খাদ্য রপ্তানিতে ঝুঁকছে ভেনেজুয়েলা

তেল সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে। অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার সাধারণ মানুষ। দেশটিতে এই সংকট চলছে কয়েক বছর ধরে। পণ্যদ্রব্যের দাম নাগালের বাইরে, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও খাদ্য সংকটে সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে ওঠেছে দুর্বিষহ। প্রতিদিনই ক্ষুধার্থ মানুষের তালিকা লম্বা হচ্ছে, অপুষ্টি জেঁকে বসছে দেশটিতে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ভেনেজুয়েলার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মারাকিয়াবো ক্ষীণ আশার আলো ছড়াচ্ছে। সেখানে এবার ব্যাপকহারে চিংড়ি চাষ হয়েছে। উৎপাদিত চিংড়ির সিংহভাগই রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ এবং এশিয়ায়। এ দুই মহাদেশে ৯০ শতাংশ চিংড়ি রপ্তানি করছে ভেনেজুয়েলা। শুধু চিংড়ি নয়, ভেনেজুয়েলা থেকে এমন অনেক পণ্য এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

ভেনেজুয়েলার এই রপ্তানিমুখিতার পেছনে রয়েছে দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বাণিজ্য কৌশল। প্রেসিডেন্ট চাইছেন, নগদ অর্থের মাধ্যমে ঝিমিয়েপড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে। এ অবস্থায় নগদ মুদ্রা উপার্জনের নানা উপায় খুঁজছেন তিনি। খাদ্য রপ্তানিকে এমনই এক উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। খাদ্য রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে স্থানীয় টেলিভিশনেও ভাষণ দিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে ভেনেজুয়েলার দশটি স্থানীয় খাদ্য উদ্যোক্তা ও নির্বাহী কর্মকর্তারা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, আরো বেশি পণ্য রপ্তানি করতে বর্তমান প্রশাসন বিধিনিষেধও শিথিল করেছে।

শুধু সামুদ্রিক খাবার নয় পনির, অ্যাভোকাডো, সিরিয়াল, এমনকি ক্যান্ডি বিক্রির জন্যও আন্তর্জাতিক ক্রেতা খুঁজছে ভেনেজুয়েলা। অবশ্য এ ধরনের পণ্য বিক্রির পরিমাণ তুলনামূলক অনেক কম। এখনো পর্যন্ত ভেনেজুয়েলা সার্বিকভাবে একটি তেল রপ্তানি নির্ভরশীল দেশ। গত বছর দেশটি ২৯ বিলিয়ন ডলারের তেল রপ্তানি করেছে। অবশ্য অল্পস্বল্প হলেও ভেনেজুয়েলা তেলবহির্ভূত পণ্য রপ্তানি শুরু হয়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরে পুষে রাখা সরকারের মনোভাব পরিবর্তনের আভাস হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভেনেজুয়েলা সরকার বহুদিন ধরেই মৌলিক পণ্য ঘাটতির পেছনে বেসরকারি খাতকেই দোষারোপ করে আসছিল। পণ্য মজুদ করার অভিযোগও রয়েছে কোম্পানিগুলোর ওপর। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, দোকানগুলো পণ্যশূন্য থাকার কারণ মূল্য ও মুদ্রায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা ধরে রাখতে বাধ্য হয়ে বিদেশে পণ্য রপ্তানি করার কথা জানিয়েছে বিভিন্ন কোম্পানি।

অ্যারিজোনাভিত্তিক উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ইমপোর্ট জিনিয়াসের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৪০টি কোম্পানি প্রথমবারের মতো পণ্য রপ্তানি শুরু করেছে। এসব কোম্পানির অর্ধেকই খাদ্যপণ্য বিক্রি করে। ভেনেজুয়েলার মুদ্রার পতনের কারণে অনেক পুরনো রপ্তানিকারক যে কোনো সময়ের তুলনায় বিদেশে পণ্য বিক্রির ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ভেনেজুয়েলার চিংড়ি শিল্প সংগঠনের প্রধান ফার্নান্দো ভিলামাইজার বলেন, ‘স্থানীয়দের ক্রয় সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে আমরা বাধ্য হয়ে বিদেশমুখী হচ্ছি। টিকে থাকতে হলে আমাদের বিদেশে পণ্য বিক্রি করতে হবেই।’

গত বছর ভেনেজুয়েলার কোম্পানিগুলো ৮১ মিলিয়ন ডলারের চিংড়ি রপ্তানি করেছে, যা ২০১৬ সালে ছিল ৫৪ মিলিয়ন ডলার। ভেনেজুয়েলান অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্টাসের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ভেনেজুয়েলায় তেল-বহির্ভূত পণ্য রপ্তানির মধ্যে বর্তমানে চিংড়ির অবস্থান চতুর্থ।

পনিরও পাড়ি জমাচ্ছে সীমান্তের ওপারে
ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থেকে। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ভেনেজুয়েলার জ্বালানি শিল্প মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নগদ মুদ্রা উপার্জনে সরকার মরিয়া হয়ে তেল রপ্তানির বিকল্প খুঁজতে শুরু করে। গত জুলাইয়ে মাদুরো সরকার রাজধানী কারাকাসের বাইরে একটি কারখানা স্থাপন করে, যা জাপানে চকোলেট রপ্তানি করবে। প্রেসিডেন্ট মাদুরো এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই পণ্যসহ অন্যান্য রপ্তানির পেছনে আমাদের লক্ষ্য ইউরো, রুবল, ইউয়ান এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি সংগ্রহ করা।’ তবে ভুট্টার ময়দা ও চালের মতো খাদ্যশস্য এখনো রপ্তানি নিষিদ্ধ।

অন্যদিকে, শুধু আয়ের উদ্দেশ্যেই খাদ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো রপ্তানি বাড়াচ্ছে, তা কিন্ত নয়। বিভিন্ন ধরনের সরকারি অনুমোদনপত্র জোগার করাও তাদের লক্ষ্য। খাদ্য শিল্প সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও নির্বাহী কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট উগো চাভেজের আমলে এ ধরনের অনুমোদনপত্র প্রায় সময়ই প্রত্যাখ্যান করা হতো অথবা বিলম্ব করা হতো। তবে মাদুরো সরকার এখন আরো বেশি অনুমোদনপত্র দিচ্ছে। 

চলতি বছর পণ্যদ্রব্যের দামে নিয়ন্ত্রণও অনেকটা শিথিল করেছে সরকার। তবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের বিষয় হলো- স্থানীয়দের চাহিদা মেটাতে ভেনেজুয়েলার দোকানগুলোতেও পণ্য উঠাতে হবে। কিন্তু পণ্য সহজলভ্য হলেও অতিমূল্যস্ফীতির কারণে খুব কম মানুষেরই তা কেনার সাধ্য রয়েছে। পুষ্টি নিয়ে কাজ করা কারাকাসভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সিটিজিনারি ইন অ্যাকশনের দেওয়া তথ্যমতে, পাঁচ বছর আগের তুলনায় ভেনেজুয়েলায় নাগরিক প্রতি দৈনিক ক্যালরিগ্রহণ ৫৬ শতাংশ কমে এক হাজার ৬০০ ক্যালরিতে পৌঁছেছে। ক্যালরি গ্রহণের এই হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার ক্যালরির তুলনায় অনেক কম। ভেনেজুয়েলার লাখো নাগরিক সরকারি খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি এবং ভর্তুকিপ্রাপ্ত খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল।

পণ্যদ্রব্যের মাত্রাতিরিক্ত দামের কারণে ভেনেজুয়েলাবাসীর ক্রয়সক্ষমতা কমে গিয়েছে। অন্যদিকে, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাহিদা না থাকার কারণে ভেনেজুয়েলার দুটি বড় খাদ্য কোম্পানি এম্প্রেসাস পোলার এবং জেনারেল দে অ্যালিমেন্তুস (জেনিকা) সেসব পণ্য রপ্তানি শুরু করেছে, যেগুলো এতদিন শুধু ভেনেজুয়েলাতেই বিক্রি করতো তারা। এ দুটি কোম্পানি মিলে গত বছর সমন্বিতভাবে ৫৯ হাজার ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে। এসব পণ্যের বেশিরভাগই আর্জেন্টিনা ও চিলিতে বিক্রি করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নেসলের ভেনেজুয়েলা শাখা জুন পর্যন্ত ১৮ হাজার ৬০০ ডলার মূল্যমানের ১৮ টন ইনসট্যান্ট সিরিয়াল যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের রেকর্ডে এ তথ্য পাওয়া গিয়েছে। স্থানীয় বাজারে এ ধরনের পণ্যের চড়ামূল্যের কারণে সাধারণ মানুষ তা কেনা বাদ দিচ্ছেন। এমনই একজন ডোরিস মলিনা। হিসাবরক্ষণের কাজ করা ২৮ বছর বয়সী মলিনা বলেন, ‘প্রচুর দামের কারণে আমি আমার ছেলেকে আর সিরিয়াল দেই না।’ গত বছরের পর থেকে এ পর্যন্ত নেসলের ইনসট্যান্ট সিরিয়ালের দাম বেড়েছে প্রায় তিন হাজার ৪০০ শতাংশ।

এক বিবৃতিতে নেসলে জানিয়েছে, কাঁচামাল কেনার জন্য তাদের বিদেশি মুদ্রা প্রয়োজন। আর বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহের লক্ষ্যেই পণ্য রপ্তানি করছে তারা। আর ভেনেজুয়েলার আইন পুরোপুরি মেনেই অন্য দেশে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। আর এ ধরনের বিক্রি কার্যক্রমে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও লঙ্ঘন করা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় ভেনেজুয়েলা সরকার অথবা অয়েল জায়ান্ট পেট্রোলিওয়স দে ভেনেজুয়েলার মতো রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসায় নিষেধ রয়েছে। আর ভেনেজুয়েলার বেসরকারি কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাছে দেদারসে পণ্য বিক্রি করতে পারবে। আর এই সুযোগটি লুফে নিতে নিত্য-নতুন অনেক কোম্পানি গজিয়ে উঠছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ভেনেজুয়েলায় বেসরকারি কোম্পানিগুলোর রপ্তানি ২৬ শতাংশ বেড়েছে।

কর ও ফি
জনসম্মুখে প্রেসিডেন্ট মাদুরো রপ্তানিকারকদের প্রশংসা এবং রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিলের ঘোষণা দিলেও সরকার রপ্তানিকারকদের ওপর কর বৃদ্ধি করেছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত বন্দরগুলোয় বেড়েছে নানা রকম ফি। ফল প্রক্রিয়াজাতকরন কোম্পানি ভেনেজোলানা দে ফ্রুটাস দেশে চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে তিন বছর আগে নেদারল্যান্ডসে কমলা বিক্রি শুরু করে। কোম্পানিটির ম্যানেজার কারোলিস লাগোনা জানিয়েছেন, নেদারল্যান্ডস কোম্পানির রাজস্ব সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ উৎসে পরিণত হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে ভেনেজুয়েলা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট বন্ধ থাকায় চলতি বছর মালামাল পরিবহন ব্যয় ৬০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। এ প্রসঙ্গে দুগ্ধপণ্য ব্যবসায়ী আলবার্তো দোহাও বলেন, ‘এটি একটি ধৈর্য্যরে প্রতিযোগিতা। যেখানে তোমার দম ধরে রাখার জন্য অক্সিজেনের একটি বড় ট্যাংক থাকতে হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //