মন্দির বা মসজিদের আচার-অনুষ্ঠানের চাইতে তার ভূমির ওপর রয়েছে মানুষের আসল নজর। দাঙ্গার মাধ্যমে মানুষকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে তাদের জমি দখলে নেওয়া হচ্ছে আমাদের ইতিহাসের আসল খেলা। অন্নদাপ্রসাদ রায় তার ‘খুকি ও খোকা’ ছড়ায় একই বিষয় তুলে ধরেন, ‘ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা/জমিজমা ঘরবাড়ি।’ ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ মাত্র ১৭ দিন চলে; কিন্তু বহু দশক পরও রয়ে যায় তার বিষাক্ত ফল- ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ (১৯৬৫)। জবাবে ভারতও ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ (১৯৬৮) চালু করে। দুই দেশই এই খেলায় মেতে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও এ আইন অলৌকিকভাবে টিকে যায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে এই শত্রু সম্পত্তিকে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। বর্তমানে অনেকের মধ্যে অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। ২০০১ সালে সংসদে ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ’ আইন করে প্রকৃত মালিক বা তার ওয়ারিশদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু যথাযথ বিধিমালা না থাকায় তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১১ ও ২০১২ সালে সরকার তা সংশোধন করে বিধিমালা প্রণয়ন করে এবং ২০১২ সালে সম্পত্তি অবমুক্ত করার বিধিমালা চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করে।
পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে ‘ক’ ও ‘খ’ তফসিলের মধ্যে ‘খ’ তফসিল বাতিল করে সম্পত্তি অবমুক্ত করা হয়। ‘ক’ তালিকাভুক্ত সম্পত্তি বলতে বুঝায় যে সম্পত্তিগুলো সরকারের দখলে রয়েছে। যদি কারো নাম ভুলক্রমে ‘ক’ তালিকাভুক্ত হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই মামলা করার মাধ্যমে তা অবমুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অর্পিত সম্পত্তি আইন ২০০১ ধারা ১৩ অনুযায়ী ‘ক’ তফসিলভুক্ত সব সম্পত্তি অবমুক্ত করার জন্য অবশ্যই অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সেই সম্পত্তি নিয়ে যদি দেওয়ানি আদালতে কোনো মামলা অনিষ্পন্ন থাকে তাহলে সেই মামলা আপনা-আপনি বাতিল হবে।
ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে বড় সুবিধা হলো মামলার দীর্ঘজট বা সময়ক্ষেপণ থাকবে না। অন্যদিকে বিচার প্রার্থীরা দ্রুত রায় পাবেন। এমনকি কারো যদি তামাদি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন করে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে তামাদি মওকুফ এবং রায়ের জন্য আবেদন করতে পারে। অর্পিত সম্পত্তি আইন ২০০১ আইনের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসক সেই সম্পত্তি চাইলে ইজারা দিতে পারবেন। এতে করে কোনো সরকারি সম্পত্তি চাইলে পেশিশক্তি দিয়ে দখল বা ভোগ করতে পারবে না।
অন্যদিকে সম্পত্তি ইজারা দেওয়ায় সরকারের রাজস্ব আদায় হবে। এই আইনের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল তার ডিক্রি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে, ডিক্রি প্রস্তুত হওয়ার ৪৫ দিন পর, রায় ও ডিক্রির অনুলিপি জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠাবে এবং জেলা প্রশাসক এই ধারা অনুযায়ী সেই ডিক্রি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেবে এবং জেলা প্রশাসক অনধিক ৩০ দিনের নোটিশ প্রদান করবেন, যদি সেই সম্পত্তি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দখলে থাকে তা দখল পরিত্যাগ করার জন্য।
সেই সময়ের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তর করা সম্ভব না হলে পরবর্তী ৩০ দিনে জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট দখলদার থেকে আইনগতভাবে উচ্ছেদ করতে পারবেন। যদি জেলা প্রশাসক কোনো সম্পত্তি ইজারা দিয়ে থাকেন এবং সেই সম্পত্তি নিয়ে কারো যদি দাবি থাকে তাহলে ২৫ ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিতে পারবেন।
সম্প্রতি হাইকোর্ট অর্পিত সম্পত্তি আইনের ৯, ১৩, ১৪ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে যে দুটি রিট পিটিশন করা হয়েছিল তা খারিজ করে দিয়েছেন। তার অর্থ দাঁড়ায় এই আইনটি সংবিধান পরিপন্থী নয় এবং পূর্বের ন্যায় এই আইনটি কার্যকর। যদি কোনো আদালতে দেওয়ানি মামলা অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে চলমান থাকে তাহলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে মামলা করার জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল হওয়াতে মামলাসংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতা দ্রুত সমাধান করা যাবে এবং রায় বাস্তবায়ন হবে। অন্যদিকে জেলা প্রশাসককে সেই সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক করায় অবৈধ দখলদার মুক্ত থাকবে, জবাবদিহির আওতায় থাকবে। এতে ইজারা দিয়ে সরকার রাজস্ব আদায় করতে পারবে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh