অর্থনৈতিক সংকটে আর্জেন্টিনায় উগ্র ডানপন্থার উত্থান

প্রতিষ্ঠা-বিরোধী ক্রোধের তরঙ্গে চড়ে অতি-ডানপন্থিদের অত্যাশ্চর্য বিজয় হয়েছে আর্জেন্টিনায়। তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে এক সংকটে নিমজ্জিত অর্থনীতির উত্তরাধিকারী হয়েছেন। তবে এ সংকটই তাকে ক্ষমতায় আনতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সাবেক টিভি ব্যক্তিত্ব থেকে রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠা হাভিয়ের মিলেই তার বিপর্যস্ত দেশকে ‘আবার মহান’ করার যে রাস্তা খুঁজছেন প্রাইভেটাইজেশনের মধ্য দিয়ে, তাতে সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

আর্জেন্টিনার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন অতি ডানপন্থি রাজনীতিবিদ হাভিয়ের মিলেই। গত ১৯ নভেম্বর তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। ১০ ডিসেম্বর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেন। এর মধ্য দিয়ে আর্জেন্টিনায় ডানপন্থি ধারার উত্থান নিশ্চিত হলো।

হাভিয়ের তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ও পেরনিস্ট অর্থনীতিতে বিশ্বাসী সাবেক অর্থমন্ত্রী সের্হিও মাসাকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। নির্বাচনে মোট ভোটের মধ্যে মাসা পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ এবং হাভিয়ের পেয়েছেন ৫৬ শতাংশ ভোট। বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক টানাপড়েনে আর্জেন্টিনার জনগণ সাবেক প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজের শাসনের প্রতি বিরক্ত ছিলেন। মাসা ছিলেন ফার্নান্দেজ প্রশাসনেরই অর্থমন্ত্রী। আর তার প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে।

হাভিয়ের এমন এক সময়ে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন যখন দেশটিতে মূল্যস্ফীতি প্রায় ২০০ শতাংশ, দারিদ্র্যের হার ক্রমেই বাড়ছে এবং সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি একটি মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে বলেন, ‘জানি স্বল্পমেয়াদে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তারপরও আমরা আমাদের প্রচেষ্টার ফল দেখতে পাব। মোদ্দাকথা হলো-কঠোরতার কোনো বিকল্প নেই এবং শক ট্রিটমেন্টেরও বিকল্প নেই।’ নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, ‘অবক্ষয়ের মডেল শেষ করার সময় এসেছে, পেছনে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই।’ প্রশাসনের সামনে থাকা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সামনে বিপুল পরিমাণ কাজ পড়ে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের অভাব ও দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন বিষয় মোকাবিলা করতে হবে আমাদের। পরিস্থিতি অনেক জটিল এবং এখানে হালকা চালের আধখেঁচড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই।’

নির্বাচনের আগে হাভিয়ের দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নত করার বেশকিছু পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি অর্থনৈতিক ‘শক থেরাপি’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে- কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া, মুদ্রা হিসেবে পেসোকে বাতিল বা সংস্কার করা এবং সরকারি ব্যয় কমানো। তার এসব প্রতিশ্রুতি অর্থনৈতিক কারণে সংক্ষুব্ধ  থাকা ভোটারদের অনুরণিত করেছিল, যা তার জয়ের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

বছরের পর বছর ধরে আর্জেন্টিনার অর্থনীতি সংকটে নিমজ্জিত। এর ফলে দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে ক্ষোভ ও হতাশা বপন করেছে। হাভিয়েরকে রাজনৈতিকভাবে ‘বহিরাগত’ বলে উল্লেখ করেন তার সমালোচকরা। তিনি এ সিস্টেমটিকে ‘উড়িয়ে দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তার নিজস্ব সমর্থকরা তাকে ‘এল লোকো’ (পাগলা) বলে ডাকে। হাভিয়ের একজন সাবেক অর্থনীতিবিদ এবং টিভি ব্যক্তিত্ব। তার প্রায় কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। কয়েক দশকের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষোভের ঢেউয়ের উপর চড়েই ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে ট্রিপল-ডিজিটের মুদ্রাস্ফীতিতে পঙ্গু একটি দেশ, যেখানে দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে, সেখানে ‘পরনির্ভর, মূর্খ, অকেজো রাজনৈতিক শ্রেণির অবসান ঘটাবেন’।

হাভিয়ের নিজেকে এনার্কো ক্যাপিটালিস্ট বা অরাজ-পুঁজিবাদী বলে উল্লেখ করেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের ল্যাটিন আমেরিকা প্রোগ্রামের প্রধান এবং আর্জেন্টিনা প্রকল্পের পরিচালক বেঞ্জামিন গেডান বলেন, ‘আর্জেন্টাইনরা দুটি অত্যন্ত অপ্রীতিকর বিকল্পের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। একদিকে আপনার বর্তমান অর্থমন্ত্রী, যিনি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ অর্থনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অন্যদিকে একজন খুব উগ্র ডানপন্থি বহিরাগত ব্যক্তি, যিনি অসাধারণভাবে ভিন্ন কিছু প্রস্তাব করেছেন, যিনি অর্থনীতিকে ডলারাইজ করতে চান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ধ করতে চান, বন্দুকের মালিকানা এবং অস্ত্র বিক্রিকে উদার করতে চান- একজন অদ্ভুত ব্যক্তি, যিনি তার কুকুরের ক্লোন করেছেন এবং দাবি করেছেন যে তার পোষা প্রাণী তার সিনিয়র উপদেষ্টা।’

ক্ষমতায় হাভিয়েরের বিস্ময়কর উত্থান আর্জেন্টিনার ভোটারদের হতাশার একটি পরিমাপও বটে। তা শাসক শ্রেণি এবং দেশের পরিস্থিতির প্রতি গণঅসন্তোষের গভীরতা প্রকাশ করে। এটি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য একটি পণ্য, যা তাদের রেটিং বাড়ানোর জন্য উসকানিমূলক কথা বলাকে উৎসাহিত করে। আর্জেন্টিনার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলোতে ‘রাজনৈতিক শ্রেণি’কে তীব্রভাবে নিন্দা করেছেন এবং মুদ্রাস্ফীতি ও তার যৌনজীবন সম্পর্কে কথা বলে নাম কামিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠা-বিরোধী ক্রোধ আর্জেন্টিনাবাসীদের পরিবর্তনের জন্য আকুল আকাক্সক্ষার সঙ্গে অনুরণিত হয়েছিল। তার চুলের বিকৃত স্টাইল এক্স-মেন সিনেমার উলভারিন দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং অশ্লীল বক্তৃতা শুধু তার প্রচারণায় আরও বড় অবদান রেখেছে।

দুই বছর আগে হাভিয়েরের ক্রমবর্ধমান টেলিভিশন স্টারডম তাকে আর্জেন্টিনার নিম্নকক্ষ কংগ্রেসে একজন আইনপ্রণেতার আসন নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছিল। মাত্র কয়েক মাস আগে তাকে প্রেসিডেন্টের জন্য দীর্ঘ তালিকার নিচের দিকে দেখা গিয়েছিল। তবে আগস্টের প্রাথমিক নির্বাচনে যখন তিনি সর্বাধিক ভোট পান, তখন রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ নতুন করে লেখা হয়।

রাজনৈতিক বৃত্তে আসার আগে হাভিয়ের আর্জেন্টিনার অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসায়িক সংগঠন কর্পোরাসিওন আমেরিকার প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন। যা দেশের বেশিরভাগ বিমানবন্দর পরিচালনা করে। তার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে রয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে অর্থনীতিতে ডলারের অবাধ প্রবেশ, যাতে ‘মুদ্রাস্ফীতির ক্যান্সার’ রোধ করা যায়। এর মধ্য দিয়ে তিনি আর্জেন্টিনার বিপর্যস্ত মুদ্রা পেসোকে বাদ দেবেন এবং আর্থিক নীতির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে দিয়ে সব বাজারের হাতে তুলে দেবেন। যার অর্থ- তিনি গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণই কর্পোরেটদের হাতে দিয়ে দেবেন।

হাভিয়ের নিজেকে রাষ্ট্রের ভয়ানক প্রতিপক্ষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি জনগণের স্বাধীনতা খর্ব করার এবং তাদের পকেট খালি করার অভিযোগ করার জন্য রাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। প্রচারণা সমাবেশে তিনি প্রায়শই মঞ্চে উপস্থিত হতেন একটি ইলেক্ট্রিক করাত হাতে, প্রতীকীভাবে রাষ্ট্রকে কেটে ফেলার রূপ নিয়ে। তিনি সরকারি ব্যয় ১৫ শতাংশ কমানোর, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে বেসরকারিকরণ এবং জ্বালানি, পরিবহন এবং বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে, মিলেই ‘আর্জেন্টিনাকে আবার মহান করার’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে পরিচিত স্লোগানটিকে মানিয়ে নিয়েছেন। তিনি ট্রাম্পের একজন প্রশংসক। উসকানিমূলক বিবৃতি দিয়ে প্রচারাভিযান জুড়ে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। পোপ ফ্রান্সিসসহ বিশেষজ্ঞদের প্রতি বাজে মন্তব্য করতেও পিছপা হননি হাভিয়ের। তাদের সামাজিক ন্যায়বিচার রক্ষার জন্য ‘মূর্খ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ট্রাম্প এবং তার ব্রাজিলীয় মিত্র জাইর বলসোনারোর মতো, হাভিয়ের প্রগতিশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে ‘ধর্মযুদ্ধ’ ঘোষণা করে রক্ষণশীল ভোটের আবেদন করেছেন। তিনি যৌন শিক্ষাকে ঐতিহ্যগত পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার ‘মার্ক্সবাদী চক্রান্ত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং গর্ভপাত বাতিল করার জন্য একটি গণভোটের প্রস্তাব করেছেন, যা আর্জেন্টিনা ২০২০ সালে বৈধ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ঘটাতে মানুষের ভূমিকা রয়েছে এ ধারণাটিকেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

ল্যাটিন আমেরিকার রাজনীতির সিনিয়র লেকচারার জুয়ান-পাবলো ফেরেরো বলেন, ‘হাভিয়েরের নীতি শুধু নারীদের জন্য নয়, সাধারণভাবে সংখ্যালঘুদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। কারণ তিনি একই সাংস্কৃতিক যুদ্ধ চালাচ্ছেন, যেটা ডানপন্থিরা অন্যত্র চালাচ্ছে। তিনি মানবাধিকার হরণের এজেন্ডায়ও ফিরে যাচ্ছেন, যাতে আর্জেন্টিনা গণতন্ত্রে উত্তরণের পর থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। সংখ্যালঘুদের পার্লামেন্টে ও রাস্তায় তার পদক্ষেপকে প্রতিহত করতে হবে।’

যদিও ট্রাম্প ও বলসোনারো হাভিয়েরকে স্বাগত জানিয়েছেন। বর্তমানে কেউই ক্ষমতায় নেই। আর্জেন্টিনার দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ব্রাজিল ও চিলির মধ্য-বাম নেতারা তাদের প্রতিক্রিয়ায় লক্ষণীয়ভাবে আরও সতর্ক ছিলেন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা তাকে তার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন নাম উল্লেখ না করে। তবে হাভিয়ের ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের একাধিকবার সমালোচনা করেছেন এবং তাকে ‘সর্বগ্রাসী’, ‘আগ্রাসী কমিউনিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরের মাঠেই হোক বা আন্তর্জাতিক মঞ্চে, আর্জেন্টিনা অজানা ও অন্ধকার পথে যাত্রা করবে ‘এল লোকো’-এর নেতৃত্বে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //