বাংলাদেশের অনেক জেলায় বন্যা হচ্ছে। এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে ভারতকে। তার কিছু যৌক্তিক কারণও রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে ৫৪টি আন্তঃদেশীয় নদী রয়েছে এবং এসব নদীর অনেকগুলোর উজানে ভারতীয় অংশে ব্যারেজ বা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করায় বাংলাদেশের ভাটি অংশে যেমন প্রয়োজনের সময় বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহিত না হওয়ায় কৃষিসহ নানা কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়, তেমনি অতিরিক্ত পানি সামলানোর নামে বর্ষা মৌসুমে বাঁধগুলোর গেট খুলে দেওয়ায় ভাটি এলাকা বন্যাকবলিত হয় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
পানির এমন একতরফা নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকেই বলছেন ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। সেটা হতে পারে আইনি ব্যবস্থা। জাতিসংঘ প্রণীত আন্তঃদেশীয় নদীর জন্য আইন রয়েছে। তবে সেই আইনে বাংলাদেশ কী ব্যবস্থা নিতে পারবে, প্রশ্নটা চলেই আসে। কারণ আন্তঃদেশীয় নদীর পানির বিষয়ে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিল ভারত, পাকিস্তান। ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ওই সভায় আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন গ্রহণ করা হয়। কনভেনশনের শর্ত ছিল, ৩৫টি দেশ কনভেনশনের প্রতি অনুসমর্থন করলে তা আইনে পরিণত হবে। জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আইনটি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি। সেই বিবেচনায় কনভেনশনে বাংলাদেশের প্রথম অনুসমর্থনকারী দেশ হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত কনভেনশনটিতে অনুসমর্থন করেনি।
১৯৯৭ সালের কনভেনশনটিতে ৩৪টি দেশ অনুসমর্থন দেওয়ার পর দীর্ঘদিন ৩৫তম দেশের অনুসমর্থন না পাওয়ায় আইনে পরিণত হচ্ছিল না। পরে ২০১৪ সালের মে মাসে ভিয়েতনাম ৩৫তম দেশ হিসেবে অনুসমর্থন করে। ফলে একাধিক দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অভিন্ন নদীর জন্য জাতিসংঘের আইনটি প্রণীত হয়। যেহেতু ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের কথার কোনো গুরুত্ব না দিয়ে তাদের পানি বিষয়ক সাম্রাজ্যবাদী নীতি অব্যাহত রেখেছে, তাই বাংলাদেশ আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে পারে। তবে বাংলাদেশকে সেই প্রক্রিয়ায় যেতে হলে উল্লেখিত আইনের জন্য অনুসমর্থন প্রয়োজন হবে। ভারত থেকে শুধু তিস্তার পানির জন্যই এই আইনটি জরুরি তা নয়, ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি আসে ভারত থেকে। প্রতিটি আন্তঃনদীর পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে জাতিসংঘের আইনে অনুসমর্থন দেওয়া জরুরি। এ ছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে কোনো ইস্যুতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে মতানৈক্য হলে আইনি প্রতিকার চাইলে সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হওয়া নয়। ভারতের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা জয় করেছে। এতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভারত যদি কোনো নদীর পানি প্রত্যাহার করে আর আমরা প্রতিবাদহীন বসে থাকি তা হলে তারা অন্যান্য নদীর পানি সহজে প্রত্যাহার করতে চাইবে।
তাই আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে, প্রয়োজনে আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়াটাই জরুরি। করণ আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন যদি উভয় রাষ্ট্র পালন করত তাহলে বাংলাদেশ অনেক লাভবান হতো।
কনভেনশন অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশের উজানে তাদের দেশেও যখন কোনো অভিন্ন নদীর পানি কোনো লাভজনক কাজে লাগাবে তার অংশীদার বাংলাদেশও হবে। উজানের দেশের যে কোনো কাজ ভাটির দেশে যদি কোনো ক্ষতি বয়ে আনে তাহলে তার ক্ষতিপূরণ দেবে উজানের রাষ্ট্র। তাই আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভারত থেকে আসা সব নদীর পানির ন্যায্য অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। জাতিসংঘ প্রণীত আইনে লড়াই চালিয়ে যাওয়া। তার আগে আমাদের আইনটিতে অনুসমর্থন দিতে হবে। আর ভারত যদি জাতিসংঘ প্রণীত আইন মানতে না চায় তা হলে সেটাও বিশ্ববাসী দেখবে। সে জন্যই আমাদের আইনি লড়াইয়ে যাওয়া জরুরি।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh