন একটা আপস সিদ্ধান্ত হলো-পরদিন সকালে এই আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গণে আমতলায় ছাত্রসভা ডাকা হোক, তখন সিদ্ধান্ত দেখা যাবে কী হয়?

একুশে ফেব্রুয়ারির সকালবেলা থেকে সারাদিনে কী কী ঘটেছিল?

একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ছাত্রসভা হলো, সেখানে ইডেন কলেজ ও কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রীরা পর্যন্ত অংশ নিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাসহ সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিধি ছিল। বাইরের রাস্তায় খাকি হাফ প্যান্ট পরা পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়ল, লাঠিপেটাও হলো অনেক। এরই মধ্যে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য ছাত্রদের মিছিল ব্যাচ হিসেবে বেরুল।

ছাত্রছাত্রীদের আলাদা আলাদা খণ্ড খণ্ড দল বের হচ্ছিল, সেখানেও লাঠিপেটা হলো, গ্রেপ্তারও হলো অনেক। আমার অনেক বন্ধু, যেমন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের আলি আজমল, ফজলুল হক হলের আনোয়ারুল হক খান এ রকম আরও বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেন। হাবিবুর রহমান শেলী পরে বিচারপতি হয়েছিলেন, তিনিও গ্রেপ্তার হলেন।

এই পরিস্থিতিতে সবার একটাই লক্ষ্য ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণটা তখন বিশাল আয়তনের। এখন যেখানে নার্সেস কোয়ার্টার, আউট ডোর-তখন সেখানে বিরাট বিরাট ছাউনি ছিল, আমরা বলতাম মেডিক্যাল ব্যারাক। সেখান থেকে জগন্নাথ হল তো ১০০ গজ দূরে, সুতরাং সবচেয়ে কাছের জায়গাটিতে একত্রিত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই উদ্দেশ্যেই সবাই চেষ্টা করেছে, কেউ রেললাইনের পেছন দিয়ে, কেউ মাঝখানের পাঁচিল ডিঙিয়ে, কেউ ইট খুলে-আমিও ওই পথ দিয়ে গেলাম।

তারপর...

বাইরের রাস্তা দিয়ে পুলিশের লাঠির পিটুনিকে উপেক্ষা করে দুপুর ১২টা নাগাদ বেশ ভালোই জমায়েত হলো। পুলিশ তখন তাদের ব্যারিকেড সরিয়ে আমাদের ফুলার রোডে অর্থাৎ সেক্রেটারি রোডে নিয়ে এলো। বেশ শক্ত করেই ব্যারিকেড দিল, যাতে জগন্নাথ হলের দিকে যেতে না পারে এই জমায়েত থেকে কেউ। এই অবস্থায় যত বেলা গড়াচ্ছিল ততই সাধারণ মানুষ যোগ দিচ্ছিল। তা না হলে কী করে সালাম এখানে গুলিবিদ্ধ হবেন-সচিবালয়ের পিয়ন, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মানুষ আবদুল জব্বার গুলিবিদ্ধ হবেন?

পরিস্থিতিটা এমন ছিল যে শিক্ষার্থীদের বাইরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকেরা এসে হাজির হয়েছে; কিন্তু পুলিশ গুলি চালাল ঠিক কোন সময়ে?  

ছাত্র-অছাত্র সবারই মিলিত চেষ্টা ছিল বাইরে বেরোনোর, লাঠিপেটা খেয়ে গণপরিষদের ভেতরে ঢোকা। এই অবস্থার মধ্যে বেলা ৩টা ২০ মিনিট, এই সময়টা লেখা আছে এলিস কমিটির রিপোর্টে। তখন হঠাৎ সশস্ত্র পুলিশ নিরস্ত্র ছাত্রদের জমায়েতে বিনা প্ররোচনায় গুলি চালাল। গুলি চালানোর পর প্রথম শহীদ কে-এটা সব সময় সিরিয়ালি বলা হয় না। সিরিয়ালি বলা উচিত। প্রথম শহীদ দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র রফিক উদ্দিন, তাঁর মাথায় গুলি লেগেছিল। মাথায় গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় তাঁর, স্পট ডেড। আর আমাদের ২০ নম্বর ব্যারাকটা ছিল ফুলার রোডের সঙ্গেই লাগানো। এর কাছেই আবদুল জব্বার তলপেটে গুলিবিদ্ধ হলেন। তাঁকে সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে হাসপাতালে নিলাম।

আর ১২ নম্বর ব্যারাকের কাছেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন আবুল বরকত। তিনি মারা গেলেন অনেক পরে, অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছিল তার আগে। জব্বার ইমার্জেন্সিতে নেওয়ার অনেক পরে, আমার ব্যক্তিগত ধারণা-অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা গিয়েছিলেন। তাহলে প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন, দ্বিতীয় শহীদ আবদুল জব্বার, তৃতীয় শহীদ আবুল বরকত। সালাম, যাঁর নাম দ্বিতীয় শহীদ হিসেবে উচ্চারিত হয়, এটা ঠিক না-উনি মারা গেলেন আরও পরে, তাঁর পায়ের গোড়ালিতে গুলি লেগেছিল। হাসপাতালে ভর্তি তিনি, মারা গেলেন এপ্রিল মাসে, আমি বলি-যথাযথ চিকিৎসার অভাবে।

কারণ পায়ে গুলি লাগা লোক মরে যায় কীভাবে? আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাটা এমনই ছিল। আরেকটা কথা আমি বরাবরই বলি-এখানেও বলছি, আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। আমাদের ব্লাড ব্যাংক বা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা ভালো থাকত, রক্ত পরিবহনের ব্যবস্থা যদি ভালো থাকত, তাহলে অন্তত আবুল বরকতকে বাঁচানো যেত। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মারা গেছেন তিনি, অন্য কোনো কারণে নয়। অপারেশন করে অনায়াসেই এটা করা যেত; কিন্তু উনি মারা গেলেন। 

এরপর ভাষা আন্দোলন মূল রূপে সঞ্চারিত হতে থাকে, দেশের জেলা শহর থেকে গ্রামাঞ্চলেও...

ভাষা আন্দোলন, একুশের ভাষা আন্দোলনে-এতটা গতি সঞ্চারিত হওয়া এবং প্রদেশব্যাপী ব্যাপকভাবে জেলা শহর, থানা শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ার কারণ হলো ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ। ২০১৯ সালে আমার লেখা একটা বই প্রকাশ করেছে ‘প্রথমা প্রকাশন’, নাম-‘ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’। এটা মূলত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন কীভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে, কোথায় কোথায় গেছে, সেটার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

প্রত্যেকটি জায়গায় আমি দেখেছি, পুলিশের গুলিবর্ষণে ঢাকায় ছাত্রদের মৃত্যুর খবরই আন্দোলন শুরু করার একটা প্রেরণা, যা স্কুল পর্যন্ত বিস্তৃত। সে কারণে শিক্ষায়তনিক আন্দোলন গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছিল।

এর পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার অবস্থা কেমন ছিল? 

২২শে ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় দিনেই ঢাকা হয়ে উঠেছিল মিছিলের শহর। মিছিলগুলোতে একটা নতুন স্লোগান ছিল, ‘ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, সর্বস্তরে বাংলা চালু কর।’ এ ছাড়া সরকারবিরোধী আন্দোলনের স্লোগান তো ছিলই, সঙ্গে ছিল ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সারা ঢাকা সেদিন মিছিলের শহর। লাল-কালো, লাল মানে-লাল বর্ণমালায় লেখা ব্যানার, ফেস্টুন আর কালো মানে-কালো ব্যাচ, কালো পতাকা।

শহীদ মিনার তৈরি হলো কখন?

এই লাল-কালোর সমাহারে ঢাকা সেদিন প্রতিবাদের শহর। মিছিলের শহর। সেদিন ছাত্র আন্দোলন গণ-আন্দোলনে পরিণত হলো। যখন সাধারণ মানুষ শুনতে পেল, ঢাকায় সাধারণ ছাত্রদের পুলিশ গুলি করে মেরেছে, তখন সারা দেশের মানুষ জাগল, আন্দোলন বেগবান হলো। এইভাবে আন্দোলন চলল গোটা ফেব্রুয়ারি মাস। এর মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটল শহীদ মিনার তৈরি।

ওই যে দ্বিতীয় দিনে একটা আলাদা স্লোগান তৈরি হয়েছিল, সেটা ছিল ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। এই স্লোগানের পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে, আমাদের বন্ধুবান্ধব এমনি কথা প্রসঙ্গে (এটা কাকতালীয়ও বলা যায়) বললেন, শহীদ স্মৃতি অমর করতে, একটা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করলে কেমন হয়? শহীদ মিনার নয়, তখন কথাটা ছিল ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’।

২৩ তারিখ রাত, এই এক রাতের শ্রমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে এবং সেখানকার ছাত্রদের চেষ্টায় আবুল বরকতের গুলিবিদ্ধ হওয়া রক্তমাখা স্থানটিতে ১০ ফুট উঁচু, ৬ ফুট চওড়া একটি শহীদ মিনার তৈরি হলো, দুজন রাজমিস্ত্রির সহায়তা নিয়ে হোস্টেল প্রাঙ্গণে জমা ইট বালু সিমেন্ট দিয়ে। এই সিমেন্ট সরবরাহে সহায়তা করেছিলেন আমাদের কলেজের সম্প্রসারণ কাজের সাব কন্ট্রাক্টর, হোসেনি দালানের পিয়ারী সরদার।

তার কাছ থেকে চাবি এনে গোডাউন থেকে হাসপাতালের স্ট্রেচারে করে সিমেন্ট এবং বালু হাসপাতাল প্রাঙ্গণ থেকে হোস্টেল প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হলো। কারফিউয়ের মধ্যে, পুলিশি টহলের মধ্যে রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টার মধ্যে একটি শহীদ স্তম্ভ তৈরি করা হলো। সেই সময়ের রেপ্লিকাটি আমার কাছে রয়েছে। পরদিন রবিবার ২৪ তারিখ, সরকারি ছুটির দিন। সেই দিন থেকে শুরু করে সারাক্ষণ ঢাকার মানুষ এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। কেউ ফুল দিয়ে, কেউ টাকা পয়সা দিয়ে, কেউ অলঙ্কার দিয়ে। 

কিন্তু শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ পুলিশ ভেঙে দিয়েছিল কখন?

২৬ তারিখ ভেঙে ফেলা হলো, সশস্ত্র পুলিশ হোস্টেল ঘেরাও করে; কিন্তু শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ শুধু ঢাকা শহরে নয়, গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক জেলা শহর, মহকুমা শহরগুলোতেও হয়েছিল। যেমন রাজশাহী, মহকুমা শহর নড়াইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়সহ অনেক জায়গায় এ শহীদ মিনার তৈরি হয়েছিল। এই আন্দোলন চলেছে ২৭ তারিখ অবধি, তখনকার সরকার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার আগ পর্যন্ত এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার পর হোস্টেলগুলোকে খালি করে ফেলা হলো, শুধু মেডিক্যাল কলেজ এবং মিটফোর্ডের মেসগুলোতে ছাত্ররা ছিল, আমরা ছিলাম।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গেল যে, আন্দোলন আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে গেল। ৫ মার্চ সাধারণ হরতাল ডাকা হয়েছিল ঢাকায়, সেটা খুব সফল হয়নি। ইতিমধ্যে অনেক রাজনীতির খেলা চলতে শুরু করেছে। 

তাহলে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বের সময়কাল একুশে ফেব্রুয়ারির পর থেকে? 

১ সপ্তাহ থেকে ১০ দিনের ভাষা আন্দোলন। এক সপ্তাহই বলা উচিত।

এই আন্দোলনের ফলে আমাদের ভাষাপ্রীতি যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি আমরা পেলাম শহীদ দিবস আর শহীদ মিনার...

আমরা কী পেয়েছি? পেয়েছি দুটি প্রতীক। প্রথমত একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস, প্রতিবাদ দিবস বা ভাষা দিবস যা-ই বলি। দ্বিতীয়ত শহীদ মিনার, এটা প্রতিবাদ-আন্দোলনের একটি প্রতীক। এই আন্দোলনের ফলাফল কী? ফলাফলটা হলো-এর আগ পর্যন্ত আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি রাজনীতিতে পাকিস্তানি চেতনাটাই প্রধান ছিল।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কি একুশে ফেব্রুয়ারির পর একটা নতুন চেতনা জাগ্রত হলো এরপর?

এই আন্দোলনের পর দেখা গেল, রাজনীতি এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এ আন্দোলনের প্রভাবে একটি বাঁক ফেরা পরিবর্তন। পরিবর্তন দুই দিকে-রাজনীতিক বিচারে দুই ধারায়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা, সঙ্গে প্রগতিশীল রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চিন্তা। এই দুই ধারায় পরিবর্তন, যেটা পাকিস্তানি কনসেপ্টের পুরোপুরি বিরোধী।

এই দুটোর পরিপ্রেক্ষিতেই ভাষা আন্দোলনের যত তাৎপর্য বলো আর তার প্রতিক্রিয়া বা তার ফলাফল বিশ্লেষণ করো-এগুলো একুশের মাধ্যমে হয়েছে। তিনটি স্লোগান আমরা ২১ তারিখ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত মিছিলে মিছিলে দিয়েছি-‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, সর্বস্তরে বাংলা চালু কর’। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সবাই স্বীকার করেন-ভাষা আন্দোলন আমাদের নতুন রাষ্ট্রের সূতিকাগার।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান প্রেরণা ছিল ভাষা আন্দোলন, এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবেন কি?

জাতীয়তাবাদী ও রাজনৈতিক প্রগতিশীল চেতনার বিকাশ, ষাটের দশকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, যুক্তফ্রন্টের বিজয়, মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মন্ত্রিসভা গঠন-এ সবই এ আন্দোলনের মাধ্যমে এসেছে। আবার আন্দোলন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে শেষপর্যন্ত ৭১ সালের যুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তা যদি হয় দল, মত নির্বিশেষে-আমি খালেদা, শেখ সাহেব এবং শেখ হাসিনার বক্তৃতাও শুনেছি, তারা সবাই এই একই কথাগুলো বলেছেন। তাহলে ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস, সেটা সরকারের সংরক্ষণ করা উচিত ছিল না? মুক্তিযুদ্ধের ১৬ খণ্ডের ইতিহাস তৈরি হয়েছে। 

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণ-রচনার বিষয়ে আপনার ভাবনাটা জানতে চাই...

ভাষা আন্দোলনের সূচনা লগ্নের সে ইতিহাস যে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গ্রামের স্কুলগুলো পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল, বিস্তৃতি লাভ করেছিল-সেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গড়া বা দলিলপত্র সংগ্রহ কিংবা লিপিবদ্ধ করার দায়িত্বটা কোনো সরকার নেয়নি কেন? একই সঙ্গে আরেকটি প্রতীক শহীদ মিনার-আমাদের এই শহীদ মিনার তো ২৬ তারিখে ভেঙে ফেলল, তার পরিপ্রেক্ষিতেই পরে ৫৫ সাল থেকে শুরু করে ৫৬ সালে এসে আমাদের সর্বদলীয় সংগঠনের একটি অংশ হক সাহেবের কেএসপি, কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবুল হোসেন সাহেব এসে ভিত্তিপ্রস্তর করেনআমাদের এ জায়গাটুকু, আমাদের হোস্টেলের অংশবিশেষ এবং ফুলার রোডের অংশবিশেষ নিয়ে। সেই শহীদ মিনারের ইতিহাসটা রচনা করা উচিত ছিল না? যা এখনো আমাদের প্রেরণা জোগাচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সব কিছুতে কাজের প্রেরণা জোগাচ্ছে-জাতি, জাতীয়তা, প্রগতিশীলতা সবখানে। অথচ এই সামান্য দায়িত্ব কেউ পালন করেনি। তাদের মূল লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া। 

সর্বস্তরে বাংলা চালু কর, এই স্লোগানটি আপনাদের আন্দোলনের সময়ের কিন্তু এখনো এটা বাস্তাবায়িত হয়নি- 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণ হয়েছে; কিন্তু আমাদের শেষ স্লোগানটি-সর্বস্তরে বাংলা চালু কর-একুশের বদৌলতে স্বাধীন বাংলাদেশে তো সেটা চালু করা সম্ভব ছিল। উচ্চ শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, উচ্চ আদালতে-সর্বত্র বাংলা ভাষা চালু হওয়া উচিত ছিল। তার বদলে আমরা কী দেখছি-১৯০ বছর যে বিদেশি শাসন এ দেশকে চালিয়েছে, তাদের রাজ ভাষা ইংরেজি এবং আদালত পর্যন্ত, উচ্চ আদালত-হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট; এখানে রাজ ভাষার প্রচলন রয়েছে একইভাবে, যেভাবে ওরা চালাত ঠিক সেভাবে সেই নিয়মেই চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আদালতের নিয়ম, বিধি-বিধান কিছুই বদলায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা উচ্চ আদালতে ব্যবহৃত হয়নি, অথচ রাষ্ট্রভাষা বাংলা। স্বভাবতই আদালতের বাংলা ভাষার সর্বপ্রকার ব্যবহার উচিত বলে আমি মনে করি।

ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর পার করে এবার ৭১তম বছর পালন করতে যাচ্ছি, সংক্ষেপে ‘বায়ান্নার একাত্তর’। এই সময়ে এসে ভাষা আন্দোলনের প্রাপ্তি কতটুকু-

ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ছাড়াও বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি মাধ্যমে ভরে গেছে, যেমন একটি বিশেষ শ্রেণির উন্নতি হয়েছে। আমি এই উন্নতিকে বলি-ভার্টিকেল গ্রোথ, মানে সামান্য ছোট্ট শ্রেণি; কিন্তু তার উচ্চতা অনেক। বিশাল এক বিত্তবান শ্রেণির জন্ম হয়েছে এদেশে, ফলে এদের এই দুর্মূল্য ইংরেজি মাধ্যমে তাদের সন্তানদের শিক্ষা নিতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অসুবিধা হচ্ছে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের। ফলে প্রত্যেকে তার ক্যারিয়ার তৈরি করতে ইংরেজি মাধ্যমে চলে যাচ্ছে, তাহলে কী হলো?

চিকিৎসকেরা তাদের ব্যবস্থাপত্র বাংলা ভাষায় লেখেন না-যেহেতু আপনি নিজেও একজন চিকিৎসক-এটা কি সরকারি উদ্যোগহীনতা না-কি এর পেছনে অন্য কোনো বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে? 

আমি জানি চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র অনেকেই বাংলায় করে থাকেন। যেমন-প্রফেসর নুরুল ইসলামের কথা জানি (তিনি আমার অতি ঘনিষ্ঠজন) তিনি দেন, আমার বন্ধু ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীও দেন, এছাড়া আরও অনেক ডা. এখন বাংলায় ব্যবস্থাপত্র লেখেন। 

এর বাইরে আমি একটা বিষয় বলি-ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও কেন মেডিক্যাল কলেজগুলোতে প্রশ্নপত্রে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও বিকল্প ভাষা হিসেবে রাখা হয় না? এটা হওয়া জরুরি। এ বিষয়ে আমার চেষ্টার কমতি ছিল না। অনেক আগে আমি এই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। বেশ আগের কথা, আমি এবং ডা. সায়ীদ হায়দার (সম্প্রতি প্রয়াত) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাদের অনেক জুনিয়র।

আমরা যখন তার কক্ষে গিয়েছিলাম সেখানে আরও কিছু বেশ জুনিয়র অধ্যাপকও ছিলেন। অধ্যক্ষকে যখন মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষায় ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও প্রশ্ন করার প্রস্তাব করেছিলাম তারা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তাচ্ছিল্য করে। আমাদের ইচ্ছেতেই বাংলায় প্রশ্ন করা যাবে না, এটা বুঝেছি তখন। আসলে আমাদের ইচ্ছে এখানে যথেষ্ট নয়। মূল বিষয় হলো আমাদের এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ঔপনিবেশিক মন, যে কারণে আমরা এখনো বাংলা ভাষায় প্রশ্ন করা থেকে শুরু করে বিদ্যাশিক্ষার জায়গায় বাংলার ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে পারিনি।  

তাহলে কি ভাষা আন্দোলনের প্রতি শেষাবধি আমাদের দায়িত্বহীনতা প্রকাশ পাচ্ছে না? এই ৭১ বছরে এসে এর মূল্যায়ন কীভাবে করবেন?

আমি যদি বলি-ভাষা আন্দোলন এখানে ব্যর্থ! ভুল বলা হবে? ভাষা আন্দোলনের স্লোগানটাও তো ব্যর্থ হলো! সেই কারণেই আমি বলি, আমাদের সরকারগুলোর এক ধরনের উদাসীনতা, এক ধরনের অবহেলা-দুটোই কাজ করেছে। একুশের সুফলটা আমি ভোগ করেছি, ভোগ করছি-কিন্তু এর প্রতি যে দায় দায়িত্ব, সে দায়-দায়িত্বটুকু পালন করিনি এবং করছি না। এটাই হলো ভাষা আন্দোলনের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির একটা মূল্যায়ন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //