নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন

দুই দশকেও হয়নি নীতিমালা

দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলনের মুখে এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধনী এনে অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা ইতিমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। তবে মৃত্যুদণ্ড হলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে কি না- এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক রয়েই গেছে।

ধর্ষণের মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বছরের পর ঝুলে থাকার অভিযোগ আবারো সামনে এসেছে। কিন্তু আইনে যা আছে, তদন্ত এবং বিচার যেভাবে হয়- এই প্রক্রিয়াগুলোতে গলদ কী আছে বা সমস্যাগুলো কোথায়-এ সব প্রশ্ন এখন আলোচনায় এসেছে।

ধর্ষণের ঘটনায় এতদিন একমাত্র শাস্তি ছিলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এখন করা হলো মৃত্যুদণ্ড অথবা যাaবজ্জীবন সাজা। সর্বোচ্চ এই শাস্তি ধর্ষণ এবং সার্বিকভাবে নারী নির্যাতন বন্ধে কতটা সহায়ক হবে-এ নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

তারা বলেছেন, একজন নারী যখন ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন, তখন তার মামলা করা থেকে শুরু করে তদন্ত এবং বিচার-প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই নারীকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করা হয়। সেটাকে বিশেষজ্ঞরা বড় গলদ হিসাবে দেখেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলেছেন, আইনে অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলো চিহ্নিত না করে শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধান এনে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না। যখনই একজন নারী আসবেন আদালতে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে, এখানে প্রথমেই ধরে নেয়া হয় যে, তিনি হয়তো সত্য কথা বলছেন না, তিনি মিথ্যা বলছেন।

তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, এই যে আমাদের যুগ যুগ ধরে ব্রিটিশ সময় থেকে চলে আসা ধারা আমরা শক্তিশালীভাবে লিগ্যাসি বহন করে বেড়াচ্ছি। অন্য সকল মামলার থেকে যখন ধর্ষণের মামলা হবে, এটার অর্থই হচ্ছে যে, একজন নিরপরাধ ব্যক্তি ফেঁসে যেতে পারে। এই যে প্রো-অ্যাকিউস্ড (অভিযুক্তের স্বপক্ষে) অ্যাপ্রোচটা-এখানে একটা পরিবর্তন দরকার। বিচার প্রক্রিয়ায় আমাদের গলদগুলো এত বেশি, সেগুলোকে অ্যাড্রেস করা প্রয়োজন। এই গলদগুলো এত শক্তভাবে শেকড় গেড়েছে যে, আপনি আইনে মৃত্যুদণ্ড লিখে দিলেই কোন পরিবর্তন আসবে না।

আইনের দুর্বলতা নিয়ে তাসলিমা ইয়াসমিন আরো বলেছেন, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঘটে পারিবারিক সহিংসতা। এই পুরো আইনেই কিন্তু পারিবারিক সহিংসতাকে কোন অপরাধ হিসাবে দেখা হচ্ছে না। এটা একেবারেই আনজাস্টিফাইঅ্যাবল, যখন এই আইনটার মূল বিষয়ই ছিলো নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করা। এটা নিয়ে ভাবা দরকার ছিলো যে, পারিবারিক সহিংসতাকে আমরা কেন অন্তর্ভুক্ত করছি না?

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল ২০০০ সালে। বিশ বছরেও এই আইনের কোন বিধিমালা করা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধ এবং বিচার সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব বিষয়ে ব্যাখ্যা বা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকে বিধিমালায়, যা আইনে থাকে না। সেজন্য প্রতিটি আইনের ক্ষেত্রেই বিধিমালা প্রয়োজন হয়।

অনেক আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের বিধিমালা তৈরির আদেশ এসেছিল উচ্চ আদালত থেকে। কিন্তু এখনো তা করা হয়নি। আইনজীবীরা বলেছেন, বিধিমালা না থাকায় ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের মামলায় একেক বিচারক একেকভাবে বিচার করেন। সেটাকে তারা অন্যতম সমস্যা হিসাবে দেখেন।

নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেছেন, আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা যা রয়েছে, তাও সীমিত। সেকারণেও ধর্ষণের অনেক ঘটনায় সঠিক বিচার হয় না বলে তিনি মনে করেন। ধর্ষণের সংজ্ঞাটাকে কিন্তু আরো বিস্তৃত করতে হবে। সেখানে অস্বাভাবিক ধর্ষণের ঘটনা যেটা অনেক মামলায় আসছে, যেমন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে যেটা হলো, এগুলো কিন্তু সবই ধর্ষণের সংজ্ঞায় আনতে হবে।

এখন আইনে ধর্ষণের যে সংজ্ঞা আছে, তাতে বলা হয়েছে, কোন পুরুষ যদি বিয়ে ছাড়া কোন নারীর সাথে যৌন সঙ্গম করে, সেখানে ওই নারীর সম্মতি না থাকলে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে বা প্রতারণামূলকভাবে তা করা হলে, তবেই সেটা ধর্ষণ হিসাবে গণ্য হবে।

এই সংজ্ঞা আরো বিস্তৃত করার জন্য নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে দুই বছর আগে। যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এখনকার সংজ্ঞা বাস্তবসম্মত বলে তারা মনে করেন। একইসাথে তিনি বলেছেন, ধর্ষণের সংজ্ঞায় সংস্কারের বিষয় তারা বিবেচনা করতে পারেন।

তিনি বলেন, ধর্ষণের যে সংজ্ঞা, যতটুকু এখন আছে, সেটা নিয়ে আমার মনে হয় না, খুব একটা বিতর্ক হওয়া উচিত। কারণ বাস্তব সংজ্ঞাটাই আছে। তারপরও এটাতো পরিবর্তন করা যায়। এটা আমরা দেখতে পারি।

ধর্ষণ মামলার তদন্ত নিয়েও অভিযোগের শেষ নেই। নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলেছেন, বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল থাকলেও তদন্তের ব্যাপারে বিশেষায়িত কোন ব্যবস্থা নেই।

পুলিশ অন্য অনেক মামলার সাথে ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের মামলা তদন্ত করে থাকে এবং সেজন্য লম্বা সময় লেগে যায়। তারা মনে করেন, দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের অভাবে তদন্তে দুর্বলতার প্রভাব বিচারের ক্ষেত্রে পড়ছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নীনা গোস্বামী বলেছেন, ১০ বছর ধরে তারা প্রায় তিনশটি ধর্ষণের মামলায় আইনী সহায়তা দিচ্ছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মামলারই বিচার শেষ করা যায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। সমস্যাটা হচ্ছে, তদন্ত যিনি করছেন, তিনি তদন্তে সময় লাগাচ্ছেন। তিনি অনেকবার সময় নিয়ে তারপর হয়তোবা আদালতে চার্জশিট দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, চাজশিট দেয়ার পর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এই সাক্ষ্য নেয়ার সময় শুরু হয় সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনা। ভিকটিমের সাক্ষ্যটা ভাইটাল সাক্ষ্য। কিন্তু আরো অনেক সাক্ষী দরকার হয়। যিনি মেডিকেল করেছেন, সেই ডাক্তারের সাক্ষী নিতে হয়। জবানবন্দী নেয়া ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষ্য লাগে। সাক্ষীদের আনার কোন ব্যবস্থা নাই। সরকারি কর্মকর্তা যারা সাক্ষী হন, দিনের পর দিন তারাও আসতে গাফিলতি করেন। এখানে কোন জবাবদিহিতা নাই।

নীনা গোস্বামী বলেন, গাফিলতির কারণে শুধু দেরি হয়, তা নয়, প্রসিকিউশনের গাফিলতির কারণে মামলার সবল দিকগুলো আদালতে ঠিকমত তুলে ধরা সম্ভব হয় না।

যদিও আইনে ছয় মাস বা ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা বলা আছে। কিন্তু সেটা কাগজে কলমেই রয়ে গেছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন।

তাদের অভিযোগ হচ্ছে, পুলিশী তদন্তে দিনের পর দিন সময় চলে যায়। অবশেষে তদন্ত শেষ হলে কোন মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তখন সরকার পক্ষের সাক্ষী হাজির করা নিয়ে চলে টালবাহানা। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা নাই। ফলে ধর্ষণের শিকার একজন নারী এবং তার পরিবারকে দীর্ঘসূত্রিতার ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান নারী নির্যাতন মামলার দীর্ঘসূত্রিতার বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন, বিচার থেকে শুরু করে তদন্ত- প্রতিটি পর্যায়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি।

তিনি বলেন, হাইকোর্ট কিছুদিন আগেও একটা পর্যবেক্ষণে স্ট্রংলি বলেছেন, আইনে ১৮০ দিনের যে বিধান রয়েছে, সেটা কার্যকর হচ্ছে না। এটা যতটা কার্যকরভাবে তদারক করার কথা, সেটা আমরা দেখতে পাই না। আরেকটা মামলায় হাইকোর্ট বিভাগই বলেছেন যে, একটা মনিটরিং সেল হবে। কিন্তু দুই বছর হয়ে যাওয়ার পরও এ ব্যাপারে আমরা একটা শিথিল মনোভাব লক্ষ্য করে আসছি। এটা একটা বিরাট অন্তরায়।

এখন অবশ্য দেশজুড়ে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আইনের বিধিমালা তৈরি এবং বিচার প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবস্থাগুলো দৃশ্যমান হবে। তিনি সাক্ষী সুরক্ষার ব্যাপারেও নতুন আইন করার কথাও উল্লেখ করেছেন। আমি মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ করবো, তিনি যেন নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারকদের জন্য একটা প্র্যাকটিস ডাইরেকশন দেন। যাতে তাড়াতাড়ি মামলাগুলো শেষ হয়। এর পাশাপাশি প্রসিকিউটরদের ডাইরেকশন পাঠাচ্ছি, ধর্ষণ মামলায় তারা যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হন, সেগুলো যেন চিহ্নিত করা হয় এবং চিহ্নিত করে তারপর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী ধর্ষণের ঘটনা ছাড়া নারী নির্যাতনের বেশিরভাগ মামলা হয় যৌতুক নিয়ে পরিবারে নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগে। এই অভিযোগের ক্ষেত্রে আপোষের মাধ্যমে মীমাংসার বিষয় আইনে যুক্ত করা হয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা এটিকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন।

তবে এখন আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আনার পাশাপাশি আরেকটি বড় পরিবর্তন করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ধর্ষণের শিকার নারী এবং অভিযুক্তের ডিএনএ পরীক্ষা। এনিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

তাসলিমা ইয়াসমিন মনে করেন, এই ডিএনএ পরীক্ষার বিষয়টি দ্রুত বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। ডিএনএ টেস্ট করার জন্য একটা বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে একজন বিচারক মনে করতে পারেন যে, এই সুনির্দিষ্ট মামলাটির ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন রয়েছে। তখন একজন বিচারক চাইলে ডিএনএ টেস্টের জন্য বলতে পারেন। কিন্তু যদি আমি বলে দেই যে, সব মামলাতেই ডিএনএ টেস্ট করা হবে, এটা আসলে কতটুকু প্র্যাকটিক্যাল? যেমন যেসব মামলায় ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন নাই, সেখানে ডিফেন্স থেকে স্বাভাবিকভাবেই সুযোগ নিতে পারে। ডিফেন্স সেই সুযোগ নিতে পারে যে, যতক্ষণ না ডিএনএ টেস্ট করানো হচ্ছে, ততক্ষণ মামলার বিচার সহজে পেছানো যাবে।

তিনি বলেন, আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ডিএনএ পরীক্ষা কেন্দ্রগুলো আসলে কতটা রিসোর্সফুল। ঢাকার যে কোন একটা ট্রাইব্যুনালে অন্তত সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মামলা ঝুলে আছে। এর মধ্যে যদি অন্তত দুই হাজার মামলাও ডিএনএ টেস্টের জন্য যায়, ল্যাবগুলোর সেই সক্ষমতা আছে কিনা-সেটাও বিবেচনা করার বিষয়।

তবে সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, বাস্তবতা বিবেচনা করে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচারের ট্রাইব্যুনালের একজন পাবলিক প্রসিকিউটর বা পিপি সালমা হাই বলেছেন, অভিজ্ঞতা থেকে তিনি মনে করেন যে ডিএনএ পরীক্ষার কারণে সঠিক বিচার পাওয়া যাবে। ধরেন একটা মেয়ে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো। কিন্তু অভিযুক্ত তা অস্বীকার করলো। এখন ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। এখানে অস্বীকার করার কোন সুযোগ থাকবে না।

ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে একজন নারীকে মামলা করা এবং তদন্ত থেকে শুরু করে লম্বা সময় ধরে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এগুতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বিচারে গিয়ে সেই নারীকে তার চরিত্র নিয়েও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। এজন্য মানবাধিকার কর্মীরা বহু বছরের পুরোনো সাক্ষ্য আইনকে দায়ী করেছেন।

নীনা গোস্বামী বলেছেন, মামলার শুনানিতে আইনের সুযোগ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নারীকে তার চরিত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের আইনজীবী এমন সব প্রশ্ন করেন, তার মাধ্যমে তাকে আরেক বার হেনস্তা করা হয়। সাক্ষ্য আইনটা অনেক দিনের পুরোনো। এই আইনে বলা আছে, ডিফেন্স নেয়ার জন্য ডিফেন্স এর আইনজীবী ক্ষতিগ্রস্ত নারীর চরিত্র তুলে প্রশ্ন করতে পারবে। এর ফলে সারভাইভার কোর্টে সাক্ষ্য দিতে আসলে আসামী পক্ষের আইনজীবী ডিফেন্সের নাম করে তাকে চরিত্র তুলে নানা রকম হয়রানিমূলক প্রশ্ন করেন।

ঢাকায় আট বছর আগে ধর্ষণের শিকার এক নারীর পরিবারের একজন সদস্য নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকেই তাদের যেমন নিরাপত্তার অভাব ছিল। একইসাথে প্রতিটি ক্ষেত্রে হয়রানির মধ্যে দীর্ঘ সময়েও বিচার পাওয়া যাবে কিনা- সেই আশংকা তৈরি হওয়ায় এক পর্যায়ে তারা অভিযুক্ত পক্ষের সাথে বাধ্য হয়ে আপোষ করেছিলেন। এমন অনেক ঘটনা ঘটে বলে মানবাধিকার কর্মীরা জানিয়েছেন।

আইনমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ এখন বন্ধ করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেছেন। ভিকটিমের চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করার করার সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারায় একটা প্রভিশন আছে। সেটা আমরা সংশোধন করবো।

ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে এখন সরকারের পক্ষ থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিধানেই থেমে না থেকে সামগ্রিকভাবে সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এগুলো শুধু কথার কথা হয়ে থাকবে কিনা- নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীদের অনেকের সেই সন্দেহ রয়েছে।

ধর্ষণ মামলা নিয়ে অভিযোগ ও সমালোচনার মধ্যেই বাগেরহাটে মামলা দায়েরের পর সাত কর্মদিবসেই শিশু ধর্ষণ মামলায় আব্দুল মান্নান সরদার নামে এক ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সেইসাথে তাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়।

সোমবার (১৯ অক্টোবর) যুগান্তকারী এ রায় দেন বাগেরহাট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মো. নূরে আলম। গতকাল রবিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত এই মামলার বাদী-বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শোনেন বিচারক। এরপর তিনি আজ রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। এর আগে ১১ অক্টোবর পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগপত্র জমা দিলে ১৩ অক্টোবর চার্জ গঠন করেন আদালত।

মামলার বিবরণে জানা গেছে, বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার মাকোড়ডোন গ্রামের আশ্রয় প্রকল্প এলাকায় পিতৃহীন সাত বছর বয়সী এক শিশু তার মামা বাড়িতে থেকে বড় হচ্ছিলো। ৩ অক্টোবর বিকালে ওই আশ্রয় প্রকল্পের পঞ্চাশোর্ধ প্রতিবেশী আব্দুল মান্নান সরদার তাকে নিজের ঘরে ডেকে ধর্ষণ করে। পরে এই ঘটনা জানাজানি হলে সেদিন রাতেই মেয়েটির মামা মোংলা থানায় আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন ও পুলিশ মান্নানকে গ্রেফতার করে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোংলা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বিশ্বজিত মুখার্জ্জী ধর্ষণের সত্যতা পেয়ে আটদিনের মাথায় মান্নানের বিরুদ্ধে ১১ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

এই রায়কে ধর্ষকদের জন্য দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে নারী উন্নয়ন ফোরামের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী রিজিয়া পারভীন বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আন্তরিক থাকলে অল্প সময়ের মধ্যে যে বিচার কাজ শেষ হতে পারে এটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই রায় ধর্ষকদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হবে। স্বল্প সময়ে রায় হলে বাদী পক্ষ অনেক স্বস্তি পায়। নির্যাতিতাও তার বিভীষিকাময় স্মৃতি ক্ষত ভোলার আগেই বিচারের রায় শুনে মানসিক শান্তি অর্জন করতে পারেন। আমরা দাবি করবো অন্যান্য ধর্ষণ মামলার বিচারও যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এপিপি রনজিৎ কুমার মন্ডল বলেন, সকল সাক্ষ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে যে রায় আদালত দিয়েছে তাতে আমরা খুব খুশি হয়েছি। এই রায় ভবিষ্যতের ধর্ষকদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এই রায়ে মামলার বাদী শিশুটির মামাও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আব্দুল মান্নান সরদারের সাবেক স্ত্রী আমেনা বেগম বলেন, যে মামলায় আমার সাবেক স্বামীকে সাজা দেয়া হয়েছে, সে এই ধরণের কাজ করতে পারে না। সে ষড়যন্ত্রের শিকার। আমি ন্যায় বিচার দাবি করি। সে শারীরিকভাবে অক্ষম। তাই আমি তাকে বছর খানেক আগে ডিভোর্স দিয়েছি। স্থানীয় ইউপি সদস্য পূর্ব শত্রুতার জেরে এই মামলা দিয়েছেন।

এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী লিয়াকত হোসেন বলেন, এটা একটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলা। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবো।

বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ড. একে আজাদ ফিরোজ টিপু বলেন, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজকে যে রায় হয়েছে সেটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতেও এ ধরণের ত্বরিতগতিতে মামলার রায় হলে বিচার প্রার্থিরা হয়রানির হাত থেকে মুক্তি পাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //