বাজেটে সুরক্ষার পরিবর্তে জনগণের দুঃখকষ্ট বাড়বে: ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

গত ৩০/৪০ বছরে অর্থনীতিতে এতটা সংকট দেখা যায়নি। সংকটের এই সময়ে বিশেষ কর্মসূচি সংবলিত বাজেট প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটি করা হয়নি। উল্টো বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জনগণের সুরক্ষা দেবে না, বরং দুঃখকষ্ট আরও বাড়াবে। সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে এসব মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হারুন-অর-রশিদ।

চলমান সংকটের মধ্যে বাজেট কতটা সময়োপযোগী বলে আপনি মনে করেন
দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী সংকট বিরাজমান। মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট মানুষ, জ্বালানি সংকটে নাজেহাল জনজীবন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমশ কমছে, ব্যাংকগুলোও তারল্য সংকটে ভুগছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের দুর্যোগপূর্ণ ও বিশেষ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ সরকারের কাছে একটি বিশেষ ধরনের বাজেট প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু সরকার থেকে বিশাল অঙ্কের যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি একেবারেই সাদামাটা। বাজেটের খুবই অল্প কিছু ভালো দিক আছে। তবে সেটির পরিমাণ একেবারেই ছিটেফোঁটা। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির জাঁতাকলে দেশের সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছে।

তারল্য সংকটের সময় ব্যাংক ঋণ নির্ভর বাজেট কতটা বাস্তবসম্মত 
গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য যে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সেখানে বাজেটে ঘাটতি রয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। বিশাল এই ঘাটতি পূরণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে রেকর্ড পরিমাণ ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। 

ব্যাংক খাত এমনিতেই নানা সংকটে রয়েছে। নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে খেলাপি ঋণে ধুঁকছে ব্যাংকগুলো। বৈদেশিক মুদ্রার আয় অনেক কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়া হিতে বিপরীত হবে। সরকার নিজে বেশি পরিমাণ ঋণ নিলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে না। এতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়বে না। বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। 

ঋণ নেওয়ার এই প্রবণতার কারণে শিল্প খাতে উৎপাদন কমে যাবে। উৎপাদন কমে গেলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। কর্মসংস্থান কমে গেলে মানুষের আয় কমে যাবে। আবার উৎপাদন কমলে পণ্যের দাম আবার বাড়বে। ফলে নানামুখী সংকটে বিপর্যস্ত হবে জনজীবন। অথচ বিগত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির কমানোর জন্য বাজেটে কার্যকরী পদক্ষেপ দরকার ছিল। সেটি করা হয়নি। 

আয়কর রিটার্ন জমা দিলে দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে এই প্রস্তাব সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী 
সরকার গত এক যুগেও কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে পারেনি। এখন হঠাৎ করেই বাড়িয়ে ফেলবেন, এটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। সরকার বিভিন্ন খাতে ভ্যাট বাড়িয়েছেন। ভ্যাট ধনীদের জীবন মানে কোনো পরিবর্তন না আনলেও গরিবের জীবন ধারণে বড় প্রভাব ফেলে। রিটার্ন জমা দিলেই ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে এই সিদ্ধান্ত স্ববিরোধী। একদিকে বলা হচ্ছে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত আবার বলা হচ্ছে আয় না থাকলেও দিতে হবে কর। এ সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক যুক্তিতে ঠিক হয়নি। এটি এমনভাবে করা হচ্ছে ৫০ ধরনের সেবা নিতে গেলে ন্যূনতম করপ্রদানের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে। সেবা পাওয়া নাগরিক হিসেবে সবার অধিকার। কর আদায়ের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। করফাঁকি ও অর্থপাচার অহরহ হচ্ছে। সেগুলো বন্ধ না করে নাগরিক অধিকার বন্ধের সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত নয় বলে আমি মনে করি। 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট কীভাবে সমাধান করা যায়
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির এই সংকট দুঃখজনক। এটিও সৃষ্টি হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে। রেমিট্যান্স কমে গেছে, রপ্তানি আয় কমেছে। আবার আমদানিও কমে যাচ্ছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হলে আবার সেই শিল্পের উৎপাদন কমে গিয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, মানুষেরও আয় কমে যাবে। অর্থনীতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের প্রভাব মারাত্মক। বিদ্যুতের জন্য কয়লা আমদানিতে সব মিলিয়ে হয় ১ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল রিজার্ভ থেকেই এই অর্থের জোগান দেওয়া। কিন্তু কেন এটি করা হচ্ছে না আমার কাছে তা বোধগম্য নয়। 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেত
আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম কমছে। কিন্তু আমাদের বাজারে তা বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ও বাজারব্যবস্থার দুর্বলতা। অভ্যন্তরীণ বাজারে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ানো দরকার। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে ছিটেফোঁটা ভর্তুকি অর্থহীন। এতে চলমান সংকটের সমাধান হবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //