কে পাচ্ছেন অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব

দেশের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় দায়িত্বে থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম পরলোক গমন করেছেন। সিনিয়র আইনজীবী মাহবুবে আলমের প্রজ্ঞা এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে অভাবনীয় দক্ষতার কারণে বিভিন্ন সময় গুঞ্জন শোনা গেলেও বিকল্প খোঁজার প্রয়োজন মনে করেনি সরকার।

তবে তাঁর মৃত্যুর পর আইনজীবীদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে- কে পাচ্ছেন পরবর্তী অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব? রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক এই পদে সরকার কাকে নিয়োগ দেবে এ নিয়ে কৌতূহল রয়েছে।

নতুন অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক আইন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে মুরাদ রেজা, মোমতাজ উদ্দিন ফকির এবং এস এম মুনীর দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের মধ্যে সিনিয়রিটির দিক দিয়ে এগিয়ে আছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ করার আগ পর্যন্ত তিনিই ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করবেন এটা মোটামুটি নিশ্চিত।

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা

মুরাদ রেজা অ্যাটর্নি জে
নারেল হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন। কারণ তাঁর দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি বিভিন্ন সময় অ্যাটর্নি জেনারেলের অবর্তমানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। অতীতে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার নজিরও রয়েছে।


অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন
সাম্প্রতিক সময়ে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিনের নাম সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে। দীর্ঘ দিন বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের দখলে থাকা সুপ্রিম কোর্ট বারের নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়ে তিনি পরপর দুইবার সভাপতি হয়েছেন। ফলে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তাঁর নিয়োগের সম্ভাবনার কথাও বলছেন অনেকে। কমপক্ষে পাঁচজন আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের বিকল্প হতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন।

ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন এমন গুঞ্জন রয়েছে। বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র আইনজীবী যিনি বিট্রেনের কুইন্স কাউন্সিল থেকে কিউসি পদধারী। আজমালুল হোসেন কিউসি আলোচিত মুন সিনেমা হলের মামলা দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন এবং আপিল বিভাগ থেকে ক্ষতিপূরণের আদেশও পেয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন মামলায় তিনি আইনজীবী হিসেবে ছিলেন।

অ্যাডভোকেট কামরুল হক
বিভিন্ন সময় অ্যাটর্নি জেনারেল পরিবর্তনের গুঞ্জনে সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট কামরুল হক সিদ্দিকীর নামও আলোচনায় এসেছে। এই আইনজীবীর সততা ও দক্ষতার সুনাম রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

মনসুরুল হক চৌধুরী
সিনিয়র আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরীও অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন। ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ মনসুরুল হক চৌধুরীর সংশ্লিষ্ট মহলে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনী
নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগের তালিকায় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর নামও শোনা যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট এস এম মুনীর করোনাকালে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। বিষয়টিকে অনেকে তাঁর ওপর সরকারের সুদৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করছেন।

ব্যারিস্টার নিহাদ কবির
নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ঢাকার (এমসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবিরের নামও শোনা যাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী সরকার দেশের প্রথম নারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ব্যারিস্টার নিহাদ কবিরকে নিয়োগ দিলে আশ্চর্যের কিছু হবে না। এমসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ সুপ্রিম কোর্টে সিভিল প্র্যাকটিস করেন।

বাংলাদেশের ১৩তম অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রবিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএসএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা সাতটা ২৫ মিনিটে মারা যান। পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ৪ সেপ্টেম্বর জ্বর নিয়ে সিএমএইচে ভর্তি হন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সেখানে নমুনা পরীক্ষায় তার শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। (২০ সেপ্টেম্বর) তার পরিবার জানিয়েছিল, করোনামুক্ত হওয়ার পর তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু করোনাভাইরাস ও হৃদরোগের ধাক্কা নিতে পারেনি প্রবীণ এই আইনজীবী।

১৯৪৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মৌছামান্দ্রা গ্রামে জন্ম মাহবুবে আলমের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও লোকপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়ার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রিও নেন তিনি। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে অ্যাডভোকেট হিসেবে নিবন্ধিত হন মাহবুবে আলম। ১৯৭৫ সাল থেকে হাইকোর্টে আইন পেশায় যুক্ত মাহবুবে আলম। পরে ১৯৮০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্র্যাকটিসের অনুমতি পান। এর মধ্যে নয়া দিল্লির ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ থেকে সংবিধান ও সংসদীয় আইন বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে সভাপতির পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে নিযুক্ত হন তিনি। ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে পাঁচ বছর পূর্ণ হয় তার। এরপর আরেক দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে তাকে এই পদে বহাল রাখা হয়। আমৃত্যু তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত দীর্ঘ মেয়াদে আর কোনো অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের রেকর্ড নেই। দীর্ঘ ১১ বছর ৮ মাস ১৪ দিন তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে সাংবিধানিকভাবে ‘অ্যাটর্নি জেনারেল’ পদটি শূন্য হয়েছে।

কর্মজীবনে দক্ষতা ও সাফল্যে মাহবুবে আলম ‘সিনিয়র অ্যাডভোকেট’ হিসেবে স্বীকৃতি পান ১৯৯৮ সালে। ওই বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে ২০০১ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯৩-৯৪ মেয়াদে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ২০০৫-০৬ মেয়াদে সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন মাহবুবে আলম। মাহবুবে আলম একজন মনোনীত প্রবীণ পরামর্শক ছিলেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলা; সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলা; বিশেষ করে কাদের মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মো. কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মামলা; পিলখানা হত্যাকাণ্ড মামলার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মামলা রাষ্ট্রপক্ষে পরিচালনা করেছেন মাহবুবে আলম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //