সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ২০২৪ সালের ১ জুলাই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ শুরু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে তা সরকার পতনের এক দফায় রুপ নেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ছিলেন হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির আহবায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ত হওয়া, কোটা আন্দোলন থেকে সরকারের পতন, বর্তমান চ্যালেঞ্জ, করণীয়সহ নানা বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে কথা বলেছেন হাসনাত আবদুল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম ডি হোসাইন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিভাবে পুরো জাতিকে এক করল?
সংকট ও বৈষম্য পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎসহ প্রতিটি খাতে আওয়ামী লীগ সরকার বৈষম্য তৈরি করে রেখেছিল। অথচ দেখানো হতো এই রাষ্ট্রে কোনো সমস্যাই নেই, সবকিছু উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। এই সমস্যা ও সংকট থেকে পুরো জাতি এক হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। অনেক মানুষ তার ছোট সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। আবার অনেক শিক্ষার্থী মা-বাবাকে না জানিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। রাষ্ট্রের সার্বিক অবস্থা আমাদের যেমন দেখানো হয়েছে আর বর্তমানে আমরা যেমন দেখছি- এ দুটির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। রাষ্ট্রের সমস্যাগুলো আমাদের সামনে খোলাসা হয়েছে।
এই ঐক্য নষ্টের কি কোনো চক্রান্ত চলছে?
দেখুন, এই ঐক্য, সরকার ও আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে হামলা, গুজবসহ নানাভাবে আন্দোলন করার চেষ্টা চলছে। তবে সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো যখন হয়, তখন মন্দিরের বাইরে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাসহ সবাই পাহারা দিয়েছে। যখনই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে, তখনই আমরা আবার একসঙ্গে দাঁড়িয়েছি, মন্দির পাহারা দিয়েছি, মসজিদ পাহারা দিয়েছি, যারা সংখ্যালঘু রয়েছে তাদের বাড়ি পাহারা দিয়েছি। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে আমরা সবাই একসঙ্গে হয়েছি। যখন বন্যা হলো তখন দেখলাম যে, এই বন্যাটি আমাদের সম্প্রীতি, জাতীয় ঐক্যের আরো একটি অনন্য উদাহরণ তৈরি করল। এমন বন্যা আগে হলে কী হতো, মানুষ সরকারের প্রতি আস্থা রাখত না, কিন্তু আমরা এবার দেখেছি মানুষ এই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা রেখে, ছাত্র-নাগরিক নিজ উদ্যোগে কীভাবে বিভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে রাস্তায় নেমেছে। বিশেষ করে, টিএসসিতে দেখেছি, সবাই এগিয়ে এসেছে, যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করেছে। ত্রাণ সংগ্রহের যে একটি দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটি জাতীয় ঐক্যের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। সেখানে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মতভেদ, সামাজিক মর্যাদা, রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রাধান্য পায়নি। বরং সবাই একটা পরিচয়ে এই জাতীয় সংকটকে মেনে নিয়ে সেটাকে প্রতিরোধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এই ফ্যাসিস্ট সরকার ‘আফসোস লীগ’ হয়ে আবার ফিরে আসতে চাচ্ছে। যতভাবেই ফ্যাসিস্ট সরকার ফিরে আসতে চেয়েছে, ততভাবেই ছাত্র নাগরিক ঐক্যের মধ্য দিয়ে ওই ফ্যাসিস্ট সরকারের যত ধরনের লিগ্যাসি রয়েছে, সেটিকে প্রতিরোধ করতে পেরেছি। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে ছাত্র নাগরিকের ঐক্যটি আমরা স্পষ্ট করতে পেরেছি, এটি হচ্ছে আমাদের জাতীয় অর্জন।
নতুন সরকার গঠনের পর মানুষ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছে কেন?
গত ৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত অনেক আন্দোলন হয়েছে বিভিন্ন দাবি নিয়ে। গত প্রায় ছয় মাসের প্রতি দিনই মানুষ দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলছেন। রাষ্ট্র যে সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে, রাষ্ট্রকে যেমন দেখতাম আসলে তেমনটি ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। এই যে মানুষ রাস্তায় নেমে আসছে, সমস্যা নিয়ে কথা বলছে, যেটা গত ১৬ বছর পারত না।
বর্তমানে রাষ্ট্রের প্রধান চ্যালেঞ্জ কী বলে মনে করছেন?
রাষ্ট্রের প্রধান এবং প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রতিটি জায়গায় সমস্যাগুলোকে স্তর বিন্যাস করা, মানুষ যে অবিলম্বে সমাধান চাইছে, তা না করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী সমাধান করাই হচ্ছে প্রধান চ্যালেঞ্জ।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকে কীভাবে দেখতে চান?
ক্যাম্পাস হবে গবেষণার উর্বর ভূমি। ছাত্র ও শিক্ষকদের সম্পর্ক হবে জুনিয়র ও সিনিয়র স্কলারের। আমরা সেখানে দেখতে চাই, ভয়ের কোনো পরিবেশ থাকবে না। হল দখল, সিট দখল, ক্যান্টিনে ফাও খাওয়ার মতো কোনো সংস্কৃতি থাকবে না। স্বাধীনভাবে যে যার মত প্রকাশ করতে পারবে এবং বিশ্বমানের যে শিক্ষাব্যবস্থা, তা নিশ্চিত হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভারত বাংলাদেশকে কীভাবে দেখছে?
অনেক ক্ষেত্রে ভারত আওয়ামী লীগের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখছে। ভারতের মিডিয়ায় দেখানো হচ্ছে যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা অনিরাপদে রয়েছে। এটা সঠিক নয়। মাঠের অবস্থা ভারতকে জানানো উচিত। এসব বিষয় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেছি। ভারত সরকারের সঙ্গে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের যে সম্পর্ক ছিল, যে চুক্তিগুলো হয়েছে, সেগুলো যেন প্রকাশ করা হয়। ফেলানি হত্যাসহ সীমান্তের সব হত্যার বিচার নিশ্চিত করা, পানির ন্যায্য হিস্যা বাস্তবায়ন, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক যেন ন্যায্যতার সঙ্গে হয়- এসব বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে মূল চাওয়া কী?
জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বাহাত্তরের মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে। সেই সঙ্গে এই ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করতে হবে। তবে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সর্বদলীয় সংলাপের পরবর্তী কর্মপন্থা হিসেবে গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজন থেকে অভিমত নিচ্ছে সরকার। অভিমতগুলো পর্যালোচনা করে একটি সংশোধিত ও সর্বজনগ্রাহ্য ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জনগণের উপস্থিতিতে তা অনতিবিলম্বে ঘোষিত হবে আশা করছি।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh