চাকরির বাজার খুলবে কবে

স্বাভাবিক সময়েই বেকারত্বের অভিশাপে দুর্বিষহ শিক্ষিত তরুণদের জীবন। তবে সবার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হলেও প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ চাকরি পেয়েছেন; কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাস সেটিও বন্ধ করে দিয়েছে। 

একদিকে নতুনরা চাকরি পাচ্ছেন না, অন্যদিকে অনেকেই চাকরি হারিয়ে আবার বেকারত্বের অন্ধকার জীবনে প্রবেশ করেছেন। সম্প্রতি দু-একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তবে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক কম। 

আবার করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় আঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে অনতিদূরে শীতকালেই। তাই চাকরির বাজারে সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা করছেন হতাশ তরুণরা। 

মহামারি প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। দীর্ঘদিন অচলাবস্থার পর কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে বিশ্ব। অনেক দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কমতে শুরু করেছে; কিন্তু এরই মধ্যে বিশ্বে ফের আসছে করোনাভাইরাসের আরো এক প্রবাহ। এতে আবারো ব্যাহত হবে উৎপাদন, আমদানি ও রফতানি। তলানিতে ঠেকবে চাহিদাও। কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরতে হবে লাখ-লাখ শ্রমিককে, যা বিশ্বের অর্থনীতির ওপর তীব্র প্রভাব ফেলতে পারে। 

  • হতাশ তরুণরা
  • শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যাহত
  • আন্তর্জাতিক বাজার বন্ধ
  • আশা দেখাচ্ছে সরকারি নিয়োগ

এদিকে মহামারির কারণে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও আক্রান্ত। কোনো সার্কুলার নেই, কোনো চাকরির পরীক্ষা নেই। এই মহামারি কবে শেষ হবে, কবে আবার চাকরির প্রক্রিয়া শুরু হবে, তা কেউ জানে না। যারা বেকার, চাকরির খুব প্রয়োজন, তাদের জীবনটা এই মহামারির কারণে অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কোনো কাজ নেই, যতদিন যাচ্ছে পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছেন তারা। পরিবারের সদস্যদের মলিন চেহারা সেই হতাশা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

দেশে প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষ নতুন করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। শেষ পর্যন্ত এই শ্রমশক্তির কত অংশের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, তার কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে এর বড় অংশই চাকরির বাজারে প্রবেশের সুযোগ পায় না। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যায়। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশই বেকার। করোনাভাইরাসের কারণে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে।

আইএলও বলছে, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় প্রবাহের জেরে বিশ্বজুড়ে ৩৪ কোটি মানুষ কাজ হারাতে পারেন। আর দরিদ্রসীমার নিচে চলে যেতে পারেন শুধু ভারতেরই চার কোটি মানুষ। তাদের আশঙ্কা, ২০০৮-২০০৯ সালের আর্থিক সংকটের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে। গত বছর ডিসেম্বরে আড়াই কোটি মানুষের নতুন করে বেকার হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল আইএলও। করোনাকালে সেই সংখ্যা আরো বাড়বে বলে জানায় সংস্থাটি। 

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘নতুন চাকরি তো নেই, যারা ছিল, তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। তার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে তরুণদের ওপর। যতদিন পর্যন্ত অর্থনীতি ঠিক না হবে, ততদিন তাদের সবার শ্রমবাজারে প্রবেশ করাটা কঠিন হবে। এমনকি করোনাভাইরাস-পরবর্তী সময়েও যেসব কাজের সৃষ্টি হবে, সেগুলোর ধরন কিন্তু অন্যরকম হবে। এখন বেশিরভাগ কাজকর্ম ঘরে বসে হচ্ছে। ফলে ডিজিটাল বা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কাজ বেশি হবে। ফলে আগের গতানুগতিক শিক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়া যাবে না। বাজার উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ, সেই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার দরকার হবে। যুবকদের এই সমস্যা ও সংকটের ব্যাপারে এখনই গুরুত্ব দেয়া উচিত।

শিক্ষিত, অশিক্ষিত তরুণদের চাকরির বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্য ও উন্নত কয়েকটি দেশ। ওইসব দেশেও করোনাভাইরাস ভয়াবহ আঘাত এনেছে। এমনকি দ্বিতীয় ধাপে আঘাত আসছে অনেক দেশে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভের ঝুঁকি প্রবল। ১৫টি দেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঝুঁকি প্রবল। এই সর্বোচ্চ ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে ভারতও। দেশটির সাথে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত আয়ের জনসংখ্যার দেশগুলোর মধ্যে এই জোনে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, চিলি, পাকিস্তানের মতো দেশগুলো। এই গোষ্ঠীতে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সুইডেন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা ও কানাডা। জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো দেশগুলো ঝুঁকিপ্রবণ গোষ্ঠীতে রয়েছে। 

যেসব দেশের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি নিয়ে বাংলাদেশের শিল্প সচল থাকে সেসব দেশও ব্যাপক ঝুঁকিপ্রবণ। অনেকেই ছুটিতে বাড়ি এসে কাজে যোগ দিতে পারেননি। এতে বিদেশের বাজারে যেমন চাকরি অনিশ্চয়তা, তেমনি দেশের বাজারে চাকরি হারানোর শঙ্কা তীব্র হচ্ছে।

সরকারি হিসাবে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। যদিও বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ছয় কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ছয় কোটি আট লাখ নারী-পুরুষ আর ২৭ লাখ বেকার। সম্ভাবনাময় কিন্তু সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের সুযোগ পান না এরকম ব্যক্তি (লেবার আন্ডার ইউটিলাইজেশন), যাদের ছদ্মবেকার হিসেবে বর্ণনা করা হয়, এ রকম মানুষ রয়েছেন প্রায় ৬৬ লাখ। তারা চাহিদা মাফিক কাজ না পেয়ে টিউশনি, রাইড শেয়ারিং, বিক্রয় কর্মী ইত্যাদি খণ্ডকালীন কাজ করেন। দেশে বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশ হলেও যুব বেকারত্বের হার ১১.৬ শতাংশ। করোনাভাইরাসের কারণে তা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। 

আইএলও বলছে, মহামারিতে শিক্ষার্থীরা তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে বেকারত্ব, সেইসাথে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণও ব্যাহত হচ্ছে। এতে তাদের চাকরিতে প্রবেশ ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। 

বিভিন্ন ব্যাংক ও বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান নতুন লোক নিয়োগের পরিবর্তে আগের কর্মী ছাঁটাই করছে। দেশের অন্তত ছয়টি ব্যাংক বিপুলসংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছেন। ব্যাংকগুলো বলছে, আগে থেকেই খেলাপি ঋণের চাপ, তারল্য সংকট, তার ওপর ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতির কারণে করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবে তাদের ব্যবসা খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যয় কমানো ছাড়া সামনে কোনো বিকল্প নেই। বেতন না কমালে ছাঁটাই করতে হবে। 

এদিকে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো বেতন কমিয়ে লোক ছাঁটাই কম করছে; কিন্তু ছোট বা মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক কর্মী ছাঁটাই করছে। এখন ডেভেলপমেন্ট সেক্টর, এনজিও বা ই-কমার্স কোম্পানি ছাড়া আর কেউ কর্মী নিয়োগ করছে না।

তবে সম্প্রতি চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য কিছু সুখবরও এসেছে। করোনাভাইরাসের কারণে স্থগিত হওয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির জট খুলতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের বয়সে ছাড় দিয়েছে সরকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত ২৫ মার্চ যাদের বয়স ৩০ (সাধারণ প্রার্থীর সর্বোচ্চ বয়সসীমা) হয়েছে, তারাও আটকে থাকা নিয়োগের জন্য আবেদন করতে পারবেন। সরকারি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা শুরু হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আরিফ হোসেন খান জানান, কিছু নিয়োগ পরীক্ষা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুরু হয়েছে। এছাড়া সরকারি ৫ ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) ১ হাজার ৫১১টি শূন্য পদে এমসিকিউ এবং লিখিত পরীক্ষা শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে। এর বাইরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ, ইউজিসিতে নিয়োগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নার্স নিয়োগ, প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিয়োগ, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর, নির্বাচন কমিশন, নৌবাহিনীসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো করোনাভাইরাসের সময় নতুন নিয়োগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন তা দিন দিন বাড়ছে বলে জানালেন বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর। 

তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সময়ে স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ৮০ শতাংশ চাকরির বিজ্ঞপ্তি কম এসেছে। তবে এটি এখন দিন দিন বাড়ছে। গত জুলাইয়ে তিন হাজার চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। আগস্টে এক হাজার বেড়েছে। আর ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার নতুন চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে বিডিজবসে।’

তবে সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলেও বড় ধরনের নিয়োগ এখনো আটকে আছে। করোনাভাইরাসের কারণে বেশ কিছু পরীক্ষা স্থগিত করেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। যেমন- ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি পরীক্ষা এ বছরের এপ্রিলে হওয়ার কথা ছিল। এ ছাড়া ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল আটকে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে বেশ কিছু নিয়োগ পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়নি। খাদ্য অধিদফতরের এক হাজার ১০০ পদের আবেদনকারী ছিলেন ১৫ লাখ। এ পরীক্ষাও নেয়া যায়নি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //