মিডিয়া ট্রায়াল ও আইন

একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি যে ধরনের ফৌজদারি অপরাধই করুক না কেন, আদালতে অপরাধ প্রমাণের আগে পর্যন্ত আইনের দৃষ্টিতে তাকে অপরাধী বলা যায় না। ভয়ংকর অপরাধী বা বড় সন্ত্রাসী হলেও তাকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। অন্যথায় আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তবে বাংলাদেশে বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেপ্তার করার পরে নারী-পুরুষদের প্রায়ই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। সেখানে জব্দ করা জিনিসপত্র সাজিয়ে গণমাধ্যমের সামনে এমনভাবে তাদের উপস্থাপন করা হয় ও বর্ণনা তুলে ধরা হয়, যাতে বিচারের আগেই তারা জনমনে দোষী বলে চিহ্নিত হয়ে যান। অনেকের ক্ষেত্রে নানা রকম আপত্তিকর বিশেষণও ব্যবহার করা হয়।

এ রকম কর্মকাণ্ড বন্ধ করার বিষয়ে ২০১২ সালে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মহামান্য হাইকোর্ট। তার পরও সেটি বন্ধ হয়নি। এমনকি ভ্রুক্ষেপও করছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও মিডিয়াগুলো। অথচ ফৌজদারি কার্যবিধির ভাষ্য হচ্ছে, সাক্ষী প্রমাণ দ্বারা আসামি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ ধরে নিতে হবে। 

এসব ঘটনা ওই ব্যক্তিদের জন্য শুধু মানহানিকর নয়, মানবাধিকারের লঙ্ঘনও বটে। কারণ পরবর্তী সময়ে তিনি যদি দোষী প্রমাণিত না হন, তাহলে তার প্রতি মিডিয়া ট্রায়ালে যে অন্যায়টা করে ফেলা হচ্ছে, সেটার দায়ভার কে নেবে। মিডিয়া কিন্তু সেই দায় নেয় না। তাই সবার সচেতনতা দরকার।

মানুষের জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম ও সম্পত্তির ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইনগত সুরক্ষার লক্ষ্যে নাগরিকের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখ্য উদ্দেশ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভুল তদন্তের কারণে একজন মানুষকে কি পরিমাণ হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝবেন না। অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০-এর ১৪ ধারা অনুযায়ী কোনো ভিকটিমের নাম, পরিচয়, ছবি প্রচার না করার ব্যাপারে এবং শিশু আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী কোনো শিশুর পরিচয় প্রকাশ না করার ব্যাপারে বিধি-নিষেধ রয়েছে। ১৪ ধারার উপ-ধারা (১)-এর বিধান লঙ্ঘন করা হলে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা প্রত্যেকে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই যদি মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে থাকে, তাহলে ওই মামলায় বিচারকার্য অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। আবার সাক্ষ্য আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তির কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(১) অনুযায়ী, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না থাকায় শুধু মিডিয়া ট্রায়াল আবেগ দিয়ে কিংবা নিজেদের সফলতার সংবাদ প্রচার করায় সাধারণ জনগণ নিজেকে বিচারক ভেবে যে যার মতো করে মন্তব্য করে চলেছে। 

অন্যদিকে গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলেও স্বাধীনতার বিষয়ে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, যা সাংবাদিক-সম্পাদককে ভালোভাবে পাঠ করে আরো দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। অপরাধীকে নির্যাতন করে বা শাস্তি দিয়ে অপরাধ দমন করা যায় না। অপরাধী যাতে পরবর্তী সময়ে আর অপরাধ না করে, সেদিকেই খেয়াল রাখা জরুরি। তা ছাড়া ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অভিযুক্তকে অপরাধ প্রমাণের আগে অপরাধী বলার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মিডিয়া ট্রায়ালের সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh