লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের মধ্যে অন্যতম। সামরিক জীবনে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, সেনা সদর দপ্তরে কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল, মাস্টার জেনারেল অব অর্ডিন্যান্স এবং সামরিক সচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ রাইফেলসের (বর্তমান বিজিবি) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে পরিচালিত সীমান্ত সুরক্ষা মিশনগুলো সফলভাবে সম্পন্ন হয়, যা বিডিআরের সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল। সাম্প্রতিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম ডি হোসাইন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি, তা উন্নতির জন্য আপনি কী করছেন?
৫ আগস্টের পর যে পরিস্থিতিতে পুলিশ দায়িত্ব নিয়েছে তার থেকে বর্তমানে অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। তবে জনগণ বা আমরা এখনও সন্তোষজনক পর্যায়ে উপনীত হতে পারিনি। জনবান্ধব পুলিশ, আমরা কিন্তু এটা করতে পারিনি। এটাকে কীভাবে ভালো করা যায়, তা নিয়ে কাজ চলছে। জাতীয় স্বার্থের বাইরে কোনো ধরনের অবৈধ আদেশ যেন পুলিশ সদস্যদেরকে দেওয়া না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের পুলিশের অধিকাংশ সদস্যই ভালো। কিন্তু গুটি কয়েকজনের অতিউৎসাহমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য এতদিন পুলিশ জনবান্ধব হতে পারেনি। আশা করি দ্রুত পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে। অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ সদস্যরা তাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
পুলিশ সদস্যদের এখন কি সমস্যা রয়েছে?
বাংলাদেশ পুলিশে এখনও বেশকিছু সমস্যা রয়ে গেছে। তাদের থাকার জায়গা ও খাবারের মান সন্তোষজনক নয়। নিম্নপদস্থ পুলিশ সদস্যদের টিএডিএ বিল অনেক বকেয়া পড়ে গেছে। অতিসত্বর এসব পরিশোধ করা হবে। কর্তব্য পালনের সুবিধার জন্য তাদের একই রেঞ্জের মধ্যে বদলি ও পদায়ন করা যায় কিনা তা বিবেচনা করতে বলেছি। এ ছাড়া আন্দোলনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলো মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে চাহিদাপত্র আহ্বান করে অতিদ্রুত মেরামত কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। ভাড়া বাসার পরিবর্তে জমি অধিগ্রহণ করে নিজস্ব জায়গায় থানা ভবন নির্মাণ করা যায় কিনা তা যাচাই করা হবে।
কীভাবে পুলিশের সংস্কার করা হবে?
সংস্কারের কাজটা আমি করছি না। এ জন্য আলাদা কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটি কাজটি করবে। তারা প্রতিবেদন দেবে, সেই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সংস্কার হবে। যেসব পুলিশ সদস্য এখনও কাজে যোগ দেননি, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তারা আর পুলিশ সদস্য নয়, তাদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?
আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো আইন-শৃঙ্খলা। বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব সন্তোষজনক না হলেও উন্নতির দিকে রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি উন্নতি করার চেষ্টা করছি। বাজারে যাতে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি না থাকে, সে ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের সতর্ক থাকতে হবে। কেউ চাঁদাবাজি করলে দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করতে হবে। গত ৫ আগস্টের পর পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছিল। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে অনেকটাই ফিরে এসেছি। পর্যায়ক্রমে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে কি দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে?
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালীতে সংঘটিত বন্যা এবং পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ ও শেরপুরের বন্যা পরিস্থিতির কারণেই মূলত দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়েনি। কারণ কুমিল্লা দেশের অন্যতম বৃহৎ সবজি উৎপাদনকারী জেলা। বন্যার কারণে এ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সবজির দাম বেড়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির জন্য আনসার সদস্যরা কি কাজ করছে?
আনসারদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। ব্যাটালিয়ন ও অঙ্গীভূত আনসার উভয়েই তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে। আনসারদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ভবিষ্যতে আরও ভালোভাবে পালন করতে হবে। গত ৫ আগস্টের পর পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছিল, এর মধ্যে কিছু আনসার সদস্যের উসকানিতে তারা সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে ৫ আগস্টের পর আনসার সদস্যরা দূতাবাস, বিমানবন্দর ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেজন্য নিঃসন্দেহে তারা সাধুবাদ ও প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতির অবকাশ রয়েছে। সেখানে আনসার বাহিনীরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে।
পাহাড়ে নিরাপত্তা নিয়ে কি কোনো শঙ্কা আছে?
যারা পাহাড়ে শান্তি ও নিরাপত্তা ভঙ্গের চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের যে ধরনের সহযোগিতা লাগবে, আমাদের পক্ষ থেকে তা দেওয়া হবে। পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তার কোনো শঙ্কা নেই। আপনারা দেখেছেন কারা সেখানে নিরাপত্তা ভঙ্গ করার চেষ্টা করে। আপনাদের মিডিয়ায় ভালোভাবে প্রচারিত হয়েছে, কীভাবে এই শঙ্কাগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে এবং কীভাবে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের লোকজন সেগুলো মোকাবিলা করেছে। কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতকারীর সব সময় চেষ্টা থাকে যাতে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার সেটি হতে দেবে না। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ট্রাফিক ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের কেন যুক্ত করা হচ্ছে?
শিক্ষার্থীরা ৫ আগস্টের পর রাস্তায় ভালো কাজ করেছেন। দেশের আপামর জনসাধারণের কথা বিবেচনা করে ছাত্ররা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সড়কে ট্রাফিক দায়িত্ব পালন করে শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। এখন আমাদের সঙ্গে যদি তারা কাজ করেন, তাহলে হয়তো রাস্তার পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হবে। শুধু সরকার কিংবা পুলিশের মাধ্যমে কাজ করে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার আশানুরূপ উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন নগরে বসবাসকারী জনগণকে সম্পৃক্ত করা। ২১ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ডিএমপির ‘ট্রাফিক পক্ষ’-এর কার্যক্রমে প্রাথমিকভাবে ৩০০ শিক্ষার্থীকে সম্মানীসহ যুক্ত করা হয়েছে। পরে এ সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের কাজ যেমন গতিশীল হবে, তেমনি জনভোগান্তি অনেক কমে আসবে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh