স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৪০ এএম
জো বাইডেন
১ নভেম্বর মার্কিন সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় লিখেন, ‘বাইডেন একজন পরীক্ষিত ক্যাস্ট্রোর পুতুল! ট্রাম্পকে ভোট দিন।’
ওই টুইটে তিনি কোন ক্যাস্ট্রোর কথা বলেছেন, তা নিশ্চিত করেননি। তবে ধারণা করা যায়, ট্রাম্প মার্কিন আগ্রাসন ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করা কিউবান কিংবদন্তি ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কথাই বলেছেন।
ট্রাম্পের এই উদ্ভট দাবির বিপরীত মেরুতেই রয়েছেন জো বাইডেন। তিনিও অন্য মার্কিন নেতাদের মতোই বৃহৎ করপোরেট কোম্পানির স্বার্থেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা প্রণয়ন করে এসেছেন। জানুয়ারিতে ক্ষমতা নিতে যাওয়া বাইডেন প্রশাসনের মধ্য ও লাতিন আমেরিকায় নীতিগত কোনো পরিবর্তন হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
২০০৯ সালে বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পর থেকে টানা আট বছর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন জো বাইডেন। ওই বছরই হন্ডুরাসে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল জেলায়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির সেনাবাহিনী। এ ডানপন্থী ক্যুদেত্যার মূলে ছিল ওবামা-বাইডেন প্রশাসন, যা তাদের প্রথম বড় সফলতা। এর মধ্য দিয়ে হন্ডুরাস পরিণত হয় এক নয়া-উদারনৈতিক নরকে- হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ বেড়েছে ভয়াবহ আকারে; সেইসাথে নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, গুম, নির্যাতনে রয়েছে নিরঙ্কুশ দায়মুক্তি। এসবই হয়েছে ও হচ্ছে মার্কিন সামরিক ও পুলিশি সহায়তায়।
কথিত ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ দোহাই দিয়ে হন্ডুরাস, মেক্সিকোর মতো ‘ট্রিগার হ্যাপি’ দেশগুলোতে এমন সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হয়। ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়কালে লাতিন ও মধ্য আমেরিকায় ক্রমাগত সামরিকায়ন বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ডানপন্থী, করপোরেট-বান্ধব বর্বরতা ও কথিত মাদক যুদ্ধের ভয়াবহ সহিংসতার পরও ২০১২ সালে মধ্য আমেরিকা সফরকালে বাইডেন এসব অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন।
ক্যু-পরবর্তী সময়কালে হন্ডুরাসে প্রধানত যেসব প্রবণতা দেখা যায়, তার মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণ, বৃহৎ ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের নামে জমি দখল, নিরঙ্কুশ পরিবেশ দূষণ ও অন্যান্য মার্কিন মদদপুষ্ট নয়া উদারনৈতিক কর্মকাণ্ড, যা দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও সাম্প্রদায়িক উচ্ছেদকরণ তীব্র করে তোলে। কার্যত হন্ডুরাসসহ লাতিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশের অবস্থা একইরকম- নয়া উদারনৈতিক নরক। জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা না থাকায় সেখানকার লোকজন অন্য দেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
২০১৪ সালে অভুক্ত হন্ডুরানদের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় লাভের দাবি জানায়। বাইডেনের মতে, ‘এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই বিপজ্জনক প্রবণতা।’ ২০১৫ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ‘মধ্য আমেরিকার জন্য একটি পরিকল্পনা’ শীর্ষক এক নিবন্ধে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার নীতিগত অবস্থান ব্যাখ্যা করেন- কীভাবে হন্ডুরাস, গুয়েতেমালা, এল সালভাদরের মতো দেশে সহিংসতা ও দারিদ্র্য বাড়িয়েও বিদেশে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়!
বাইডেনের পরিকল্পনা ‘সমৃদ্ধির জন্য জোট’ বলেও পরিচিত, যার ভিত্তি- সুরক্ষাই সবকিছু সম্ভব করে তোলে। ওই পরিকল্পনা অনুসারে, মার্কিন প্রশাসন, উপরোল্লিখিত তিন দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাসমূহ ও বেসরকারি খাতের মধ্যে এক সহযোগিতামূলক ক্ষেত্র গড়ে উঠবে। ওই তিন দেশে যে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তার মূলে রয়েছে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ক্রমাগত মার্কিন হস্তক্ষেপ। আর যখন ওই দেশগুলো অস্থিতিশীল অবস্থায় পড়ল, তখন কথিত উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির নামে ওইসব স্থান নিরাপদ করতে সামরিকায়নের পরিকল্পনা জোরদার করা হয়। আর এতে লাভবান দুটি ক্ষেত্র হলো- আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাসমূহ ও বেসরকারি খাত।
২০১৯ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন তার ওই পরিকল্পনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে মধ্য আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি নিজের দেশকে বসবাসযোগ্য করতে কিছু ব্যবস্থা নিন, যেন মানুষ দেশ ছেড়ে না পালায়। আমরা এ কাজে আপনাদের সহযোগিতা করব, যেমনটি করেছি কলম্বিয়ায়।’
উল্লেখ্য, ২০০০ সালে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায় বিপুল পরিমাণ মার্কিন সহায়তা পাঠানোর অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন তৎকালীন প্রভাবশালী সিনেটর বাইডেন। কার্যত ওই সহায়তার মধ্য দিয়ে কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীকে মার্কিন পুতুলে পরিণত করা হয়। দেশটিতে মার্কিন মদদপুষ্ট সেনাবাহিনীকে বিশেষ দমনাভিযান পরিচালনায় বোনাস, হলিডে বোনাসসহ বিপুল আর্থিক ও সামরিক সহযোগিতা প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে ওই সেনাবাহিনী। আর হত্যার পর বক্তব্য দেয়া হয়, নিহতরা সবাই বিদ্রোহী অথবা মাদক চোরাচালানকারী ছিলেন। কলম্বিয়ার ডানপন্থী সরকার এ হত্যাযজ্ঞকে দেখিয়েছে- তারা মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হচ্ছে। এর ফলে আরো বেশি মার্কিন সহায়তা আসতে থাকে; সেইসাথে পাল্লা দিয়ে চলে হত্যার মিছিল।
বাইডেনের দেখানো সুন্দর, পরিপাটি কলম্বিয়ার বিপরীতে রয়েছে এক কুৎসিত, দূষিত কলম্বিয়া। সেখানে তেল-গ্যাস উত্তোলন, খনি শিল্প ও শিল্পোৎপাদনের নামে বিষাক্ত বর্জ্যে মাইলের পর মাইল জমি পরিত্যক্ত হয়েছে, দূষিত হয়েছে সাগর, নদী, জলাভূমি। ফলে বাস্তুচ্যূত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। অধিকারের প্রশ্ন তোলার ‘অপরাধে’ মানবাধিকারকর্মী ও অ্যাক্টিভিস্টদের হত্যা, গুম নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টে লেখা এক নিবন্ধে কলামিস্ট জন ওয়াশিংটন জানান, বাইডেনের কলম্বিয়া পরিকল্পনাই বেসরকারিকরণ ও নয়া উদারনৈতিক সংস্কার জোরদার করেছিল- যুক্তরাষ্ট্র ও কলম্বিয়ার মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব হয়। সেইসাথে বহুজাতিক-অধিজাতিক করপোরেশন ও মাইনিং কোম্পানি কলম্বিয়ায় আস্তানা করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কারণ তারা সেখানে খেয়াল-খুশি মতো পরিবেশ ধ্বংস করার, আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার নিরঙ্কুশ সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে বাইডেনের পরিকল্পনা নিশ্চিতভাবেই সফল।
এ সম্পর্কে বাইডেনের নির্বাচনি প্রচারণা দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘মধ্য আমেরিকার জনগণের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সুরক্ষা ও সমৃদ্ধি গড়ে তোলাই বাইডেনের পরিকল্পনা।’ ওই পরিকল্পনা অনুসারে, মার্কিন নেতৃত্বের পুনঃনবায়ন আঞ্চলিক সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও সেখানে হাজারো মানুষকে হত্যা করা মার্কিন মদদপুষ্ট খুনে বাহিনীর বিচারের বিষয়ে কোনো কথা নেই। বাইডেনের নতুন পরিকল্পনায় চার বছরব্যাপী আঞ্চলিক ‘উন্নয়নের’ জন্য চার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়, যার উদ্দেশ্য শরণার্থী সংকট মোকাবেলা বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও ওই পরিকল্পনার মূলে রয়েছে মধ্য আমেরিকায় আরো বেশি করপোরেট বিনিয়োগ। দুর্নীতি দমনও ওই পরিকল্পনার কেন্দ্রীয় বক্তব্য; অথচ মার্কিন নীতিই ওই দুর্নীতির জনক।
মধ্য আমেরিকা বিশ্লেষক বেলেন ফারনান্দেজ কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় এক নিবন্ধে জানান, দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কথা বলা হলেও, ২০১৪ সালে হন্ডুরাসে এ দুটি অভিযোগে অভিযুক্ত উগ্র-ডানপন্থী হুয়ান অরলান্ডো হারনান্দেজ ক্ষমতায় আসেন। বাইডেন তখনো ভাইস প্রেসিডেন্ট। নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায়, নারীর ক্ষমতায়নকে উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ ২০১৬ সালে যখন পরিবেশকর্মী, আদিবাসী নেত্রী বেরতা কাসেরেসকে ভূমিদস্যুরা হত্যা করে, তখন এ নিয়ে মার্কিন প্রশাসন মুখে কুলুপ এঁটে রাখে। তখনো ক্ষমতায় ওবামা-বাইডেন। ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনা করলেও আইনি পরিবর্তনের কথা এড়িয়ে গেছেন বাইডেন। শুধু ট্রাম্পের নির্বাহী ক্ষমতায় অভিবাসী আইনে যে পরিবর্তন করা হয়েছিল, তা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয় বাইডেনের নির্বাচনী দলের পক্ষ থেকে।
মেক্সিকান-আমেরিকান অ্যাক্টিভিস্ট নাতাশা এলিনা উলম্যান বলেন, ওবামা-বাইডেন প্রশাসনের আট বছরে প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতারিত করা হয়, তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ১৯৯৬ সালের অভিবাসী আইনে পরিবর্তন আনার কথা বলা হলেও তা করা হয়নি। এবারো এ প্রশ্নে নীরব বাইডেন। ওই আইনের জোরেই ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করার সুযোগ পেয়েছে।
মধ্য আমেরিকা থেকে শরণার্থীর ঢল থামাতে কাঠামোগত পরিবর্তনের কথা বলেছেন বাইডেন। তিনি সঠিকই বলেছেন। তবে তা হওয়া দরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোগত পরিবর্তন, যে কাঠামো নিজ দেশের জনগণের অধিকার যেমন অক্ষুণ্ন রাখবে, তেমনি অন্য দেশে হস্তক্ষেপ করা থেকেও বিরত থাকবে। এমন কাঠামোগত পরিবর্তন অবশ্য বাইডেনের কাছ থেকে আশা করা যায় না।
ABOUT CONTACT ARCHIVE TERMS POLICY ADVERTISEMENT
প্রধান সম্পাদক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ | প্রকাশক: নাহিদা আকতার জাহেদী
প্রধান সম্পাদক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ
প্রকাশক: নাহিদা আকতার জাহেদী
অনলাইন সম্পাদক: আরশাদ সিদ্দিকী
অনলাইন সম্পাদক: আরশাদ সিদ্দিকী | ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
© 2021 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh