সাহিত্যে বড় পরিসরে দেখলে গোষ্ঠীবাদিতা থাকবেই: হাসান রনি

হাসান রনি, তারুণ্যদীপ্ত বাংলাদেশি কবি। এক দশকেরও অধিক সময় তিনি জন্মভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে দূর আমেরিকায় বসবাস করছেন। 

বাংলা কবিতা ও বিশ্বকবিতা পাঠের ভেতর-বাহির এক অসামান্য ভ্রমণ তার রয়েছে। ফলে সমকালিন কবিদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে তার দূরত্ব এবং দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়। তার কাব্যদর্শন এবং চর্চার ভেতরও রয়েছে দেশীয় মনস্তত্বের তীব্রতর প্রতিফলন। হাসান রনি’র এ যাবৎ কোনো কবিতার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি; কিন্তু বাংলাভাষার সমকালিন কবিতার জগতে তার কবি স্বীকৃতি মিলেছে বেশ আগেই, সাম্প্রতিক কবিতাচর্চা এবং বাংলা কবিতা সম্পর্কিত এই সাক্ষাৎকার একটি নতুন চিন্তার উন্মোচন ঘটাবে বলে আশা করা যায়।

সম্প্রতি হাসান রনির এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন- সাম্প্রতিক দেশকাল এর সাহিত্য সম্পাদক এহসান হায়দার।

আপনার কবিতাচর্চা শুরু হয়েছিল কীভাবে?

যখন নিজের চারপাশ ভীষণ চাপ দিচ্ছিল আর একা করে দিচ্ছিল খুব, তখনই কবিতা লেখার শুরু। আমি যা দেখতে পাই এই পৃথিবীতে, তার উল্টো এক বয়ান আমাকে লিখতে বাধ্য করেছিল। একরকম ঘোরগ্রস্তের মতোই আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম।

দীর্ঘদিন হয়ে গিয়েছে আপনি কবিতা লিখছেন, এখনো কোনো গ্রন্থ প্রকাশ হয়নি আপনার। এটি কি ইচ্ছাকৃতভাবেই করেন নি, নাকি অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে এর পেছনে?

বই বের করে কাউকে কবি-লেখক হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। প্রতিবছর প্রচুর বই বের হয় আবার নাইও হয়ে যায়। একজন লেখকের জীবন খুবই কষ্টের, লেখক নতুন কিছু দেখাতে চান যা দৃশ্যমান নয় মাঝেমাঝে। আবার তিনি যে জগতটা আমাদের দেখাতে চান সেটা ঠিক ইল্যুশনও নয়। এত এত ভালো কবিতা লেখা হয়েছে সেসবের সঙ্গে লড়ে আপনাকে আপনার নিজস্ব দর্শন, চিন্তা ও ভাববার স্পেসটুকু বের করে নিতে হয়। নিজের কথাটিই আবার সামগ্রিকতাকে ধরতে পারছে কি-না সেইদিকটিও খেয়াল রাখতে হয়।

কবিতা নয় কেবল, শিল্পের সব ক্ষেত্রেই গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে অপচর্চার দিক লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশে ঢাকার সাহিত্য পরিমণ্ডলে এই গোষ্ঠীবাদিতা তীব্র। বৃত্তের বাইরে থেকে প্রান্ত বা আঞ্চলিক পর্যায় থেকে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র কতটা মুক্ত বলে মনে করেন? আপনি যে শহরে জন্মেছেন, শিল্প-সাহিত্যে সেই হবিগঞ্জ কতটা সমৃদ্ধ আজকের দিনে?

আমি যে শহরে জন্মেছি সেখানে মেইনস্ট্রিম সাহিত্য বলতে কিছু ছিল না। আমার এক বড় ভাই আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ছেলেবেলায় আমার মনোজগতে ভীষণ প্রভাব ফেলেন। তিনিই আমাকে সাহিত্যিক জীবন-যাপনের ব্যাপারে আকৃষ্ট করেছিলেন। 

সাহিত্যে বড় পরিসরে দেখলে গোষ্ঠীবাদিতা থাকবেই, আপনি সজাগ হলে এসব আপনাকে নিজের কাজের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী করে তুলতে পারে। লেখালেখিতে প্রথমদিকে প্রভাব এড়ানোর কাজটা করতে হয়। দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান যা কিছু টেক্সটে আনছি, সেই-সবকিছুকে আগে নিজের বিশ্বাস করতে হয়। আপনি দূর থেকে দেখছেন বাংলা কবিতা গুটিকয়েক লোকের মাধ্যমে নতুন কিছু বলতে চাইছে, সেটা সবসময় ঠিক নয়। কবিতা একটা সময়ধরে সবার কাজের মাধ্যমেই এগোয়। ধরুন, ভাষার কাজ, আমরা দেখি সাধু আর চলিত ভাষা মিলিয়ে কেউ বলতে চাইছেন, সেটা নতুন নয়। কী বলতে চাইছেন সেটাই দরকারি। যেমন চিত্রকল্প আর দৃশ্যকল্পও ঠিক এক ব্যাপার নয়।

আপনি গত এক যুগের কাছাকাছি সময় আমেরিকাতে বসে বাংলা কবিতা চর্চা করছেন। আমেরিকায় বাংলা কবিতা কতটা এগিয়েছে বলে মনে করেন?

আমরা যারা এখানে থেকে কবিতা লিখছি তাদের প্রায় সবারই চিন্তার স্মৃতি- সে বাংলাদেশেই রয়ে গেছে। কবিতা পছন্দের দিকটা আগে পরিস্কার হওয়া উচিত। কোন সব কবিতার ভিত্তিতে বাংলা কবিতা নতুন বলে মনে হচ্ছে, বা এগিয়েছে তা জানাটাও জরুরি। পাঠককে আকৃষ্ট করা কবিতাই- নতুন কাজ নয়।

গত কয়েক দশক হলো আমেরিকাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ থেকে কবি-লেখকদের আমন্ত্রিত হয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদেশে যেমন সার্ক কবিতা সম্মেলন, আঞ্চলিক সাহিত্য সম্মেলন সবই চলে দল বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে-বিষয়টি এভাবেও বলা যায়, একজন আয়োজক থাকেন দায়িত্বে, তিনি তার অনুগত ও সুবিধামতো লোকদেরই যুক্ত করেন। আপনাদের আমেরিকান লিটারারি সোসাইটির সমস্ত সাহিত্য কর্মকাণ্ডও কি ওই রকম?

এখানে যারা আসেন, তারা এখানে দায়িত্বে আছেন-এমন কারো সঙ্গে সুসম্পর্কের ভিত্তিতেই হয়তো আসেন। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছি, আমি এমনসব প্রকাশনাকে এখানে আসতে দেখেছি যারা গুটিকয়েক প্রবাসী আমেরিকানদের বইগুলোই নিয়ে আসেন যেগুলোর আদৌ কোনো মেইনস্ট্রিম ভ্যালু নাই। আপনি আমাকে জানতে চাইতে পারেন মেইনস্ট্রিম কী? আমি চিন্তা বদলের কথা বলছি। চিন্তা বদলের প্রক্রিয়াই মেইনস্ট্রিম। এখানে যেসব হয় তার সাথে সেই অর্থে চিন্তাবদলের মতো প্রধান-প্রধান বিষয়গুলো হাজির থাকে না।

আপনার কবিতায় অলংকার, উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং প্রতীকী বিষয় নানান রূপে এসে ধরা দেয়। বিষয়গুলি কবির ভাবনায় ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র থেকে বিস্তার লাভ করে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবেন?

আগেই বলেছি, আমি মনে করি একজন কবির প্রাথমিক কাজ হলো নিজের টেক্সটকে আগে নিজে বিশ্বাস করা; কিন্তু এটা স্রেফ বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাও নয়। এক না দেখা জগতকেই আমরা বিনির্মাণ করি। দেখা গভীর হলে অনেককিছু এমনি এমনি ঘটে যায়। একজন লেখক যখন লেখার টেবিলে থাকেন এই একা পৃথিবীর ভাষ্যকার সে নিজে। কতটা আলাদা একটা জায়গা থেকে তিনি বলছেন সে বলাটা সবাই বিশ্বাস করবেন সেটা চাওয়া অন্যায়। এত কোলাহলে একা থাকার বিশ্বাস আনাটা কঠিন, অন্তত লেখালেখির ক্ষেত্রে। যদিও আনতে পারলে সেটা মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষেও ভালো! লেখালিখি নিজেকে ভারমুক্ত করার কাজটা সহজ করে অনেকক্ষেত্রে। আর অনেক বুদ্ধিমান লেখকই নিভৃতে থাকার সুযোগটাও ছেড়ে দেন না।

কোভিড পরবর্তী সময়ে সাহিত্য একটি চূড়ান্তভাবে প্রজেক্টে রূপ নিয়েছে। নানামুখী প্রকল্প এসে গিয়েছে, অ্যাপ এসে গিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক। সৃষ্টিশীল জ্ঞানচর্চা এবং শিল্পচর্চার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে নানাভাবে। এ বিষয়গুলিকে একজন কবি হিসেবে আপনি কিভাবে দেখেন? 

কোভিডের সময়ে অস্তিত্ব-সঙ্কটের যে দিকগুলো এসেছিল তা ধীরে ধীরে মানুষ ভুলে গেছে। বড় বড় দুর্যোগও আমাদের ততটা প্রভাবিত করে না বোধহয়, যতটা নিজেদের সামনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমরা বদ্ধপরিকর। সেটা এই মাধ্যমগুলো করতে পারে সহজেই। এই যে ধরেন ফেসবুক কী সাপ্লাই দিচ্ছে কবিতার ক্ষেত্রে। কবিতা থেকে ছোট ছোট চুম্বক অংশ তুলে তা জনপ্রিয় করার চেষ্টা। আগে গুডরিডস থেকে অনেককিছু পড়তাম এখন এসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগে। এরমধ্যে এন্তোনিও পোর্কিয়া, মার্ক স্ট্রেনড আর চার্লস বুকস্কির জগতেরই ছোট অংশ ঘুরেফিরে আসে। সেটাও পজেটিভ ছোট লাইনের মাধ্যমে পাঠক আর কবি এক জায়গায় নিজেদের জানাতে পারছেন। নতুন পাঠকের দোষ কী?

প্রচলিত ধারার বাইরে আপনি সাম্প্রতিক সময়ে কবিতায় নতুন কোনো কাজ দেখেছেন, যা আপনাকে ভাবিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে কিংবা নতুন সম্ভাবনা দেখছেন কী রকম, বাংলা কবিতায়?

কবিতায় নতুন কিছু হয়েছে কি-না তার আগে প্রচলিত ধারাটা সামগ্রিক কি-না তা জানা দরকার। কবিতা লেখার চেয়ে কবিবন্ধুর মুখ রক্ষা করা সাহিত্য হলে, হ্যাঁ-এগিয়েছে গোত্রভিত্তিক পাঠক বেড়েছে। আরো সহজ করে বলতে চাই না আমি। সমসাময়িক বলে এ প্রশ্নটা এড়াতেও চাই। অনেক অনেক ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে বলব না আমি, আমি বলব অনেক কবি নিজের কবিতার দিকে নজর দিচ্ছেন আর আমাদের কবিতাকে সমৃদ্ধ করছেন। তারা জানেন কী করছেন, বাকিটা সময় বলে দিবে। একই সাথে এও বলব, ভালো কবিতা চেনার মতো সৎ ও যোগ্য সমালোচকেরও অভাব আছে আমাদের। আপনি ভাবুন, একজন বুদ্ধদেব বসু না থাকলে ভেসে যেতে পারত জীবনানন্দ দাশও। আমাদের মধ্যে তেমন কেউ না থাকার দরুন, যোগ্য হয়েও কেউ কেউ যে ভেসে যাচ্ছেন না- তা বলা যায় না।

সমকালীন আমেরিকান কবিতার সঙ্গে সমকালীন বাংলা কবিতার সাজুয্য দেখেন কি?

আমেরিকান কবিদের আপনি অনুবাদ করছেন, তাদের কবিতার চুম্বক অংশের মতো কবিতা লিখে অনেক কবিই জনপ্রিয় এখন বাংলাদেশে। কবিতায় যাপন করা সহজ কথা নয়, বাংলাদেশের কবিরা কবিতার চেয়ে কবির জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে বেশি। একজন ভালো লেখককে আর্থ-সামাজিকভাবে সাহায্য করতে হয় যেন কবি তার কাজটা করতে পারেন। আমাকে বলেন আমাদের পূর্ববর্তী কবিরা যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আছেন তারা কতটা সাহায্য করার মনোভাব প্রকাশ করেন? যেসব কবিরা বিদেশ থাকেন, তারাও দেশে কবিদের সঙ্গে কথা বলে স্রেফ পরম্পরা রক্ষা করেন। এর চেয়ে বেশিও না কমও না। বাংলাদেশে যে-ই লিখছেন তারা দৈনন্দিন অমানুষিক জার্নি শেষ করে কবিতা লিখছেন। তাদের এ কাজকে আমেরিকান কবিদের কাজের চেয়ে অনেক বড় কাজ মনে হয় আমার কাছে।

জন অ্যাশবেরি আমার প্রিয় একজন কবি। ভদ্রলোক পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। যতটা জানি আপনিও এ কবির একজন অনুরাগী...

হ্যাঁ, উনি আমার প্রিয় কবিদের একজন। তার জগত অ্যাবস্ট্রাক্ট বলে আমার আরো ভালো লাগে হয়তো। একজন কবি তার চারপাশ, সময় নিয়ে যখন সচেতন থাকেন তিনি তার কাজটা করে যেতে পারেন। অ্যাশবেরিও সচল এক শহরে থেকে তার বলাটা অদৃশ্য করতে পেরেছিলেন বলে আমার মনে হয়।

একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গাটি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

কবিদের সমাজের প্রতি দায়বব্ধতা নেই একঅর্থে। কারণ কবি সমাজের সমস্যাগুলো আগে দেখেন, তাই কবি আর সমাজের বিরুদ্ধমত সবসময় একতালে চলতে থাকে। যেখানে রাষ্ট্র কবিদের সব বলতে দেয় না, লিখতে দেয় না, সেখানে তার দায়বদ্ধতা আসে কি? কবি নিজের ইচ্ছায়ই একটা সাম্যের পৃথিবী গড়তে চান। কবিতার জার্নিটা কোনো না কোনোভাবে সেই দায়বদ্ধতাই পূরণ করে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh