ইউরোপের মুখে সভ্যতার কথা রসিকতা মাত্র: হ্যান্স কুন্দনানি

‘ইউরোহোয়াইটটনেস’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে রীতিমত পুরো ইউরোপে সাড়া ফেলে দিয়েছেন হ্যান্স কুন্দনানি, যিনি কিনা চ্যাথাম হাউসে ইউরোপ প্রোগ্রামের সহযোগী ফেলো হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। সম্প্রতি তিনি তার এক সাক্ষাৎকারে ইইউ ও ইউরোপীয়দের নিয়ে খোলামেলা তার মন্তব্য তুলে ধরেছেন। তিনি তার প্রকাশিত গ্রন্থের মাধ্যমে পাঠকদেরকে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী অতীতের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ ভাবমূর্তি পুনর্বিবেচনা করতেও বেশ প্রভাবিত করেছেন। তার পুরো বই জুড়ে ইউরোপীয় প্রকল্প সম্পর্কে তার একান্ত ভাবনা তুলে ধরেছেন। 

তার সাক্ষাৎকারটি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো 

ইউরোপীয়দের নিয়ে উল্লেখযোগ্য পৌরাণিক কাহিনী সম্পর্কে যদি বলেন?

আমি বিশেষভাবে দুটি উল্লেখ করব। প্রথমটি হলো-ইইউ মূলত nগর কেন্দ্রিক সভ্যতা নিয়ে গড়ে উঠেছে। কসমোপলিটানিজম নিয়মে সাধারণত সমগ্র বিশ্বের সাথে সংযুক্ত থেকে নিজ দেশ বা নগর সভ্যতার উন্নয়েন কাজ করতে হয়, কিন্তু ইউরোপ সমগ্র বিশ্বের অংশ হতে পারেনি। ইউরোপপন্থী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এ দুটো বিষয় নিয়ে বেশ ভুল মতবাদ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যখন তারা ইউরোপীয় একত্রীকরণের কথা বলে থাকে, তখন তারা কখনও কখনও মনে করে যে তারা বিশ্বকে এক ছাতার নিচে আনতে বলছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটি করছে না কেউ। একইভাবে, যখন তারা বলে "আমি একজন ইউরোপীয় বা আমি একজন ইউরোপীয় নাগরিক," তারা মনে করছে যে, আমি বিশ্বের বিশেষ শ্রেণির নাগরিক, কিন্তু আসলে তারা তা নয়। তারা বলছে যদিও আমি এই বিশেষ অঞ্চলের একজন নাগরিক যার একটি বিশেষ ইতিহাস এবং বিশ্বের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।

দ্বিতীয় মিথ -ইইউ একটি শান্তি প্রকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যা সম্পূর্ণ ভুল মতবাদ নয়। ১৯৪৫ সালের পর ইউরোপীয়রা যুদ্ধ প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তারপর থেকেই ইউরোপীয়রা শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। বাস্তবে, ইউরোপীয়রা ১৯৪৫ সালে সাধারণভাবে যুদ্ধ প্রত্যাখ্যান করেনি। তারা কেবল গোষ্ঠীগত যুদ্ধ প্রত্যাখ্যান করেছিল।

ইউরোপীয়রা নিজেদেরকে স্বতন্ত্রভাবে শান্তিপূর্ণ ভাবতে পছন্দ করে। আসল গল্পটি আরও জটিল। বিশেষ করে, ইউরোপীয়রা যে পরিমাণে সামরিক শক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে, এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেও হয়ে থাকেনি এমনকি ইউরোপের মধ্যেও নয়। 

ইইউ-এর মূল ফোকাস কী শান্তি থেকে ক্ষমতার দিকে সরে গেছে?

আমি এভাবে বলব না যে এটি শান্তির বিষয় থেকে ক্ষমতার বিষয়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। আমি মনে করি এটির সাথে সর্বদা ক্ষমতার পাশাপাশি শান্তির বিষয়াদিও ছিল। বিশেষ করে, শান্তি প্রকল্প হিসাবে ইইউ-এর ধারণা সম্পর্কে বলছিলাম। ১৯৫০ -এর দশকে ইউরোপীয় একত্রীকরণের মূল কারণ ছিল ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের মাধ্যমে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের উপনিবেশগুলোকে একত্রিত করে আধিপত্য বিস্তার করা। যেদিও নিজেদের মধ্যে সেটি করতে সক্ষম ছিল না তারা। 

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে ১৯২০-এর দশকে যদি তাকাই তবে এটিকে  শুধুমাত্র নতুন বলে মনে হবে, কারণ প্রো-ইউরোপীয়রা পূর্বোক্ত পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে ইউরোপের একটি গল্প বলতে কেবল পছন্দ করে। এটি কেবল একটি পরিবর্তনের মতো মনে হচ্ছে এখন, কারণ আমরা কীভাবে ইউরোপীয় একীকরণ শুরু হয়েছিল তার আসল ইতিহাস ভুলে গেছি।

আপনার বই থেকে বোঝা যায় যে ইউরোপের নাগরিক ধারণাগুলি জাতিগত-সংস্কৃতির দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। পরিচয়ের রাজনীতির সাথে ইউরোপের নব্য উদারীকরণের সংযোগ কী?

ইউরোপের প্রাচীনতম ধারণাগুলি প্রধানত জাতিগত-সাংস্কৃতিক কেন্দ্রিক। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যযুগে ইউরোপীয়দের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের ব্যপক সমর্থন। অন্যদিকে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যখন ইইউ একটি সম্পূর্ণ নাগরিক আঞ্চলিকতায় বিকশিত হওয়ার সবচেয়ে কাছাকাছি পর্যায়ে এসেছিল তখন থেকে আজকের আধুনিক আধুনিক যুগ পর্যন্ত ইউরোপের মধ্যে নাগরিক ধারণা পাওয়ার স্বাদ পাবেন। বিশেষ করে, ৬০ দশক থেকে ৯০-২০০০ এর মধ্যে ইউরোপের একটি ধারণা ছিল সামাজিক বাজার অর্থনীতি, কল্যাণ রাষ্ট্র এবং শাসনের অরাজনৈতিক পদ্ধতির ওপর কেন্দ্রীভূত থাকা যা ইউরোপীয়দের একত্রিত করেছিল।

আমি যেভাবে নিওলিবারেলিজমকে বুঝি তা কেবল অর্থায়ন নয়, এটি অর্থনৈতিক নীতির অরাজনৈতিকীকরণও। গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল বিষয় হলো বিভিন্ন স্বার্থের সমন্বয় সাধন করা।  পাশপাশি সমাজের লোকেদের বিভিন্ন ধারণা বা ভিন্ন স্বার্থ থাকে যেসব নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। বর্তমান ইউরোপীয় কমিশনে, ২০১৯ সাল থেকে উরসুলা ভন ডের লেয়নের কমিশন, ইউরোপীয় জীবনযাত্রার প্রচারের জন্য একজন ইউরোপীয় কমিশনার হিসেবে তার কাজ দেখা যাচ্ছে তিনি কেবল অভিবাসীদের বাইরে রাখার বিষয়েই ব্যস্ত। আর এটি একটা ইস্যুকে স্পষ্ট করছে যে শুধুমাত্র দক্ষিণ থেকে আগত অভিবাসীরাই নয় বরং পূর্ব থেকে আসা অভিবাসীরাও ইউরোপীয় জীবনধারার জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ইউরোপে যাদেরকে "বহিরাগত" হিসাবে দেখা হচ্ছে তাদের বিষয়ে ইউরোপের ইতিহাস থেকে আপনার কাছে কী বার্তা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ রয়েছে?

আমি বলব- বিভিন্ন সময়ে "অন্যদের" নিয়ে ইউরোপকে সংজ্ঞায়িত করার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং এটি ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু মোটামুটিভাবে আমি বলব যে, মধ্যযুগীয় যুগে যখন ইউরোপ খ্রিস্টান ধর্মের সমর্থক ছিল তখন একই সঙ্গে ইহুদি ও মুসলিমদের বহিরাগত বা অন্যান্য হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। যদিও পশ্চিমা এবং পূর্ব খ্রিস্টান জগতের মধ্যে বিভাজন বাদ দিয়ে এটি করা হয়েছিল। এবারে আধুনিক যুগে যদি দেখি, তবে দেখব ইউরোপের একটি নতুন জটিল আধুনিক ধারণা রয়েছে। আর তা হলো আংশিকভাবে ইউরোপীয় জোটকে আলোকিত করা। এটি কিছুটা বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সাথে সম্পর্কিত। এটি একটি ধর্মীয় ধারণার পরিবর্তে ইউরোপের একটি যুক্তিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ ধারণাও বলা যায়। একই সময়ে ইউরোপের ধারণাটি আফ্রিকা এবং এশিয়া এবং বিশেষ করে আমেরিকার জনগণের সাথে ইউরোপীয়দের মুখোমুখি হওয়ার পটভূমিকা থেকে  উদ্ভূত হয় । আর সেটি থেকে ‘’ইউরোপীয় হোয়াইটনেস’’ এর জন্ম। 

২০ শতকের দিকে বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর একটি ভূ-রাজনৈতিক ব্লক হিসাবে ইউরোপের নতুন ধারণা জন্ম হয়েছে যা আমি আগে উল্লেখ করেছি। ইউরোপীয় সভ্যতা বা ইউরোপীয় চেতনা নিয়ে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন হুমকির মুখে পড়েছে।

বর্তমান ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্ধিতকরণ নিয়ে পূর্ব ইউরোপীয় দেশ এবং তুরস্কের যোগদান প্রক্রিয়াকে কীভাবে দেখেন?

আমি অনলাইনে একবার একটি আলোচনা দেখছিলাম যে জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (ডিজিএপি) একটি বৈদেশিক পলিসি থিঙ্ক ট্যাংকের সঙ্গে ঠিক এমন কিছু প্রশ্ন নিয়েই ৯০ মিনিটের দীর্ঘ আলোচনা করছিল। তবে সেখানে কিন্তু তুরস্কের কথা উল্লেখ করা হয়নি। কেউ তা তুলে ধরার কথাও ভাবেনি। এটি ইইউ বৃদ্ধিতে ইউরোহোয়াইটনেস কীভাবে ভূমিকা পালন করে সে সম্পর্কে আপনার প্রশ্নের উত্তর বললাম।

আমি মনে করি যে তুরস্ক একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলেও এটিকে একটি মুসলিম দেশ হিসাবে দেখা হয়। পশ্চিম বলকান অঞ্চলের দেশগুলি এই ক্ষেত্রে আরও জটিল, কারণ এ অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব রয়েছে যা কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম। 

আপনি ইইউ সম্পর্কে আপনার ধারণা কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলতে চান?

দেখুন, এটি ইউরোপকে কিছুটা পেরিফেরাল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে আমি যখন ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ইউরোপীয় পররাষ্ট্র নীতির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (ECFR) এ কাজ করছিলাম তখন বিষয়টি বেশ প্রভাবিত করে আমাকে। যখন আমি প্রথম কাজ শুরু করি তখন আমি একধরনের প্রো-ইউরোপীয় ছিলাম এবং আমি ভেবেছিলাম আমি ইইউ সম্পর্কে বুঝতে পেরেছি। 

আমি দুই বছর আগে নিউ স্টেটসম্যান নামে একটি ব্রিটিশ ম্যাগাজিনে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। যেখানে ইউরোহোয়াইটনেস ইস্যুকে বেশ প্রসারিত করে। বইটি লিখতে আমাকে ECFR এর প্রাক্তন বস, মার্ক লিওনার্ড অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি এ প্রবন্ধটিকে একটি উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রকল্প হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন যা ইইউ-কে আরও বেগবান করতে পারে। 

আপনি কি মনে করেন যে ইইউ এখনও সভ্য হিসেবেই পরিগণিত হচ্ছে?

একজন পোলিশ শিক্ষাবিদ জ্যান জিলোনকা যিনি অক্সফোর্ডে বহু বছর ধরে ছিলেন, তিনি বর্ধিতকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে ইইউ-এর সভ্যতামূলক নানান বিষয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।  যাকে তিনি 'উত্তর-আধুনিক সভ্যতামূলক মিশন' বলে অভিহিত করেছেন এবং আমি মনে করি তিনি একদম সঠিক। কিন্তু আমার মনে আছে, ECFR-এ থাকাকালীন আমার প্রাক্তন বসের সাথে এ বিষয়ে আলোচনাটি হয়েছিল। আর তখন তিনি বলেছিলেন যে ইউরোপীয়দের মুখে সভ্যতার কথা হাস্যকর ছাড়া কিছু নয়। 

পলিটিক্স

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //